কবি বাহারুল হক তাঁর কবিতায় অন্ধকার ফুঁড়ে ফুঁড়ে এক অদ্ভুত আলোকিত আলো এনে হাজির হন পাঠকের সামনে আর তাঁর উদাত্ত আলোর মহিমায় তিনি জানিয়ে দেন মানব জীবনের আবেগের স্বরূপকে। তাঁর কবিতায় বিজ্ঞানমনষ্কতা আর আবেগীয় ভাব এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় যে, পাঠক খুব সহজেই চিনে নেয় আমাদের এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবীকে। কবির কবিতার উপমায় মহাবৈশ্বিক যাত্রা থেকে শুরু করে যে নক্ষত্রমণ্ডলের ব্যবহার বারে বারে আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয়, তাতে খুব সহজেই কবিতার প্রতি তাঁর দীর্ঘ বসবাস আর প্রবল প্রেম প্রগাঢ় মূর্ত হয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। কবি তাঁর কবিতার বিষয় হিসেবে নিয়ে আসেন তাঁর মনোজগতে অবিরাম বিচরিত হওয়া কাল ও মহাকালের সব ঘটনাবলী আর এক অদ্ভুত প্রকৃতিজাত মাতৃপ্রেম।
কবি বাহারুল হক একজন ঋদ্ধ মানুষ, যিনি কবিতার অপার রাজ্যের অপূর্ব প্রাণময় স্বাদ নিতে পাঠককে নিয়ে যান ইতিহাসের কালযাত্রা থেকে পৃথিবীর প্রান্তর থেকে তেপান্তরের জনপদ আর অকর্ষিত ভূমিতে। কবির কবিতার বিষয়বস্তু আর শব্দ চয়ন এত বেশি পরিচিত আর পরিমিত যে সব শ্রেণীর কবিতা প্রেমিক পাঠক খুব সহজেই তাঁর কবিতা রাজ্যকে একেবারে নিজেদের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে মনে করে নেন।
মনিস রফিক
ডঃ বাহারুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়া প্রাণিবিদ্যার একজন অধ্যাপক। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তিনি ছিলেন বরাবরই সাহিত্যমনা। লেখালেখির অঙ্গনে নিজেকে বেঁধে রেখে তিনি বুঝিয়েছেন সাহিত্যকে তিনি কিভাবে তার হৃদয়ে ধারণ করেন। নটরডেম কলেজে থাকতে তিনি ছিলেন কলেজের মাসিক ম্যাগাজিন ঢাক-ঢোল-এর সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলে ক্লাস, গবেষণা, প্রশাসনিক নানা কার্যক্রম ইত্যাদির চাপে পড়ে তিনি একান্তভাবে সাহিত্যামোদি হয়েও সাহিত্য জগতে সক্রিয়ভাবে বিচরণ করা থেকে বিরত থাকলেন; গভীরভাবে মনোযোগ দিলেন গবেষণা কাজে আর সেসব গবেষণালব্দ ফলাফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাইন্টিফিক জার্নালে প্রকাশের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিক্যাল রচনায়। তম্মধ্যেও তিনি সাহিত্যের রসায়নে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ রচনায় লিপ্ত থাকলেন। তিনি ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমির সদস্য হলেন এবং বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান পত্রিকার একজন প্রবন্ধকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কানাডা আসার পর শুরু করলেন ছোট গল্প লেখা। এ পর্যন্ত তার লেখা অর্ধ শতাধিক ছোট গল্প ‘বাংলা কাগজ’ এ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক সমাদৃত সে সব ছোট গল্পের কয়েকটি হলো- দেহঘড়ি, ফরমালিন, বিবাহ বিভ্রাট, আপেল, অণু নগরী ক্রিসেন্ট টাউন, ইত্যাদি। ড: বাহারুল হক মাঝে মাঝে কবিতাও লেখেন। তার রচিত কবিতার মাত্রা এবং স্বাদ ভিন্ন। বিজ্ঞানের ছাত্র বলে তিনি বিজ্ঞানের নানা শব্দ তার কবিতায় লাগসই ভাবে বসিয়ে তার মনের ভাবকে বিশেষ এক দ্যোতনায় অন্যরকম এক আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে তুলে ধরেন। আজকালকার জনপ্রিয় আধুনিক কবিতার স্টাইল বজায় রেখে তিনি ফ্রী ভার্স কবিতা লেখেন। তার কবিতায় প্রায় দেখা যায় মিত্রাক্ষরের সাথে অমিত্রাক্ষর স্তবকের সংমিশ্রণ। তবে ফ্রী ভার্স বলে তার কবিতায় স্তবকের আকার এক রকম থাকে না। এটাও একটা স্টাইল বৈ কি!
