ঋতু মীর : “Motherhood: All love begins and ends there”
১।
নবজাতক শিশুর তারস্বর কান্নায় চমকে তাকায় সত্যবতী। সাবওয়ের বগির এই গিজগিজে ভিড়ে এত ছোট্ট শিশু! নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা হচ্ছে শিশুটির। হয়তো প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত সে, হয়তো পেট ব্যথা করছে, হয়তো এত ভিড়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। এতটাই ছোট যে হাত পা ছুঁড়ে কান্নার মত যথেষ্ট দমও বুঝি নেই বুকের খাঁচায়। ল্যাতপ্যাত করছে ঘাড়, মাথা। শিশুটির চোখ, চাউনি হঠাৎ কেন এমন যান্ত্রিক লাগে তা বুঝে উঠতে পারে না সত্যবতী। ঠিক যেন কিছুটা নিয়ম মাফিক খুলছে এবং বন্ধ করছে। দেখা যায় এমন দূরত্বে বসা সত্যবতীর মনোযোগের পূর্ণ মাত্রাই এখন বগীর কোণে তিন সিট দখল করে বসা তরুণী মায়ের উপর। সিটের উপর পা উঠিয়ে শিশু কোলে নিয়ে বসেছে ষোড়শী মা। তাকে ঘিরে আছে চার পাঁচ জন সমবয়সী বন্ধু। তিন সিটের সবটুকু দখল করে তরুণী মা শিশু নিয়ে তার সংসার জাঁকিয়ে বসেছে। একপাশে রাখা ছোট বাস্কেটে ডায়পার, জামা, এপ্রন, মোজা, খেলনা এমনকি এক জোড়া ছোট্ট জুতাও নজরে পড়ে সত্যবতীর। হাতের ঠিক পাশেই অপেক্ষাকৃত ছোট অন্য একটি বাস্কেটে ফিডারসহ দুধ বানানোর নানাবিধ সরঞ্জাম। শিশু পালনের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এমন থরে থরে নিপুণ গোছানো দেখে চমৎকৃত হয় সত্যবতী। খুব সাবধানে ঘাড়ের নীচে হাত রেখে মেয়েটি শিশুটিকে তার খুব কাছে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গীতে দাঁড়ানো তরুণের বাহুতে তুলে দেয়। চোখের ভাষায় সাবধান বাণী। মেয়েটির ঠোঁটের নড়ন চড়ন, হাত নেড়ে কথা বলার ভঙ্গী দেখে দূর থেকেও সত্যবতী আঁচ করে যে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিই শিশুর পিতা। ছোট্ট শিশুকে কিভাবে কোলে নিতে হবে মেয়েটি সেটাই অভিজ্ঞ এক মায়ের মত বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওভাবে নয়, এভাবে ধরে, ঘাড়ের ঠিক নিচে এভাবে হাত রাখো! বগলের নিচে হাত দিয়ে হ্যাচকা টান দিও না যেন, নরম হাড়ে ব্যাথা লাগতে পারেতো! বোতলে দুধ ভরে এবার শিশুর মুখে তুলে ধরে মেয়েটি। শিশুর কান্না থামে না, থেমে থেমে হিক্কা তুলে কাঁদে অবোধ শিশু। একটু অস্থির বিব্রত দেখায় মাকে। দুধের বোতল যে মুখেই তুলছে না! সত্যবতীকে বিস্ময়ে অবাক করে দিয়ে বন্ধুদের ঘিরে থাকা পর্দায় যাত্রীদের চোখ আড়াল করে breast feeding এ ব্যস্ত হয়ে যায় তরুণী মা। এতক্ষণে কান্না থামে শিশুর। পরম নির্ভরতায় মায়ের বুকে ঘুমিয়ে যায় সে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের সারা মুখে মাতৃত্বের স্বর্গীয় ছায়া খেলা করে। আর ছেলেটি দায়িত্ববান এক পিতার ভ‚মিকায় অতন্দ্র প্রহরীর মত মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। মাতৃত্বের এই দৃশ্যপট অবলোকন করে ভাললাগা অনুভিতিতে সিক্ত, অভিভুত সত্যবতী গন্ত্যব্যের উদ্দেশ্যে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে।

