ভজন সরকার : একাকীত্বের একটা আলাদা আনন্দ আছে। নির্জনতার মতোই তা একান্ত আপন, নিজস্ব এবং স্নিগ্ধ। একা থাকলে নিজের জন্য সময় করা যায়, নিজের মতো করে ভাবা যায়, পরিকল্পনা করা যায়। নিজেকে প্রশ্ন করার, আত্মজিজ্ঞাসার সময় তো একা থাকাই। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে, নির্জন এবং একাকীত্বেই মোক্ষ লাভ হয়েছে। হোক না তা রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভ কিংবা কোনো মহান নেতাদের কারাজীবনে রচিত বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ। সব কিছুর উৎসমূল কিন্তু ওই নির্জনতাই।
জেলখানার নির্জনতা না থাকলে বিশ্বের অনেক মহৎ গ্রন্থ লেখা হতো না। বার্ট্রান্ড রাসেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিরোধী কথা বলায় ৬ মাস জেলে ছিলেন। এ সময়েই তিনি লিখেন সেই বিখ্যাত ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফি’- যেখানে বার্ট্রান্ড রাসেল দেখিয়েছেন, যুক্তি হলো গণিতের ছোটবেলা আর গণিত যুক্তির বড়বেলা।
জেলখানার নির্জনতা না থাকলে জওহরলাল নেহেরু কি লিখতেন ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে অনেক বছর জেলে ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। সেই সময়ে তিনি লিখেন ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইটি, যেখানে ভারতের বহুত্ববাদী জাতিসত্ত্বা ও আদর্শের কথা আছে, যা পড়ে সে সময়ের বিশ্ব চমকে গিয়েছিল।
জেলখানার নির্জনতাতেই বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসামান্য ডাইরিগুলো লিখেছেন। বংগবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থগুলো তো জেলখানার নির্জন কক্ষে বসেই লেখা।
যে কোনো মহান সৃষ্টিকর্ম তা হোক সাহিত্য- চিত্রকলা-সংগীত, নির্জনতা ছাড়া রচিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ স্নানঘরের একাকীত্বে অনেক গানের কথা ও সুর আউড়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “গান এসেছে। দিনু (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর)-কে ডেকে নিয়ে আয়।”
ট্রেনে, বোটে, রাতের অন্ধকারে একাকী পায়চারী করার সময়ে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন। একাকী থাকা মানে কিন্তু শুধুই নির্জনবাস নয়। কোলাহলেও নিজের চিন্তার জগতে নিমগ্ন থাকা যায়। রবীন্দ্রনাথসহ বিশ্বের মহীষীগন তাঁদের মহান কর্ম একান্ত নিবিষ্টতা থেকেই রচনা করেছেন কিংবা সম্পন্ন করেছেন।
যুগ পাল্টে যাচ্ছে। এক সময়ের বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ সংযুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। যোগাযোগহীনতার বাতাবরণ উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। দূরতম দ্বীপও প্রযুক্তির কল্যাণে নিকটতম হচ্ছে। ইনফরমেশন টেকনোলজি বা তথ্য-প্রযুক্তি এতো সহজলভ্য হচ্ছে যে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের ঘটনাও নিমিষেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি মুঠোফোনে একটি মাত্র ক্লিকে।
তথ্য প্রযুক্তির সহজ প্রাপ্যতার উপকার যেমন আছে, ক্ষতিকর দিকও আছে তেমনি। প্রযুক্তি মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বাকে কেড়ে নিয়েছে। প্রযুক্তি মানুষকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যে, একদিন হয়ত ব্যক্তিগত বলে আর কিছু থাকবে না।
