কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
মনিস রফিক : পাঁচ.
আমি প্রায়ই ভাবি বর্তমান রাজনৈতিক ময়দানে আমরা যারা কোনো বিষয়ের চুলচেরা বিচার না করেই একে অপরের ব্যক্তিগত ইমেজ নিয়ে টানাটানি করি বা একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করি, এই বিষয়টা দেখে বাবার কেমন প্রতিক্রিয়া হতো। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তিনি হতাশ হবার সাথে সাথে আমাদের ওপর বিরক্ত হতেন।
আমরা তিন ভাই ছোটবেলা থেকে যে আসল শিক্ষাটা পেয়ে এসেছি তা হচ্ছে অন্যের কাজ এবং অন্যের প্রতি সম্মান জানানো, আর এ সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে কখনোই যেন অন্যের সামাজিক অবস্থান বা পদবীর বাছবিচার না করি। একজনের প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। মাঝে মধ্যেই আমাদের বাবা মা কোনো বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ সম্মান করার মত বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের সামনে তুলে ধরতেন এবং বুঝিয়ে দিতেন, এমন ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁদের কেমন সম্মান পাওয়া উচিৎ। আমাদের হাউস কিপার হিলদাগার্দে ওয়েস্ট ছিলেন এমন একজন সম্মানীত ব্যক্তি। তাঁকে আমরা ‘হিলদা’ বলেই জানতাম। আসলে হিলদা কেমন ভালোবাসা আর ভালোলাগার একজন ছিলেন তা অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর প্রতি আমাদের পরিবারের সবার অন্য রকম এক ভালোবাসা ছিল, কারণটা অবশ্যই ছিল তাঁর অন্য রকম ভালোবাসার এক উষ্ণতা যা মনে হতো চারিদিক দিয়ে সব সময় বিচ্ছুরিত হতো।
একদিন আমার কোনো কথা বা আমার প্রতি হিলদার সাবলীল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মা ঠিকভাবে অনুধাবন না করে মনে করেছিলেন, আমি হয়তো হিলদার সাথে অভদ্র কোনো আচরণ করেছি। ফলে সংগে সংগে মা আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘জাস্টিন, তোমার এই জীবনে তুমি রাজা, রাণী, সরকার প্রধান বা এমন সব বিখ্যাত ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছো যা পৃথিবীর খুবই কম জনের ভাগ্যে জুটে। কিন্তু মনে রেখো ঐ সব ব্যক্তিদের ক্ষমতা বা পদবী যাই হোক না কেনো, একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তাঁরা অনেকেই আমাদের হিলদার কাছে ¤øান হয়ে যাবেন।’
বাবা আমাদের যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কঠোর হতেন তা হচ্ছে, আমরা অন্যদেরকে কেমন শ্রদ্ধা করি বা আমাদের ব্যবহারে কেউ সামান্যতম কষ্ট পান কি না। আমাদের চোখে চোখে রাখার জন্য যে আরসিএমপি আফিসার দায়িত্বে ছিলেন একদিন কৌতুক বশে তাঁকে ‘টেকো’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। অফিসার ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলেন। এমন বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে বরং তিনি আনন্দই পাচ্ছিলেন, কিন্তু পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আমার কথাটা বাবার কানে গিয়েছিল। আমার কৌতুকতা শোনার সাথে সাথে তিনি আমাদের সামনে হাজির হলেন। তারপর ঐ মুহূর্তেই তিনি আমাকে সেই অফিসারের কাছে আমার এমন কথা ও ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতে বললেন। অফিসার কিন্তু আমার ঐ কথাটার মধ্যে কোন বেয়াদবী দেখেননি, বরং তিনি তার সাথে আমার এই ধরনের ব্যবহার উপভোগই করছিলেন। কিন্তু এমন এক বিষয় আমার দ্বারা হতে পারে সেটা বাবা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। অফিসারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে তিনি আমাকে সেদিন যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেন আমি আর কারো সাথে ওমন ব্যবহার না করি।