২।
Parenting প্রশিক্ষণ কোর্সের রুমে ঢুকতেই হতচকিত হয় সত্যবতী। এই ক্লাসরুমের আবহটাই যেন এক ভিন্ন ধাঁচের। বড়সড় রুমের একপাশে রাখা খাটে সাদা চাদরের বিছানায় শায়িত একটি মেয়ে। তার পাশে লাগোয়া বেবিকটে ঘুমন্ত শিশু। এটা কি ক্লাসরুম? হ্যাঁ! ক্লাসই তো! ওই তো ছাত্রছাত্রী পরিবেষ্টিত একটা জটলার মধ্যে শিক্ষককে দেখা যাচ্ছে। ‘Cultural shock’ ব্যাপারটা এই বিভূঁইয়ে পা রাখার পর থেকেই নানাভাবে ঘটে চলেছে সত্যবতীর মধ্যে। আজ যেন মগজের তন্ত্রীতে বিষম ধাক্কা খেলো সত্যবতী। শিক্ষকের সামনে কালো সাদা মিলিয়ে বেশ কয়েকটি পুতুল। প্রথম দর্শনে সেগুলোকে সত্যিকারের মানব শিশু বলেই ভ্রম হয় সত্যবতীর। ভিতরে যন্ত্র ফিট করা কান্না এবং হাসির শব্দে, হাত, পা নড়া চড়া, চোখের পাতা ফেলা, বন্ধ করার নিখুঁত কারিগরী কৌশলে আসল নকলে তালগোল পাকিয়ে বোকা হয়ে যায় সত্যবতী। স্ত্রলারসহ একে একে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ডামি শিশুর দায়িত্ব এসাইন করছে মহিলা শিক্ষক। এক মাসের বেশি সময় ধরে ডামি পুতুল রুপি নবজাতক লালন পালনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে শিক্ষার্থী। এদের কেউ কেউ সিঙ্গেল মায়ের ভ‚মিকা নেবে, কেউ আবার জীবন সঙ্গীর সাথে শিশু লালন পালনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। দাম্পত্য, সংসার, সন্তান লালন পালন, দায়িত্ব, কর্তব্য সবকিছুর কাল্পনিক এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটেই কোর্স কারিকুলাম তৈরি। সত্যিকারের বাবা মায়ের মতই দায়িত্ব, শিশুর যত্ন এবং পরিচর্যার বিষয়টা সবাই গভীর মনোযোগে শুনছে। শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষাক্রম এখানে কতটা বাস্তব এবং জীবনমুখী তার জলজ্যান্ত প্রমাণ যেন এই Perenting কোর্সের আয়োজন। হাতে কলমে ভবিষ্যতে শিশু পালনের কাজটি করার দক্ষতা শিক্ষার্থী স্কুল জীবনেই অর্জন করছে। মা হওয়া, সন্তান পালন, সাংসারিক দায় দায়িত্বের নানারকম ঝক্কির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ‘অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের’ বিষয়েও সজাগ হওয়ার বিষয়টা তৈরি হচ্ছে এই সময়েই। মগজে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে যায় সত্যবতীর। ট্রেনে তরুণীর কোলে দেখা শিশু পালনের দৃশ্যের সাথে কোথায় যেন এর অবিকল মিল। তাহলে কি চোখে দেখা সেই নবজাতক আসল নয়, এমন ধরণের ডামী কোন পুতুলই ছিল সেটা? তরুণী মায়ের দায়িত্বজ্ঞান, শিশুর পরিচর্যা কোন কিছুতেই যে সত্যবতীর মনে একবিন্দু সন্দেহ জাগেনি। কেবলমাত্র সেই শিশুর চোখ খোলা, বন্ধ করা তখন কেন এত যান্ত্রিক লেগেছিল তা যেন এতক্ষনে আবিষ্কার করে সত্যবতী।