কৃষ্ণ পক্ষের চাঁদ
নদীর শাখা আছে, পর্বতের আছে উপত্যকা,
মরুভূমির আছে মরুদ্যান।
পরাস্ত এই আমার আছে শুধু স্মৃতি কথা।
বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে টেনে তুলে আনা
নানা বর্ণ, শব্দ, আর বাক্যের তিক্ত সংমিশ্রন,
ভুলা না ভুলা দ্রৌপদী বার্নিক।
পাহাড়ের উপর কৃষ্ণ পক্ষের মেদহীন বাঁকা চাঁদ-
বিগতযৌবনা, ক্ষয়িষ্ণু, অধরা, প্রস্থানোদ্যত।
আমার অপলক দৃষ্টি ঐ শ্রীহীন বাঁকা চাঁদের দিকে।
আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপী পরাস্ত সব মানবের
স্থির প্রতিবিম্ব সেই চাঁদ,
স্তব্ধ নিষ্প্রভ, বেজার হতোদ্যম।
ইচ্ছা করে চাঁদের মুখে রুপের পলেস্তরা এঁকে দেই;
ইচ্ছা করে চাঁদের কানে কানে বলি-
ফিরে আস হিমাংশু, ফিরে দেখ,
আমি তো যুযুৎসু নই, নই কোন নটী;
তুমি এক নিস্পন্দ কালো দিঘি হও
আমি নীল পদ্ম হয়ে ফুটি।
মোহনায়
জোয়ার ভাটার সততঃ
মাতামাতিতে ভরপুর আঁকা বাঁকা নদী।
তারই কুল ধরে ধীরে নৌকা বেয়ে
এসে পড়েছি মোহনায়;
নদী আর সমুদ্রের মিলন মেলায়;
ভয় আর সাহসের নীল উপত্যকায়।
সম্মুখে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্র,
যেখানে চলছে লোনা জল, নীল রঙ,
আর উত্তাল ঢেউয়ের অর্থহীন আস্ফালন।
অবাধ্য ভয়ের ডংকা বাজে বুকের ভিতর।
বদর বদর বলে
সমুদ্রের দিকে ছুটে যেতে আর সাহস পাই না।
উদ্ভ্রান্তের মত চেয়ে থাকি দূরে, বহু দূরে।
দেখি নৌকা যায়, সাম্পান যায়,
জাহাজের মাসতুলে পতাকা উড়িয়ে উড়িয়ে
যায় নীল সাগরের ব্যাপারীরা।
গাংচিল উড়ে বেড়ায়,
এখানে সেখানে ডুবে আর ভাসে শুশুকের দল;
লোনা জল চিরে ছুটে বেড়ায় নানা রকম মাছ
আমি শুধু চলৎ শক্তিহীন
জেলি ফিসের মত লক্ষ্যহীন ভেসে বেড়াই মোহনায়।
আমার পেছনে হতাশা সন্মুখে ভয়।
কবে আসবে অমাবস্যার অদম্য জোয়ার আমার রক্তে?
কবে আমি ছুটে যাব সাগরের বুকে?
কতটুকু জল হলে বন্যা হয়?
আচ্ছা বলতো কতটুকু জল হলে বন্যা হয়?
সিলভিয়া প্লাথ – এর কবিতা বা
এডগার এলান পো – এর গল্প নিয়ে
আমার মাতামাতি তোমার ভালো লাগে না।
তুমি বলো – বোকা!
আচ্ছা বলতো- দৃষ্টি বই-পুস্তক থেকে
কতটুকু দুরে নিলে মানুষ বুদ্ধিমান হয়?
বলতো- কতটুকু জল হলে বণ্যা হয়?
রোদেলা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনে বা
বৃষ্টি ঝরা রাতে সোনা ব্যাঙের ডাক শুনে
আমার উদ্বেলতা তোমার ভালো লাগে না।
তুমি বলো – বোকা!
আচ্ছা বলতো- মন কতটুকু নিরুদ্ব হলে
মানুষ বুদ্ধিমান হয়?
বলতো কতট্কু জল হলে বণ্যা হয়?
ঘুমে থাকা – জেগে থাকা
ঘুমে থাকার চেয়ে জেগে থাকা অনেক ভালো।
ঘুমে থাকলে তুমি আস;
কখনো মাথার লম্বা বেণী দুলিয়ে
কখনো মেঠো পথে নাচতে নাচতে
কখনো সর্ষে ক্ষেতে পা দাপিয়ে।
কখনো তুমি বটের ছায়ায় ঠায় দঁড়িয়ে
কখনো বা পাতার বাঁশি ধুম বাজিয়ে।
কখনো জল তরঙ্গ ঝরনা পাড়ে
কখনো পড়ো পড়ো ছোট্ট সাঁকো পরে।
কখনো তোমার মুখে হাসির ঝিলিক
কখনো বা ক্রন্দন
কখনো তুমি আকাশগঙ্গা
কখনো বা লাল চন্দন।
বুকের ভিতর বিবশ আবেগ উথলে উঠে
আমি ধরতে যাই, স্পর্শ করতে চাই
না, তুমি নাই তুমি নাই।
ঘুমে থাকার চেয়ে জেগে থাকা অনেক ভালো।
জেগে থাকলে তুমি আস না,
অযথা স্বপ্ন দেখার নেই কোন যাতনা।
প্রেমার্দ্র জোৎস্না
মাঝে মাঝে মনে হয়
তুমি শামছুর রাহমানের কবিতা-
‘একটি মুনাযাতের খসড়া’ বা
আবদুল গাফফার চৌধুরীর
‘একটি মুনাযাতের জবাবের খসড়া’।
মাঝে মাঝে মনে হয়
তুমি অভ্রংলিহ অট্টালিকা বা
অনতিক্রম্য আন্দিজ পর্বতমালা।
মাঝে মাঝে মনে হয়
তুমি পদ্মার ধু ধু বালুচর বা
আমাজন নদী তীরে দুর্গম গহীন অরণ্য।
আমার একান্ত ইচ্ছা তুমি একবার সানফ্লাওয়ার হও;
দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ ব্যাপী
অসংখ্য অগণিত ফোটে থাক আর
বাতাসের গায়ে গায়ে আন্দোলিত হও।
তুমি একবার, শুধু একবার
প্রেমার্দ্র জোৎস্না হও,
তারপর আমার চোখে মুখে ঝরে পড়।
দুবেলা দোটানা
দুবেলা দোটানা আর ভালো লাগে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই
অফিস যাওয়ার তাড়া।
মিটিং আছে, এপয়েন্টমেন্ট আছে,
সে আসবে, ও আসবে, আরো কত কি!
অথচ মন বলে একদম না যাই।
বসে থাকি আর পড়ে যাই-
দৈনিক, সাপ্তাহিক, নাটক, নভেল, অথবা কবিতা –
রবি ঠাকুর, জীবনানন্দ, বা আমার নিজের লেখা
একটা যা পড়ে গিন্নি বলেছিল- ‘যত্তোসব’!
