বিদ্যুৎ সরকার : কথা ছিল তুমি আসবে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম এক না বলা শিহরণ, অজানা এক সুখানুভূতি নিয়ে। না তুমি এলে না। যতটুকু ভালোলাগা থাকলে ভালোবাসা অংকুরিত হয়, যতটুকু চঞ্চলতা জাগলে হৃদয়ে কম্পন অনুভূত হয় – এর সব কিছুরি আয়োজন ছিল শুধু তুমিই আসোনি। মাধবী লতারা কি আজ ফোটেনি, পাখিরা কি গান গায়নি, টাইগার হিলে ‘সান রাইজ’ দেখতে যায়নি বুঝি কেউ, ঝরে নৌকা ডুবি হবে জেনেও কেউই কি নাও ভাসায়নি? একটি সকাল কেমন করে দুপুরে রূপান্তরিত হয় সময়ের অসময়ে তা তো জানা হলো না তোমার। অপেক্ষার রেল স্টেশন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হোয়ে যায় কী অবলিলায় শুধু, ভুক্তভোগীরাই বলার অধিকার রাখে সংগোপনে। ‘লং উইক, – এন্ড’- এ এ শহর প্রেমিক শূন্য হোয়ে গেছে কোন সকালে কেউ তা জানে না। শুধু সুবোধ ছেলে কী অবোধের মতো অপেক্ষায় থাকে ‘কোন্ সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে….’।

স্বপ্ন কী অধরা এমন কিছু? স্বপ্ন কী শুধুই স্বপ্ন স্বপ্ন খেলা? স্বপ্ন পূরণের বার্তা নিয়ে কে আছে দুয়ারে দাঁড়িয়ে? আমিতো তোমার কথাই ভাববো! ‘সে কি মোর অপরাধ?’ এটা কি আমার প্রতি তোমার অবহেলা, নাকি ইচ্ছে করে লুকোচুরি খেলা? আমিতো কোন শেরপা নই, দুঃখের সকল বোঝা কাঁধে নিয়ে নিমেষেই উঠে যাবো পর্বত চূড়ায়। মেট্রো হলের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লে তুমি, চোখ তোমার চলমান ছবি ‘সান ফ্লাওয়ার’ পোস্টারের উপর। কিছু না বলেই টিকেট কাউন্টারে হাত গলিয়ে দুটো টিকিট নিয়ে নিলে। বললে, এবার দেখলে মোট চারবার হবে। যত বার দেখি ততবারই ভালো লাগার কারণ খুঁজে পাই আমি। আমি বললাম আমার দু’বার। যদ্দুর মনে পড়ে এর আগে অভিসার হলে দেখেছিলাম হয়তো। তখন ঢাকার ‘মধুমিতা’, ‘অভিসার’ আর ‘নাজ’ হলগুলোতে ভালো ভালো ইংরেজি মুভি আসতো প্রায়ই। এমন কি ঢাকায় বসেই আমি সোফিয়া লরেনের ‘সান ফ্লাওয়ার’ ছাড়াও ‘ক্লিউপেট্রা’, ‘ইয়েস্টার ডে টু ডে এন্ড টুমরো’ ‘টু ওইমেন’-এর মতো মুভি দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে। কোলকাতা এসে আজ আবারও দেখছি তোমার সাথে। একটু আগেও দৃশ্য পট ভিন্ন ছিল। কথা হচ্ছিল সেকেন্ড সেমিস্টার শেষ করে এবার ছুটিতে ঢাকা যাবো দু’জনে একসাথেই। প্রস্তাবটা এসেছিল তোমার পক্ষ থেকে। মেট্রোর উল্টো দিকে গড়ের মাঠে বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এসব কথা হচ্ছিল। খোসা ছাড়িয়ে তুমি খাচ্ছিলে আমাকেও দিচ্ছিলে।
বাদাম বিলাস ক্রমে ক্রমে ভালোবাসার অনুষঙ্গ হোয়ে উঠলো সেই আদি কাল থেকেই। যেখানেই আড্ডা সেখানেই বাদাম বিলাস। তোমার বাদাম প্রীতি আমাকেও প্রভাবিত করলো। কথা বলা আর বাদাম খাওয়ার অলক্ষ্যে রাস্তার ওপারে মেট্রো হলের দিকে বার কয়েক লক্ষ্য করছিলে অতঃপর ‘সান ফ্লাওয়ার’ দর্শন। সিনেমা দেখে হল থেকে বের হোয়ে সোজা কফি শপ। বিগ বার্গার সাথে মাগ ভর্তি হট্ কফি। দুপুরের লাঞ্চটা নির্ভেজাল সেরে ফেললাম অনায়াসে। কফি শপ থেকে বের হয়ে কাছের ট্রাম স্টপ অব্দি পথ চলতে চলতে কাল আবার দেখা হবার প্রতিশ্রæতি নিয়েই তুমি টালিগঞ্জগামী ট্রামে উঠে পড়লে। আমি তার উল্টো পথে শিয়ালদাগামী একটি বাসে উঠে পড়লাম। সেই সকাল থেকেই অপেক্ষায়মান। যখন আমাদের দেখা হবার কথা ছিল, দশটা ত্রিশ – তখন থেকেই অপেক্ষা করছি নির্দিষ্ট অশোক গাছটার তলায়। সময় ধাবমান, রোদের প্রখরতা পাল্লা দিয়ে বারছে, বারছে উত্তাপ। ভালো লাগার সব উত্তাপ বুঝি মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। সকাল গড়িয়ে দুপুর ছুঁই ছুঁই। গাছের ছায়া গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল – এর দিকে। গাড়ি ছুটছে এসপ্ল্যানেড দিয়ে, গাড়ি ছুটছে ক্যাসোরিনা এভিনিউ দিয়ে। সবারই নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে। শুধু আমিই নিরুদ্দেশের একাকী যাত্রী। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে এসে অনেকগুলো ঘোড়া দেখে থমকে দাঁড়ালাম। ‘মহিনের ঘোড়াগুলো’ ব্যান্ড শো আজ সন্ধ্যেতে কলা মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে। তোমাকে চমকে দেব বলে কিছু না জানিয়ে শো – এর দুটো টিকিট করে রেখে দিয়েছিলাম। তুমি যে ‘মহিনের ঘোড়াগুলো’ ব্যান্ডের দারুন ভক্ত তা আমার জানা ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল ওখানে দাঁড়ান ঘোড়াগুলোর একটার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসি। পরক্ষণেই ভাবনার ইউটার্ন – তুমিইতো আসোনি। কথা ছিল তুমি আসবে…..।

