হাসান গোর্কি : ২০১৪ সালের ৮ মার্চ কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাবার পথে হারিয়ে যায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স এর বিমান-ফ্লাইট এম এইচ ৩৭০। ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল তল্লাশি অভিযানের পর অনেকটা ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে অনুসন্ধানকারীরা খোঁজাখুঁজির কাজটা বন্ধ করে দেয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। সাত বছর অতিক্রান্ত হলেও বিমানটির ভাগ্যে কী ঘটেছে সে বিষয়ে কোন ভাল অনুমান নেই। অ্যাংলো আমেরিকান সাংবাদিক ও লেখক নিগেল চাওর্থনের লেখা “ফ্লাইট এম এইচ ৩৭০: দ্য মিস্ট্রি” নামে একটা বই প্রকাশিত হবার পর রহস্যটি নতুন মাত্রা পেয়েছিল। তিনি দাবি করেছিলেন বিমানটি তার নির্ধারিত গতিপথ থেকে ভুলক্রমে কিছুটা পশ্চিমে সরে গিয়ে গালফ অব থাইল্যান্ড-এ চলমান যুক্তরাষ্ট্র- থাইল্যান্ড সামরিক মহড়া অঞ্চলের উপর চলে গেলে রণতরী থেকে গুলি করে সেটা সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়।
ঘটনাটি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্যে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় বিমানটির দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে চলে যাবার গল্প ফাঁদে এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটিকে কৌশলে ঐ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। এই ফাঁকে তারা বিমানটির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলে। চাওর্থন তেলের রিগে কর্মরত নিউজিল্যান্ডের একজন শ্রমিককে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উল্লেখ করেছেন যিনি বলছেন, “স্থানীয় সময় রাত ১টা ৫০ মিনিটের দিকে আমি একটা জলন্ত বস্তুকে সমুদ্রে পড়ে যেতে দেখি। আমার ধারণা ছিল এটা মহড়ায় অংশগ্রহণকারী কোন বিমান যা দুর্ঘটনায় পড়েছে।”
১৯৮৩ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর কোরিয়ান এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইট ০০৭ নিউইয়র্ক থেকে আলাস্কার এঙ্করেজ হয়ে সিউল যাবার পথে নিষিদ্ধ সোভিয়েত আকাশ সীমায় ঢুকে পড়লে সোভিয়েত যুদ্ধ বিমান গুলি করে সেটাকে কামচাটকা উপদ্বীপের কাছে ওখটস্ক সাগরে ফেলে দেয়। ১৯৮৮ সালের ৩ জুলাই তারিখে ইরান এয়ারের একটা এয়ারবাস এ ৩০০ (ফ্লাইট এ আই ৬৫৫) তেহরান থেকে দুবাই যাবার পথে যুক্তরাষ্ট্র নেভির ইউ এস এস ভিনসেন্স থেকে উৎক্ষিপ্ত গাইডেড মিসাইলের আঘাতে সাগরে পড়ে গেলে ২৯০ জন যাত্রী এবং ক্রুর সকলেই নিহত হয়। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটির ভাগ্যে সেরকম কিছু ঘটে থাকতে পাড়ে বলে নিগেল চাওর্থন ধারণা দিয়েছিলেন। তাঁর লেখা “ফ্লাইট এম এইচ ৩৭০: দ্য মিস্ট্রি” নামের বইটি প্রকাশিত হবার পর মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এক টুইট বার্তায় বলেছিলেন, “বিমানটির ভাগ্যে যাই ঘটে থাকুক তা সি আই এ জানে।” তাই চাওর্থনের ধারণাকে এক কথায় কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
যা-ই ঘটে থাকুক;, বিমানটির হারিয়ে গিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদী রহস্যের জন্ম দিয়েছে। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া রহস্যময় ঘটনাগুলোর মধ্যে তো বটেই, এটাকে কেউ কেউ স্মরণকালের সেরা রহস্য বলে দাবি করছেন। এর আগে বিমান হারিয়ে যাবার সবচেয়ে রহস্যজনক ঘটনাটি ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক পর পর। ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর ইউ এস নেভির ৫ টি এ্যাভেঞ্জার টর্পেডো বোম্বার বিমান প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে গেলে ফ্লাইট কমান্ডারের বিমানের কম্পাসে ত্রুটি দেখা দেয়। তিনি সমস্যাটি কন্ট্রোল টাওয়ারকে অবহিত করেন। এরপর কোন রকম বিপদ সংকেত প্রেরণ করা ছাড়াই সবগুলো বিমান একসাথে হারিয়ে যায়। বহুদিন গবেষণার পর তদন্তকারীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে রাডার থেকে প্রাপ্ত স্বয়ংক্রিয় তথ্যে এমন কোন ভুল ছিল যা বিমানগুলোকে ফিরে আসার সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার পরিবর্তে বিপরীত দিকে চালিত করেছে এবং নেভিগেশন এলাকার বাইরে নিয়ে গেছে। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জ্বালানি নিঃশেষ হবার কারণে বারমুডার কাছাকাছি আটলান্টিকে ডুবে গেছে বিমানগুলো। এটা আজ থেকে ৭৬ বছর আগের কথা। প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতার কারণে তখনকার দিনে এরকম একটা দুর্ঘটনা খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে জ্বলজ্যান্ত একটা বিমান হারিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।
ওবামা প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের একটা ছবি তোলা হয়েছিল। দাবি করা হয় যে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ১ মিলিয়ন লোকের প্রত্যেককে ঐ ছবি থেকে আলাদা করে চেনা সম্ভব। এমনকি নেমপ্লেটে লেখা তাদের নামও পড়া সম্ভব। যতদূর মনে আছে ছবি তোলার কাজে যে ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল তার রেজুলেশন ছিল ১৪৭৪ মেগা পিক্সেল। আকাশে ভাসমান সক্রিয় প্রায় ১০০০ কৃত্রিম উপগ্রহের নজরদারিতে আছে (উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর কিছু এলাকা বাদে) পৃথিবীর সমগ্র জল ও স্থলভাগ। আকাশে উড্ডয়নরত যে কোন বিমানের পাইলট এখন অটোমেটেড বিল্ট ইন ডিভাইস এর সাহায্যে বিমানটির দ্রাঘিমা এবং অক্ষাংশগত অবস্থান, জ্বালানি তেলের মজুত, কেবিন প্রেসার, বাইরের বায়ু চাপ, বায়ু প্রবাহের কৌণিক গতি, ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা, নিকটতম বিমানবন্দরের দূরত্ত্ব, ঝঞ্ঝাপূর্ণ এলাকার (যদি থাকে) অবস্থান, ঐ রুটে চলাচলকারী অন্য বিমানের অবস্থান সহ সকল প্রয়োজনীয় তথ্য নিখুঁতভাবে জানতে পারেন। আবার এই সবগুলো তথ্যই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটতম বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রন কক্ষে প্রেরিত হতে থাকে। বিমানের কোন অংশে বাইরের আঘাত জনিত ক্ষত বা যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ককপিটে বসে পাইলট যেমন জানতে পারেন, একইভাবে নিয়ন্ত্রন কক্ষে দায়িত্বরত ব্যক্তিটিও তা সাথে সাথে জেনে যান। ফলে দুর্ঘটনা পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর কারণ নির্ণয় এখন আর কোন কঠিন কাজ নয়।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানকে বিবেচনায় নিলে নিরাপত্তা সূচকে হারিয়ে যাওয়া বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজের অবস্থান তৃতীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে এয়ারবাস এ ৩৩০ এবং এয়ারবাস এ ৩৪০। তবে নির্মাণকালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে হিসেবে নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বোয়িং ৭৭৭-কেইএ যাবতকাল নির্মিত সবচেয়ে নিরাপদ বিমান হিসেবে মনে করছেন। এটাই হল পৃথিবীর প্রথম সম্পূর্ণ কম্পিউটার নকশাকৃত বিমান যা ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক উড্ডয়ন শুরু করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬৯ টি এয়ারলাইনস, মোট ১৯৭৫ টি ‘বোয়িং ৭৭৭’ কেনার অর্ডার দিয়েছে; যার মধ্যে ইতোমধ্যে ১১৭৮ টি সরবরাহ করা হয়েছে। বড় আকৃতির বিমানের চাহিদা এবং বিক্রির ক্ষেত্রে বিগত ১৮ বছরে এটাই সর্বোচ্চ সূচক।
বোয়িং ৭৭৭-র এটা দ্বিতীয় দুর্ঘটনা। এর আগে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই একটি বোয়িং ৭৭৭ সানফ্রানসিসকো বিমানবন্দরে অবতরণের সময় পাইলটের অদক্ষতায় সানফ্রানসিসকো বে-র সীমানা প্রাচীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে রানওয়েতে বিধ্বস্ত হলে তিনজন যাত্রী নিহত হন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে সমন্বয় করে ফ্লাইট এম এইচ ৩৭০-র ভাগ্যে কী ঘটেছে উড্ডয়ন বিশেষজ্ঞরা সে বিষয়ে একটা অস্পষ্ট ধারণা তৈরি করেছেন। ফ্লাইট এম এইচ ৩৭০ কুয়ালালামপুর থেকে ৮ মার্চ স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৪১ মিনিটে ২৩৯ জন যাত্রী ও ক্রু সমেত বেইজিং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে এবং এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এসময় বিমানটি ভিয়েতনামের চিয়া মাও পেনিনসুলার পাশে দক্ষিণ চীন সমুদ্রের ওপর থাকার কথা। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার মুহূর্তেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তাই প্রথম অনুসন্ধান অভিযানটি চালানো হয় এই অঞ্চলেই। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ান সামরিক রাডার তথ্য দেয় যে বিমানটিকে ফুকেটের দক্ষিণে মালাক্কা প্রণালীর পাশ দিয়ে উড়তে দেখা গেছে। ফলে অনুসন্ধান এলাকা আন্দামান সাগর এবং দক্ষিন বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়।
এক সপ্তাহ খোঁজাখুঁজি করার পর অনুসন্ধানকারীরা যখন মোটামুটি নিশ্চিত হন যে বিমানটি এই এলাকায় বিধ্বস্ত হয়নি তখন তাদের কাছে নতুন খবর আসে। ভারত মহাসাগরের ওপর ভাসমান একটি অস্ট্রেলীয় কৃত্রিম উপগ্রহ কর্তৃক সংগৃহীত উপাত্ত থেকে তারা নিশ্চিত হন যে অদৃশ্য হয়ে যাবার সাত ঘন্টা পর কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও বিমানটির স্বয়ংক্রিয় ডাটা বিনিময় ব্যবস্থা চালু ছিল। এবং বিমানটি থাইল্যান্ড এবং কাজাকাস্থানের মধ্যবর্তী করিডোর দিয়ে উত্তর দিকে উড়ে গেছে অথবা ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের করিডোর ধরে দক্ষিণে চলে গেছে। তবে উত্তরে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম একারণে যে তাতে সেটা কয়েকটি দেশের রাডারে ধরা পড়ার কথা। এই বিমানের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক জেনারেল ইলেক্ট্রিক এভিয়েশনের সদর দপ্তরে চালু অবস্থায় সকল বিমানের ইঞ্জিন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাটা পৌঁছে যায়। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হারিয়ে যাবার পরও বিমানটির ইঞ্জিন পরবর্তী সাত ঘন্টা চালু ছিল। সবদিক বিবেচনা করে সংশ্লিষ্টরা দক্ষিণ ভারত মহাসাগরকেই বিমানটি অনুসন্ধানের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেন। কিন্তু দীর্ঘ অনুসন্ধানেও সেখানে বিমানটির কোন ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি।
বিমানটি ছিনতাই হয়ে থাকলে কোথাও অবতরণ করত। ছিনতাইয়ের পর বিধ্বস্ত হলে মূল হোতারা এর কৃতিত্ব দাবি করার কথা। যান্ত্রিক গোলযোগে ধ্বংস হলে ধ্বংসাবশেষ না পাবার কারণ নেই। কোথাও নিরাপদে অবতরণ করে থাকলে এতদিন সেটা গোপন থাকার কথা নয়। বিমানটিতে দূর নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে চালানোর প্রযুক্তি সংযোজিত ছিল। কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কি ভুমিতে বসে এটার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল? সেক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন দেখা দেয়- এর ধ্বংসাবশেষ গেল কোথায়? ১৯৭২-র অক্টোবরে আন্দিজ পর্বতমালায় বিধ্বস্ত ফ্লাইট ৫৭১-র মত কোন বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের দুর্গম খাদে গিয়ে কি অবতরণ করেছে বিমানটি? ঘটনাটা আসলে কী?
উড্ডয়ন নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন এমন একজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞের একটা নিবন্ধ ২০১৫-র মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে হিন্দুস্তান টাইমস- এ প্রকাশিত হয়েছিল। তার ধারণা বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে হতাশাগ্রস্থ পাইলট জাহিরি আহমাদ আত্মঘাতী হয়ে এ কাজটি করে থাকতে পারেন; যেভাবে ১৯৯৯ সালে মিশরীয় এয়ারলাইন্সের এক পাইলট ২১৭ জন যাত্রী সমেত যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডে আছড়ে পড়েছিলেন। ঐ নিবন্ধে যে অনুমান ব্যক্ত করা হয়েছে তা মোটামুটি এরকম: রাত ১টা ০৭ মিনিটে প্রথম বার্তাটি পাঠানোর পর কো পাইলট টয়লেটে গেলে জাহিরি ককপিটের দরজা বন্ধ করে দেন এবং ১ টা ১৯ মিনিটে দ্বিতীয় বার্তাটি (গুড নাইট। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস থ্রি সেভেন জিরো) পাঠান। মাত্র ১২ মিনিটের মাথায় আবার একটা বার্তা পাঠানোর দরকার ছিল না; বিশেষ করে সেখানে যখন কোন নতুন নির্দেশনা বা প্রয়োজনীয় কোন তথ্য নাই। এরপর তিনি নির্বিঘেœ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে এন্টেবি থেকে ছিনতাইকৃত এয়ার ফ্রান্সের বিমান যাত্রীদের উদ্ধারে যাবার সময় ইসরাইলী কমান্ডোরা মিসর, সুদান এবং সৌদি আরবের রাডার ফাঁকি দিয়ে ২৫০০ মাইল দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছেছিল। লোহিত সাগরের ওপর দিয়ে ওড়ার সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিমানগুলোর উচ্চতা ছিল সর্বাধিক ৩০ মিটার।
