আবু এন এম ওয়াহিদ : আধুনিক জমানায় রাষ্ট্রের আওতায় রাষ্ট্রকে অবলম্বন করেই সুখে হোক কিংবা দুঃখে হোক, জনগণের জীবন ও জীবিকা টিকে আছে। এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি মানুষ ছাড়াও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্র ও তার নাগরিক একটা আরেকটার পরিপূরক। এই দুইয়ের মাঝে বৈপরীত্য কিংবা সাংঘর্ষিকতার কোনো অবকাশ নেই। তবে আমার গুরুতর সমস্যা আছে তার সাথে, যে রাষ্ট্র এবং জনগণের মাঝখানে অবস্থান করে। আর এ সমস্যা নিয়ে আজকে দু’কথা বলতে চাই যদি আপনাদের সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। আলোচনাটা এ ভাবে শুরু করলে কেমন হয়? সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ শত শত বছরের অভিজ্ঞতা, চিন্তা-ভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যে চারটি মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্র গঠন করেছিল – তা হলো, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য মানবিক সমঅধিকার এবং তাদের জান, মাল ও সম্ভ্রমের নিশ্চয়তা। মানবিক সমঅধিকারের মধ্যে পড়ে – অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ইনসাফের সর্বজনীনতা। লিখিত হোক কিংবা অলিখিত হোক, শুরুতে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটি অন্তর্নিহিত চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির অধীনে জনগণ রাষ্ট্রের আইন মানতে ও আইনানুগ খাজনা দিতে বাধ্য, বিনিময়ে রাষ্ট্র দেশের সকল মানুষের অধিকারের ষোল আনা হেফাজতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এই পবিত্র চুক্তির ওপর ভর করে জনগণের টাকায় রাষ্ট্রের তহবিল গড়ে ওঠলো, দেশি-বিদেশি শত্রুর বিপরীতে জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষার জন্য নানান কিসিমের জবরদস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রও তৈরি হলো। শুরু থেকে আজ অবধি, চুক্তি আনুযায়ী জনগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে আসছে, কিন্তু রাষ্ট্র তার দায়িত্ব বড়জোর আংশিকভাবে পালন করতে পারছে, সহিভাবে, পূর্ণভাবে কোথাও পারছে না। কেন পারছে না? তার উত্তর খুবই সহজ, কিন্তু সমাধান শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব! ভাবতে গেলে মাথা আউলা-ঝাউলা হওয়ার উপক্রম!

রাষ্ট্রের এই অপারগতার প্রধান ও মূল কারণ হলো – এত সময় নিয়ে, এত চিন্তা করে, এত ভোগান্তির পর মানুষ যে রাষ্ট্র বানালো, তার কোনো অবয়ব নেই, মগজ তো নেই-ই, মাথাও নেই, হাত-পা-ও নেই। রাষ্ট্র একটি ধারণা মাত্র! এ তো এক বিমূর্ত প্রতীক! মানুষ বুঝতে পারলো, মাটির পুতুলকে দিয়ে যেমন কোনো কাজ হয় না, রাষ্ট্রকে দিয়েও তাদের কোনো ফায়দা হবার নয়! রাষ্ট্র গঠনের সময় এ গুলো যে দার্শনিক, সমাজচিন্তক ও জনগণের অজানা ছিল তা নয়। তাই, রাষ্ট্র বিনির্মাণের সময়ই রাষ্ট্রের কারিগররা আরেকটি ধারণাকে সামনে নিয়ে এলেন। তার নাম দিলেন – ‘সরকার’। মূলে সরকারের কাজ ছিল জনগণের হয়ে জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এই সুযোগে সরকার আইনানুগভাবেই রাষ্ট্রের অর্থবিত্ত ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। আর এখান থেকেই সভ্যতার গর্ভে জন্ম নিলো অসভ্যতার অন্ধকার দিক।

কথা ছিল – চুক্তি অনুযায়ী, সরকার সমস্ত জনগণ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের যাবতীয় অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। কিন্তু সরকার ক্ষমতায় বসে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সেই চুক্তির কথা বেমালুম ভুলে গেল। ক্ষমতায় বসেই সরকার দেশের জনগণকে দুই ভাগে ভাগ করল – ‘সরকারপন্থী’ ও ‘সরকারবিরোধী’। এখানেই শেষ নয়, সরকার, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ‘সরকারপন্থী’-দের যাবতীয় ভালো ও মন্দ কাজের সুরক্ষা দিতে লাগলো এবং ‘সরকারবিরোধী’-দের ওপর নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্যাতন শুরু করলো। কম আর বেশি, সব দেশে, সব সমাজে হাজার বছর ধরে এই অবিচার ও অনাচার চলছে, তো চলছেই – যেন এর কোনো শেষ নেই! পার্লামেন্ট, আইন, আদালত কোনো কিছু দিয়েই সরকারকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না, তার জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যে সব দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, সে সব দেশে ৪/৫ বছর অন্তর অন্তর সরকার বদল করে স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক মানুষ একটি সাময়িক নিঃশ্বাস নিতে পারে, কিন্তু যে সব দেশে নির্বাচনের নামে তামাশা হয়, যে সব দেশে নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি, সে সব দেশের ‘সরকারবিরোধী’ নাগরিকদের মুক্তিরও কোনো উপায় নেই। সরকারের করুণা এবং অনুকম্পাই তাঁদের সসম্মানে বেঁচে থাকার এক মাত্র গ্যারান্টি। খাজনা-দেওয়া স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সরকারবিরোধীদের কপালে গোলামী ছাড়া আর কিছু লেখা থাকে না।

পশ্চিমা দুনিয়ায় আইনসভা, আইন-আদালত ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটি নির্দলীয়ভাবে কাজ করে, তাই সেখানে সরকাবিরোধীদের ওপর অত্যচারের স্টিমরোলার এতটা কঠিন, এতটা নিষ্ঠুর নয়। কিন্তু অন্যান্য দেশে এই জাতীয় জুলুম ও বেইনসাফীর মাত্রা কমছে তো না-ই, বরং দিনে দিনে বাড়ছে, বেড়েইে চলেছে। এই সমস্যার কোনো সমাধান সক্রেটিস, প্ল্যাটো, অ্যারিস্টোট্ল যেমন দিয়ে যেতে পারেননি তেমনি পারেননি আধুনিক কালের ছোটবড় কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিক। কারণ একটাই। সরকারের হাত অনেক লম্বা। তার এক হাতে টাকার থলি, আরেক হাতে বন্দুক। দুর্বল চরিত্রের চাটুকার ও লোভীদের দিকে টাকা ছুঁড়ে মারে, আর দুর্বিনীত সাহসীদের বুকে বন্দুক নিশানা করে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আদালত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে নীরবে সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। আদালত রায় দেয়, কিন্তু সে রায় কার্যকর করার তার কোনো শক্তি নেই, সামর্থ নেই, ইচ্ছেও নেই। সংবিধান আইন করে, কিন্তু সরকার আইন ভঙ্গ করলে কী শাস্তি তা সংবিধানে লেখা থাকে না, আর থাকলেই বা কী? কার কথা কে শোনে। এ অবস্থার প্রতিকার কী? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আজ অবধি সরকারকে কার্যকরভাবে জবাবদিহীতার আওতায় আনার কোনো প্রক্রিয়া-পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেননি। আমার এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনো দিন মিলবে না, কিন্তু প্রতিদিন জোরগলায় এ প্রশ্ন উচ্চারিত হোক আপনার-আমার-সবার কণ্ঠে!

জুন ০৮, ২০২০
ন্যাশভিল, টেনেসি
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
Email: awahid2569@gmail.com