ফরিদুর রহমান : মাদ্রিদে তিন দিনের সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে যেদিন ভ্যালেন্সিয়া যাবার কথা সেদিন বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠেছি। মাদ্রিদ রেলস্টেশন থেকে ভ্যালেন্সিয়ার ট্রেন ছেড়ে যাবে সকাল সোয়া নয়টায়। স্টেশনে পৌঁছাতে পনের কুড়ি মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তারপরেও অপরিচিত রেলস্টেশনে একটু আগে পৌঁছে যাওয়াই ভালো ভেবে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়েছি। লুনা একটা ট্যাক্সিক্যাব ডেকে দিয়েছে। মালপত্র গাড়িতে তুলে কাইয়ে ইয়াসুস দেল ভ্যালের পাথুরে গলিপথে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। রাস্তায় পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত এক তরুণী তার লম্বা হাতলওয়ালা ঝাড়- হাতে কাজ করছিলেন। হঠাৎ তিনি কাজ থামিয়ে আমাদের গাড়ি লক্ষ করে থামতে ইশারা করলেন। আমরা বুঝতে না পেরে প্রায় পার হয়ে যাচ্ছিলাম, তখনও তিনি প্রাণপনে আমাদের থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চালক গাড়ি থামালে তিনি পেছনে দেখিয়ে দিলেন। লুনা একটা প্যাকেট হাতে ছুটতে ছুটতে আসছে। জানালা খুলে প্যাকেটটা সে হাতে দেবার পরে মনে হলো আমাদের কন্যা আনিকার জন্যে দেয়া তার খোকন চাচুর সন্দেশের প্যাকেট লুনার ফ্রিজে রেখেই আমরা ভ্যালেন্সিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। শেষ মুহূর্তে ব্যাপরটা লুনার চোখে পড়েছিল। দুজনকে দীর্ঘ ধন্যবাদ জানিয়েও আটটা বাজার আগেই পৌঁছে গেলাম মাদ্রিদ স্টেশনে।
নয়টা দশেরর ট্রেন নয়টা দশেই ছেড়ে গেল মাদ্রিদ। রেনফে’র দুধ সাদা ট্রেনের মতো এতো স্নিগ্ধ সুন্দর রঙের রেলগাড়ি আমি আর কোথাও দেখিনি। কামরায় দু’সারি চেয়ারের রঙও হালকা ধুসর। এই রেলযাত্রার সব জায়গায় দেখেছি পরিশীলিত রুচির স্প্যানিশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয়। দু ঘণ্টার যাত্রায় স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের লাল মাটির চষা বিস্তৃত জমি, উঁচু নিচু পাহাড়ি অঞ্চলে মাঝে মাঝে সবুজ ঝোপঝাড় আর ছোট ছোট শহর নগর পার হয়ে ভ্যালেন্সিয়া পৌঁছলাম ঠিক এগারোটা পাঁচে। ফেস্টিভ্যাল কো-অর্ডিনেটর ক্রিস্টিনা অ্যাপারিসিও আগেই মেইলে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘রেল স্টেশনে তোমাদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত থাকতে পারবো না বলে দুঃখিত। মাই ট্যাক্সি নামের একটা ট্যাক্সি নিয়ে সহজেই হোটেলে চলে আসতে পারবে।’ আমি উত্তরে জানিয়েছি, ‘ট্যাক্সি যখন আমার তখন আর সমস্যা কী!’
ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে মাই ট্যাক্সি নিয়ে হোটেল মেরিনা আতারাজানস পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। চমৎকার ছিমছাম শহর। সুদৃশ্য বাড়িঘর পথে পথে পুরোনো গির্জা এবং দুই একটি প্রতœতাত্বিক সংরক্ষিত বাড়িঘর বাদ দিলে যেটুকু চোখে পড়েছে তার পুরোটাই আধুনিক স্পেন! আমাদের হোটেলের সামনে এসে নামতেই দেখা গেল সামনে পানির ফোয়ারা ও ভাস্কর্যে সাজানো একটি প্রাচীন গির্জা আর পেছনে একটু দূরে নীল সমুদ্র। হোটেলের সামনের ফুটপাথে কমলা গাছে ঝুলছে থোকা থোকা পাকা কমলা। এর আগে গ্রিসে এই দৃশ্য দেখা ছিল বলে আমার কাছে খুব অবাক লাগেনি, কিন্তু হেনার কাছে এই দৃশ্য নতুন! কমলার বাগান নয়, কোনো পার্ক নয়, শহরের পায়ে চলার পথেও ঝুমঝুম করছে কমলা!
