ভজন সরকার : আবৃত্তির নামে যা শোনা যায়,তাদের অধিকাংশই শ্লোগান, কবিতা নয়। অথচ আবৃত্তির নামে চলছে উৎকট অংগভংগি, ঢং ও উচ্চকন্ঠের ভাঁড়ামি। কবির কাছ থেকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর অবসরেই বদলে যায় কবিতার ভাব পাঠকের স্বকীয় বোধবুদ্ধি বিবেচনায়। এর মাঝখানে আবার ঢুকে পড়েন আবৃত্তিকার!

বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে কিংবা বিনয় মজুমদারের কবিতার আবৃত্তি তেমন কি শোনা যায়? বাংলা কবিতা আবৃত্তি জগতের প্রথম জনপ্রিয় কবিতা বোধ হয় “বিদ্রোহী”। “বিদ্রোহী” কবিতা আবৃত্তি জনপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণ ছিল, সে অন্য আলোচনা। রবীন্দ্রনাথের যে কবিতাগুলো আবৃত্তিকারদের কন্ঠে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা কবিতা হিসেবে নয়, বরং যাঁরা কবিতাগুলো পাঠ করেছেন তাঁদের নাটকীয় পরিবেশনাতেই কবিতাগুলো কবিতার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য আবেদনে শ্রোতার কাছে পৌঁছেছে।

আশি-নব্বই দশকে বাংলাদেশে তরুণ সমাজের কাছে হঠাৎ পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রেমালাপ কবিতার নামে ছড়িয়ে পড়লো এবং জনপ্রিয়তাও পেলো। কথোপকথন-১,২,৩,৪ এ রকম করে করে ৪০ সিরিজের কথোপকথন; যা কবিতা বলে আবৃত্তি হলো সেগুলো কবিতারই সর্বনাশ কিন্তু আবৃত্তির সর্বস্ব।
পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন-১ শুরু হয়েছিল এ রকমঃ
“তোমার পৌঁছুতে এত দেরী হলো?
-পথে ভিড় ছিল?
-আমারও পৌঁছুতে একটু দেরী হলো
সব পথই ফাটা ।
-পথে এত ভিড় ছিল কেন?
-শবযাত্রা? কার মৃত্যু হল?”

কবিতা হিসেবে এ লাইনগুলো কতটুকু উৎরে গেছে সে বিচারে না গিয়েও বলা যায় এ বাক্যগুলোকে যারা কবিতা বলবেন তাঁদের কবিতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অথচ ওই পূর্ণেন্দু পত্রীই এখনও আবৃত্তিকারদের কাছে তো বটেই, যাঁরা আবৃত্তি সংঘের কবি তাঁদের কাছে কবি হিসেবে প্রধান তো বটেই অনুকরণীও বটে। অথচ পূর্ণেন্দু পত্রী নিজেও নিজেকে হয়ত এতবড় কবি ভাবতেন না কোনদিনও!

তখন তো বটেই এখন আরও এক উৎপাত অতি প্রকটভাবে যুক্ত হয়েছে-সেটা যন্ত্র-অনুসংগ। কবিতার বিষয়ের সাথে, ছন্দ-তালের সাথে মিল নেই এরকম রাগ-রাগিনীর ব্যবহার শুধু অবিবেচকতাই নয়, অর্বাচীনতাও বটে।

একবার এক অনুষ্ঠানে এক বিশিষ্ট আবৃত্তিকার পড়ছিলেন শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের কবিতা “অবনী বাড়ি আছো”। কন্ঠের বিরাম, আবেগ, উচ্চারণ সব কিছু মিলিয়ে কবিতাটির মূল বক্তব্যই বদলে দিলেন ভদ্রলোক। অথচ ভদ্রলোকের কন্ঠের মহিমায় হাততালিও পড়লো খুউব। বাড়ি এসে শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের কন্ঠেই শুনলাম কবিতাটি। অভিসম্পাত নয়, বড় করুণা হলো কবিতাপাঠক ভদ্রলোকের জন্য আর যারা অতি উৎসাহে হাততালিতে উৎসাহিত করছিলেন; সে কবিতা না-বোঝা না-পড়া শ্রোতাদের প্রতিও এক দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার ছিল না ।

ওদিন এক আবৃত্তিকার বলছিলেন, “আবৃত্তিকারের আবৃত্তি এই কবিতাকে আরও ‘রিচ’ করেছে”। আবৃত্তি কখনো কবিতাকে ‘রিচ’ (আবৃত্তিকার ‘উন্নত’ অর্থে বুঝিয়েছেন) করতে পারে শুনে আমি নিজেই ‘পুওর’ হয়ে গেলাম। আরেক কবি নাচের সাথে নিজের কবিতা পড়লেন নানা বাদ্যযন্ত্র মিশিয়ে।

এ প্রসংগে বিশ্ব মহিলা ব্যাডমিন্টন সমিতির এক ঘোষণার কথা মনে পড়ল। ব্যাডমিন্টনকে আরও জনপ্রিয় ও দর্শকপ্রিয় করার জন্যে মহিলা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়দের টেনিসের মতো একটু ছোট ও খোলামেলা পোশাক পরা বাধ্যতামূলক করার কথা হচ্ছিল তখন, জানি না সিদ্ধান্তটি এখনও বাস্তবায?িত হয়েছে কিনা।
সে কথাটি শুনে আমার এক কবি বন্ধু বলছিলেন, ‘কবিতা ও আবৃত্তিকে জনপ্রিয় করতে এ রকম কিছু করা যায় না?’
আমি বললাম, “একটু বুঝিয়ে বলো?”

বন্ধুটি বললো, “আবৃত্তিকার (ত্থুক্কু বাচকশিল্পীদের) যাত্রার পোশাকের মতো একটা ড্রেসকোড দিলে শ্রোতারা আরও আগ্রহী হতো?”
আমি বললাম, “একটু বেশি অকাব্যিক হয়ে যাবে।”
বন্ধু বললো, “চিৎকার ছাড়া আবৃত্তির মধ্যে কাব্যিকতা দেখছো কোথায়?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না ।

বিশ্বায়ণ আর কর্পোরেট দুনিয়ার ঝুঁকিটাই এরকম- সবাই চায় সস্তা হাততালি, সবাই চায় বিনিয়োগ ও সেখান থেকে মুনাফা। সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতও সে পুঁজিবাজারে ঢুকে গেছে।
সবাই চায় সাততাড়াতাড়ি প্রচার; প্রচারেই প্রসার। শিল্পের চেয়ে জনপ্রিয়তার ঝোঁকটাই মূখ্য। সেদিন দেখলাম, এক লোক লিখেছেন, “তিনি অমুক আবৃত্তি সংঘের কবি।”
আসলে এর কোনো অর্থই নেই। আবৃত্তির জন্যে কবিতা লেখা?

কবিতা বিমূর্ত; ভালো কবিতা-মন্দ কবিতা ব’লে কিছু নেই। তাই ব’লে বৃন্দ-উচ্চারণে উচ্চারিত সব পদ্য কিন্তু কবিতা নয়; কবিতা নয় অডিটোরিয়াম কাঁপানো উচ্চকন্ঠের শ্লোগানও; যদিও অধিকাংশই সুললিত শব্দের যাত্রাপালার চিত্রনাট্য।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )