বনানী বাবলি : এই তো মাত্র কয়দিন আগে, বিজয়ের মাসে (ডিসেম্বর ২০, ২০২১) বাংলা হারালো আরো একটি নক্ষত্র। বেগম মুশতারী শফী, মুক্তিযোদ্ধা শুধুই নন, যিনি যুদ্ধ করে গেছেন জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে। ভাষা নেই আজ কী বলে তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা দেই, কী বলে নিজের মনকে আজ বলি দেখা তো আর হলো না বাংলার এই বিপ্লবী মায়ের সাথে… ১৫ই জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। এই বিশেষ দিনটির জন্য তিনি অপেক্ষা করতেন সব সময়। সারা দিন থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মুশতারী লজে তাঁর শুভাকাঙ্খীরা আসতেন একে একে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। তাঁকে নিয়ে “বাংলাদেশ তোমারই জন্য” বইয়ের অংশ শেয়ার করছি পাঠকদের জন্য যা ছিল আমার অতি ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আমরা বাংলার স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি কিন্তু হৃদয়ে অনুভব করতে পারি না কী ভাবে দেশটি স্বাধীন হলো বা কিসের বিনিময়ে হলো, কিংবা কেন হলো? প্রতিদিন নিচ্ছি বাংলা মায়ের সোঁদা মাটির গন্ধ, নিচ্ছি প্রতিদিন লাল সূর্যের আলো-তাপ, পুরোনো ঝাপসা হয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি খুঁজে বেড়াই এই সোনামাখা ধূলিকণায় আর ঐ সবুজ অরণ্যে, গর্বে বলি এই দেশ আমার মা, এই দেশের ভাষা আমার মায়ের ভাষা একটা স্বাধীন দেশের নির্ভিক পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমি, মাথা উঁচিয়ে।
কিন্তু বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি নিজেরই অজান্তে, কী দিয়েছি দেশকে? দেশের মাটিকে? দেশের জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছেন সেই মহীয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের মনে রেখেছি কতখানি? যাঁদেরকে আমাদের মাথার মনি করে রাখার কথা ছিল পেরেছি কি কথা রাখতে? চেয়েছি কি জানতে তাঁদের মনের ব্যাথা? পেরেছি কি জানতে তাঁরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন? সুধী পাঠক, এই লেখাটা রচনা করেছিলাম গত বছর। ভেবেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা, বেগম মুশতারী শফীর জন্মদিনে উত্সর্গ করবো কিন্তু কিছু যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য প্রকাশ আর করা হয়নি। আজ ভাবছি কেন অপেক্ষা আবার আগামী জন্মদিনের জন্য? প্রতিটা দিনই – এক একটা সুবর্ণ দিন, যদি পারি ধরে রাখতে এই মুহূর্তগুলি, দিতে পারি তাঁহারই চরণ তলে, আমার এই সামান্য অর্ঘ্য।
বেগম মুশতারী শফী, এক মুক্তিযোদ্ধা যিনি প্রতিনিয়ত যুদ্ধই করেছেন সমাজের অচলায়তনকে ভেঙে নুতন সমাজ গড়ার স্বপ্নে। ১৯৬৩ সালে যিনি প্রথম চট্টগ্রামের মুশতারী লজে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “মেয়েদের প্রেস” নামে একটি ছাপাখানা। এই ছাপাখানাতে শুধু মেয়েরাই কাজ করতো সমস্ত প্রোডাকশন সেক্টরে পাবলিকেশনের জন্য ১৯৬৩ সালে মুশতারী শফী তাঁর সহযোদ্ধা স্বামী ডাক্তার শফীর সাহায্য ও অনুপ্রেরণায় গড়ে তুলেছিলেন নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মেয়েদের নিয়ে একটি সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান “বান্ধবী সংঘ”। তারপর ১৯৬৪ সালে গড়ে তুলেন “বান্ধবী” মাসিক পত্রিকা এবং সেই সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদিকা পদে নিযুক্ত হন। যিনি ১৯৬০ ও ১৯৬৩ সালে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াসে শত সহস্র ছিন্নমূল, বাস্তহারাদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ করে রিলিফ দিয়েছিলেন এবং আর্তের সেবায় দুহাত বাড়িয়ে দেয়া যাঁর ছিল আনন্দ। শুধু তাই নয় এই শফী দম্পতির আবাসিক ভবন মুশতারী লজ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা। যেটা লিপিবদ্ধ আছে “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ; দলিলপত্র-৫ খন্ড” তে এবং এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
