ডঃ বাহারুল হক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলজিতে অনার্সে ভর্তি হবো। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। কয়েক শতের মধ্য থেকে ৩০ জনকে নেয়া হলো। চান্স পেলাম কিনা দেখতে গেলাম। দেখলাম যারা চান্স পেল তাদের লিস্টে প্রথম নামটি একটা মেয়ের নাম- এঞ্জেলা ফৌজিয়া সুলতানা জামান। নামটা বেশ আকর্ষণীয়।

ক্লাস শুরু হলো। এঞ্জেলার সাথে দেখা হলো। হালকা পাতলা গড়নের একটা মেয়ে, উচ্চতাও বেশি নয়। পরনের কাপড় চোপড়, হাঁটা চলার ভঙ্গী, কথা বলার স্টাইল দেখে বুঝলাম অভিজাত পরিবারের মেয়ে, তার সাথে আছে সব কিছুতে একটা দৃড় মনোভাব। বেশিদিন আর একসাথে ক্লাস করা হলো না। একটা ছুটি আসলো।ছুটির পর সবাই এসেছে একমাত্র এঞ্জেলা ব্যাতিরেকে।এঞ্জেলা কোথায়? জানলাম এঞ্জেলা মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত; চিকিৎসার জন্য তাকে আমেরিকা নেয়া হয়েছে। সে ই প্রথম আমি জানলাম ক্যান্সার একটা ব্যাধির নাম এবং এ ব্যাধি হলে চলে যেতে হয়।

এঞ্জেলাও চলে গেছে; প্রথমে আমেরিকা, তারপর….। প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা, কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে সেই নাম- এঞ্জেলা ফৌজিয়া সুলতানা জামান। ক্যান্সার শব্দটা শুনলেই আমার মনে পড়ে এঞ্জেলার কথা।

*** সিনিঅরদের একটা দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে একদিন প্রথম বারের মত গিয়েছিলাম এলেন গার্ডেন দেখতে। দলে অন্তর্ভুক্ত আমরা সবাই যে একে অপরকে আগে থেকে চিনতাম তা কিন্ত নয়। ফলে সেখানে গিয়ে আমরা অপরিচিতদের সাথে পরিচিত হবার প্রয়াস নিলাম। আমি আমার পরিচয় দিচ্ছিলাম। এক পর্যায় এক আপা আমাকে বললেন, “আচ্ছা, জুলজি যদি আপনার অনার্স হয় তাহলে বোটানি নিশ্চয় সাবসিডিয়ারি ছিল”। বললাম – “হাঁ ছিল”। আপা বললেন -“বোটানির ক’জন শিক্ষকের নাম বলেনতো যারা আপনাদের ক্লাস নিত”। আমি বললাম – “যদুলাল স্যার, ইসমাইল স্যার, ডিএনআই স্যার, হাদি স্যার”। আপা এবার বললেন- “আচ্ছা আপনার ইয়ারের, কিন্তু অনার্স করতো বোটানিতে এরকম কজনের নাম বলেনতো”। আমি বললাম – “শাকিব লোহানি, নাদিরা, চুমকি, জাহেদ, আনোয়ার”। আপা একটু মুচকি হাসলেন। মনে হলো আপা যেন কি একটা সত্য উদ্ঘাটন করতে যাচ্ছেন এবং প্রায় সফল হয়ে এসেছেন। আপা এবার বললেন – “বোটানির কোন ম্যাডাম আপনাদের ক্লাস নিতেন না”? আমি বললাম- “নিতেন নিতেন, রোকেয়া আপা আমাদের ক্লাস নিতেন”। আমার কথা শুনে আপা হেসে বললেন- “তুমি আমার ছাত্র; আমি তোমাদের রোকেয়া আপা”। ঘটনার আকস্মিকতায় আর খুশীতে আমি কিছুটা চমকিত হলাম এবং বললাম- “আপা, আমি খুব লজ্জিত যে আমি আপনাকে চিনতে পারিনি”। আপা বললেন- “তুমি যে আমার ছাত্র হবে তা কিন্তু তোমাকে দেখে আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। কারণ আমি তোমাদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসও নিতাম”। আপার প্রচন্ড ধীশক্তির প্রসংশা করতে হয়। যাই হোক, আমি আপাকে অনুসন্ধানী নয়নে দেখে যাচ্ছিলাম। আপা এখন একজন প্রৌঢ়া। ১৯৭২ সনের রোকেয়া আপাকে এই রোকেয়া আপার সাথে মেলালাম। ১৯৭২ সনে রোকেয়া আপা ছিলেন সদ্য জয়েন করা খুব সুশ্রী অবয়বের অধিকারী ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্য একজন প্রভাষক। আজকের এই রোকেয়া আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের একজন রিটায়ার্ড প্রফেসর। আপা এখন থাকেন টরন্টোতে।

*** কুমিল্লায় সাহিত্যামোদিদের একটা ‘সোসাইটি’ ছিল। ফিজিক্সের প্রফেসর সেলিমা আপা ছিলেন তার প্রধান। বোধ হয় আমি ছিলাম সর্বকণিষ্ঠ সদস্য। আমি তখন অকৃতদার ফলে সময় ব্যয়ের একটা ভালো সুযোগ পেলাম। আপার বাসাতেই আমাদের বসা হতো। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কথা হতো। আপা ‘টপিক’ উপস্থাপন করতেন। একদিন আলোচনা চললো রবি ঠাকুরের একটা গান নিয়ে। গানের কথা ছিল-
“তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা,
তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন স্বপনের পারা”
আপা বললেন- “আচ্ছা, কবি যদি কাননের পরিবর্তে বাগান আর গগনের পরিবর্তে আকাশ লিখতেন তাহলে কি গানটির আবেদন কম হতো”? ব্যাস, ওটা নিয়েই আলোচনা। আজ চার দশক পরে সে সব দিনের কথা মনে পড়লে হাসি আসে। কি জন্য এত কথা এত আলোচনা! কবির ইচ্ছা হয়েছে লিখেছেন। কারো ভালো লাগলে গাইবে, শুনবে; ওই গানের শব্দ নিয়ে কেন এত কথা বললাম!!

*** পাঁচ ছেলে, ছেলে বৌদের নিয়ে মিঃ চৌধুরীর সুখের সংসার। ঘটা করে তিনি ছেলেদের, তাদের বৌদের জন্ম এবং তাদের বিবাহ বার্ষিকী পালন করেন প্রতিবছর। বুদ্ধিমতী, হাসি-খুশি, সকলের প্রিয় তার বড় বৌ মাকে এবার তিনি বললেন- “বৌমা, আর তো পারছি না। খরচ বেশি হয়ে যায় এ সবে; কি করি বলোত”। বৌমা বললেন- “থাক বাবা। বাদ দেন । এসব আর করতে যাইয়েন না”। শ্বশুর বললেন- “তা কি করে হয়? বাদ দিতে তো পারি না। এত বছর করে আসছি”! বৌমা বললেন- “তাহলে বাবা, এক কাজ করেন। আপনি শুধু বৌদের গিফ্ট দেন। আপনার ছেলেরা মাইন্ড করবে না”। শ্বশুর চুপ করে রইলেন। বৌমা কিন্ত চুপ থাকলেন না। বৌমা শ্বশুরের সাথে মজা করবার উদ্দেশ্যে বললেন- “বাবা, আমার কাছে আরেকটা বুদ্ধি আছে; তাতে আপনার খরচ একেবারেই কম হবে”। শ্বশুর বললেন- “কি রকম”? বৌমা বললেন- “বাবা, আপনি শুধু আমাকে একটা গিফ্ট দেন, আর কাউকে কিছু দিতে হবে না। এতে আপনার গিফ্ট দেওয়ার অভ্যাসটা থাকলো, খরচও খুব কম হলো। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি বাবা, আমি এ গিফ্টের কথা কাউকে বলবো না এবং সবাইকে বলবো- বাবার আগের সেই দিন কি আছে? বাবা আগের মত এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে কেন যাবেন? এ ধরনের সব অনুষ্ঠান বাদ”।

