ঋতু মীর : “Appreciate what you have, where you are and who you are with in this moment”
১।
এত কিছু রেঁধেছিস আমার জন্য সত্য! এই যে শর্ষে বাটা ইলিশ, ছোট মাছের চচ্চড়ি, কুমড়া বড়ি, লাউ চিংরী, টমেটোর টক! তোর কিভাবে মনে আছে এর সবগুলিই আমার ভীষণ পছন্দের? আহা! বড়ির তরকারী কতদিন খাইনি। কোথায় পেলি দোস্ত! ভালোবাসার এক উজ্জ্বল আলো সত্যবতীর মুখে আঁকিবুঁকি কাটে। গলার স্বর অদ্ভুত কোমলতায় ভেজা। বান্ধবীর চোখে নিবিড় দৃষ্টি রেখে বলে – আমার সব মনে থাকে রে। সেই যে রূপসা নদীতে নৌকা বেয়ে তোদের গ্রামের বাড়িতে গেলাম সবাই মিলে। কত কি রেঁধেছিল খালা মানে তোর মা! আর ফেরার সময় তুই হাঁটু পানিতে শাড়ি ভিজিয়ে দাঁড়িয়েছিলি শেষ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নৌকাটা দেখা যায়! পাড়ে দাঁড়ানো তোর বাবা উদ্বিগ্ন তাকিয়ে ছিলেন আমাদের নৌকার দিকে। জানিস! নৌকায় উঠে সুমিতা আর আর ওর ছোট বোন নমিতার নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয়ে সেকি চিৎকার। দেখে আমি হেসেছিলাম বলে দু’বোনের সেকি রাগ আমার উপর। আমার হাসির গমকেই নাকি নৌকাটা প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠেছিল। এতই কি হেসেছিলাম আমি? আসলে স্রোতের টানে ওইখানে নৌকাটা সত্যিই টালমাটাল হয়েছিল। কি কাণ্ড দ্যাখ! যদি সত্যি ডুবে যেতাম তাহলে আমার সংসার দেখতি কি করে? দুই বান্ধবী মিলে অনাবিল হাসে। ফেলে আসা দিনের গল্পে, সুখ স্মৃতিতে কথার খই ফোটে দু’জনের মুখেই। এত কথা এত গল্প! এক বেলায় এই খাওয়ার টেবিলে শেষ হবার নয়। চল তোর সংসারটা ঘুরে দেখি একটু। এত পরিপাটী তুই সত্য! একেবারে ‘সোনার সংসার’! এত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিস। আচ্ছা ! আমি তো ইচ্ছে করেই একদম একাই এলাম যে প্রাণ ভরে গল্প করবো আর তোর যাতে কোন বাড়তি ঝামেলা না হয়। তুই তো দেখি সব নামিয়ে জামাই আদরে টেবিল সাজিয়ে দিয়েছিস। কি সুন্দর সব জিনিষে খাবার বেড়ে রেখেছিস। এত কষ্ট করে এত জিনিষ পত্র নামালি কেন সত্য? এই দেশে কি কেউ সাহায্য করার আছে? মৃদু হাসিতে বান্ধবীর দিকে তাকায় সত্যবতী। বান্ধবীর চোখ উচ্ছ্বাসের আনন্দে ঝিকমিক করছে। পরম মমতায় ওর প্লেটে ভাত তুলে দেয় সত্যবতী। সেই সাথে নিজেও বসে যায় ওর পাশে। জানিস! এখন আর অত খেতে পারি না। কি যেন হয়েছে। খেলেই পেট ভারী হয়ে থাকে। সব কিছু হজমও করতে পারি না আগের মত। আগের মত? মানেটা কি! উৎকণ্ঠিত সত্যবতী যেন আতঙ্কিত কিছুটা! এত লম্বা চওড়া শরীরে খাবারের পরিমাণ যা হওয়া প্রয়োজন সেটুকু খেতে পারতে হবেতো তাই না! ডাক্তার দেখা জলদি! সত্যবতীর অনুসন্ধানী চোখ বন্ধুর শরীরের অলি গলিতে ঘুরে বেড়ায়। মেয়েদের সাধারণ উচ্চতার চেয়েও ওই শরীর মাথায় একহাত বেশি উঁচু লম্বা। চওড়া চোয়াল, পাথালী দেহ, হাত, পা আর কাঁধের গড়নে কিছুটা পুরুষালি ভাব। প্রসঙ্গ উঠলেই হাসিতে গুড়ো গুড়ো হয়ে প্রায়ই বলতো- দ্যাখ সত্য! আমার মনে হয় কোনদিন বিয়েই হবে না। আমার সমান লম্বা ছেলেতো বাজারেই নাইরে, আল্লাহর কাছে অর্ডার দিতে হবে। আঞ্চলিক টানে বান্ধবীর কথা বলার ধরণটা আপন করা এক অনুভূতিতে সত্যবতীকে ছুঁয়ে যেতো। ওর উপস্থিতিটা সত্যবতীর মনে নির্ভরতার জন্ম দিত। সারা অবয়ব ঘিরে সহজাত সৌন্দর্যের ভাবটা সত্যবতীকে অনায়াসে কাছে টানতো। ঘন দুধের ক্ষীরের বাটি এগিয়ে দিয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। ভীষণ পছন্দের গুড়ের ক্ষীর আজ খেতে পারবে তো? আচ্ছা সত্য? তুই যে কি সুন্দর গান গাইতি। ক্লাসের