জাহিরি একজন দক্ষ পাইলট। তিনি জানেন বিমানটিকে কীভাবে রাডার থেকে অদৃশ্য করে ফেলা যাবে। তিনি বিমানটিকে নামিয়ে আনেন সমুদ্র পৃষ্ঠের ৩০-৫০ মিটারের মধ্যে এবং এই উচ্চতা দিয়ে দক্ষিণ- পশ্চিমে হাজার দুয়েক মাইল উড়ে গিয়ে ভারত মহাসাগরের উৎস মুখে এমন এলাকায় পৌঁছেন যেখানে কোন রাডার ব্যাবস্থা মোটেই সক্রিয় নয়। এরপর তিনি বিমানটিকে স্বাভাবিক উচ্চতায় নিয়ে সোজা দক্ষিনে চালিয়ে নিয়ে যান পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চল- দক্ষিন ভারত মহাসাগরে এবং আলতো করে পানিতে অবতরণ করান যাতে কোন ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন না রেখে বিমানটি অক্ষত অবস্থায় ডুবে যায়। প্রশ্ন হতে পারে আত্মহত্যা করার জন্য তিনি আট ঘন্টা বিমান চালিয়ে এতদূর গেলেন কেন? মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা আত্মহত্যা করার সময় কেউই চায়না তার মৃতদেহ নিয়ে পরে টানা হেঁচড়া হোক। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাবার কোন উপায় থাকে না। জাহিরি হয়ত সে উপায়টি খুঁজে পেয়েছিলেন।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশনের (আইসিএও) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে বিশ্বে মোট বিমান যাত্রীর সংখ্যা ছিল ২.৯ বিলিয়ন- যা এখন তিনশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে প্রাথমিক হিসেবে জানা গেছে। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানকে হিসেবে নিলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ বাহন বিমান। পৃথিবীতে প্রতিদিন মোটামুটি এক লাখ ত্রিশ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। সে হিসেবে বছরে ফ্লাইট সংখ্যা দাঁড়ায় পৌনে পাঁচ কোটি। বিগত পনেরো বছর যাবত ছোট বড় মিলিয়ে বছরে গড়ে ১৫০ টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি সোয়া তিন লাখ ফ্লাইটের মধ্যে দুর্ঘটনায় পড়েছে মাত্র একটি ফ্লাইট। এই দুর্ঘটনার মধ্যে কেবিনের বায়ু চাপ কমে যাওয়া, চাকা ফেটে যাওয়া, যান্ত্রিক বৈকল্যের কারণে জরুরি অবতরণও অন্তর্ভুক্ত। আর এই পনেরো বছরের মধ্যে প্রাণহানি ঘটেছে এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৯৫ টি; বছরে গড়ে ১৩ টি-যাতে মারা গেছেন সর্বমোট ১৮০৪৭ জন আরোহী। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১২০০ জন। অর্থাৎ প্রতি ছত্রিশ লক্ষ ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট প্রাণহানি ঘটানোর মত গুরুতর দুর্ঘটনায় পড়েছে। পরিসংখ্যান মতে বিমান ভ্রমণের সময় যে কোন একজন বিমান যাত্রীর মৃত্যু ঝুঁকি ছত্রিশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। বিষয়টি এরকম যে কোন যাত্রী যদি এক কোটি চুয়াল্লিশ লক্ষ ঘন্টা উড্ডয়ন করেন তাহলে তার একবার বিমান দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি যদি প্রতিদিন চার ঘন্টা করে বিমান ভ্রমন করেন তাহলে এগারো হাজার আটশ বছরের মধ্যে তার প্রাণ হারাবার সম্ভাবনা একবার। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি জানেন না দুর্ঘটনাটা তার প্রথম ফ্লাইটেই ঘটবে কিনা। ২০১২ সালের জুন মাসে এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ নেটওয়ার্কের এক সন্মেলনে অংশ নিতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে হ্যানয় গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর যাত্রায় বাহন ছিল এই বোয়িং ৭৭৭। আর কুয়ালালামপুর থেকে হ্যানয় পর্যন্ত যাত্রায় সেই অঞ্চলের ওপর দিয়ে কিছু সময় উড়তে হয়েছিল যেখানে বিমানটি অদৃশ্য হয়ে গেছে।
hassangorkii@yahoo.com
– আলবার্টা, কানাডা