রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
পঁচিশ.
সপ্তম অধ্যায়
ভবিষ্যতের কথা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) আমি ধরে নিয়েছিলাম যে আমাদের ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ যদি নিজেদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অধিক মাত্রায় সম্পৃক্ত বোধ করে তবে সেটি কোম্পানির সমস্ত লোকজনের উপর একটা ধনাত্মক প্রভাব পড়বে। কোম্পানির মনোবল ক্রমান্বয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। সে সময়ে আমার কোন ধারণা ছিল না কত নাটকীয়ভাবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে আমরা এর প্রভাব দেখতে পারবো।
বোর্ডের কাছে প্রাথমিক সাক্ষাৎকার দেয়ার ছয় মাস অতিবাহিত হতে চলল। বোর্ড যেভাবে আমাকে পরিক্ষা নিরিক্ষা করেছিলেন সেটি আমার পেশাগত জীবনে আর কখনও ঘটেনি। আমি আর কখনও এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মূখীন হইনি। বিশেষ করে ব্যাবসায়িক বুদ্ধিবৃত্তির কথা বলছি। আমাদের কোম্পানি কিভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, কোম্পানির কোন সমস্যা কিভাবে সমাধান করা দরকার ইত্যাদি বিষয়ে আমি কখনও এত তথ্য এত সংক্ষিপ্ত সময়ে গভীরভাবে চিন্তা করিনি। আমি কোম্পানি পরিচলনার কাজে প্রতিদিনের চাহিদা মোতাবেক মাইকেলকে সহযোগিতা করে এসেছি (মাইকেল সেখানে উপস্থিত থাকলেও তাঁর মনোযোগ অন্য কোথাও অন্য কোন বিষয়ের উপর নিপতিত ছিল)। লম্বা চাপযুক্ত দিনগুলো আমাকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে ফেলছে।
আমার এই মানসিক উত্তেজনা কাজের চাপের কারণে ঘটেনি। আমার মধ্যে অনেক বেশি কর্মস্পৃহা ও কর্মক্ষমতা ক্রিয়াশীল। আমি যে কারও চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠার সাথে লাগাতার কাজ করতে পারি। যে কারণে আমি নিজের কর্মক্ষমাতার জন্য নিজেই গর্ববোধ করি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় পরিক্ষা হচ্ছে মানুষের মুখোমুখি হওয়া। তাঁদের প্রকাশ্যে বলা যে আমার পরবর্তী প্রধান নির্বাহী হওয়া উচিৎ নয়। ডিজনির উত্তরাধিকার হওয়া ছিলো একটা গল্পের সৃষ্টি করা। চারিদিকে জনশ্রুতির ছড়াছড়ি হবে। বোর্ড আমাকে নিয়ে কি ভাবছেন? কে এখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করছেন? কোম্পানি কি স্বাভাবিক ন্যায্য সিদ্ধান্ত নেবে? এ সমস্ত চিন্তা আমার মাথায় নিরলসভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ব্যাবসায়িক বিশ্লেষক এবং ভাষ্যকাররা মূলত বোর্ডের সদস্যদের মতামতেরই প্রতিধ্বনি করেছিলেন। আমাকে প্রধান নির্বাহী না করার পক্ষেই তাঁরা একমত হয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘ডিজনির উদ্দীপক শক্তি হিসাবে নতুন কাউকে দরকার, যা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেবে। ইগারকে প্রধান নির্বাহী করার অর্থ আর একজন বড়সড় মাইকেল আইজনারকে ক্ষমতায় বসানোর সামিল।’
যদিও এতসব তখনও খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশ হয়নি। প্রক্রিয়া শুরু হবার আগে জেফরি কিটজেনবার্গ বারব্যাঙ্কে ডিজনি অফিসের কাছে আমার সাথে সকালের নাস্তা করছিলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার ডিজনি ছেড়ে যাওয়া উচিৎ। আপনি প্রধান নির্বাহী হতে পারবেন না। আপনার সুনাম ক্ষুন্ন হবে।’ আমি জানতাম মাইকেলের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে প্রকাশ করা, একটা কুস্তি লড়ার সামিল। কিন্তু আমি তখনও ভাবিনি বাইরের লোকজন আমাকে কলঙ্কিত ভাববে। জেফরি আমাকে কলঙ্কমুক্ত থাকার তাগিদ দিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া লঙ্কাকান্ডগুলোর জন্য আমাকে মাইকেল থেকে আলাদা ভাববার কোন উপায় থাকল না। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য কোম্পানির জন্য কল্যাণকর কিছু একটা করা দরকার।’