পিকনিকে যতবার গিয়েছি তুই সবসময় গান শুনিয়েছিস। আজ একটু গান শোনাবি আমাকে? অবশ্যই শোনাবো। দ্যাখ! ওই যে হারমনিয়াম, মাইক্রোফোন সব রেডি করে রেখেছি আগে ভাগে। তোকে গান শোনাবো বলেইতো! হীরক দ্যুতির আলো জ্বলে উঠে ওর চোখে। কৃতজ্ঞটায় যেন চোখটা ভিজে যায়। পুরো মুখটাতে অপ্রার্থিব এক স্বর্গীয় আলো ছড়িয়ে যায়। শুধু আমার একার জন্য এত আয়োজন, এত কিছু সত্য? শুধু আমার জন্যই তোর এই অপেক্ষা? গলার স্বরে শিশির ভেজা আদ্রতা। সত্যবতীর চোখও ভিজে ওঠে দ্রুত।
২।
অনেকদিন পরেই দুজনের দেখা। যোগাযোগটা একরকম বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছিল। জীবন চলার বিচিত্র নিয়মে আজ এতদিন পরে দুজনেই একদেশে পরবাসী। ছেলে মেয়ে স্বামীসহ জমজমাট সংসার তাঁর। সবকিছু উজাড় করে ঢেলে বলে সত্যবতীকে। উচ্চপদস্থ স্বামীর চাকরীর পদমর্যাদা লাজুক হেসে গলা নামিয়ে গল্প করে। ‘কোনদিন বিয়েই হবে না’ এই প্রসঙ্গ টেনে দুজনে আবার ঠাট্টায় মজে যায়। বান্ধবীর দিকে গর্বের দৃষ্টিতে তাকায় সত্যবতী। তার স্বামী-স্ত্রী অন্তঃপ্রাণ- এই প্রসঙ্গের গল্পটা অল্পবয়সী মেয়ের কৌতূহলে কান পেতে শোনে সত্যবতী। হিরন্ময় ভাললাগায় মন ভরে ওঠে। বন্ধুর ভালো থাকার খবরগুলো সত্যবতীকে অন্যরকম আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আজ। একেই কি বলে বন্ধুত্ব! অথবা বন্ধুর জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা? বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে আজ ভিতরে প্রচণ্ড কষ্টের অনুভূতি মগজে চেপে বসে সত্যবতীর। কথায় কথায় বান্ধবী জানিয়েছিল তার শরীরটা ভাল নেই। বায়পসির রিপোর্টে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার অর্থাৎ ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
সেই শেষ দেখা। ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার গল্পটা সত্যবতীর সমস্ত স্নায়ুকে অবশ করে দিয়েছিল। কি এক শক্তির উৎস ভিতরে জিইয়ে রেখে বলেছিল- আমি যাচ্ছিরে সত্য! সবাইকে একদিন যেতে হবে। আমি না হয় কিছুদিন আগেই গেলাম। জানো জোনাকি! ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের না ছিল পছন্দের শাড়ি কাপড় না ছিল সখ আহ্লাদ পূরণের কোন সুযোগ। অথচ মনের কোন দৈন্যতা কখনই আমাদের স্পর্শ করেনি। আমাদের সেই সময়টা কি এক ঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল। অল্পতেই মন ছিল জল ভরা দিঘীর মত টইটুম্বুর। কি নির্মল সুন্দর সময় কাটাতাম আমরা। শোন জোনাকি! মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কে মায়ামমতা, বন্ধুত্বের বন্ধনটা আজ বড় অদ্ভুতভাবেই শিথিল। আমাদের চারপাশে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাবগ্রস্থ মানুষের ভিড়টাই এখন যেন বড় বেশি। ‘যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে সন্তুষ্টির চেয়ে ‘যা নেই’ সেই খতিয়ানেই যেন মানুষ বড় বেশি ব্যস্ত আজ। বন্ধুত্বের নিঃশর্ত সম্পর্কের জাল আর কেউ পেতে রাখে না। সম্পর্কে প্রত্যাশার বল্গাহীন ঘোড়াটা যেন বড্ড বেশি ছোটে এখন। তুমি ঠিক বলেছ সত্য। জোনাকির স্বরে অন্যরকম গভীরতা। স্বার্থপরতা, প্রত্যাশার পারদ সম্পর্ককে যেন বড় বেশি জটিল করে ফেলছে। A relationship must be unconditional with unconditional love, unconditional care, unconditional respect! আর নিঃশর্ত ভালোবাসার রূপটাই তোমার ভিতরের শান্তি পূর্ণতাকে নিশ্চিত করবে সত্য! (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com