আতোয়ার রহমান : প্রচন্ড কান ফাটা শব্দে বিমান ঢাকার আকাশে উড়ল। কখনো বত্রিশ কখনো ঊনচল্লিশ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছে বিমান। কখনো গাঢ় কখনো হালকা সাদাকালো মেঘের চাদর উড়ে যাচ্ছে গহিন গভীরে, সমান্তরালে উড়ছে নিঃসীম শূন্যতা। কানাডার অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে ছুটছে বিমানটি। সেখানে বিকেলে অবতরণ করবে।

নিজ আসনে বসে ডিস্প্লে স্ক্রিনে তাকাল মামুন। বিমান এখন পঁয়তাল্লিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে। ওপারেই কানাডা। শার্টের পকেট থেকে ডাঃ মামুন তার দাদা ডাঃ রইসুদ্দিনের ছবি বের করে দেখছে আর ভাবছে তার পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য চিকিৎসা পেশাটা সে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবেতো।

মামুনকে বহনকারী এমিরেটস এয়ার লাইন্সের বিশালদেহী এয়ারবাসটি শেষ বিকেলে পিয়ারসনে নিরাপদে অবতরণ করল। সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি, এ-সময়ে অল্প অল্প শীত পড়ছে। কানাডার কথা অনেক শুনেছে সে। চারিদিকে তাকাচ্ছে। তাকানোর উদ্দেশ্য শুধু স্বপ্নের এই নতুন দেশটা দেখা না-দেখা শাহেদ তাকে নিতে এল কি না। সিগারেট ধরাবে কিনা বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে হাসি হাসি মুখে শাহেদ হাজির। এয়ারপোর্টে এসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার জন্য শাহেদকে ধন্যবাদ জানিয়ে মামুন শাহেদের দামি লেক্সাস গাড়িতে চড়ে তার স্কারবরোর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।

শুরুতে নতুন দেশকে বেশ ভাল লাগলো মামুনের। গত সপ্তাহান্তে শাহেদ তার পরিবারের সাথে মামুন ও তার পরিবারকে নিয়ে পল্লী কানাডার শোভা দেখতে কয়েকশ মাইল গাড়িতে ঘুরেছে। কানাডার গ্রামের অপূর্ব রুপছটায় মুগ্ধ হলো মামুন।

এর মধ্যে ছয়মাস কেটে গেছে। এবার নতুন দেশে, অপরিচিত পরিবেশে নতুন করে জীবন শুরু করার পালা। খোঁজ খবর নিয়ে জানল তার দেশে করা ডিগ্রী এখানে স্বীকৃত নয়। সে এখানে মেডিকেল প্রাকটিস করতে পারবে না। তার ডিগ্রী এখানে একজন ভাল অভিবাসী হওয়ার জন্য প্রাকটিস করতে পারবে। শাহেদকে এজন্য দোষারোপ করল সে। ‘তুমি কানাডার কথা এতো বাড়িয়ে বলেছো কেনো?’ -শাহেদকে একরাশ অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করলো মামুন। বন্ধু শাহেদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সে কানাডায় অভিবাসি হওয়ার আবেদন করেছিলো এবং ভিসা পাওয়ার পর চোখমুখ বন্ধ করে চলে এসেছিল। শাহেদ এখানকার জীবনযাপন বিষয়ে যা বলেছিল তার সঙ্গে কোন মিল খুঁজে পায় না মামুন। এখন এগুলোকে তার কাছে শুভঙ্করের ফাঁকি আর লুকোচুরি মনে হয়।

মামুনের পিতৃপ্রদত্ত নাম মমিন উদ্দিন। মামুন তার ডাকনাম। মামুনের বাবা চেয়েছিল মামুনকে তার মতো হতে। মামুনও তার বাবা অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিনের মতো একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক হতে চেয়েছিল। সে নিজেও সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম বি বি এস ডিগ্রী নিয়ে কিছুদিন ঢাকার মিরপুরে একটা ক্লিনিকে কাজ করে। পরে তার এক শিক্ষকের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্ষু বিষয়ে এফসিপিএস কোর্সে ভর্তি হয়। রাতের বেলা ক্লিনিকে ডিউটি এবং দিনে ক্লাস করে তিন বছরের কোর্স পাঁচ বছরে সমাপ্ত করে।

দেশে আয়-উপার্জন ভালই ছিল মামুনের। ক্লিনিকের পাশেই চেম্বার দিল, রোগীও ভালো পেতে লাগলো। দিন দিন রোগীর চাপ বাড়তে থাকল, রোগী দেখে কুলাতে পারে না। কিন্তু ক্লিনিকে ছানির অপারেসনে করতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকে এক রোগীর মৃত্যু হলে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনল ডাক্তার মামুনের বিরুদ্ধে। “ভুল চিকিৎসায় চক্ষু চিকিৎসকের হাতে রোগীর মৃত্যু” শিরোণামে পত্রিকায় খবর বের হল। এ নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ হল, ক্লিনিক ভাংচুর হল, মারমুখী জনতার আক্রোশ থেকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেল মামুন। স্থানীয় এমপিকে ধরে মৃত রোগীর স্বজনদেরকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে আপোষ করল। এ কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় চেম্বারে রোগী আসা কমতে কমতে একসময় শুন্যের কোঠায় নেমে এল। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল সে।

মার্চের শেষা-শেষি। পড়ন্ত বিকেল। মিরপুর দশ নম্বরের আনারকলি রেস্তরাঁর প্রায়ান্ধকার একটি ছোট কেবিনে বসে আছে মামুন। কেবিনের দরজায় পর্দা ঝুলছে। রেস্তোরাঁয় এসময়টায় লোকজন কম। বসে বসে চা খাচ্ছে আর খবরের কাগজ পড়ছে মামুন। কাগজ পড়তে পড়তে মামুন দেখে কানাডায় দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সের চাকরি পাওয়া যাচ্ছে। কানাডা অভিবাসী বন্ধু শাহেদের কাছে ফোনে খোঁজ খবর নিয়ে কানাডায় ইমিগ্রেশনের আবেদন করলো। ভিসা পেয়ে দেরি না করে পাঁচ বছর আগের কোনও একদিন বিমানে কানাডার উদ্দেশ্যে উড়াল দেয় এবং টরন্টোতে বসবাস করতে থাকে। সে সময় তার ছেলে অর্ণবের বয়স তিন বছর আর মেয়ে অথৈয়ের বয়স তের মাস।

চিকিৎসা পেশা মামুনের রক্তে বললে কম বলা হয়, বরং তা তার শিরা উপশিরায় তথা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত। মামুনের বাবা, ডাঃ শামসুদ্দিন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক ছিলেন। তার বেশ হাত যশ ছিল। তার দাদার ছোট ভাই, রইসুদ্দিন সাহেব, একজন নামকরা ডাক্তার ছিলেন। তিনি সেই সময় অবিভক্ত ভারতে কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত একজন ছাত্র ছিলেন। রংপুরের মাহিগঞ্জে তার চেম্বারে সুদুর আসাম, জলপাইগুড়ি, এমনকি কলিকাতা থেকে রোগী আসতো। ট্রেনে, ঘোড়ার গাড়িতে, গরুর গাড়িতে, পায়ে হেঁটে রোগী আসতো, সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যেত। দূর দুরান্ত থেকে ওরসে আসা ভক্ত-শিশ্য-মুরিদের দল পীরের দরগায় যেমন সারি ধরে বসে শিরণী খায়, দূর দুরান্ত থেকে আসা রোগীও তেমনি তার বাড়ির সামনে দীর্ঘ সারি ধরে বসে তার জন্য অপেক্ষা করত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রোগী দেখেও কুলাতে পারতেন না। ভিড় সামলানোর জন্য ভলান্টিয়ার ছিল।

তিনি নাম মাত্র মূল্যে তাদের চিকিৎসা দিতেন, চিকিৎসাকে বাণিজ্যের চোখে দেখতেন না, রোগীদের অবহেলা করতেন না। মানুষজনও তাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতো, কসাই বলতো না। জনশ্রæতি আছে, অনেক মুমূর্ষু রোগীকে, অন্য ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়েছে এমন জটিল রোগীকেও তিনি বাঁচিয়ে তুলেছেন। সেবার এ অঞ্চলে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দেয়। তাঁর বাড়ির সামনে তাবু, সামিয়ানার নিচে অবস্থান করা রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা লোকজনের হাট বসেছিল। এখনো এলাকার প্রবীণদের মুখে সেই মহামারীর গল্প শুনলে গা শিউরে উঠে। দিনের বেলা বিলের ধারের বটগাছের ডালে শকুন ডানা ঝাপটায়, মরা লাশের জন্য শ্যেন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। রাত গভীরে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে। তখন রংপুর-দিনাজপুরের এই জনপদে কোন মেডিকেল কলেজ ছিলনা। যেন তার কারনেই সেই সময় ‘পীড়ার আঁকর ভূমি’ খ্যাত এই জনপদের মানুষ মেডিকেল কলেজের অভাব অনুভব করেনি, এমনই যশ ছিল তাঁর হাতে।