কেন আসোনি বা আসতে পারনি তাও জানাওনি। এভাবেই বুঝি ইচ্ছেগুলো মিছে হোয়ে যায়, ভালো লাগাগুলো হারিয়ে যায় মনের অতলান্তে। ছক্কা! ছক্কা! বলে ময়দানের ছেলেগুলো চিৎকার করছিল। টেনিস বলকে ক্রিকেট বল বানিয়ে সপাটে মারছিল ক্ষুদে ক্রিকেটাররা। এ শব্দ শুনে পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলাম তোমাকে। দু’হাতে দুটো আইসক্রিম, একটা আমাকে দিয়ে অন্যটি খেতে শুরু করে দিলে মনের আনন্দে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলতে শুরু করলে, ‘আমিতো সেই অশোক তলা থেকেই তোমাকে অনুসরণ করে আসছিলাম আর দেখছিলাম তোমার এক্টিভিটিস। মাঝে মধ্যে এমন করে তোমাকে ভাবনায় ফেলতে ভীষণ ভালো লাগে আমার।’ এক নিমেষে কথাগুলো বলে গেল সে। রাগ-অনুরাগের ঠিক চরম মুহূর্তে সে এমন কিছু করবে যার দরুন সব অভিযোগ – অনুযোগ এক ফুতকারে উবে যায়। এই তাপদাহে আইসক্রিমে ঠোঁট ছোয়াতেই দেহ -মন দুটোই জুড়িয়ে গেলো যেন আমার। আ হা কি ঠান্ডা, আ হা কি মিষ্টি!

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা