ভজন সরকার : ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের শুরু পানিপথের প্রথম যুদ্ধের মাধ্যমে ১৫২৬ সালে। মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর মাত্র বছর চারেক শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। এই স্বল্প সময়েই তিনি বাংলা-বিহারসহ বিশাল এলাকা নিজের শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন। কথিত আছে মাত্র বারো হাজার সেনা নিয়ে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীর লক্ষাধিক সেনাকে পরাজিত করেন। ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের কাহিনি শুনে এই এলাকার রাজা এবং শাসকেরা এমন ভীত হয়ে পড়েছিল যে, বলা যায় বিনা যুদ্ধেই বাবরের কাছে বাংলা-বিহারের অনেক এলাকা সমর্পন করা হয়। এটাই বাংলা-বিহারের অধিবাসীদের শক্তিমত্তার ইতিহাস।

মুঘল শাসকেরা পরে আরো প্রায় তিন শ’ বছরের অধিক সময় বাংলাসহ ভারতবর্ষের শাসক ছিলেন। শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পরাজিত হোন ১৮৫৭ সালে। মুঘল সাম্রাজ্যের এই পতন-যুদ্ধকে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবেই আমরা জানি।

এত সব বলার পেছনের কারণ, বাংলার অধিবাসীরা যে কেবল শৌর্য-বীর্যহীন ছিল তাই নয়; অনেক অকর্মা-অপদার্থ শাসকেরাও বাংলা শাসন করে গেছেন যুগের পরে যুগ। ‘টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত’-খ্যাত সুবেদার বা প্রদেশ বাংলার শাসক শায়েস্তা খাঁর কথাই বলা যায় । মুঘল এ সেনাপতিকে সম্রাট আওরঙ্গজেব শাস্তিস্বরূপ বাংলার সুবেদার করে দিল্লি থেকে বাংলায় পাঠিয়ে দেন।

আওরঙ্গজেব মারাঠি রাজা ছত্রপতি শিবাজিকে শায়েস্তা করার জন্য শায়েস্তা খাঁকে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে শায়েস্তা খাঁ নিজ পুত্রসহ তাঁর অধিকাংশ সেনাকে হারান । সরাসরি সন্মুখ যুদ্ধে শিবাজির তরবারির আঘাতে শায়েস্তা খাঁর তিনটি আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন হয় এবং সংজ্ঞাহীন হয়ে কোনো মতে প্রাণে রক্ষা পান। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সেনাপতি শায়েস্তা খাঁর প্রতি এতো বিরক্ত হোন যে, শুধু আত্মীয়তার কারণে তাঁকে প্রাণে না মেরে বাংলার সুবেদার করে পাঠিয়ে দেন। যদিও শায়েস্তা খাঁ গাঙ্গেয় বাংলায় এসে পরে অনেক বীরত্ব দেখিয়েছিলেন।

শায়েস্তা খাঁ দীর্ঘ বিশ বছর বাংলার সুবেদার ছিলেন। আরাকান রাজাকে পরাজিত করে চট্রগ্রামসহ বিশাল এলাকা বাংলার দখলে এনেছিলেন। পরবর্তীতে উত্তর ভারতের কুচবিহার এবং আসামেও মুঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলাকে বানিজ্য এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্টিত করেছিলেন। কিন্তু শায়েস্তা খাঁকে মুঘল সাম্রাজ্যে একজন দুর্বল সেনাপতি হিসেবেই দেখা হয়। আবার শায়েস্তা খাঁকে শায়েস্তা করার জন্য ছত্রপতি শিবাজি আজও দক্ষিণ ভারতে দেবতার আসনেই বসে আছেন।

বাংলায় বীরত্বের ইতিহাসে ‘বারো ভূঁইয়া’-দের নাম এখন পর্যন্ত সর্বজনবিদিত। ১৫২৬ থেকে ১৫৩০ সাল পর্যন্ত মুঘল সম্রাট বাবর বাংলার বিভিন্ন এলাকা দখলের চেষ্টা করলেও সমগ্র বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের দখলে আসে আরও পরে সম্রাট শাহজাহানের আমলে।
সম্রাট আকবর তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু “বারো ভূঁইয়া”-দের শৌর্যের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। আমরা আজও যাঁদের নিয়ে গর্ব করি যেমন ঈসা খাঁ, মুসা খাঁ, প্রতাপাদিত্য, ফজল গাজী, বাহাদুর গাজী, চাঁদ রায়, কেদার রায়, বীর হাম্বীর প্রমুখ সব ‘বারো ভূঁইয়া’-দেরই নাম।

‘বারো ভুঁইয়া’-দের পরে বাংলা তথা বাঙালিদের বীরত্বের ইতিহাস লিখতে ইতিহাসবিদদের কয়েকশ’ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সিপাহী বিদ্রোহ মূলত সংঘটিত হয়েছিল উত্তর ভারতের দিল্লী, মিরাট্, গোয়ালিয়র, ঝাঁসি, লক্ষনৌ-এ সকল অঞ্চলে। সিপাহী বিদ্রোহে বাংলা তথা বাঙালিদের অংশ গ্রহনের ইতিহাস তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। যদিও এর ১০০ বছর আগেই অর্থাৎ ১৭৫৭ সালেই ব পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা-বিহার ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে চলে গিয়েছিল। পলাশী যুদ্ধে বাংলা তথা বাঙালির বিশ্বাসভংগের এবং ষড়যন্ত্রের ইতিহাস তো ঘৃণ্য ও কলঙ্কময়।

দীর্ঘ সময় আফগান, মুঘল এবং ব্রিটিশ শাসনের পরে বাঙালির সত্যিকারের বীরত্বের প্রতিফলন ঘটে ১৯৭১ সালে। এক সাহসী নেতার দেশপ্রেম এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের প্রতি ভালোবাসায় বাঙালি জেগে ওঠে। জাতিসত্ত¡া এবং ভাষার জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ডের আকাঙ্ক্ষাকে এই নেতা জাগিয়ে তোলেন। এই সাহসী জননেতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তাঁর জীবিতকালেই বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনক খতাবে ভূষিত ও সম্মানিত হোন।
একটি সুসংগঠিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামের পেছনের যে উদ্দীপনা, যে সাহস সবই জুগিয়েছেন জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ নয় মাসে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সবখানেই ছিলেন শেখ মুজিব। যদিও তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দী কিন্তু সব মুক্তিযোদ্ধার প্রেরণাতেই ছিলেন শেখ মুজিব।
ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন উৎসর্গ, দুই লক্ষ মা-বোনের লাঞ্ছনা এবং কয়েক কোটি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট ও অমানবিক দুর্দশা পেরিয়ে স্বাধীন হয় একটি ভূখন্ড। মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিবাহিনী এবং ভারত সরকারের মিত্রবাহিনীর যৌথ প্রতিরোধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তান নামের সেই ঘৃণিত এবং অত্যাচারী দেশটির লক্ষাধিক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী কাপুরুষের মতো এই দিনে অসহায়-অমর্যাদাকর আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়।

ইতিহাসে শৌর্য-বীর্যহীন জাতি হিসেবে বাঙালির যে পরিচয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে তা মুছে যায়, ভুল প্রমানিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “মানুষ না হওয়া” বাঙালি সেদিন যেন আবার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ঐশ্চর্য নিয়ে জ্যোতির্ময় রূপে আবির্ভূত হয়।
(ভজন সরকারঃ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)