শুজা রশীদ : (পর্ব ২৫)
৩৫.
শারদীয় রঙের বাহার রিমাকে সবসময়েই আপ্লুত করে। অক্টোবারের মাঝামাঝি আসতেই শহরের চারদিকে নানান স্থানে দর্শণীয় রঙের খেলা শুরু হয়ে গেল। ওক আর মেপল গাছের পাতায় যে কমলা আর লালের নানান রূপ দেখা যায় রিমার সেটাই সবচেয়ে প্রিয়। ওর এপার্টমেন্ট থেকে সামান্য হাঁটা পথ ওয়ার্ডেন উডস পার্ক। সেখানে গেলেই মন ভরে শারদীয় রঙ উপভোগ করা যায়।

ও শুনেছে অনেকেই শহর ছেড়ে দূরে দূরে যায় পাতার রঙ দেখার জন্য, বিশেষ কর এলগনকুইন পার্কে যেখানে নাকি শরৎকালে প্রকৃতি এমন অপূর্ব রূপ নেয় যে দেখলে যে কারো মন উথাল পাথাল করে উঠবে। এই শহরের বাইরে আজ পর্যন্ত কোথাও খুব একটা যাওয়া হয়ে ওঠে নি ওর, গেলেও খুব বেশি দূরে নয়। মিন্টুর সাথে প্রেম হবার পর সে তাকে রিচমন্ড হিল আর অরোরাতে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রেটার টরন্টো এরিয়াতে রিচমন্ড হিল অভিজাত এলাকা বলে পরিগণিত। একদিন সেখানে বিশাল একটা বাড়ি কিনবার শখ ছিল মিন্টুর। ওর বাবা-মা চাইলে সেখানে বাড়ি কিনতে পারত না তা নয় কিন্তু নতুন করে আরোও দেনার মধ্যে পড়ার মত মানসিক অবস্থা তাদের তখন ছিল না।

বাড়ি ঘর নিয়ে রিমার কখনই কোন আগ্রহ ছিল না। ফ্রি ওয়ে ধরে অনেক দূরে ড্রাইভে যাওয়াটাই ওর ভালো লেগেছিল। প্রথমে হাইওয়ে ৪০১ নিয়ে পরে ধরেছিল হাইওয়ে ৪০০, ছোট ছোট মায়াবী শহর আর দিগন্ত ব্যাপি শষ্য ক্ষেতের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছিল ওরা, মনে পড়ে গিয়েছিল ফেলে আসা দেশের কথা, যদিও ঢাকায় থাকতে গ্রামে খুব একটা কখনই যাওয়া হত না ওর। হয়ত প্রতি তিন-চার বছরে ওর দাদুর গ্রামের বাড়িতে একবার যাওয়া হত, যদিও দূরত্ব অনুযায়ী গ্রামটা ছিল মাত্র শ’ দুই মাইল দূরে। যে কয়েকটা দিন সেখানে থাকত ওরা, ওর ভালো লাগত সেই গ্রাম্য প্রাকৃতিক পরিবেশ। ঢাকার হাজারটা ঝঞ্জাট থেকে দূরে গিয়ে নিজেকে মুক্ত পাখীর মত মনে হত।