আমার নিজের মর্যাদা সমুন্নত রাখা বলতে জেফরি কি বুঝাতে চায়ছেন? তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি তাঁর কথায় হতভম্ব হয়ে পড়লাম, মনে মনে রাগান্বিত হলাম। জেফরি কি ভাবে এত নিশ্চিৎ হলেন যে আমার সময় শেষ। তাঁর কথা সত্য ধরে নিয়ে আমি খানিকটা বিষ্মিত হয়েছি। হতে পারে আমি পুরোটা বুঝে উঠতে পারিনি। আমার চার পাশের মানুষজন দিবালোকের মতো স্বচ্ছ সবকিছু বুঝতে পারছে। তারা বুঝতে পারছে আমার ডিজনির প্রধান নির্বাহী হবার কোন পথ খোলা নেই। অথবা হতে পারে এর সমস্তটাই হলিউডের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। এ সমস্ত সড়যন্ত্রে কান দিয়ে আমার কোন লাভ হবে না যেখানে আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাকে আমার সেরা গল্পটি নির্মাণের কাজ করে যেতে হবে।
আপনার সম্পর্কে কে কি ভাবছেন বা লিখছেন বা একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি আপনার সম্পর্কে বা অন্য একজনের সম্পর্কে কি ভাবছেন, তিনি তার চারপাশের মানুষের সাথে আপনার সম্পর্কে কি বলছেন এগুলো নিয়ে আপনার ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আপনার সন্দেহ হতেই পারে আপনি কোন গুজবের কলে আটকা পড়ে গেলেন না তো। আপনার কাছে যখন স্পষ্ট হয়ে যাবে সে আমার সম্পর্কে অন্যায়ভাবে মানুষের কাছে আমার কুৎসা রটনা করছে তখন তার উপর রাগ হতেই পারেন বা তাকে আপনি আঘাতও করতে পারেন। কিন্তু এগুলো নিয়ে কোন রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করতে গেলেই আপনি নিজেকে আরও ছোট আর তুচ্ছ করে ফেলবেন। আমি বিশ্বাস করি না এই পদের আমিই যোগ্যতম ব্যক্তি। আমি বিশ্বাস করি না সহজাতভাবে আমার এই পদটি পাওয়া উচিৎ। তবে আমি বিশ্বাস করি এই পদের জন্য আমিই সঠিক ব্যক্তি। এর প্রমাণের একটা অংশ জনসমক্ষে বহুবিধ সন্দেহ প্রকাশের নিচে চাপা পড়ে গেছে এবং এটি দৃঢ়ভাবেই বিদ্যমান। ওরল্যান্ডো সেন্টিনাল খবরের কাগজে প্রকাশিত শিরোনাম আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, সেখানে লেখাছিল, ‘আইজনারের উত্তরাধিকারীকে স্পষ্ট দেখা যায় না’। আরও অনেকে একই ধরণের অনুভূতি প্রকাশ করছেন। আমার আরও মনে হচ্ছিল প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ বলছেন অথবা লিখছেন বোর্ড যদি আমাকে প্রধান নির্বাহীর দ্বায়িত্ব দেন, আমি দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করতে অস্বীকার করবো কিনা। স্ট্যানলি গোল্ড অন্য এক প্রকাশনায় উল্লেখ করেছেন যে আমি একজন ভদ্রলোক আর কঠোর পরিশ্রমী নির্বাহী, কিন্তু ডিজনি বোর্ডের সকল সদস্যের খোলামেলা প্রশ্ন আমার কছে বোর্ড যদি আমাকে প্রধান নির্বাহী করে তবে মাইকেলের জায়গায় আমার আসিন হওয়া উচিৎ হবে কিনা। তাঁর কথায় একটা ভীতিকর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গ্যারি উইলসন নামে একজন বোর্ড মেম্বার শুধুমাত্র চিন্তা করেননি যে আমার প্রধান নির্বাহী হওয়া উচিৎ, তিনি পরিষ্কারভাবে এও ভেবেছিলেন আমাকে সহজেই প্রলুব্ধ করে বা অপমান করে তিনি তার এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন। এই প্রক্রিয়াটি যতটা না আমার চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, ধ্যান ধারনার পরিক্ষা ছিল তার চেয়েও বেশি ছিল আমার মেজাজের গতি প্রকৃতির পরিক্ষা। যারা আমার সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানেন, তারা আমার সম্পর্কে ঋণাত্মক মন্তব্য প্রকাশ করবেন, আমি তা মেনে নেবোনা। এগুলো মেনে নিলে আমি যে ভাবে নিজেকে জানি, সম্মান করি তার পথ রুদ্ধ হবে।
নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হতে আমাকে পনের বার সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে। প্রথমে সকল বোর্ড মেম্বারদের সামনে। দ্বিতীয়ত প্রত্যেক বোর্ড মেম্বারের সাথে এককভাবে। তারপর ইচ্ছুক বোর্ড মেম্বারদের সামনে ফোলোআপ সাক্ষাৎকার। তার পরেরটা আমার পেশাগত জীবনে সবচেয়ে অপমানকর সাক্ষাৎকার দেবার অভিজ্ঞতা। গ্যারি রোচ নামে একজন হেডহান্টারের সাথে সাক্ষাৎকার। তিনি বেশ সুপরিচিত অনুসন্ধানমূলক ব্যবসা হেড্রিক এন্ড স্ট্রাগলস প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।
