ঋতু মীর : “Life is a continuous process of adjustment, be you! The world will adjust”
১।
দাওয়াতের বাড়ির গোল টেবিলটায় কিছুটা ঠাসাঠাসি হয়েই বসেছিল সত্যবতী। চারপাশে সব তার কাছের মানুষ, প্রিয় মুখ। একের কাঁধে অন্যের কাঁধ ছোঁয়াছুঁয়ি। একজনের হাত অন্যজনের গলা জড়িয়ে হাসিতে, কথায়, গল্পে আয়েশের ভঙ্গিমায় শিথিল। চেপেচুপে বসে থাকা কয়েকটি অপরিচিত মুখে চকিতে চোখ বুলায় সত্যবতী। একেবারেই অদেখা অচেনা তা নয়, তবে জানাশোনার ঘনিষ্ঠতা ততটা নিবিড় নয় যতটা হলে দেখা মাত্রই লাগামহীন উচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিতে পারে। গান বা কবিতার মত ‘কথা’ বলাটাও সত্যবতীর ভীষণ পছন্দের। অন্যপক্ষের কথা শোনার চেয়ে বলাতেই যেন তার আগ্রহ বেশি। কথা সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতাও সত্যবতীর মাঝে খুব একটা কাজ করে না। একটা বলার থাকলে দশটা বলেই যেন সে একধরনের উজাড় করা আনন্দ পায়। সত্যবতীর স্বভাবে দুই বৈপরীত্য সবসময়েই প্রকট। একদিকে সে আপাদমস্তক সামাজিক। কোন কিছুর সাতে পাঁচে নেই এমনটা তার সহজে মিশে যাওয়া স্বভাবের সাথে একেবারেই খাপ খায় না। বিপরীতে সে বাড়াবাড়ি ধরনের ঘরকুনো, অন্তর্মুখী, নিভৃতচারী এবং কিছুটা গোপনতাপ্রিয়ও বটে। নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য বলয় তৈরি করে সে যেন আত্মরক্ষার নিপুণ কৌশলে ‘নিজেকে’ নিয়েই ভাল থাকার এক অবিমিশ্র সুখে বেঁচে থাকে। নিজের স্বভাবের এই ভীষণ বৈপরীত্য বিশ্লেষণ করে কোন তল খুঁজে পায় না সত্যবতী। না এদিক না ওদিকের ফলাফল স্বরূপ মাঝে মাঝেই ভারসাম্যহীন এক অস্বস্তির পরিবেশে হাবুডুবু খায় সত্যবতী। প্রায়শই সে অপ্রতিভ বোকা বোকা অভিব্যাক্তিতে নিজেকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে ভেবে দিশেহারা হয়। স্বত্বার নিজস্ব অস্তিত্বকে বজায় রেখে স্বতঃস্ফূর্ততায় আনন্দ কুড়ানো যায় এমন আসরেই যেন সে মানানসই। আর সে কারণেই বুঝি তার যাওয়ার জায়গাগুলো প্রচণ্ড সীমিত হয়ে আসছে ক্রমাগত। যে আসরের আবহাওয়া তাকে comfort zone এ পৌঁছে দিতে পারে না সেখানে নিজের উপস্থিতিকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয় সত্যবতীর। অতিথি আপ্যায়নের প্রথম লগ্নে ঝুপ করে টেবিলটায় বসেই হৈ চৈ উল্লাসে খলবল করে উঠে সত্যবতী। ইসসস! এই কয়দিনে কত কথাই না জমা হয়ে আছে। সে মুহূর্তে সত্যবতীর মনটা যেন এক মুক্ত হরিণ! ছুটেছে বল্গাহীন! সত্যবতী যেন এক স্রোতস্বিনী! গতির নিজস্ব বেগে নিজের নিয়মে কলকল ধাবমান। এক নিঃশ্বাসে ভেতরের সব জমা কথা আগে ভাগেই বলা চাই আরকি! উল্টা দিকে ‘মক্ষীরানী’ হয়ে বসা মহিলা আঙ্গুলের সুচতুর ইঙ্গিতে সত্যবতীকে থামিয়ে দেয়। কথার মাঝখানে আচমকা বাধাগ্রস্থ সত্যবতী বিব্রত বিড়ম্বনায় বোবা হয়ে থাকে। কি প্রসঙ্গে তার কথার ফোয়ারা বইছিল সেটা যেন বিস্মরণের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। আস্তে আস্তে নিজের ঘোর থেকে আসরে ফেরে সত্যবতী। মহিলার দিকে পূর্ণ মনোযোগে তাকায়। সাজগোজে বেশ রুচিশীল, পরিমিত। সুক্ষ মেকাপে বয়সের বলিরেখার দৃশ্যমানতা প্রায় অদৃশ্য। স্বল্প চুল ঈষৎ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কিল্প আটকিয়ে সুচারু বিন্যস্ত। মাথার টাক স্বল্প চুলে ঢাকার কৌশলে মুগ্ধ হয় সত্যবতী। চুলের স্টাইলে যে অবয়বে আকাশ-জমিন পার্থক্য আনা যায় মহিলা যেন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। সাদা জমিনে সাদা বুটি কাজ শাড়িটা তার দেহবল্লরীকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। জুয়েলারী, হাতের ব্যাগসহ সব কিছুই যেন টায়ে টায়ে নিখুঁত। নিজ স্বাস্থ্যের সচেতন যত্নে বয়সকে যেন কিছুতেই ছুঁতে দেয়নি মহিলা। তাইতো! সে যে সত্যিই আজ এই আসরের ‘মক্ষীরানী’! নিজের উচ্ছ্বাসে ব্যস্ত সত্যবতী কেন যে এতক্ষণ দেখেনি তাঁকে !