*** কাউকে বেআদব বলে আমরা এটা বুঝাতে চাই যে তার আদব লেহাজ ম্যানার এসব নাই। ভালো কথা, আপনি এই দুনিয়াতে একটা মানুষ পাবেন যার নাম বেয়াদব? পাবেন না। আচ্ছা বেগুন বললে আমরা কি বুঝি? কিছু একটা বুঝি যার কোন গুন নাই। ঘটনা চক্রে বেগুন একটা সবজির নাম। দুনিয়াতে এত নাম থাকতে এই সবজির নাম বেগুন হলো কেন? কে রাখলো এই নাম? এই সবজির কি কোন গুন নাই? না হয় নাই, তাই বলে তার নাম বেগুন হবে? বেগুনের যদি স্বর থাকতো তাহলে বেগুন সেই নামদাতাকে নিশ্চই বেয়াদব বলতো। বেগুনের নাম বাইগুন হলে ভালো হতো। ‘বাই’ মানে ২ (দুই); গুন মানে কোয়ালিটি ; অতএব বাইগুন মানে যার দুইটি গুন আছে। ‘বাই’ দিয়ে আরো শব্দ:- বাইসাইকেল, বাইনোকুলার, বাইকার্বোনেট, বাইউইকলি, বাইএনুএল, বাইপোলার, বাইল্যাটারেল,—–, ইত্যাদি।

*** রাত বড় হচ্ছে আর ছোট হচ্ছে দিন। দিনের আলো উষ্ণতা হারাচ্ছে, রাতে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। গাছের পাতা ঝরে পড়ছে; অনাবৃত বৃক্ষরাজি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে কোন সুদুরের কে আসবে বলে। অবশেষে আসবে তীব্র ঠান্ডার পিঠে চড়ে সফেদ বরফ। সব খোলা অনাবৃত। যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসে যাবে বরফ। না বলার কেহ নাই। এখানে কেউ না বলে না। পাখী, প্রজাপতী, কেউ না বলে না । বরং দেশ ছেড়ে চলে যায় দুরে বহু দুরে। উড়ে যায় কানাডা গীজ। রাতে দল বেঁধে ডাক দিয়ে দিয়ে তাদের দক্ষিণ দিকে উড়ে যাবার দৃশ্য দেখি। উড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা দল। ডাক শুনি। সেই একই ডাক যে ডাক আমি শিশু কালে শুনতাম রাতে আমাদের উঠানে দাঁড়িয়ে। সেটি ছিল আগমনের দৃশ্য। হাজার হাজার মাইল দুরে এ পাখীদের জন্মস্থান কানাডায় দাঁড়িয়ে তাদের বহির্গমনের দৃশ্য দেখবো তা কোন দিন ভাবনায় আসেনি। ফিরে আসার আশায় বুক বেঁধে উড়াল দেয়া কানাডিয়ান গীজদের উদ্যেশ্যে আমি বলি- তোমার জন্মভুমি ছেড়ে এখন চলে যাও আমার জন্মভুমিতে; সেখানে শীতের তীব্রতা নাই, বরফের নির্মমতা নাই। সেখানে ভোমরা ফুলের সাথে কথা কয়, নীল পদ্মের উপর নাগ শিশুরা খেলা করে, দিগন্ত বিসতৃত সরিষা ক্ষেতে সরিষা ফুল দোল খায়। আরো বলেছি – সাবধানে থেকো, হয়তো হঠাৎ অচেনা শব্দ শুনবে, সে শব্দ তোমাকে ঠেলে দিবে আরো অচেনা ৩য় এক জগতে, যেখেনে গেলে তোমার আর কোথাও ফিরে যাওয়া হবে না।