শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

৭.
আমাদের গল্পের মাঝখানে কোন এক সময়ে অরুণ এসে ঘরে ঢুকেছে টের পাইনি। সুদর্শন লম্বা গঠনের অরুণের সাথে মাসিমার চেহারায় যথেষ্ট মিল রয়েছে। পরিচয় পর্ব শেষ হলে অরুণ বলল- “আপনার গল্প মায়ের কাছে রোজ শুনতে পাই, খুব আগ্রহ ছিল আপনাকে দেখবার জন্য”। অনেক ধন্যবাদ জানালো আমাকে মাসিমার প্রতি খেয়াল রাখার জন্য। আমি তাকে জানালাম যে এটা আমাদের কর্তব্য। আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করার পরে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম যাতে ওরা নিজেদের মত কথা বলতে পারে, যাবার আগে অরুণকে বলে এলাম যে যাবার পথে সে যেন অবশ্যই নার্সিং স্টেশনে থেমে আমার সাথে কথা বলে যায়। ফেরার পথে দেখলাম এলিভাটরের কাছে এরিখের জিনিস পত্র স্তুপ করে রাখা, বুঝলাম এরিখের নাতনী এসেছে দাদুর জিনিস পত্র নিয়ে রুম খালি করে দেবার জন্য।
এরিখের জন্ম ১৯২০ শে, ১৯৩৯ শে ২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় এরিখের বয়স ১৯ এবং সেই বছরেই সে তার স্কুল সুইটহার্ট কে বিয়ে করে সংসারী হয়েছিল। বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় পামেলা প্রেগন্যান্ট হয়েছিল। বছর ঘুরেতে মেয়ে এল কোলে। মেয়ে এমিলির যখন ৫ মাস বয়স তখন এরিখের ডাক এসেছিল যুদ্ধে যাবার জন্য। বউকে কাঁদিয়ে, ফিরে আসার প্রতিশ্রæতি দিয়ে এরিখ যুদ্ধে গিয়েছিল। আহত হয়ে এরিখ ফিরে এসেছিল যুদ্ধ শেষের কিছু আগে। যুদ্ধক্ষেত্রে এরিখেদের বাংকারের খুব কাছে বোমা পড়েছিল।

ওদের ট্রুপের অনেকে সেদিন মারা পড়েছিল কিন্তু এরিখ প্রানে বেঁচে গিয়েছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে বড় কোন অংগহানি ছাড়াই সে বেঁচে গিয়েছিল। সারা শরীরে ঢুকেছিল অসংখ্য ছোট ছোট স্প্লিনটার। ১ মাস হাসপাতালে থাকার পরে বাড়ি ফিরে এসেছিল এরিখ কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি এরিখ। এত মৃত্যু দেখে এরিখ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল। চিকিৎসার মাধ্যমে সেটা ঠিক হলেও ডিপ্রেশন থেকে এরিখ বেরোতে পারেনি এবং সেই সাথে শ্রবনশক্তি হারিয়েছিল পাকাপোক্ত ভাবে। এরিখ এবং পামেলার দাম্পত্য জীবন খুব সুখের ছিল না। ওদের আরো দু’টো ছেলে-মেয়ে হয়েছিল এবং পামেলাকে একাই সব সন্তানদের বড় করতে হয়েছিল। এরিখের উপস্থিতি ছিল ওদের জীবনে আবার ছিলও না কারণ এরিখ নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকত, খুব একটা কথা বলত না প্রয়োজন ছাড়া।

সপ্তাহের প্রতি শুক্রবারে সে স্থানীয় পাবে যেত বিয়ার খাবার জন্য এবং বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য। পামেলাকে কাজে ঢুকেছিল এবং এরিখের মা বাচ্চা সামলাতে সাহায্য করত যখন পামেলা কাজে থাকত। এরিখের কাছ থেকে পামেলা কিছুই পায়নি তাই তার শরীর, মনে ছিল এক অপরিসীম চাহিদা আর পামেলা সেটা লুকানোরও কোন চেস্টা করেনি। জীবনে অনেক পুরুষ এসেছে তার কিন্তু এরিখকে ছেড়ে যায়নি কখনো। এরিখ ভেটেরান বেনিফিট পেত যেটা একটা নিশ্চিত মাসিক আয় ছিল কিন্তু সারাক্ষন ঘরে পামেলার দম আটকে আসত বলে সে কাজের মাধ্যমে মুক্তির সাধ নিয়েছিল।

এসব গল্প আমি এরিখের নাতনীর কাছ থেকে শুনেছিলাম। পামেলা মারা গিয়েছে নয় বছর আগে। ততদিন পর্যন্ত পামেলাই এরিখের দেখাশোনা করত। হাটাচলাতে এরিখের কোন সমস্যা ছিল না কিন্তু ওর ছিল এলজাইমার রোগ। একই কথা বার বার বলত, ভুলে যেত ২ মিনিট আগে কি বলেছে। সব ভুলে গিয়ে ছেলে বেলায় আটকে গিয়েছিল। এরিখ ওর মাকে খুঁজত হরহামেশাই। একটা মজার বিষয় ছিল এরিখকে নিয়ে; সে তার সাহায্যকারী সব মেয়েদের চুমু খেতে চাইত। খুব সুন্দর করে জিজ্ঞেস করত- “আমি কি তোমাকে একটা চুমু খেতে পারি?” তার উত্তরে সবাই বলত “এরিখ, আমি বিবাহিত, তোমাকে চুমু খেলে আমার হাজবেন্ড রাগ করবে”, সাথে সাথে এরিখ বলত “সরি”, দু’ মিনিট পরেই আবার সেই একই চুমু খাবার বায়না। আরো মজার বিষয় হল; কেউ যখন বলত আমি বিবাহিত এরিখ তার আঙ্গুলে আংটি খুজত। আংটি না থাকলে জানতে চাইতো ওয়েডিং রিং কোথায়? একবার একটা মজার ঘটনা ঘটল, খুব অল্প বয়সী একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে কাজে ঢুকেছে এবং কোন একটা কারণে ওকে এরিখের বিষয়ে আগে থেকে বলা হয়নি যেটা কিনা সব নতুনদের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। মেয়েটি প্রথমদিন কাজে এসেছে এবং যে উয়িংসে ওর কাজ পরেছে সে দিকেই এরিখ থাকে এবং যথারীতি সেও চুমুর প্রস্তাব পেয়েছে। সবাইকে ডাইনিং হলে বসিয়ে মেয়েটি নার্সিং স্টেশনে এসে বলল যে সে কাজ ছেড়ে দিতে চায়, দেখি তার চোখ, নাক লাল। বুঝলাম অনেক কান্নাকাটি করেছে। কাজ কেন ছাড়বে জানতে চাইলাম তখন সে বলল “চুমু” কাহিনী। শুনে আমরা হেসে ফেললাম। আমাদের হাসি দেখে মেয়েটির চক্ষু চড়কগাছে! সরি বলে ওকে বুঝিয়ে বললাম যে এরিখ এটা সবার সাথে করে, এটা নতুন কিছু নয় এবং এটার পিছনে ওর কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই। কিভাবে সে এর হাত থেকে বাঁচতে পারে তাও বুঝিয়ে বললাম। মেয়েটি চিন্তিত ভাবে বলল যে সে বিবাহিত নয় এবং তার ওয়েডিং রিং নেই, তাকে বললাম যে সমস্যা নেই; এরিখেকে বলতে হবে “রেডি হয়ে নাও তারপরে হবে”, এরপরে বলবে “দেরি হয়ে গিয়েছে এরিখ, আজ নয় কাল হবে”, পরক্ষণেই এরিখ ভুলে যায় কি বলেছিল সে। মেয়েটি যেন হাফছেড়ে বেঁচেছিল। দেখলাম লজ্জা পাবার একচিলতে হাসি মুখ। বললাম “ডাইনিং হলে ছুটে যাও, ওখানে এখন অনেক কাজ তোমার”। হাসি মুখে চলে গেল সে। পামেলা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল ন’বছর আগে, ওদের ছেলে মেয়েরাও কেই বেঁচে নেই, এরিখের সার্বক্ষণিক সাহায্যের প্রয়োজন বলে নাতি-নাতনীরাই সবাই মিলে আলোচনা করে এরিখকে হোমে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু পালা করে ওরা এরিখের দেখাশোনা করত এবং খোঁজখবর রাখত। শেষ পর্যন্ত লম্বা একটা অসুখী জীবন থেকে মুক্তি মিলেছে এরিখের। হয়ত সে অবশেষে তাঁর মায়ের দেখা পেয়েছে অথবা পায়নি। কিন্তু অপার শান্তি মিলেছে নিশ্চয়ই। এরিখের আত্মার শান্তি হোক। এগিয়ে গিয়ে এরিখের নাতনীকে জিজ্ঞেস করলাম কোন সাহায্য করতে পারি কিনা, সে হাসি মুখে বলল প্রয়োজন নেই, ধন্যবাদ দিয়ে সবার জন্য প্রেয়ার্স করতে অনুরোধ করল। আমি এরিখের খালি রুমটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভাবলাম “এখানে এখন নতুন কেউ আসবে, আবার শুরু হবে নতুন কোন গল্প।”