তার দাদা দবির উদ্দিন ডাক্তারি না করলেও একজন জনপ্রিয় স্কুল শিক্ষক ছিলেন। স্থানীয় গোপাল লাল হাই স্কুলে বায়োলজি পড়াতেন তিনি । তার এক চাচা, রিয়াজ উদ্দিন রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম দিকের নামকরা ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপতরের মহাপরিচালক হিসেবে অবসরে যান। তার মামা ডাঃ আব্দুর রশিদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেছিলেন। পরে চিকিৎসা ক্যাডারের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার পরও সেপথ ছেড়ে এনজিও লাইনে কাজ শুরু করেছিলেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ওই আন্তর্জাতিক এনজিওর বাংলাদাশে মিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হয়েছিলেন। পরে আফ্রিকার একটি দেশে কর্মরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ডাঃ রশিদ।

ড্যানফোর্থের কান্ট্রি স্টাইলে বসে আছে মামুন। মন ভাল নেই তার। গ্যাস স্টেশনে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তার মনে হচ্ছে এর চেয়ে রিক্সা চালনার কাজ ঢের ভাল। ছুটির দিনগুলোতে সে এই হোটেলের একেবারে উত্তর পশ্চিম কোণের কফি কালারের পাথর বসানো ছোট টেবিলটায় সাধারনত বসে। কফি খায় আর আপন মনে ড্যানফোর্থ পত্রিকা পাড়া থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকাগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে, পরিচিত কারো দেখা হলে আড্ডা মারে। আজও সে সেখানে তার পছন্দের এক কাপ ডাবল ডাবল গরম কফি নিয়ে বসেছে। শীতের দুপুর। পাশের ম্যাপল গাছের শুকনো ডালের ফাঁক গলে জানালার কাঁচ ভেদ করে তার টেবিলে এসে পড়েছে এক টুকরো সূর্যের সোনালি আলো। সেই আলো কফির কাপ থেকে উড়ন্ত ধোঁয়ার কুন্ডলির উপর পড়ে যেন রংধনু তৈরি করেছে। হঠাৎ সেখানে হাজির হামিদ সাহেব-গায়ে কালো ওভারকোট, মুখভরা পাকা দাঁড়ি। হামিদ সাহেব পঞ্চাশোর্ধ্ব, বেটেখাটো, হাল্কা-পাতলা গড়ন, কফির মত গায়ের রঙ, মাথায় বড় একটা টাক। তিনি তার মাথার পেছনের একগোছা লম্বা চুলে হাত দিয়ে পুরো মাথার টাক ঢেকে ফেলার ব্যর্থ চেস্টা করছেন।

হামিদ সাহেব কম্যুনিটি নেতা। যেখানে মানুষের বিপদ দেখেন, সবার আগে সেখানেই ছুটে যান, সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলেন। কম্যুনিটির লোকজনও তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধ্যা করে। মামুনকে দেখে পরিচিত ভঙ্গিতে হেসে, পেঙ্গুইনের মত পা উঁচু করে ধীর পায়ে হেঁটে তার টেবিলে এসে বসলেন হামিদ সাহেব। মামুন তার জন্য চিনি ছাড়া এক কাপ বøাক কফির অর্ডার দিল। মামুন জানে হামিদ সাহেব বø্যাক কফি খান। বেশ কয়েক মাস আগে ডাইবিটিস ধরা পড়ার পর থেকে হামিদ সাহেব বøাক কফি খাওয়া শুরু করেছেন। হামিদ সাহেব মামুনের দুরাবস্তার কথা শুনে তাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘আর বেশি না মাতিয়া। কানাডা খুব বালা দেশ, চিন্তা করিওনা। সরকারি টেকায় পড়াশনা শুরু করি দেও। ডিগ্রি ও অইব, ঘর ও ছলবো। ডাক্তারর বহোত ডিমান্ড, ইনকাম ও মাশাল্লা।’ এক নাগারে তার নিজ জেলা সিলেটের স্থানীয় ভাষায় উপদেশ দিলেন মামুনকে।