বিকালে অফিসে একদম মন বসে না,
মন শুধু বলে বাসায় ছুটে যাই।
স্কুল ফেরত আমার দুহিতার সাথে
সহাস্য খুনসুটিতে মেতে উঠি, বা গিন্নিকে ডেকে বলি
– ‘দাওতো চিনি বেশি দিয়ে
বড় কাপে এক কাপ চা’।
লুটে পড়া সকাল আর দুরাধর্য্য বিকাল
নিয়ে আমি যে কি করি!
ইচ্ছা করে পাগলা মৌমাছি হয়ে যাই
তারপর সকাল আর বিকালের গায়ে
মুহুর্মুহ হুল ফুটাই।
তবে যদি যন্ত্রণা কাতর সকাল আর বিকাল
গড়াগড়ি দিয়ে একত্রিত হয় দুপুরের আঙ্গিনায়।
আলোর সিম্ফনি
আমি নিরবে দেখে যাই আকাশের মোহনায় আলোর সিম্ফনি।
উদ্ধত স্বভাবের ভিজিব্যাল, ইনফ্রারেড, আল্ট্রাভায়োলেট, আর গামা রশ্মির সতত: মাতামাতি;
কি অহংবোধ!
সর্বদা তারা জানান দিয়ে যায়- “দিয়েছি, দিচ্ছি, আরো দেবো,
সর্বত্র রং ছড়াবো”।
আমার ভালো লাগেনা তাদের এই উদ্ধত স্বভাব, হৈ চৈ, আর মাতোয়ারা ভাব।
আলোতে আমার বড় ভয়, অন্ধকার আমাকে কাছে টানে।
অন্ধকারের আছে বিনম্র এক অতি সহজিয়া ভাব,
অন্ধকার সর্বদা কথা বলে য়ায় নিঃশব্দে, চুপে চুপে;
বলে যায়- “আমার দেবার কিছুই নাই, আমি রিক্ত, নিঃস্ব”।
অথচ অন্ধকারেরই সব।
আলোকবর্ষ থেকে আলোকবর্ষ দূরের
সব নক্ষত্র অপার মায়ায় কোলে তুলে নিয়ে অন্ধকার কি চুপ চাপ!
আমি স্বযত্নে অন্ধকারের কোল থেকে তুলে নেই
কখনো ধ্রুব, কখনো অম্বা, কখনো জমদগ্নি, কখনোবা একটা আকাশগঙ্গা।
নক্ষত্রের পসরা
নীরবে নক্ষত্রের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে আছ দিব্যি খোলা আকাশে।
শব্দের কোন দ্যোতনা নাই,
নাই রঙের কোন ব্যাঞ্জনা।
আছে শুধু চিক চিক মিটি মিটি হাসি।
স্তরে স্তরে গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সি।
দেদীপ্যমান সূর্যের সে কি মাতামাতি!
কখনো দেয় শান্ত সকাল,
কখনো তপ্ত দুপুর,
কখনোবা আবীর মাখা নন্দিত গোধূলি।
আমি থাকি শুধু রাতের অপেক্ষায়;
কখন রাত নেমে আসবে,
কখন ঘন অন্ধকার হবে,
কখন ভুবন মোহন হাসি নিয়ে সব অন্ধকার পায়ে দলে
অধরা চাঁদ এসে আমায় বলবে- “তুমি আছ”?
আমি কোন বাসনার কথা আজ বলবো না।
আজ শুধু বলবো- “হাঁ, আছি। আজ কি চাই তোমার?
সপ্তর্ষি, অরুন্ধতি, কশ্যপি,
বিশ্বামিত্রা, না একটা রোহিনি”?
শুক তারা
এখানেই আমি ছিলাম, এখানেই আমি থাকতাম,
এখানেই উদয় ঘটেছিল সুখবন্দি শুক তারার।
উদয় ঘটেছিল ভূমি ফুঁড়ে প্রথমে আকাশে,
তারপর আকাশের সব বাধা পেরিয়ে একেবারে
আলোকবর্ষ থেকে আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশে।
আমি দেখেছিলাম ওকে বহু কাল নীরবে দাঁড়িয়ে,
তারপর পূর্বে-পশ্চিমে হেঁটেছি বহু পথ বহু বছর ধরে।
প্রথমে গিয়েছি সোজা পশ্চিমে, মিলেছি সুরুপা আন্দিস পর্বত মালায়।
হেঁটেছি আন্দিসের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে,
ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, হয়ে একেবারে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত।
দেখেছি অনেক সমৃদ্ধ জনপদ, মিশেছি অনেক সুধীজনে।
তারপর একদিন অকস্মাৎ সব ছেড়ে ছুড়ে আবার সোজা পূবে।
শত নদী সাগর পেরিয়ে একেবারে হিমালয়ের পাদদেশে।
এখানে কিছু কাল থিতু ছিলাম।
তারপর একে একে অতিক্রম করলাম
কৈলাশ, নন্দা দেবী, অন্নপূর্ণা, ধবলগিরি, আর কাঞ্চনঝংঘা।
সবশেষে উঠে এলাম এভারেষ্টের একেবারে সর্বোচ্চ চূড়ায়।
সেখানে বসে দেখেছি চন্দ্রের সীমাহীন দোদল্যমানতা
আর অর্বাচিন সব ধুমকেতুর অর্থহীন ছুটা ছুটি;
কিন্তু দেখিনি শুক তারার মত অবিচল, চির দেদীপ্যমান অন্য কাউকে।
কপালের লিখন
একজন একজন করে এসে নাম লিখে যাও।
পাশে ছোট্ট করে লিখে যাবে কী চাও তাও।
চাইতে পার-
রাশি রাশি পুষ্ট তৃণধান্য
সোনা রঙের সরিষা ফুলের সুমিষ্ট মধু,
চঞ্চলা চিত্রা হরিণের শুষ্ক চামড়া,
বৃদ্ধ শজারুর গায়ের শক্ত ক’টা কাঁটা,
বলবান বনরুইয়ের বড় বড় আঁশ,
লাল পিপড়ার কালো চোখ বা ক’টা বক ছানা।
চাইতে পার –
দিঘীর জলে ফুটে থাকা নীল নীল সব পদ্ম,
বেহুলার কোন উত্তরীয় কিংবা লখিন্দরের পয়জার,
নীলগিরির নীলকন্ঠ পাখির নরম রঙিন পালক,
ফারাও রাজমহিষীদের ব্যবহৃত কিছু সুগন্ধি।
চাইতে পার-
নাদুস নুদুস মেরু পক্ষীর মাংসচর্বি,
মরুভুমির রাজবহরী বাজ পাখির ধারালো ঠোঁট,
ডাইনোসরের ডিম্ব কিংবা জলহস্তীর সফেন দুগ্ধ,
ভীরু লজ্জাবতীর শিশিরভেজা কিছু ফুল,
লবঙ্গলতিকার কাঁচা পাকা সব ফল।
অর্জুনের সেই তীর ভরা তূণও তোমরা চাইতে পার,
সব, সব তোমরা চাইতে পার,
কিন্তু খবরদার আমার কাছে কিছুতেই চাইবে না