মিন্টু ওকে কথা দিয়েছিল একবার ওকে শারদীয় রঙ দেখানোর জন্য দূরে কোথাও কোন রিসোর্টে নিয়ে যাবে, কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারেনি। বিয়ের পর পরই তাদের আর্থিক অবস্থার এমন অবনতি হল যে সংসার চালানোই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, হাজার খানেক ডলার খরচ করে দুই দিনের জন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে নি। তার মত অনেক মানুষই আছে এই শহরে যারা সারাটা জীবন এখানে কাটিয়েছে কিন্তু উত্তরে মার্কহ্যাম, পূর্বে পিকারিং কিংবা এজ্যাক্স আর পশ্চিমে দেড়শ কিলোমিটার দূরে নায়েগ্রা ফলসের বাইরে আর কোথাও যায়নি।
নায়েগ্রা ফলস অবশ্য কেউ না গিয়ে থাকতে পারে না। টরন্টো এসে পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক এই নিদর্শণ না দেখলে তো জীবনই বৃথা! বিয়ের পর মিন্টু তাকে দুই রাতের জন্য নায়েগ্রা ফলসে নিয়ে গিয়েছিল। সেটাই ছিল ওদের মধু চন্দ্রিমা। মোটামুটি ভালোই লেগেছিল ওর। সবকিছু ভীষণ উপভোগ করছিল। কিন্তু ফেরার আগের দিন রাতে ওকে নিয়ে একটা ক্যাসিনোতে হাজির হয় মিন্টু। টানা ছয় ঘন্টা পোকার খেলে সে। তার পাশে বসে মনে মনে নিজেকে শাপ-শাপান্ত করছিল রিমা। কোন দুঃখে সে এসেছিল ক্যাসিনোতে। ঐ রকমই ছিল মিন্টু। অসম্ভব এক রোখা। প্রথমে সে হারছিল, তখন খেলে যাচ্ছিল জেতার লক্ষ্যে, এক পর্যায়ে সে জিততে থাকে, তখন থামতে পারছিল না এই ভেবে যে সেটাই বুঝি তার ভাগ্য পরিবর্তনের দিন। তারপর এক সময় সে আবার হারতে শুরু করে। এভাবেই চলতে থাকে সেই অভিশপ্ত চক্র। সেই রাতে রিমা যতখানি অসহায় বোধ করেছিল তেমনটা বোধহয় সারা জীবনে কখন করে নি। তার অনুনয়, বিনয়, অনুরোধ কোন কিছুই বিরত করতে পারেনি মিন্টুকে।
“কি ভাবছ এতো?” তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে জানতে চায় আসমা। হাইওয়ে ৪০১ দিয়ে ড্রাইভ করছে সে, চলেছে পূর্বে।
প্যাসেঞ্জার সীটে ইতস্তত করে নড়ে চড়ে বসে রিমা, বুঝতে পারে স্মৃতির গহবরে হারিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। এই ড্রাইভটা ওকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে মিন্টুর সাথে রিচমন্ড হিলস কিংবা নায়েগ্রা ফলসে যাবার কথা।

আজ আসমার সাথে এই যাত্রা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। খান বিশেক লেসন নেবার পর আসমা রিমাকে রোড টেস্ট দেয়ার জন্য চাপাচাপি করতে থাকে। কানাডায় ড্রাইভিং লাইসেন্স তিন পর্যায়ে দেয়া হয়, জেনেছে রিমা। প্রথমে থাকে লিখিত পরীক্ষা, যাকে বলা হয় এ১. সেই টেস্ট ও দিয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে। তারপর হচ্ছে এ২. রোড টেস্ট। শহরের ভেতরের রাস্তায় নেয়া হয় এই টেস্ট। পাশ করলে মোটামুটি ভাবে সবখানেই গাড়ি চলানো যায় যদিও হাইওয়েতে কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। বছর খানেক এ২ লাইসেন্স থাকলে একটা তৃতীয় টেস্ট দিতে হয় হাইওয়েতে এ লাইসেন্স পাবার জন্য।
আজ রিমার এ২ লাইসেন্সিং টেস্ট। রাস্তায় গাড়ী চালানোর পরীক্ষা। সহজ ব্যাপার নয়।

আসমা বেশ খোঁজ খবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি অব টরন্টোতে রোড টেস্ট না দিয়ে পঞ্চাশ কলোমিটার পুর্বে অশোয়া থেকে দিলে রিমার পাশ করার সম্ভাবনা অনেক বেশী। শহরটা ছোট হলেও জেনারেল মটরের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট থাকার কারণে বিখ্যাত। সেখানে ড্রাইভিং টেস্ট পাওয়াও যায় তাড়াতাড়ি আবার পাশের হারও সিটি অব টরন্টোর চেয়ে অনেক বেশি।
দিনটা বৃহষ্পতিবার, বিকাল। টেস্টের সময় দেয়া হয়েছে বিকাল পাঁচটা। তখন রাস্তায় থাকবে অফিস ফেরত গাড়ির ভীষণ ভীড়। রিমার খুব ভয় লাগছে।
“ভয় পেও না,” আসমা ওকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করে। “তোমার কোন সমস্যাই হবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে চালাবে। অনেক প্রাক্টিস করেছ তো।”
রিমা দূর্বল্ভাবে হাসে। “আমার বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে!”
আসমা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। “যদি ফেল কর খুব রেগে যাব কিন্তু!” শাঁসাল সে। “তোমার বিল্ডিঙয়ের গ্যারাজে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে একটা গাড়ি। যদি স্বাধীনতা চাও পাশ করতে হবে। মাথায় ঢুকছে?”
রিমা ভীত গলায় হাসে।