মামুন বলল, ‘আঙ্কেল, আপনার কথা শুনে ভরসা পেলাম। আপনি এত সুন্দর করে পরামর্শ দিয়ে সমাধান দিলেন ক্যামনে, আমার জানতে ইচ্ছা করছে।
‘বুঝ চোনি বা। এটা বহুত দিনর অভিজ্ঞতার ফল। ছিয়াত্তর সাল তাকি দেশ ছাড়ছি। দশ দেশ ঘুরার বাদে ক্যানেডায় আইলাম। ইনো কাম পাওয়ার পথ অনেকে জানেনা, কিন্তু রাইট ওয়েতে চেস্টা করলে একটা কাম পাওয়া কঠিন নয়’ তৃপ্তির হাসি হেসে কথাগুলো বললেন তিনি।
হামিদ সাহেবের কথায় ভরসা পেলো মামুন। ভাবল, মন্দ কী? কিছুদিন কষ্ট করে পড়াশোনায় মগ্ন হবে, বাকি জীবনটা স্বাচ্ছন্দ্য আর নির্ভাবনায় কাটিয়ে রঙিন ফানুশের মত খোলা আকাশে উড়বে।

তারা বাইরে বের হল। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাস এতই ঠান্ডা যে তাতে নিঃশ্বাস নেয়াই কষ্টকর, কথা বলা দুরের কথা। হামিদ সাহেব হাতের ইশারায় বিদায় জানিয়ে পাশের পার্কিং লটে পার্ক করা তার গাড়িতে চড়ে বার্চমাউন্ট রোডের তার বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সিলভার রঙের গাড়িটি দৃষ্টিসীমার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত মামুন সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে উইন্টার জ্যাকেটের পকেটে দুহাত রেখে ক্রিসেন্ট টাউনে তার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে থাকল।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে সোফায় বসে সে হামিদ সাহেবের উপদেশ নিয়ে ভাবল, পড়াশুনাটা সে করবে, অবশ্যই করবে। কিন্তু পরক্ষনই আবার ভাবে, পড়তে চাইলেই তো হয় না। এখন তার বয়স হয়েছে।’তার মত একজন আধবয়েশি লোক কি পড়তে পারবে?’ -নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করে মামুন, ‘তা-ও যে সে সাবজেক্ট নয়, একেবারে চিকিৎসা বিজ্ঞান। স্বরণশক্তি কমেছে, আগের মত এনার্জি নেই। তার উপর ইংরেজিতে আমি বরাবরই দুর্বল’ নিজের উপর আস্থাহীনতার সুরে কথাগুলো বলল সে। নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে তবুও সাহস সঞ্চয় করে পড়তে এলো মামুন। খোঁজ খবর নিয়ে জর্জ ব্রাউন কলেজে ভর্তি হল।
মামুন লেখাপড়াতে মন দিল। কিন্তু সে লক্ষ করলো এখানকার পড়াশোনার পদ্ধতি আর দেশের পড়াশোনার পদ্ধতি একরকম নয়। এরা সিলেবাসটিকে একটা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় সাজিয়ে বেশ জটিল করে তুলেছে। পড়াশোনার চাপে মামুনের নাওয়া খাওয়া বন্ধ হবার যোগাড়। টিম হর্টনের পার্ট টাইমের কাজটা ছেড়ে দিতে হলো। আয় উপার্জনও কমে গেলো। এরই মধ্যে বার্বার কথা শুনে তার রীতিমত মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেল।

বিশ বছরের টগবগে তরুনী বার্বা জর্জ ব্রাউনে ওর কোর্স মেট। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ। সোনালি চুল, সবুজাভ চোখে কেমন যেন ভেজা ভেজা চাহনি। পড়াশুনায় সিনসিয়ার, আপটুডেট খবর রাখে। বার্বা বললো এখানে ডাক্তার হওয়ার জন্য একটা রি-কোয়ালিফাইয়িং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। আর তার জন্য এরকম দশটি কোর্স ও দশটি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। মামুন হাতের আঙুলে হিসেব করে দেখল এ প্রক্রিয়া শেষ করতে কমপক্ষে আরো দশ বছর সময় লাগবে।