২।
‘পর্যবেক্ষণ’ বিষয়টা সত্যবতীর মজ্জাগত। রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে, সামাজিক আসরে এমনকি একা ঘরেও নিবিষ্ট মনোযোগে সে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে ভালোবাসে। সেই দেখাটা কেবল প্রত্যক্ষন বা দেখার জন্যই দেখা নয়। সেই দেখাটা এমন কিছু যা আপাতঃ চোখে হয়তো দৃশ্যমান নয়। সেই দেখাটা সত্যবতীর তৃতীয় নয়নের। সেই দেখায় নিজের বিশ্বাসবোধ, পছন্দের সাথে মিল খুঁজে পেলে দ্বিধাহীনভাবে তা গ্রহণ করা, নিজের মধ্যে তা ধারণ করা। টেবিলের এই প্রান্তে সত্যবতীর চোখ এখন মক্ষীরানির দিকে। সত্যবতী মানুষের সহজাত সৌন্দর্যে বিশ্বাসী। প্রসাধন বা সাজসজ্জায় আরোপিত সৌন্দর্য যতই নিখুঁত হোক সেখানে থাকা ‘মেকি’ ভাবটা তার চোখকে ক্লান্ত করে। মহিলার বসার ভঙ্গি যেন আন্তরিকত্যা শিথিল নয় বরং অতিরিক্ত সচেতনতায় কাঠ কাঠ ঋজু। লাস্য লাবন্যের মাপজোখ করা হাসিটাতে প্রাণের ছোঁয়ার কেমন অভাব! হাসিটা যেন আরোপিত এবং দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় সদা সতর্ক! চতুর্দিকে মার্বেলের মত ঘূর্ণায়মান চোখের দৃষ্টিতে যেন কিসের ধূর্ততা আর চালাকি খেলা করছে। নাহ! এভাবে ভাবছে কেন সত্যবতী? নিজের দিকে ভ্রু ভঙ্গি করে সত্যবতী। তাকে থামিয়ে দিয়েছে বলেই কি এমন ‘নেগেটিভ’ চিন্তায় বিক্ষুদ্ধ হয়েছে মন? ধুর! আসরের আবহাওয়া বিবেচনা না করে সেই বা কেন শুরুতেই এমন মুখের আগল খুলে বসে গেল? আই কন্টাক্ট করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সত্যবতী। মহিলার হাতের গ্লাসে টলটলে রঙ্গিন তরল। গ্লাসের সবুজাভ রঙ ভেদ করে গাড় লাল তরল অন্য একটা নজরকাড়া রঙে রুপ নিয়েছে। পানীয়ের স্বাদটা চেখে দেখার ক্ষণিক ইচ্ছাটা জেগে উঠেই ধুম করে মিলিয়ে যায় সত্যবতীর। হার্ড ড্রিঙ্কে বরাবর কোন আগ্রহ নেই তার। কাজের সূত্রে সোশ্যাল ‘গেট টুগেদার’ পার্টিতে শত সুযোগেও তরল ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা কখনোই পোষণ করেনি সত্যবতী। বরাবর সে স্বাস্থ্য সচেতন। ‘অল্প স্বল্প একটু নিয়ে দেখতে পারো’ ‘ভালো লাগবে’ ‘ভালো থাকবে’ ‘গানের গলা খুলবে’- এমন প্রস্তাব সবসময় হেসে উড়িয়ে দেয় সত্যবতী। আবার তরল মদিরা ছুঁলেই ‘জাত’ যাবে এমন ভাবনার ধারকাছেও নেই সত্যবতী। অন্যের পছন্দ অপছন্দে, গ্রহণ বর্জনে তার নিজের কোন মন্তব্য নেই, তেমনি নিজের ব্যাপারেও অন্য মতের তোয়াক্কা করা সত্যবতীর ধাতে নেই। জীবন চলার নিজস্ব প্রক্রিয়াটা নিজের কাছে হীরক ভেদী আলোর বিচ্ছুরণের মত পরিস্কার। তরলের গরলে আকণ্ঠ ডুবে জীবনের অব্যসম্ভাবী সমস্যা, দুঃখ, অপূর্ণতা থেকে বিস্মৃত দেহ-মন স্বর্গীয় সুখে ‘শুন্যে’ ভাসমান হবে- এমন বিরল অনুভুতিতে ভেসে যাওয়ার বিলাসিতাকে কখনই প্রশ্রয় দেয় না সত্যবতী। ভাবনার জাল থেকে নিজেকে একপ্রকার জোর করেই ছাড়িয়ে নেয় সত্যবতী। টুকরা টুকরা বিক্ষিপ্ত গল্পের প্রসঙ্গে কান পাতে সে। অল্প অল্প সিপ করে মক্ষীরানি পানীয়ের গ্লাস ঠোঁটে ছুঁইয়ে চলেছে। ঠোঁটের লিপস্টিক এমন অক্ষত রেখে কোন কায়দায় গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ানো যায় ভেবে পায় না সত্যবতী। কিভাবে সম্ভব? সাধাসিধা প্রশ্নটা গ্রাম্য সরলতায় সোজাসুজিই করে বসে সত্যবতী। জোরে হেসে উঠে মক্ষীরানি।