উচ্চাকাংখা বা উচ্চাশা মানুষকে উন্নতির শিখরে যেমন নিয়ে যায়, তেমনি মানুষের সুখ -শান্তিকেও কেড়ে নেয়। একবার ভাবুন তো দেশের কোনো ধনী লোকের প্রতিবেশী হিসেবে নিজেকে বসিয়ে। বিল গেইটস কিংবা আম্বানির প্রতিবেশী হিসেবে একজন মধ্যবিত্ত মানুষের বেঁচে থাকা মানেই এক নরক যন্ত্রণার অন্য নাম। কারণ, আপনি যতোই নির্মহ মানুষ হোন না কেন, আপনার কিংবা আপনার পরিবারের সাথে সেই বিখ্যাত ধনী প্রতিবেশীর জীবন-যাপনের চাকচিক্য এবং প্রাপ্ততা-অপ্রাপ্ততার তুলনা আসবেই আসবে।
মনে আছে, এক সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এলাকায় বিশাল বস্তি ছিল। পলাশী মোড় থেকে চানখাঁর পুল হয়ে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে বস্তির খুপড়ি ঘর। সে এক বিশাল জনবসতি। সারাদিন রান্নার ধোঁয়া, দৈনন্দিন জীবনযাপন, ঝগড়া-বিবাদ-খিস্তি-খেওড় লেগেই থাকতো। সমাজের সুবিধে বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের এক বিশাল ক্যানভাস যেনো ছিল সে সময়ের বস্তিটি।
আমি দুঃখ-কষ্ট কিংবা মনখারাপের দিনে ওই বস্তি এলাকায় হেঁটেছি । নিজের কষ্ট, নিজের মনখারাপ দূর হয়ে গেছে। সব সময় উপরে তাকাতে নেই। এখানে উপরে বলতে সেই তথাকথিত উপরওয়ালা বুঝাচ্ছি না। যে মানুষগুলো আপনার চেয়েও খারাপ আছেন, তাঁদের দিকে তাকান, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হবেই হবে।
দিন বদলেছে। আগে নিজে স্থান বদল করে শান্তি পাওয়া যেত। এখন সে উপায়ও নেই। সোস্যাল মিডিয়ার উপদ্রুপ কত মানুষের যে ঘুম কেড়ে নিয়েছে, কত পরিবারের যে শান্তি নষ্ট করেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষকরে ফেইসবুক নামক এক সোসাল মিডিয়া অ্যাপের দৌরাত্ব।
ফেইসবুক খুললেই দেখবেন হাসিমাখা মুখের ছবি, চাকচিক্যময় জীবনযাপনের বর্ণনা, রিসোর্ট ভ্রমণের সুখকর মুহূর্ত, দামী রেষ্টুরেন্টে সুস্বাদু খাবারের ছবি। আপনার মনে হতেই পারে যে, একমাত্র আমিই কিছু পেলাম না; একমাত্র আমারই সংসারের অনটন, টানাপোড়েন; আমি ছাড়া এ বিশ্বের সবাই আনন্দের-আহ্লাদের সমুদ্রে অবগাহন করছে। ফলশ্রæতিতে যা হবে, আপনার ঘুম নষ্ট হবে, নিজেকে অসুখী-বঞ্চিত মনে হবে কিংবা মনে হতেই পারে যে, আমিই কেবল সংসারে অপদার্থ। আসলে ব্যাপারটি কিন্তু ওই আম্বানি কিংবা বিল গেইটের প্রতিবেশী হয়ে দুঃখ পাওয়ার মতোই। এক সময়ে ধনক‚বেরের সম্পদ আপনি এড়িয়ে যেতে পারতেন, এখন অসংখ্য মানুষের কৃত্রিম সুখের চিত্র ফেইসবুক বা আরো অনেক সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আপনার ঘরে ঢুকে পড়েছে।
কৃত্রিম সুখ বললাম এ কারণে যে, আপনি জানেন না সুখের মোড়কে জড়ানো মানুষগুলোর আসল কাহিনি। সবাই নিজের সুখটাই বাইরে আনে। কিন্তু দরজা বন্ধ করলে যে মানুষটা কিংবা যে মানুষগুলো, সেটিই আসল চেহারা।
তাই ফেইসবুকের মোড়কে জড়ানো সুখের ভনিতা করা মানুষগুলো থেকে দূরে থাকুন। আম্বানীর আশপাশ থেকে সরে আসা যেমন শান্তিতে থাকার উপায়, তেমনি সোস্যাল মিডিয়ার এইসব কৃত্রিম আম্বানী, যারা সব সময় দেখায় যে সুখের সাগরে ভাসছে, তাদের কাছ থেকে সরে থাকাও সুখ-শান্তিতে থাকার উপায়। যদি মনে করেন , সোস্যাল মিডিয়া আপনার নিজের ভালো থাকাকে বাধা দিচ্ছে, সব ধরণের সোস্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকুন।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক মানুষের সুখ ব্যাপারটি একান্ত নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত। নিজে ভালো থাকার উপায় নিজেকেই বের করে নিতে হবে। বছরের শুরু কিংবা বছরের শেষ সব সময়েই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “নূতন প্রাণ” শক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের আরাধ্য হওয়া উচিত। সবাইকে খৃষ্টিয় নতুন বছরের শুভেচ্ছা। শুভ হোক ২০২২।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)