২৪ সাসেক্স এর জগতের বাইরে আমাদের পরিবারের আরেকটা জগত ছিল কানাডার পশ্চিম দিকে, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় আমার নানা বাড়ীতে। মাঝে মধ্যে সেখানে বেড়াতে যাওয়া মানে ছিল অটোয়ার বাঁধাধরা জীবন থেকে একটু হালকা হওয়া আর এক ধরনের মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলা। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সিনক্লেয়ারস পরিবারটি ছিল আমাদের পরিবার বৃক্ষের অর্ধেক অংশ যা অনেকেই জানে না। সবাই আমাকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে জানে, কিন্তু অনেকেই জানে না যে, আমি একজন নামকরা রাজনীতিবিদের নাতি। আমি আগেই বলেছি আমার নানা জিমি সিনক্লেয়ার একেবারে শিশু অবস্থায় স্কটল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় এসেছিলেন। আমার নামের একটা অংশ তিনিই আমাকে দিয়েছেন। তাঁর সাথে আমার চমৎকার সুন্দর সুন্দর সব স্মৃতি আছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আরসিএএফ (রয়েল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্স) এর স্কোয়ার্ডন লিডার হিসেবে সিসিলি, মাল্টা ও উত্তর আফ্রিকায় কাজ করার পর তিনি পার্লামেন্টে স্থিতি হয়ে বসেন। তিনি উত্তর ভ্যাঙ্কুভার ও কোস্ট কাপিলানো নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী লুই সেন্ট লোরেন্ট এর মন্ত্রীসভায় মৎস্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার পর উত্তর আমেরিকা ল্যাফার্জ সিমেন্ট এর তিনি প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
সত্যিকার অর্থে জিমি ছিলেন মানুষের ভালোবাসার মানুষ। তাঁর অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল যা তাঁর আশেপাশের মানুষদের তাঁর কাছে নিয়ে আনতো আর এই অদ্ভুত ক্যারিস্মাটিক ক্ষমতার জন্যই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সত্যিকারের জননেতা। আমরা জানি, আমার বাবা গণ মানুষকে খুব ভালো ও কৌশলের সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, কিন্তু ওটা তাঁর প্রকৃতিগত কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না, বরং তিনি তাঁর দৃঢ় মনোবল আর কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু নানার ক্ষেত্রে তা ছিল আলাদা। খুবই স্বাভাবিকভাবেই তিনি মানুষকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে পারতেন। বলা যেতে পারে, তিনি জানতেন কিভাবে মানুষের মন জয় করতে হয়। নানার নির্বাচনী প্রচারণা মানে ছিল, বাড়ির সবাই মিলে আনন্দের সাথে কাজে নেমে পড়া। তাঁর এই ধরনের অদ্ভুত প্রচারণার ফলে সাধারণত মানুষের মন গলে যেতো আর জয় চলে আসতো তাঁর সম্পূর্ণ নাগালের মধ্যে। একদিন আমার কাছে বড় খালা নানার নির্বাচনী প্রচারণার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, উনার বয়স যখন ছয় বছর তখনই তিনি টেলিফোনে গান গাইতে গাইতে প্রচারণা চালাতেন। তিনি ভোটারদের কাছে ফোন করেই গেয়ে উঠতেন, ‘দুই-চার-ছয়-আট, ভোট দিবেন কাকে, জিমি সিনক্লেয়ারকে, জিমি সিনক্লেয়ারকে’। অনেক বছর পর আমি যখন মন্ট্রিয়ল এর পাপিনিউ এলাকা থেকে লিবারেল পার্টির প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন আমি প্রতিটি দরজায় দরজায় গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। এক্ষেত্রে আমি আমার নানার পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম, বাবারটা নয়। নানার অনেক বিষয়ের মধ্যে এটা আমার ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ খেয়ে গিয়েছিল।