“বোকার মত হেস না তো,” আসমা ধমক দেয়। “নিজেকে শক্ত কর। টেস্টটা সোজাই কিন্তু ভুল করলে চলবে না। অনেকেই ফেল করে। বুঝেছ?”
রিমা মাথা নাড়ে, বুঝেছে, যদিও তাকে দেখে তেমন আত্মবিশ্বাসী মনে হয় না। অশোয়াতে ফেলের রেট অন্যন্য অনেক স্থানের চেয়ে অনেক কম হলেও প্রায় ৩৬%। যদি প্রতি দশ জনে প্রায় চার জনের মত ফেল করে তাহলে সেই টেস্ট সহজ হয় কি করে? সে বুঝতে পারছে পাশ করাটা তার জন্য খুবই দরকার। নিজের গাড়ী ড্রাইভ করতে পারাটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ড্রাইভ করলে ভালো কাজ কর্ম পাবার সুযোগ অনেক বেশি থাকে।

ঘন্টা দুই পরে, অশোয়া থেকে টরন্টো ফিরবার পথে, রিমার নিজেকে মনে হয় এক রাজকুমারী যে এক স্বপ্নপূরীর চাবি হাতে পেয়েছে। অযথাই ভয় পাচ্ছিল ও। ওর ড্রাইভিং পরীক্ষা বেশ ভালোই হয়েছিল। খান দুই ছোট খাট ভুল করলেও ভালোই চালিয়েছিল। পাশ করতে তেমন কোন সমস্যাই হয়নি। ওর ঘাড় থেকে বিশাল একটা বোঝা নেমে গেছে।
“জানতাম তুমি পাশ করবে,” আসমা হাসি মুখে বলে।
রিমা নিজের আসনে হেলান দিয়ে বসে আপন মনে খিল খিল করে হেসে ওঠে। মনটা হালকা লাগছে।
“টাকাটা দিয়ে কি করবে ভেবেছ?” আসমার প্রশ্নটা এমন আচমকা আসে যে প্রথমে সে কি বোঝাচ্ছে বুঝতে দেরী হয় রিমার। তারপর ধরতে পারে। লিয়াকত নিশ্চয় আসমাকে বলে থাকবে।

“ভাবছি একটা বাড়ী কিনব, ডীটাচড, যদি সস্তার মধ্যে কিছু পাই,” ইতস্তত করে বলে রিমা। জীবনে কখন ভাবে নি আধা মিলিয়ন ডলারের মূল্য কত কম হতে পারে। বাড়ি কেনার কথা মনে হলেই মনটা দ্বিধায় ভরে ওঠে। বাড়ি কেনাবেচার ওয়েবসাইটে গিয়ে নজর বুলিয়েছে ও। যে সব বাড়ীগুলো ওর পক্ষে কেনা সম্ভব হবে সেগুলোকে দেখে মনে হয়েছে যে কোন মুহুর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। সেগুলো ঠিকঠাক করতে অনেক খরচ হবে। বাড়ি কেনার পর হাতে আদৌ কোন টাকা পয়সা থাকবে কিনা সন্দেহ।
“কোন এজেন্টের সাথে কথা বলেছ?” আসমা জানতে চায়।
“এখনও বলিনি। টাকাটা হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ না?”
“টাকাটা পেয়ে যাবে,” আসমা আস্থার সাথে বলে। “এখনই প্ল্যান করতে শুরু কর। ব্যাংকে যত কম সময় টাকাটা পড়ে থাকে ততই ভালো।”
রিমা মাথা দোলায়। ঠিক।

“আমার জানাশোনা একজন এজেন্ট আছে, খুব বিশ্বাসযোগ্য। আমার ছোট ভাইয়ের মত। তার যোগাযোগের ঠিকানা আমি তোমাকে পাঠিয়ে দেব। ও তোমার জন্য ভালো একটা বাসা ঠিকই খুঁজে দেবে। যদি সাড়ে তিন লাখ ডলার ডাউন পেমেন্ট দাও তাহলে তোমার যে উপার্জন তাতে ছয় লাখ ডলার পর্যন্ত দামে বাড়ি কিনতে পারবে। ঐ দামে স্কারবোরতে মোটামুটি একটা বাড়ি পাবে। এখানেই তো থাকবে, নাকি?”
রিমা আবার মাথা দোলায়। অন্য কোথাও যাবার তার কোন কারণ নেই। তার কাজ এখানে, যে কয়েকজন বন্ধু বান্ধব আছে তারাও এদিকেই থাকে।
“সেটাই ভালো হবে,” আসমা মাথা দুলিয়ে বলে। “এই এলাকা নিয়ে নানা জনে নানা ধরণের উল্টো পালটা কথা বলে, সেসব কথায় কান দিও না। তাদের আত্মসম্মানবোধ কম। নিজ এলাকার নামে মন্দ কথা বলার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। যদি খারাপ কিছু থেকেও থাকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে উন্নয়নের চেষ্টা করাটাই সত্যিকারের বীরত্ব।”
রিমা নিঃশব্দে মাথা দোলায়। কথাটা ভুল বলে নি আসমা। গত প্রায় আট বছর ধরে ড্যানফোর্থ এলাকায় বাস করছে ও। এটাই তার কাছে নিজের জায়গা, নিজের ঠিকানা। অন্য কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না ও।