৩।
ক্লাসের কর্মকাণ্ড এবং ট্রেনে দেখা ঘটনার সাথে কাকতালীয় যোগসূত্রে সত্যবতীর চোখ কৌতূহলে চকচক করে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় পুতুল খেলার ব্যাপারে ধর্মীয় বিধিনিষেধের কিছু ক‚পমণ্ডুকতা আর বাধ্যবাধ্যকতার বেড়াজাল ছিল। অনেকবার হাতে বানানো কাপড়ের পুতুলের সাজানো সংসার ভেঙ্গে পানিতে ফেলে দিয়ে এসেছে সত্যবতী। কিছুদিন পর আবার এক সহজাত ইচ্ছার তাড়নায় পুতুলের নতুন সংসার সাজিয়ে বসেছে। সামজিক বা পারিবারিক নিয়মের নিষেধাজ্ঞা ডিঙোতে ব্যর্থ সত্যবতী ‘আর পুতুল খেলবে না’ এমন সংকল্প মানার ইচ্ছা অনিচ্ছার টানাপড়েনেই কিশোরী থেকে তরুণী এবং ক্রমে নারী হয়ে ওঠার ধাপগুলো অতিক্রম করেছে। ফেলে আসা সময়কে টপকে আসা সত্যবতী তাদের ‘সেই সময়’ আর এখনের ‘এই সময়’ এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রায়শই খেই হারিয়ে ফেলে। কি ভীষণ পার্থক্য দুই সময়ের, দুই ভিন্ন জেনারেশনের বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায়, মানসিকতায়! যত দেখে ততই যেন বিস্ময়ের মোড়ক উন্মোচিত হয় সত্যবতীর সামনে। জানো জোনাকি! টিন এজ মাতৃত্বের বিষয়টা আমাকে মাঝে মাঝেই বেশ ভাবায়। মাতৃত্বের অনুভুতি মেয়েদের সহজাত জানি। খেলনার মাঝে শিশুর প্রতিকৃতি পুতুলই সে প্রথমে মাতৃস্নেহে হাতে তুলে নেয়। তবে মা হওয়া আর ‘মাতৃত্ব’ এর অনুভুতি- এই দুইয়ের মাঝে বাস্তবে যোজন ফারাক। ‘মা’ হওয়ার জন্য শারীরিক বিশেষ করে মানসিক প্রস্তুতি থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। সন্তান পালনের জন্য যে সহিষ্ণুতা, কষ্ট স্বীকার সর্বোপরি নিঃশর্ত ভালোবাসায় যে ত্যাগ স্বীকার- অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন মেয়ের সেই প্রস্তুতি ঠিক কতটা আছে সেটা ভাবনারই বিষয়। তারপরও অতি অল্প বয়সে ‘মা’ হওয়ার সংখ্যা কেবল দেশে নয়, এখানেও অনেক আছে। জানো জোনাকি! ক্লাশে এই বয়সের কোন মেয়েকে অকারণে হাসিতে, উচ্ছ¡লতায়, আনন্দে টগবগ করতে দেখি। অল্পতেই অসহিস্নু, রাগ, অল্পেই অভিমান, হাসা, কাঁদাও ক্ষেত্র বিশেষে এই বয়সেই ঘটতে দেখা যায়। সেই মেয়েটিই যখন আবার শিশু কোলে অসীম ধৈর্য সর্বাঙ্গে ধারণ করে মাতৃত্বের পরীক্ষা দেয় তখন সত্যি বিস্মিত হতে হয়। আমার কি মনে হয় জানো জোনাকি? আসলে motherhood changes everything! (চলবে)

Ritu Mir- Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com