এদিকে শায়লা ইদানিং বেশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে। ‘এতদিন হল কানাডায় আসলে। ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিতে পারলে না। এখানেও একটা বাসা বা কন্ডো কেনার সামর্থ্য হলো না। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। আমাদের অর্ণব ও অথৈ দিন দিন বড়ো হচ্ছে- তা কি তোমার চোখে পড়ে?’ একরাশ বিরক্তি, ক্ষোভ আর চরম হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলল শায়লা। মামুন চুপচাপ শায়লার কথা শোনে। কোন জবাব দেয় না। কোন জুতসই জবাব নেইও তার। সে বুঝতে পারছে তাদের ঘরের আবহ দিন দিন গুমট হয়ে যাচ্ছে। সে ইদানিং শায়লার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। শায়লা মামুনকে উপেক্ষা করা শুরু করে।

ফুলটাইম পড়াশুনা করেও পরীক্ষায় ভাল করতে পারল না মামুন। রেজাল্ট শেষে মামুন বলল, ‘বার্বা, এবারের পরীক্ষায় কোনমত পাশ করলাম তোমার কারণে। তুমি যদি নোট ফটোকপি দিয়ে ওইভাবে সাহায্য না করতে, তা হলে আমার দ্বারা পাশ হতনা। আশা করছি সামনের কোর্সগুলোতেও যথারীতি তোমার সাহায্য পাব।’

‘নিশ্চয়।’ মাথাভর্তি সোনালি চুল বাতাসে উড়িয়ে বার্বা হেসে বলল। মামুন নিশ্চিত হল বার্বা তাকে সামনের পরীক্ষাগুলোর প্রস্ততি নিতেও এভাবে সাহায্য করবে। দ্বিতীয় কোর্সে ভর্তি হল মামুন। যথারীতি ক্লাশ করা শুরু করল। তবে পড়ার চাপ আর কোর্সের পরিসর দেখে তার মনে শঙ্কা হল কানাডায় তার পূর্ব পুরুষের চিকিৎসা পেশা চর্চা করা হয়ত তার ভাগ্যে নেই। যা আশঙ্কা করেছিল তাই হল। গতবারের চেয়ে বার্বার সহায়তা বেশি পেয়েও মামুন এবারের কোর্সটাতে ফেল করল। মামুনের মনোবল ভেঙে গেল। বার্বার সান্তনা ও আশ্বাসেও তার মনোবল ফিরে এল না। কোর্স টিচার এর সঙ্গে কথা বলে জানল এই কোর্সটা সে পরেও করতে পারবে। এখন সে বুঝতে পারল কেন দেশ থেকে অনেক ডাক্তার এসে এখানে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা বিদ্যা চালিয়ে যেতে পারে না। সে শুনেছে অনেকে শেষ পর্যন্ত নার্সের পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়।

নোট বিনিময়, ঘনিষ্ঠতার রেশ ধরে মামুন ও বার্বা কখন যে প্রেমে পড়ে গেছে তা তারা নিজেরাই জানেনা। কলেজে, কলেজের বাইরেও তারা একান্তে কিছু সময় কাটায়। সেদিন কলেজ লাইব্রেরিতে বই খোঁজার সময় পার্টিশনের আড়ালে, একেবারে নিভৃত কোণে বার্বা তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে সেন্টার আইল্যান্ডে গিয়ে ঘন উইলো গাছের ঝোপের আড়ালে বসে বিয়ার খায়, তারপর উন্মাদের মত মামুনকে চুমু খায়। মামুন বার্বার রোদে পোড়া শুকনো ঘাস রঙের ঘন চুলের খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজে দেয়। উইলো গাছগুলো প্রবল বাতাসে হেলেদুলে মাটিতে নুয়েছিল, আবার সোজা হয়ে মাথা উঁচু করছিল। তাদের দুজনের বুকের মধ্যেও প্রেম যেন এরকম উথাল পাথাল করছিল। বয়স এক্ষেত্রে কোন বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি। তবে মামুন এখন একটা বাঁধা দাঁড় করাতে চাচ্ছে। সে এটা ভাল বোঝে বার্বার মত একটা বিশ বছর বয়সি মেয়ের সাথে প্রেম আখেরে টিকবে না; উটকো ঝামেলাও বাধতে পারে। সাত পাঁচ ভেবে সে পরিকল্পনা করে এবার সে বার্বাকে শায়লার কথা বলবে, অর্ণব-অথৈ এর কথা বলবে। ‘বার্বার সঙ্গে আমার প্রেমের এ খেলাকে শর্ট কোর্সেই সীমিত রাখতে হবে, এটাকে লং কোর্সে গড়াতে দেয়া যাবে না,’ স্বগতোক্তির স্বরে বলে মামুন।