৩৬.
সেই বিকালে বাসায় ফিরে আসমার কেনা এক প্যাকেট লাড্ডূ দিয়ে রিমার বিশেষ সাফল্যকে উদযাপন করা হল। আসমা বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর তিন সন্তানকে নিয়ে সদর্পে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে এসে হাজির হল রিমা। নীল রঙের গাড়ীটা একই স্থানে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। আসমার কাছ থেকে যখন লেসন নিচ্ছিল তখন অনেকবার ভেবেছে গাড়ীটাকে বের করে চালাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ২ লাইসেন্স নিয়ে ড্রাইভ করতে হলে সাথে এক জন এ লাইসেন্সধারী সঙ্গী থাকাটা নিয়ম। হয়ত মিলাকে ওর সাথে থাকার জন্য বলতে পারত কিন্তু মিলা ইদানীং কাজে যেমন ব্যাস্ত থাকে তাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয় নি।

নিজেকে সম্বরণ করবার আরেকটা কারণ ছিল। মিন্টু গাড়ীটাকে সব সময় ঝকঝকে তকতকে করে রাখত। সেটার শরীরে ক্ষুদ্রতম আঁচড় পড়লেও তার মেজাজ ভয়ানক খারাপ হয়ে যেত। ঘন্টার পর ঘন্টা খরচ করত ঠিক করবার জন্য। যে কারণে লাইসেন্স পাবার আগেই গাড়িটাকে বের করে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সেটার কোন ক্ষতি করতে চায়নি ও। এখন যেহেতু লাইসেন্সটা পেয়ে গেছে ওর মনবল অনেক বেড়েছে, ভয়টাও কমে গেছে।
চুপচাপ বসে থাকার ফলে ধুলার একটা আস্তরণ পড়েছে গাড়িটার শরীরে। তার চকচকে নীল অবয়ব মলিন দেখাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন মিন্টু নিজ হাতে সেটাকে ঘষে ঘষে ধুত, মোমের প্রলেপ দিত। বেচারার এই অবস্থা দেখে রিমার একটু খারাপই লাগল। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে বাচ্চারা কেউ এই গাড়িতে পা রাখেনি। জিব্রান এবং রবিন গাড়ীটাকে দেখেই খুশীতে নেচে উঠল। ফায়জার মুখ দেখে ভেতরে কি হচ্ছে বোঝা গেল না। রিমা দরজা খুলে ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিল। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল ইঞ্জিন গরম করার জন্য, সবাই বেল্ট পড়েছে কিনা নিশ্চিত হল। মিন্টু ঠিক এমনটাই করত। এটা মিন্টুর গাড়ী ছিল। মিন্টুর মত করে তার দেখভাল করাটা নিজের দায়িত্ব মনে করে রিমা।

বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ীটাকে পেছালো রিমা, চারদিকে কংক্রিটের খাম্বা, সেগুলোর কোনটাতে গিয়ে ধাক্কা খেলে সর্বনাশ। তারপর গাড়ী ঘুরিয়ে স্বয়ংক্রিয় দরজা পেরিয়ে দিনের আলোয় বেরিয়ে এলো। মিন্টুর মৃত্যুর পর গাড়ীটার এটাই প্রথম যাত্রা। বুক ভরে শ্বাস নিল রিমা, রিয়ার ভিউ মিররটা ঠিকঠাক করল, সাইড মিররগুলোতে নজর বুলিয়ে নিশ্চিত হল দৃষ্টি ঠিক মত চলে কিনা, তারপর ক্রিসেন্ট টাউন রোডে নামল, ওর নজর রাস্তায়, সতর্কভঙ্গীতে পরখ করছে প্রতিটা গাড়ীকে। এতোদিন আসমা সবসময় ওর পাশে থেকেছে। আজ এটাই ওর প্রথম একাকী গাড়ী নিয়ে বের হওয়া। কিন্তু ওর ভয় লাগছে না। রাস্তার নিয়ম মেনে চললে ভয়ের কি আছে?
ফায়জা ফিক করে হেসে উঠল। “মা, তুমি ড্রাইভ করছ!”
জিব্রানও বোনের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে খিল খিল করে আনন্দে হেসে উঠল। রবিন কিছু না বুঝেই দুই হাতে জোরে জোরে তালি দিতে দিতে ভাইয়ের সাথে হাসতে থাকে।