যাঁকে মহিলা পরিষদের ব্যানারে মিছিলের অগ্রভাগে দেখা গিয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। যিনি সমাজের সাহিত্যিক বুর্জুয়াদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলতে পারেন, “একটি দেশ যেমন কেউ একা শত্রুমুক্ত – স্বাধীন করতে পারে না, তেমনি সেই দেশের স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও কেউ একা রচনা করতে পারে না (সংগৃহিত: স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন – বেগম মুশতারী শফী)।” যুক্তিবাদী মুশতারী বলেন, “দেশের প্রতিটি মানুষেরই দেশ মুক্ত করার পিছনে কিছু না কিছু অবদান থাকেই। আর সেই অবদান যতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রই হোক না কেন, তাকে উপেক্ষায় অবহেলায় বিস্মরণের বিবরে ফেলে দিলে ইতিহাস থাকে অসম্পূর্ণ (সংগৃহিত: আমার কথা বিভাগ, স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন, বেগম মুশতারী শফী ১)।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই শফী পরিবার নিজেরদের পরিবারের জীবন বাজি রেখে অন্যের অযৌক্তিক অনুরোধে ট্রাঙ্কভর্তি গোলাবারুদ রেখেছিলেন নিজেদের আবাসিক ভবনে এবং জানি না আপনি এখনো বেঁচে আছেন কিনা (তিনি ছিলেন ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন উর রশিদ)। যদি বেঁচে থাকেন তবে এই প্রজন্মের কাছে জবাব দিন হারুন উর রশিদ, আপনি এই আগ্নেয়াস্ত্রগুলি অন্যের মাথায় রেখে একাত্তরে পালিয়ে গিয়েছিলেন কেন নিরাপদ দূরত্বে, ভারতে? আপনার কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল (তারিখ : ২৯ শে মার্চ ১৯৭১) শত্রু মোকাবেলার জন্য ওগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করা। কিন্তু আপনি তার অনুমতি দেননি তথাপি আপনি বলেছিলেন “চিন্তা করবেন না ভাবি – আমি আপনাদের বিপদে ফেলবো না।”
পেরেছিলেন কি কথা রাখতে? জবাব দিন এই প্রজন্মকে? জানবেন ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ডাক্তার শফী ও মুক্তিযোদ্ধা এহসানুল হককে ট্রাঙ্কভর্তি গোলাবারুদ নিজের বাসায় রাখার কারণস্বরূপ পাকিস্তানী সৈন্যরা (মেজর জেড. বোখারী ও মেজর এইচ. খান) এপ্রিল এর ৭ তারিখে ডেকে নিয়ে যায় তাঁর আবাসিক ভবন মুশতারী লজ থেকে। এই পাকিস্তানী হায়েনারা তাঁদেরকে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ফিরে আসেননি তাঁরা আর এই বাংলা মায়ের কোলে। আজ বারে বারে মোহিনী চৌধুরীর একটি গান শুধু মনে পড়ছে, “মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লিখা আছে অশ্রুজলে।” নিভে গেলো দুটি অমূল্য প্রাণ সেই একাত্তরে একই দিনে। একজন প্রিয়তম স্বামী, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক ডাক্তার শফী ও অন্যজন একমাত্র সহোদর চট্টগ্রাম বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র, নির্ভিক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার এহসানুল হক আনসারী।
অধ্যাপক আবুল ফজল দুর্দিনের দিনলিপি গ্রন্থে ১৮ই জুলাই উল্লেখ করেন, “বেগম শফী কিছুকাল থেকে মেয়েদের প্রেস নামে একটি ছোট্ট ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই প্রেসে কম্পোজ থেকে যাবতীয় কাজ মেয়েরাই করতো —-নিঃসন্দেহে এ একটি অনন্য উদ্যোগ। স্রেফ মেয়েরা একটি প্রেস চালাচ্ছে এর কোন দ্বিতীয় নজির আমার জানা নেই। এ সব কিছুর পিছনে ডাক্তার শফীর সমর্থন, প্রেরণা, সাহায্য ও সহযোগিতা যে ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। —-আজ সেই দরদী সমাজ হিতৈষী মানুষটিও এক অমানুষিক বর্বরতার শিকার হয়ে হারিয়ে গেছেন চিরকালের জন্য – হারিয়ে গেছেন শুধু তাঁর আপনজনের জীবন থেকে নয়, আমাদের অনেকের জীবন থেকেও।—- বেগম মুশতারী শফীর ভাগ্যের কথা মনে হলে আমার ভিতরটা যেন কেমন এক অসহ্য বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠে। স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘ সমাজ সেবার এ কি পরিণতি?” (তথ্যসুত্র: ব্যাক কভার পেজ, স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন -বেগম মুশতারী শফী)।