বেচারি বার্বার জন্য তার বড় কষ্ট হয়। এর আগেও ও ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছিল মামুনের মত মধ্যবয়সি তারই এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে। ওই স্কুল শিক্ষকেরও স্ত্রী ও দুটি সন্তান ছিল ঘরে। স্বাভাবিক ভাবে সে প্রেমের একদিন অকাল মৃত্যু ঘটে। ‘তার সমবয়সী একটা বয়ফ্রেন্ড তার কপালে জুটলনা! হয়ত সে ইচ্ছা করেই সমবয়সীদের এড়িয়ে গেছে। কে জানে?’ বলে মামুন।

মামুনের বোধোদয় হল। বার্বার জন্য সে শায়লাকে ত্যাগ করতে পারবে না। শায়লার সাথে যখন তার প্রেম শুরু তখন শায়লা ক্লাস নাইনে পড়ে আর সে একাদশে। কি গভীর ভালবাসাই না ছিল তাদের। শায়লার জন্য কত নিশুতি রাত সে কাটিয়েছে, কত কাগজ আর কালি খরচ করেছে চিঠি লিখে! কত না স্বপ্ন বোনা, প্রেমের পদ্ম রচনা! তখন তার চোখে দুনিয়ায় আর কেউই শায়লার চেয়ে সুন্দরী ছিল না। আফটার অল শায়লা তাকে অর্ণব ও অথৈয়ের মত দুটি সন্তান উপহার দিয়েছে। এক বিদেশিনি সুন্দরির জন্য শায়লা ও তার এ ভালবাসাকে অপমান করা যাবে না। তার জীবনে শায়লার যে স্থান বার্বাকে তা দখল করাতে দেয়া যায় না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।

আজ সোমবার। লং উইকেণ্ডের শেষ দিন। বাইরে প্রচন্ড ঠাণ্ডা। বাসা থেকে বের হতে মন চাচ্ছে না। মামুনের মন খারাপ। হঠাৎ শায়লা অগ্নি মূর্তি নিয়ে হাজির।

‘মামুন, তোমার কি বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে। আমি ছেলে মানুষ করে, ঘর সামলিয়ে আর কফির দোকানে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠছি, কলুর বলদের মত খাটছি, একটু দম ফেলারও সময় পাই না, আর তুমি অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঢলাঢলি, শোয়াশুয়ির সময় পাও কেমনে? এসব করতে লজ্জা করে না তোমার, ছিঃ ছিঃ!’ শায়লার বুকের মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে। অবাক হয় মামুন। শায়লার কথাগুলো যেন তার বুকে ছুরি ঢুকে দেয়ার মত বিঁধল। খুব ঠোঁটকাটা ধরণের মানুষ শায়লা। চট করে রেগে যায় না, তবে একবার রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। চোখ লাল করে সাবধান করে দেবার ভঙ্গিতে মামুনকে লক্ষ করে শায়লা আবার বলতে থাকে, ‘আমার দুঃখ হয়, তোমার এই পুরনো অভ্যাসটা এখানে এসেও ছাড়তে পারলে না তুমি। পরিবার, সমাজের দিকে তাকিয়ে তখন কিছু বলিনি। এতদিন তোমার যে অন্যায় আমি মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম, মনে কর না এখনো তা মাথা পেতে বরণ করে নেব। তুমি যদি এসব নোংরামি বন্ধ না কর, তাহলে আমি অর্ণব ও অথৈকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠবো। তোমাকে আমি সহজে ছেড়ে দেব না। তুমি আমার আসল রুপ এখনো দেখনাই।’ শায়লার আল্টিমেটামে মামুন অপ্রস্তুত হল। মামুনের মনে হল তার মাথায় কে যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। তার উপর দিয়ে যেনো একটা টর্নেডো বয়ে গেল। শায়লার চোখে আজ দয়ামায়ার কোনো চিহ্ন নেই। কী যেন বলতে গিয়ে শামুকের মত নিজের ভিতর গুটিয়ে যায় মামুন। মামুনের বুঝতে বাকি নেই শায়লা এ ইস্যুটিতে এবার একেবারে ‘জিরো টলারেন্সে’ চলে গেছে।