সত্যবতীকে অতি ‘ক্ষুদ্র’ আর ‘নিকৃষ্ট’ মানে ফেলে দেয়া দৃষ্টি তার চোখে। এই প্রথম বুঝি সে চোখে চোখ রাখে সত্যবতীর। এইরকম আসরে গ্লাস হাতে না থাকাটা একটা ‘গাইয়া’ ‘গাইয়া’ ব্যাপার নয় কি? খাও বা না খাও, হাতে নাও, ভান কর, সিপ কর। আর পার্টিতে অংশগ্রহণ বা সঙ্গ দেয়ার ক্ষেত্রে মন মানসিকতা, ‘class’ বা ‘শ্রেণী’ র ব্যাপারটা সমমান হওয়াই বাঞ্ছনীয়। পানপিয়াসী অতিথিদের কারও কারও চোখ মদির নেশায় ঘোলাটে। কেউ কেউ আবার ইচ্ছাকৃত এলোমেলো বেখাপ্পা কথায় বেসামাল। কোন তরলে কোনটা মিশালে সুধার নেশা আরও জমবে- আলোচনাটা সেই বৃত্তে ঘুরছে এখন। কার্যকারণ ছাড়াই হঠাৎ রেস্টুরেন্টে কাজের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায় সত্যবতীর। এক সপ্তাহের মধ্যে নানা ধরণের পানীয়ের নাম এবং একটার সাথে আরেকটা মিশিয়ে ককটেল বানানোর কৌশলটা বেশ রাতারাতিই রপ্ত করে নিয়েছিল সে। ক্রেতা ঢুকলেই কিছুটা আত্মবিশ্বাসে কিছুটা খেলার ছলে বলে দিতে পারতো এই মানুষ কেমন পানীয় পেলে সন্তুষ্ট হবে। শেখার অদম্য কৌতূহলে সত্যবতী স্ব-ইচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছিল হার্ড ড্রিঙ্ক পরিবেশনের কাজ। উপার্জনের তাগিদে বেঁছে নেয়া এই কাজে সত্যবতীর কোন মানসিক গ্লানি ছিল না, ছিল না কোন লজ্জা। আসর বাড়ির ঝুলন্ত ঝাড় বাতির ঠিকরে পড়া আলোয় চোখে জ্বালা ধরে সত্যবতীর। ‘ক্লাশ’ ‘শ্রেণী’ শব্দগুলোতে কেমন ‘বিভেদ’ জড়ানো! শব্দগুলোর অবিরাম ধাক্কাধাক্কির খেলাটা সত্যবতীর মাথায় ঝমঝ্মিয়ে বাজে। কথাগুলো কোন উদ্দেশ্যে ঠিক কাকে বলা হোল তা নিয়ে মাথা ঘামাবার আর প্রয়োজন মনে করে না সে। ‘আধুনিকতা, ‘মন মানসিকতা’, ‘পরিবর্তন’ এইসবের বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞায় ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত সত্যবতী ফিরে আসে নিজের ঘরে।
গোলাকৃতি এক্যুরিয়ামের গতিহীন বদ্ধ জলে বর্ণালী মাছের পিছলে পিছলে যাওয়া চলাচল আর বুদবুদ ওঠা তরঙ্গে নিমগ্ন চোখ রাখে সত্যবতী। কি এক আত্মবিশ্বাসে নিজের মনে, নিজের গতিপথেই বিচরণ করছে মাছেরা। রাতের গভীরতায় চারপাশটা কি ভীষণ নীরব, সুনসান। সমগ্র চরাচর এক অপূর্ব জ্যোৎস্নায় প্লাবিত এখন। একা জেগে থাকতে ভাল লাগে সত্যবতীর। জলের সাথে মাছের বিচরণের এই ধর্মও যে শিক্ষনীয় জোনাকি! গভীর নিঃশ্বাসে, স্বগতোক্তিতে নিজেকেই যেন বলে সত্যবতী- ‘adjust yourself in every situation in any shape, but find your own way to flow’
Ritu Mir Teacher, Toronto District School Board, Toronto. ritu.mir9@gmail.com