গ্যারিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তাঁর দ্বায়িত্ব ছিল বহিরাগত প্রার্থীদের বিপক্ষে আমাকে মূল্যায়ন করা। আবার বহিরাগত প্রর্থীদের বোর্ড ভালোমত চিনত না বিধায় তাঁদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বোর্ডকে সহযোগিতা করা। যখন আমি এ বিষয়টি জানতে পারলাম তখন আমি জর্জ মিশেলকে অভিযোগের সুরে বললাম এটি আপত্তিকর। আমাকে সম্ভাব্য যে সমস্ত প্রশ্ন করা হবে আমি সেগুলোর উত্তর আপনাদের দিয়েছি। জবাবে জর্জ আমাকে বললেন, ‘আপনাকে যা বলা হচ্ছে ঠিক তাই করুন। বোর্ড প্রত্যেকটি সম্ভাবনা পরিক্ষা করে দেখতে চায়।’
আমি গ্যারির অফিসে একটা মধ্যহ্নভোজের মিটিং-এ অংশগ্রহণ করার জন্য উড়ে গেলাম। আমারা তাঁর অফিসের একটা কনফারেন্স রুমে বসলাম। টেবিলে শুধুমাত্র পানি ছিল। গ্যারির হাতে জেমস স্টুয়ার্টের লেখা ডিজনি ওয়ার বই-এর একটা কপি দেখতে পেলাম। যেটি সবেমাত্র প্রকাশ হয়েছে। ইতিমধ্যে এটি তদন্তও করা হয়েছে। কতকগুলো ঘটনা সেখানে ভুলভাবে উপাস্থাপন করা হয়েছেল। বইটিতে মাইকেলের প্রধান নির্বাহী আর আমার প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা থাকা কালীন ঘটনাগুলো উঠে এসেছে। বইটিতে বিভিন্ন রং ব্যবহার করে কয়েকটি পাতায় বেশকিছু অনুচ্ছেদের পাশে নোট লেখা ছিল। তিনি সেই সমস্ত নোটের আলোকে আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চান। তিনি বইটির পাতা উল্টে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন, যেগুলো বিষয়ে তখন আমার সামান্যই করার ছিল বা কিছুই করার ছিল না। সাক্ষাৎকারের আধ ঘন্টা হয়েছে সে সময় তাঁর সহকারী সভাকক্ষে ঢুকলেন, হাতে গ্যারির জন্য একটা বাদামী রঙের লাঞ্চ ব্যাগ। সহকারী বললেন তাঁকে যে ব্যক্তিগত বিমানটি ফ্লোরিডায় বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবে, সেটি শীঘ্রই ছেড়ে যাবে। যেতে চাইলে এখনই যেতে হবে তা না হলে বিমানটি তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে। এ অবস্থায় গ্যারি উঠে দাঁড়ালেন এবং সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন। আমার আর দুপুরের খাওয়া হলনা। সময়ের অপচয় আর অসম্মানের কথা ভেবে মনটা রাগ আর অস্থিরতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। আমি সভাকক্ষ ত্যাগ করলাম।
আমার জীবনে শুধুমাত্র একবার মানসিক চাপ আর হতাশা আমাকে কাবু করে ফেলেছিল। এটি ছিল ২০০৫ এর জানুয়ারী মাস। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হতে এখনও কয়েক মাস বাকী রয়েছে। আমি আমার ছয় বছর বয়সী ছেলে ম্যাক্সকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে স্ট্যাপল সেন্টারে দ্রæতগতির নাগরদোলায় খেলতে গেছিলাম। খেলার মাঝখানে আমার শরীর ঘামতে শুরু করল। আমার বুক শক্ত হয়ে আসছে, আমি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছি না। আমার মা-বাবা দুজনই পঞ্চাশ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছিলেন। আমার বয়স তখন চুয়ান্ন। আর আমি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো জানতাম। সত্যিকারার্থে হার্ট অ্যাটাকের একটা ভয় আমার মধ্যে কাজ করত। একবার মন বলছে এটি হার্ট অ্যাটাক। আবার মনে হচ্ছে না আমার হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে না। আমি স্বাস্থ্যকর খাবার খায়। সপ্তাহের সাতদিনই আমি শরীর চর্চা করি। নিয়মিত শরীর পরীক্ষা করায়। না এটি হার্ট অ্যাটাক নয়। তাই কি? খেলা চলাকালীন আমি জরুরী মেডিকেল টিমকে ফোন করবো কিনা সেটি নিয়ে নিজের সাথে বিতর্ক করছি। আবার ভাবছি জরুরী মেডিকেল টিমকে দেখে ম্যাক্স ভয় পেয়ে যাবে। (চলবে) – টরন্টো, কানাডা