মামুন এমনিতে সিগারেট খায় না, কিন্তু আজ সে দ্রুত ঝুলবারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেট থেকে চুল্লির মত ধোঁয়া নির্গত হতে থাকল। মামুন দ্বিতীয় সিগারেটে টান দিয়ে ভাবতে থাকল তার ও বার্বার মধ্যকার গোপন রোমান্টিক সম্পর্কের কথা শায়লা জানল কি করে? তার সন্দেহ হয় নাসিরকে। তার ক্যাম্পাসে নাসিরই একমাত্র বাঙালি ছাত্র ছিল যার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল, কথাবার্তা হতো মাঝে মাঝে, একই সাত নম্বর বাসে করে ক্রিসেন্ট টাউনের বাসায় আসতো। যদিও সে ছিল জার্নালিজমের ছাত্র। ক্যাম্পাসের ক্যাফেতে বাম পাশে পিছনের একেবারে নিভৃতে কোণার টেবিলে একদিন চা বিস্কিট খাওয়ার সময় বার্বার সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নাসির দেখে ফেলেছিল। কিন্তু ওই একদিনই। এর পর সে আগের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়েছিল। কিন্তু নাসিরের সাথে তার কোন বিরোধ নাই, ঝগড়াঝাটি নাই। কথাবার্তায়ও মনে হয়েছে সে যথেষ্ট ভদ্র। সে ভাবে নাসিরই হয়ত বলেছে তার স্ত্রীকে। কিংবা বলেনি। হয়ত অন্য কেউ বলেছে, হয়ত সন্দেহবাতিকতা থেকে শায়লা নিজেই স্পাইগিরি করেছে। হয়তো সে নিজেই ঘুমের মধ্যে বার্বার নাম ধরে ডেকেছে অথবা বার্বার নাম ধরে শায়লাকে চুমু খেতে চেয়েছে। ঘুমের ঘোরে তার কথা বলার অভ্যাস অনেকদিনের।
এদিকে তৃতীয় কোর্সেও মামুন পাশ করতে পারল না। কোর্স কো-অর্ডিনেটর জন হেডরিক ব্যাঙ্গান্তক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মামুন, তোমাকে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।’ মামুন বুঝে ফেলল তার মত মাঝারি মেধার লোকের পক্ষে এ কোর্স শেষ করা সম্ভব নয়-এটা শুধু জিনিয়াস ও সুপার-জিনিয়াসদের পক্ষেই সম্ভব। এবার একেবারে হাল ছেড়ে দিল সে। মামুন অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ‘পারিবারিক ঐতিহ্যের বাসটা এতদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে চালিয়ে আসছিলাম। আর মনে হয় সম্ভব নয়।’ চোখ ভিজে আসে মামুনের।
শাহেদের সঙ্গে আলাপ করে ট্যাক্সিক্যাব চালানোর কোর্স শেষ করে লাইসেন্স নিল।
চিকিৎসকের লাইসেন্সের পরিবর্তে তার হাতে এখন ট্যাক্সিক্যাবের লাইসেন্স! সে কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়ল। পূর্বপুরুষের পেশায় টিকে থাকতে না পারার বেদনায় কখন যে তার চোখের কোণায় জল এসেছে সে নিজেও জানে না। ইদানিং গভীর রাতে তার বসার ঘরে দেয়ালে ঝুলে রাখা স্টেথেস্কোপটার সাথে প্রায়ই কথা বলে সে, মনে হয় যেন তার প্রয়াত বাবার সঙ্গে কথা বলছে। এটা তার বাবার দেয়া, বাবা পেয়েছিল তার দাদার কাছ থেকে। কানাডা আসার সময় সে ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। এখন মাঝে মাঝে তার মনে হয় জীবনের ও ভালবাসার খেলায় অবশেষে সে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হচ্ছে।