রিমা প্রথম সিগনালে থেমে বাঁয়ে ঘুরে ভিক্টোরিয়া পার্ক এভেনিউতে নামল। দুই লেনের রাস্তা, কিছু পরে গিয়ে চার লেন হয়ে গেছে। এই রাস্তায় গাড়ীর ভীড় অনেক বেশী। একটা গভীর শ্বাস নিল রিমা, এগিয়ে চলল সামনে। এখন ওরা চলেছে মিলার বাসায়। ফেরার পথে কোন একটা কার ওয়াশে থেমে গাড়ীটাকে পরিষ্কার করতে হবে।

দরজা খুলে ওদেরকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল মিলা। “তোমরা এখানে, হঠাৎ?”
“মা গাড়ী চালিয়ে আমাদেরকে নিয়ে এসেছে!” ফায়জা গর্ব ভরে গোপন তথ্যটা ফাঁস করে দেয়। মিলা জানত রিমা ড্রাইভিং লেসন নিচ্ছে কিন্তু রোড টেস্ট দেবার প্রসঙ্গে কিছু তাকে জানায় নি রিমা। যদি পাশ করে তাহলে জানিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে ভেবে গোপন রেখেছিল।
মিলা অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি নিয়ে বাইরে তাকাল, গাড়ীটা দেখেই তার মুখ হাসিতে ভরে উঠল। “লাইসেন্স পেয়েছ!” দুই হাত বাড়িয়ে রিমাকে জড়িয়ে ধরে সে। “এ তো খুব খুশীর খবর। আমাদেরতো সেলিব্রেট করতে হবে। চাইনীজ অর্ডার দেয়া যাক।”
“রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া যায়?” ফায়জা জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিয়ে বলে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে ওর সব সময়েই খুব ভালো লাগে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ সেই সুযোগ খুব একটা হয় না। যখন ওর বাবা বেঁচে ছিল তখনও অধিকাংশ সময় টেক আউট নেয়া হত টিপসের পয়সা বাঁচানোর জন্য। ছোট থাকতে ফায়জা ভেবে পেত না এতো কার্পণ্যের কি কারণ। একটু বড় হবার পর বুঝতে শিখেছে কখন কখন অতি সামান্য অর্থও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

মিলা তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেল। সব খরচ সে বহন করবে। এটা তার উপহার। রিমা ইতস্তত করে। টেক আউট আনাই তো ভালো। অধিকাংশ চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ক্যাশে পে করলে ১০% কম নেয়। তার উপর ভেতরে বসে খেলে যে ১৫% টিপস দিতে হয় সেটাও বাঁচবে। অকারণে বেশী খরচ করে একই খাবার খাওয়ার কি অর্থ হয়? “টেক আউটই নেই,” বলে সে। “আমি অর্ধেক দেব।”
মিলা তার কথায় কোন কর্ণপাত করে না। “আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়েই খাব। আমাকে দুই মিনিট সময় দাও। আমি ঝট করে তৈরী হয়ে আসছি। তারপর,” রিমার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে বলে সে, “ড্রাইভার বেগম, তুমি আমাদেরকে ড্রাইভ করে চায়না প্যাশনে নিয়ে যাবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। পথ আমি দেখিয়ে নিয়ে যাব।”
রিমা ভ্রূঁ কুঁচকাল। “অর্ধেক দাম কিন্তু আমি দেব। না বললেও শুনব না।”
“দেখা যাবে!” মিলা তার শোবার ঘোরে উধাও হয়ে গেল, দরজাটা লাগিয়ে দিল। “দুই মিনিট!” ভেতর থেকে চীৎকার করে বলে সে।
রিমা ফায়জার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। ফায়জা দাঁত বের করে হাসে। অনেক দিন পর ওর মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে।
– টরন্টো, কানাডা