কপালের লিখন খন্ডাবার কোন ধন্বন্তরি মহৌষধ।
পলাতক সময়
যখন তোমার সাথে অতৃপ্ত বাসনায় অহর্নিশ
কথা বলে যেতাম
তখন সময় পাশে ছিল,
যখন তোমার হাত ধরে খোলা মাঠে শুধু এদিক
ওদিক হেঁটে বেড়াতাম
তখন সময় সাথে ছিল।
যখন তোমার লম্বা বেণী ধরে অকপটে নিজের
আবেগ প্রকাশ করতাম
সময় তখন হাতে ছিল,
যখন তোমার চোখে চোখ রেখে গভীর সমুদ্র দেখে যেতাম
তখন সময় ছিল।
যখন তোমার হাতের সরু আঙুলে স্বপ্নের কুঁড়ি দেখে যেতাম
তখন ও সময় ছিল।
তারপর কাজ এলো,
তুমি এলে আলতা পায়ে ঘোমটা পরে।
খুশির বন্যা এলো
জীবন যেন জীবন পেলো।
কথার জোয়ার এলো
আবেগ-উচ্ছ্বাস দ্বিগুন হলো,
কিন্তু সময় চলে গেলো।
এখন সব আছে,
তুমি আছ, কাজ আছে।
শুধু সময় নাই, সময় এখন পলাতক।
ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে সেখানে চলে যাই
যেখানে স্বপ্নগুলো নিঃশব্দে নীরবে খেলা করে,
যেখানে খুশিগুলো চন্দ্রমুখীর নৃত্যের ঝড় তোলে।
ইচ্ছে করে সেখানে চলে যাই
যেখানে হির্ন্ময় রাত জ্যোতির্ময় দিনকে স্পর্শ করে,
যেখানে তেপান্তরের মাঠ খোলা নীলাকাশ ছুঁয়ে ফেলে।
ইচ্ছে করে সেখানে চলে যাই
সমুদ্রের উরস্ত্র ঢেউ যেখানে ব্যাকুল হয়ে তীরে আছড়ে পড়ে,
জোনাকীরা যেখানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনে নেচে উঠে।
ইচ্ছে করে সেখানে চলে যাই
যেখানে মাকড়সা নিরন্তর জাল বোনে,
পাগলা মৌমাছিরা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে,
বিরহী ডাহুকীর সকরুণ ডাক আর
ঝরনার কলতান শুধুই ধ্বনিত হয়।
যেখানে শালগাছ আকাশ ছুঁবে বলে প্রতিজ্ঞা করে,
যেখানে চিতার উল্লম্ফন হরিণ ঝাঁকে প্রবল ত্রাস আনে,
সেখানেই আমার যেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু হায় হায়
আমার যে যাবার কোনই পথ নাই।
মাকে পড়ে মনে
আজ আমার জন্মদিন।
মা তার অভ্যাস মত আজ রাতেও
স্নিগ্ধ পরিপাটি।
ভাবছেন বিছানায় যাবেন;
বিছানায় গভীর ঘুমে দুই শিশু কন্যা তার।
জানালা খোলা; বাহিরে জোছনার বান;
মায়ের হঠাৎ ইচ্ছে হলো চাঁদ দেখবেন।
দেখলেন।
আকাশের ললাটে পূর্ণিমা চাঁদ।
খুশির একটা চমক মায়ের বুক থেকে এতক্ষণে মুখে।
মা ভাবলেন- এমন একটা চাঁদ-মুখ নিয়ে এক পুত্র
সন্তান কি আজ আসতে পারে না আমার বুকে!