শাহেদের সহায়তায় একটা ট্যাক্সিক্যাবও জোগাড় হল। এখন সে পুরো দস্তর ট্যাক্সি চালক। সপ্তাহের সাত দিনই গাড়ি চালায়। ভাল আয় করে। পরিবারের অভাব অনটন কমতে থাকে। বাচ্চাদের স্কুলে যাতায়াতের জন্য নতুন একটা গাড়ি কেনে শায়লার জন্য। নিজের জন্যও একটা কেনে। শুধু তাই না, যখনই বাড়তি পয়সা কামানোর সুজোগ হয় মামুনের, চেস্টা করে এটা সেটা কিনে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে, মাঝে মাঝে টাকাও পাঠায়। কয়েক দিন আগে আটলান্টিক এভিনিউ এর শেষপ্রান্তে একেবারে লেকের ধারে একটা কন্ডো বুকিং দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই তার উপর শায়লার ক্ষোভের বরফ গলে এখন তা তলানিতে ঠেকেছে। সে এখন তাকে পোষা প্রাণীর মতো আদর করছে, তবে কুকুরের মতো নয়, বিড়ালের মতো।
গত দুইদিন সে ট্যাক্সি চালায়নি। আজকাল তার হাত-পা-মাথা ঝিম ঝিম করে, কপালের মাঝখানে ব্যাথা করে, ঘুমাতে পারে না। এই উপসর্গগুলো নতুন। বøাড-প্রেশারট্রেশার হয়েছে বোধ হয়, খাবারে রুচি নেই। ডাক্তার দেখাতে হবে। কিন্তু সে সময় কই তার? এসব উপসর্গের জন্য ট্যাক্সিকে দোষ দেয় সে। সে মনে করে ট্যাক্সি চালানো পরিশ্রমের কাজ না হলেও ব্রেনের উপর বেশ চাপ পড়ে এতে। তার এতদিনের রিলাক্সড লাইফস্টাইলের কারণে সমস্যাটা এখন বেশি মনে হচ্ছে।

সকালেই প্রচন্ড তুষার ঝড়ের পর মধ্য বিকেলেই আবার টরন্টোর আকাশ পরিস্কার। টরন্টোর আবহাওয়া খুবই আনপ্রেডিকটেবল। যাহোক, আকাশটা যেন বেশি নীল লাগছে হচ্ছে আজ। একটু আগেভাগেই ট্যাক্সি নিয়ে বের হল মামুন। মেট্রো মলের সামনে থেকে এক যাত্রীকে কিংস্টোন রোডে নেমে দিয়ে আবার মেট্রো মলের দিকে রওয়ানা দিল। জেরার্ড এন্ড ভিক্টরিয়া পার্কে এসে ডানে মোড় নিতেই একজন বয়স্ক লোক হাত ইশারা করলে থেমে তাকে গাড়িতে উঠালো। সে কক্সওয়েল এন্ড ড্যানফোর্থে যাবে। বয়স সত্তোর্ধ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, হাতে শালের চাদর। সমীহ করার মতো চেহারা।

বৃদ্ধ যাত্রী প্রথমে কথা শুরু করলো, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?, আপনি কি বাংলাদেশি?’
‘হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশি’। বলল মামুন। ‘আমিও তো বাংলাদেশি। আমার নাম পরিমল বিশ্বাস। ঢাকায় কলেজের শিক্ষক ছিলাম, ইতিহাস পড়াতাম। একমাত্র ছেলে এখানে থাকে, ছেলে, ছেলের বউ দুজনই চাকরি করে। আমাকে আর দেশে থাকতে দিল না। বছর দুই হল আমাকে নিয়ে এসেছে।’ দেশের কাউকে পেয়ে মন উজাড় করে দিলেন ওই ভদ্র লোক।
‘তা বাবা দেশে তোমার বাড়ি কোন জেলায়? ছেলে পেলে কয়জন? কতদিন হল এখানে এসেছ?’ মামুন কে আবার জিজ্ঞাসা করলেন। মামুন কে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়েই আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তা বাবাজি দেশে থাকতে কি করতে?

‘চোখের ডাক্তার ছিলাম।’ উত্তর দিল মামুন। শুনে অবাক হয় বয়োঃবৃদ্ধ ভদ্র লোক। এক অব্যক্ত বেদনায় তার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মামুনের দিকে। সম্বিত ফিরলে বলে, ‘ বল কী? আমিতো চোখের ডাক্তার দেখাতেই যাচ্ছি, আমার চোখে ছানি পড়েছে!’ বুড়োর গলায় একরাশ হতাশার সুর। বুকের ভিতর যন্ত্রণা অনুভব করে, বুকের কোথায় একটা ধাক্কা লাগে দ্রুত। পড়ন্ত রোদের আলো আর বসন্তের মৃদু বাতাসের বিকেলে বিশাল লেক অন্টারিও থেকে আকাশে ভেসে আসা ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোর মত কালো মেঘ গুচ্ছের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকেন তিনি। তা মামুনের দৃষ্টি এড়ায় না। দক্ষ গাড়িচালক মামুনের হাত কাঁপতে থাকে। মামুন বিড়বিড় করে বলে উঠে, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবতো? সমাপ্ত
লেখক, টরন্টো, কানাডা