কিছুক্ষণ পরেই দেখি অরুণ এসে হাজির। অরুণকে নিয়ে ওয়েটিং রুমের দিকে গেলাম। অরুণকে জানালাম যে মাসিমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে আসুবিধা হয়, উনি এখানকার খাবার খেতে পারেন না, বিস্বাদ লাগে মুখে। জানতে চাইলাম মাঝে মাঝে দেশী খাবার যেমন ভাত ডাল এনে খাওয়ানো সম্ভব কিনা? অরুণের মুখটা কালো হয়ে গেল। খুব ধীরে অরুণ জানালো যে সেটা সম্ভব নয় কারন ওর বউ আমেরিকান। বাড়িতে কোন ইন্ডিয়ান রান্না হয়না। মাসিমা যখন বাড়িতে ছিলেন তখন নিজের জন্য একটু দেশী রান্না করে নিতেন। অরুণ জানালো যে বিদেশে আসার পরে ও দেশে গিয়ে সেটেল করার কথা আর ভাবেনি তাই যখন সামান্থার সাথে ওর পরিচয় এবং সেটা আরো গভীর হল, সে কোন কোন পিছুটান বোধ করেনি। ক্যানাডাতে জব পাবার পরে সে সামান্থাকে প্রপোজ করেছিল, সামান্থা রাজী হতেই ওরা বিয়ে করে ফেলেছিল। মাসিমা এসব কিছুই জানতেন না। সে শুধু চাইতো অরুণ দেশে ফিরে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসুক। অরুণ জানত মা কে আনতে দেশে গেলে মাসিমা অরুণের বিয়ে নিয়ে একটা ঘোট পাকাবে তাই ভিসা হবার পরে সে মায়ের জন্য টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল কিন্তু দেশে যায়নি। মাসিমা ছেলের কাছে পৌঁছে বিদেশী বউ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল। মুখে কিছু বল্নেনি কিন্তু ছেলের মিথ্যাচারে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মাসিমা বা সামান্থা কেউই চেস্টা করেননি সম্পর্ক গড়ার। সামান্থা বুঝেছিল তার প্রতি শাশুড়ির শীতলতা। মাসিমাও কেমন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিজের ঘরেই থাকতেন বেশীরভাগ সময়। সামান্থা ইন্ডিয়ান স্পাইসের গন্ধ সইতে পারে না বলে যখন সে কাজে থাকত সেই সময়ে মাসিমা নিজের জন্য একটু রান্না করে নিতেন। সামান্থা মাসিমার সাথে কথা বলে না, এই নিয়ে অরুণ কিছু বললে সামান্থা রেগে যায়, ভাষা না জানার যুক্তি দেয়। ওরা কোথাও বেড়াতে গেলে বেশী করে খাবার দাবার কিনে দিয়ে চলে যেত, বার বার করে বলত দড়জা না খোলার জন্য। মাসিমার আকাশ ছোট হতে হতে অরুণে এসে ঠেকেছিল। অরুণ বলল, তাঁর মায়ের প্রতি যে সুবিচার হয়নি সেটা সে জানে এবং এও জানে যে, যে মুহুর্তে সে সামান্থাকে প্রপোজ করেছে সেই মুহুর্তে তার জীবনের গল্প বদলে গিয়েছে, সেখানে তার ফেলে আসা জীবনের কোন স্থান নেই। নতুন গল্পে, নতুন প্রেক্ষাপটে মাসিমার কোন ভূমিকা নেই কিন্তু তারপরেও মাসিমা ছিলেন তাদের জীবনে, ছিলেন একটি ছায়া হয়ে, একটি আসবাব হয়ে। আমি ভাবছিলাম একজন মানুষ যখন জানে যে একটি রঙিন ভালবাসাময় জীবনের শেষে সে এখন অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত কেমন হয় তার মনের গতি?… “জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায় যায়, গীতসুধারসে এসো”। হে মহাজীবন তুমি সবার প্রতি করুণাশীল হও, কৃপা কর তোমার সৃষ্টিকে। (ক্রমাগত)
– টরন্টো, কানাডা