জিমি আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। তাঁর সাথে সময় কাটানোর জন্য আমি প্রচুর সুযোগ পেয়েছি। বাবা মা যখন বেশী সময়ের জন্য দেশের বাইরে যেতেন, তখন নিশ্চিন্তে আমাকে আর আমার ভাইদের তাঁর কাছে রেখে যেতেন। পশ্চিম ভ্যাঙ্কুভারে তাঁর বাড়ীর পেছনে ছিল রকরীজ রোড। জিমি তাঁর চমৎকার বাগানের মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, গাছ গাছালিতে ভরা তাঁর বাগানটা গিয়ে শেষ হয়েছিল সাইপ্রেস খাঁড়ির বাধে। তিনি বাধটাকেও এমনভাবে বিভিন্ন ধরনের গাছ দিয়ে সাজিয়েছিলেন যে মনে হতো ওটা একটা বন। সেই বাগানের বিভিন্ন জায়গা নানা আমার এবং আমার ভাইদের নামে নামকরণ করেছিলেন। যেমন, কোনো পথের নাম দিয়েছিলেন ‘জাস্টিন’স পাথ’ আবার দূরের কোনো এক জায়গার নাম দিয়েছিলেন, ‘শাসা’স রক’ অথবা অন্য কোনো জায়গা ছিল ‘মিশেল’স লুকআউট’। ঐ সুন্দর গাছ গাছালি ভরা জায়গাটাতে আমরা তাঁর সাথে সারাদিন কাটাতাম। হয়তো তাঁকে বাগান করায় সহযোগিতা করতাম বা আমরা সবাই মিলে লুকোচুরি খেলতাম অথবা খাঁড়ির বাধে উঠা নামা করতাম।
নানার সেই বাগানের সীমানার শেষ প্রান্ত দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন। সেই রেল লাইন দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করতো। এরমধ্যে আমাদের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সেই ঐতিহাসিক ইঞ্জিন চালিত ‘রয়েল হাডসন ট্রেন’। এই ট্রেন মূলত টুরিস্টদের নিয়ে পশ্চিম ভ্যাঙ্কুভারের মধ্য দিয়ে স্কোয়ামিশ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত আসতো। আমরা যখন ঐ বিশেষ ট্রেনকে যেতে দেখতাম, তখন আমরা হাত নাড়তাম আর মাঝে মাঝে ‘ও কানাডা’ লেখা একটা বড় সাইনবোর্ড যাত্রীদের দেখাতাম। আমাদের এই কাণ্ড যখন চালকের নজরে আসতো তখন তিনি আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে একটা বিশেষ হুইসেল বাজাতেন। সেই হুইসেলের সুর ছিল আমাদের জাতীয় সংগীতের প্রথম চারটি স্বর। অভিবাসীদের প্রতি জিমির এক প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল এবং তাঁর আশে পাশে যারাই থাকতেন তাদের ভিতর এই ভালোবাসার অনুভূতি তিনি ছড়িয়ে দিতেন।
রকরীজ রোডের সেই দিনগুলির কথা স্মরণ করলে আমার চোখে ভেসে আসে সত্তর দশকের কানাডার দেশ প্রেমের সেই পোস্টারগুলির কথা যেগুলোতে সাধারণত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ছবি থাকতো। আমাদের সেই দিনগুলির কথা বলতে গেলে আমি সোজাসুজিই বলবো, আমরা আসলেই ছিলাম সেই পোস্টারের ছেলেদের মতো। সেই কারণেই কানাডার সেই জায়গাটা আমার জীবনে এক বিশেষ প্রভাব ফেলেছে এবং এসব কারণেই আমার বয়স যখন বিশ ত্রিশের মাঝামাঝি সেই সময় আমি শিক্ষক হিসেবে সেই জায়গাই আমার চাকুরী জীবন শুরু করেছিলাম।