স্বামীহারা, ভাইহারা এই মুক্তিযোদ্ধা মুশতারী ছোট ছোট সাতটি শিশু-কিশোরকে নিয়ে শুরু করলেন জীবনের অন্য এক করুণ অধ্যায়। যখন তিনি জানতে পারলেন তাঁর নাম পশ্চিম পাকিস্তানিদের কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত তখন ২৫শে মে ভারতের। দিকে যাত্রা করেন এবং ২৬শে মে থেকে আগরতলাতে শরণার্থীর জীবন শুরু করলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি কলকাতা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং দেশের সেবা করে গেলেন মুক্তিযোদ্ধাসহ আপামর বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রধানত জীবন্তিকা, উর্দু নাটক, স্বরচিত কথিকা এবং আকাশবাণীতে ও কহিকা, গল্প এইসবে চরিত্রায়ন করতেন। গল্প লিখতেন বসুমতি, যুগান্তর পত্রিকাতে এবং কখনো আত্মপ্রকাশ করেছিলেন উম্মে কুলসুম কখনো বা ডালিয়া বেগম নামে।
যুদ্ধ পরবর্তী কালে ১৯৭৪ সালের মে মাসের ২ তারিখে, বিখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসু এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মুশতারী লজে। তিনি বলেছিলেন, “আমরা মন্দিরে জুতো পায়ে প্রবেশ করি না পবিত্রতা নষ্ট হয় বলে। আজ এই বাড়ির গেটে পৌঁছে ভাবছিলাম, জুতো পায়ে প্রবেশ করবো কি? কারণ যে বাড়ি থেকে দু’টি জীবন দেশের মুক্তিযুদ্ধে উত্সর্গীত হয়েছে, সে তো সামান্য গৃহ নয়- মন্দির (সংগৃহিত: ব্যাক কভার পেইজ, স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন-বেগম মুশতারী শফী)।”
“বেগম রোকেয়া একুশে পদক ২০২১” এবং বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক অবদানের জন্য তিনি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন ২০১৭ সালের ২রা ডিসেম্বরে। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক তাঁর “স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন” এই অসাধারণ স্মৃতিচারণ বইটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে পুরস্কৃত হয় বাংলা ১৩৯৬ সালে। তাঁর অনেক প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে দুই নারী একটি যুদ্ধ, শঙ্খ চিলের কান্না, জীবনের রূপকথা, এমনও হয়, এক গুচ্ছ গল্প তোমাদের জন্য অনন্য। অভয় বসতিতে আগুন, জল চাতক, অকাল বোধন, হে প্রিয় বান্ধবী, বারুদ প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল (এই মুহূর্তে ঠিক জানি না এগুলো প্রকাশিত হয়েছে কিনা।}। অত্যন্ত মিতভাষী, মুশতারী মাত্র তিন মাস বয়সে মাতৃহীনা হন এবং দেখতে পুতুলের মতো ছিল বলেই হয়তো এই প্রিয়দর্শিনীর আদরের ডাক নাম ডলি। ছোটবেলা থেকেই নিজের দুঃখ, বেদনা, আনন্দগুলি খাতার পাতায় তারিখসহ লিপিবদ্ধ করে রাখতেন এবং সেই থেকে শুরু হয় সাহিত্যের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ।
একটা মানুষের বিচরণ ক্ষেত্র এতটাই বিশাল যে বলাই বাহুল্য, বেগম মুশতারী শফী একটি অনন্য প্রতিভা। ১৫ই জানুয়ারি ছিল এই জননীর জন্মদিন। জন্ম হোক এরকম দেশপ্রেমী, সমাজসেবী, সাহিত্যিক, যুক্তিবাদী, সাহসী অনেক মুশতারীর যুগে যুগে। তাঁর অবদানের একটু ছোঁয়া যেন এই প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে পারে দেশ গড়ার লক্ষ্যে, যা এক চলমান যুদ্ধ এই স্বাধীন বাংলাদেশের।