মা তো জানতো না আজ তার ইচ্ছা পুরণের দিন।
হঠাৎ বাহিরে মেঘ, জোছনায় ভাটা, বাতাস স্থির;
মায়ের ভিতরটা অস্থির, হৃদ-স্পন্দন রক্তের কাঁপন বেড়ে গেছে বহুগুন;
আমি আড়মোড় ভেঙ্গে একটা নাচন দিলাম;
রাগ ভৈরভি আর তাল দাদরা।
সে প্রলয় নাচনে মায়ের অভ্যন্তরীণ সব জটের বাঁধন খুলে পড়লো।
মা নতুন এক বিছানায়। আমি যেন আরো বেপরোয়া।
“প্রলয় নাচন নাচলে যেদিন আপন ভুলে,
নটরাজ হে নটরাজ জটার বাঁধন পড়লো খুলে”।
মায়ের ক্ষীণ চিৎকার; জটার সব বাঁধন খুলে ফেলে আমি
একেবারে মায়ের বুকে।
বাহিরটা ততক্ষণে আবার পরিস্কার;
অমানিশা কেটে গেছে;
আমার মায়ের যন্ত্রনার অবসান হয়েছে। মায়ের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।
চাঁদ-মুখ পুত্র-সন্তান এই আমি মায়ের বুক দখলে নিয়েছি।
আমার মায়ের মুখে মধুর হাসি।
রাত ভোর হয়েছে, জোনাকিরা ঘুমিয়ে পড়িছে,
চাঁদ বিশ্রামে;
নতুন এক সূর্য্য উঠেছে; মায়ের পৃথিবীটা বদলে গেছে।
মায়ের সুখ আর আনন্দে পাখি গান ধরেছে, ফুল গন্ধ ছড়াছে;
সে এক নতুন সুর নতুন গন্ধ।
সেদিন থেকে কাঁচা হলুদের রঙ আরো প্রগাঢ় হয়েছে;
গোলাপের পাপড়ি আরো ঘন হয়েছে;
মৌমাছিরা নতুন এক কোরাস ধরেছে।
আব্বাতো বেদিশা; সব বন্ধন ছিন্ন করে, সব যন্ত্রণা উপেক্ষা করে
কে এল? কে এই বীর পুরুষ? কী নাম রাখি তার?
মানিক, রতন, স্বপন, বাঁধন, নাকি মহা বীর আলেকজান্ডার?
হঠাৎ পড়িল মনে ভাই তাহার
তাকেই দেই নামকরণের গুরু ভার।
তিনি ভাবিলেন- সময় কত, কেমন পরিবেশ?
সব ভাবিয়া দেখিলেন বাহার নামটা হবে বেশ।
রূপ ও রাগের এক অপুর্ব সংমিশ্রণ এক অনিন্দ অধিকার-
বাহার বাহার বাহার।
“মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে”,
জন্মদিনে আজ
“মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে”।
পূর্ব – পশ্চিম
টরন্টোর বুক চিরে ছুটে চলছে পাশাপাশি
‘ইষ্ট বাউন্ড’ ট্রেন পূবে আর
‘ওয়েষ্ট বাউন্ড’ ট্রেন পশ্চিমে।
‘ইষ্ট বাউন্ড’ ট্রেন পশ্চিমে আর
‘ওয়েষ্ট বাউন্ড’ ট্রেন পূবে?
না, তা হবার নয়।
আমি বললাম – আচ্ছা, পূব আর পশ্চিম কি?
তুমি বললে –
পূবে সূর্য্য উদিত হয় আর পশ্চিমে অস্ত যায়।
আমি বললাম-
আমিতো সূর্যোদয় দেখিনি কোনদিন,
না দেখেছি সূর্যাস্ত,
আমার আবার পূব কি পশ্চিম কি!
যদি হতে
যদি কবিতা হতে
তাহলে শুধু পড়তাম আর পড়তাম;
যদি চাঁদ হতে
তাহলে শুধু দেখতাম আর দেখতাম;
যদি সাগর হতে
তাহলে শুধু ভাসতাম আর ভাসতাম;
যদি মেঘ হতে
তাহলে বায়ু হয়ে শুধু ছুটতাম আর ছুটতাম;
যদি পর্বত হতে
তাহলে বৃক্ষ হয়ে শুধু ছায়া দিতাম;
যদি ফুল হতে
তাহলে ভ্রমর হয়ে শুধু গান শুনাতাম;
যদি নিঃসঙ্গ ডাহুকি হতে
তাহলে বীরদর্পে কাছে ছুটে যেতাম;
যদি ঝর ঝর বৃষ্টি হতে
তাহলে শুধু শুনতাম আর কাঁদতাম;
যদি নদীর গভীর উত্তাল মোহনা হতে
তাহলে বিহবল হয়ে একেবারে হারিয়ে যেতাম।