জিমি আমাদের সাথে কার্ড খেলতেন এবং তিনি প্রায়ই ‘ব্যাংক’ নামে একটা খেলা খেলতে ভালোবাসতেন। কার্ড খেলার সময় তিনি আমাদের কারো হাতকে ধরে প্রায়ই বলতেন, ‘পশ্চিম মরুভূমির চ্যাম্পিয়ন’। জিমির এই উক্তিটি নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবতাম কিন্তু এর মাথা মুণ্ডু কিছুই অনুধাবণ করতে পারতাম না। আমি যখন বড় হলাম এবং জিমির অতীত সামরিক জীবন সম্পর্কে ভালোভাবে জানলাম তখন সেই ‘মরুভূমি’র মানে বুঝতে পেরেছিলাম। সেটা ছিল পশ্চিম সাহারা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেই এলাকায় তিনি বেশ কয়েকটা কঠিন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বিষয় অনুধাবণ করার পর আমার মধ্যে এক ধরণের শিহরণ জাগতো যে আমাদের সাথে কার্ড খেলার সময় তাঁর জীবনের যুদ্ধের কথা তিনি অন্যভাবে বলতেন। আমি আমার বর্তমান কাজের জন্য যখন সারা কানাডা চুষে বেড়ায় এবং অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সৈনিকদের সাথে কথা বলি বা মিশি তখনই তাঁর কথা আমার মনে পড়ে যায়। তাঁদের দায়িত্ব ও ত্যাগের কথা চিন্তা করে এবং তাঁদের সংস্পর্শে আমি সবসময় শিহরিত হই এবং আমার বারবার মনে হয়, এঁদের প্রত্যেকেরই জীবনে আছে না বলা অসংখ্য গল্প যেগুলো লুকিয়ে আছে প্রত্যকের হৃদয়ের গহীনে।
১৯৮৪ সালে নানা যখন মারা গেলেন, আমার এবং আমার ভাইদের কাছে সেটাই ছিল প্রথম মৃত্যু অভিজ্ঞতা যার মাধ্যমে আমরা প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনা অনুধাবণ করেছিলাম। ২৪ সাসেক্স এর বাড়ীতে যখন খবরটা শুনেছিলাম, তখন আমরা চিৎকার করে কান্না শুরু করেছিলাম। আমাদের এই কান্নাটা ২৪ সাসেক্স এর এক ফরাসী মহিলা কর্মচারীর কাছে কিছুটা অশোভন মনে হয়েছিল। তিনি আমাদের কান্না থামিয়ে নীরবে শোক করতে বলেছিলেন, কিন্তু আমরা তার কথা মানতে পারিনি।
সেই পশ্চিমের আরেকটা ভ্রমণের কথা মনে পড়ছে। সেবার আমার ভাইদের সাথে আমি গিয়েছিলাম সানসাইন কোস্টে। সেখানে থাকতেন আমার মা’র নানী। তাঁর অনেক বয়স হয়েছিল। আমরা তাঁকে ‘গী’ বলে ডাকতাম। অনেক অনেক দিন আগে তিনি ব্রিটেন থেকে অভিবাসী হয়ে এদেশে এসেছিলেন এবং গিবসন্স এ বসতি গড়েছিলেন। গিবসন্স ছিল খুবই শান্ত প্রকৃতি ঘেরা ছবির মত এক জায়গা। ‘গী’ তাঁর সারা জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন ঐ শান্ত নীরব জায়গায় স্থানীয় পাঠাগারের বই পড়ে। আমার মা যখন তাঁর জীবনের গল্পগুলো আমাকে শুনাতেন আর তাঁর নানীর সাথে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতির কথা স্মরণ করতেন, তখনই আমার প্রথম উপলব্ধি হয়েছিল, শুধু আমরাই ছোট নয়, আমার পিতা-মাতাও এক সময় ছোট ছিলেন অর্থাৎ সবার জীবনেই ছোটবেলা থাকে।
আমার দাদীর স্পর্শ পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু তখন আমি এত ছোট ছিলাম যে সেটা কোনোভাবেই আমি স্মরণ করতে পারিনা। আমার দাদীর নাম ছিল গ্রেস ইলিয়ট। আমার যখন জন্ম হয়, তখন তিনি ডেমেনশিয়ার শেষ স্তরে, কোনো কিছু মনে করতে পারতেন না। আমার জন্মের পর আমার মা যখন আমাকে তাঁর কোলে দিয়েছিলেন, গ্রেস তখন কিছুক্ষণের জন্য একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন। তিনি আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘পিয়েরের ছেলে?’ এই প্রশ্ন করার পর পরই তাঁর চোখের জলে তাঁর গাল ভেসে গিয়েছিল। তারপর কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে শেষ পর্যন্ত পিয়েরে আমাদের একটা ছেলে উপহার দিলো?!’ তার এক বছর পর গ্রেস পিয়েরে আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন।
মনিস রফিক : চলচ্চিত্র কর্মী, টরন্টো, কানাডা