আমরা হোটেলে চেক-ইন করে কিছু পরেই বেরিয়ে পড়লাম। দুপুর প্রায় দেড়টা। হেনা সে মহা উৎফুল্ল হয়ে কমলার সাথে একাধিক ছবি তুলে ফেললো। এই কমলা বাগানের মতো ফুটপাথ ধরে হাঁটলে নিশ্চয়ই মধ্যাহ্ন ভোজের একটা ব্যবস্থা করা যাবে। খুব বেশি দূরে যেতে হলো না। রাস্তার দুপাশেই ইতালিয়ান, ভিয়েতনামি, ভারতীয় এবং দেশ পরিচয়হীন বেশ কয়েকটা রেস্তোরা চোখে পড়লো। ভ্যালেন্সিয়ার প্রথম দিনেই কোনো ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না বলে আমরা সরাসরি ঢুকে পড়লাম তাজমহল রেস্টুরেন্টে। আমাদের উপমহাদেশীয় চেহারা দেখেই হয়তো স্বয়ং ম্যানেজার উঠে এসে হিন্দিতে বাতচিত শুরু করে দিলেন। আমি যথারীতি হিন্দি বুঝতে এবং বলতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি ইংরেজিতে আমরা আসলে ভারতীয় কিনা জানতে চাইলেন। যখন তিনি নিশ্চিত হলেন আমরা বাংলাদেশের এবং তার মুসলমান ভাই, কেবল তখনই তিনি নিজেকে পাকিস্তানি হিসাবে পরিচয় দিলেন।
এই একই অভিজ্ঞতা আমার বহুবার হয়েছে। মিউনিখের তাজমহল রেস্টুরেন্টের মালিক কর্মচারি বাবুর্চি সকলেই মুন্সিগঞ্জের বাংলায় কথার বলেন, তারপরেও সাইনবোর্ড এবং ম্যেনুতে লেখা ইন্ডিয়ার রেস্টুরেন্ট! কারণ হিসাবে জানা গেছে বাংলাদেশী পরিচয় দিয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালানো যায় না। ব্যবসার খাতিরে লোকজন বাপের নাম ভুলে যায়, দেশের নাম তো দূরের কথা। কাজেই এখন আর বিস্মিত হই না, তবে পাকিস্তানিরাও যে এই কায়দা শুরু করেছে তা জানা ছিল না। ঢুকে যখন পড়েছি, তখন আর বেরিয়ে যাবার চেষ্টা না করে মেন্যুতে মনোযোাগ দিলাম। পাকি-ভাইদের আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রæটি ছিল না এবং পরিবেশিত তন্দুর রুটি চিকেন টিকিয়া সবই চমৎকার ছিল।
পঞ্চম মিছে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে ভ্যালেন্সিয়ার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক কুইন সোফিয়া প্যালেস অফ আর্টস-এ বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। হোটেল মেরিনা আতারাজানাস থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে যেতে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছি। হোটেল থেকেই বাসের খোঁজ খবর নিয়ে বেরিয়েছি। যে কোনো শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ঘোরাঘুরি না করলে সেই শহরের অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। কাছাকাছি একটা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে স্প্যানিশ ভাষায় ‘পালাউ দে লা আর্টস’ বলে চালকের হাতে খুচরা ইওরো দিয়ে টিকেট কেনা পর্যন্ত পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। একজন সহযাত্রী সঠিক জায়গায় নামতেও সাহায্য করেছেন। কিন্তু বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা সিটি অফ সায়েন্স এ্যান্ড আর্টসের কোথায় বিজ্ঞান ভবন, কোথায় শিল্পকলা মিলনায়তন বুঝে ওঠা কঠিন। আমরা যেখানে নেমেছি সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা টিলার উপরে রঙিন পতাকা, ব্যানার ফেস্টুনে সাজানো ভবন দেখে মনে হলো হয়তো এটাই প্যালেস অফ আর্টস। কিন্তু কিছু দূর এগোবার পরে হাতের ডান দিকে আরেকটি সুদৃশ্য ভবনের শীর্ষে বেলুন উড়তে দেখে মনে হলো হয়তো এটাই আমাদের লক্ষ্যস্থল। অনুষ্ঠান শেষ করে বেরোবার পরে জেনেছি, আমরা আসলে নেমেছি ‘পালাউ দে লা আর্টস’এর পেছন দিকের বাসস্ট্যান্ডে।
পেছন দিক থেকে হলেও শেষ পর্যন্ত উৎসব প্রাঙ্গণে পৌঁছানো গেলো। কো-অর্ডিনেটর ক্রিস্টিনা জানিয়েছিল ওরা সকলেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকবে, সেখানেই দেখা হবে এবং রেজিস্ট্রেশন করে পরিচয়পত্র নিতে হবে। প্যালেস অফ আর্টস ঘিরে এবং উপরে নিচে ছোট বড় অনেকগুলা ভবন, মিলনায়তন, সেমিনার হল এবং অপেরা হাউজ মিলিয়ে সঠিক জায়গা খুঁজে বের করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। বিভিন্ন দিকের দিক নির্দেশনা থাকলেও সালা প্রিন্সিপাল, মাত্রি সোলার থিয়েটার এবং আউলা ম্যাজিস্ট্রাল-এই সব নাম দেখে নিজেরই আউলা লাগার অবস্থা। আউলা ম্যাজিস্ট্রাল হলো সঙ্গীতশালা, যেকানে চারশ দর্শক নিযে কনসার্টের ব্যবস্থা করা যায়। আর সালা প্রিন্সিপালই মূল অডিটোরিয়াম, আমাদের অনুষ্ঠানের ভ্যেনু। সেখানে পৌঁছাবার জন্যে এলিভেটর আছে। এদিকে পরিচয়পত্র বা আমন্ত্রণপত্র ছাড়া এলিভেটরের দায়িত্বে থাকা কর্তব্যনিষ্ঠ প্রহরী কিছুতেই উপরে উঠতে দেবে না। এই সময় ফেস্টিভ্যালের একজন স্বেচ্ছাসেবককে পেয়ে বললাম, ‘সেই সুদূর বাংলাদেশ থেকে ভ্যালেন্সিয়া পর্যন্ত তোমরা দাওয়াত দিয়ে এনে এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই যেতে দিচ্ছো না, এটা কেমন ব্যবহার?’
ছেলেটি তাড়াতাড়ি আমাদের একটা লিফটে তুলে নিয়ে সালা প্রিন্সিপাল পর্যন্ত পৌঁছে দিল। প্রায় দেড় হাজার দর্শকের অডিটোরিয়ামের বেশিরভাগ আসনই তখন পূর্ণ। কোথায় বসা যায় ভেবে যখন ইতিউতি তাকাচ্ছি, তখনই সহ্স্য বদনে এগিয়ে এলো স্প্যানিশ বন্ধু পেপে প্লাজা! পেপে তার আশেপাশের আরো কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সাংস্কৃতিক কর্মীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, তবে খুব দ্রুতই তাদের নাম এবং চেহারা ভুলে গিয়েছি। মঞ্চে তখন মিউজিক বাজতে শুরু করেছে।
মিছে চলচ্চিত্র উৎসবে এবারের থিম কান্ট্রি ইন্ডিয়া। কাজেই মঞ্চের ব্যাকড্রপে বিশাল হাতির প্রতিকৃতি ছাড়াও অনুষ্ঠানের একটা বড় অংশ জুড়েই ছিল ভারতীয় নাচ গানের আধিপত্য। শুরুতে উদ্বোধনী ঘোষণা, ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর যোসেফ অরবিয়লের স্বাগত বক্তব্য এবং ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধির ভাষণ ইত্যাদি বাদ দিলে জমজমাট আয়োজনের কোথাও কোনো দম ফেলার ফুরসৎ ছিল না। বিশ্বখ্যাত অর্কেস্ট্রা, স্প্যানিশ লোকানৃত্য, গ্রিক নৃত্যশিল্পীদের মনমাতানো নাচ, খ্যাতিমান স্প্যানিশ পিয়ানো বাদকের পরিবেশনা, কিশোর কিশোরীদের ভায়োলিন-চেলো এবং সুরের মূর্চ্ছনা ও রঙিন আলোর ঝলকানিতে তিনঘণ্টা যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। তবে পরিচিত হিন্দি গান অথবা মিউজিকের সাথে ভারতীয় শিল্পীদের বলিউড মার্কা নাচগান দর্শকদের বিপুলভাবে মাতিয়ে রাখলেও আমার কাছে এখানে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। আসলে অনুষ্ঠান আয়োজনের ভারতীয় পক্ষ হয়তো এই চলচ্চিত্র উৎসবের মূল সুরটা ধরতে পারেননি, অথবা জনপ্রিয়তাকেই তারা প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন। তবে শেষ বিচারে মিছে উৎসবের ভারতীয় ভার্সান যে একবোরে মিছে যায়নি, দর্শক এবং উৎসব সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া থেকে তেমনটাই মনে হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে প্যালেস অফ আর্ট ভবনের নিচে বাহন তৈরি ছিল। এবারে আর বাসে উঠে পড়তে ভুল হয়নি। বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা, জুরি মেম্বার এবং বিশেষ অতিথিদের নিয়ে নৈশভোজের ব্যবস্থা ছিল ভুমধ্য সাগরের তীর ঘেষে ভ্যালেন্সিয়া বন্দরের ভ্যালে-এ-ভেন্তাস ভবনের একটি রেস্তোরায়। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর কারণে খ্যাত ও অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত আমেরিকা কাপ বিল্ডিং এবং সংলগ্ন পার্ক ভ্যালেন্সিয়ার ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্প সংস্কৃতির দিকপালদের সান্ধ্যকালীন মিলন কেন্দ্র। স্প্যানিশ ভ্যালে-এ-ভেন্তাস নামটি নেয়া হয়েছে মধ্যযুগের একটি কবিতা থেকে, ইংরেজিতে যার অর্থ সেইলস এ্যান্ড উইন্ড! সাগর তীরেও আমাদের কোনো রেস্টুরেন্ট বা কোনো ভবনের এমন চমৎকার নাম কখনো চোখে পড়েনি। পালের সাথে বাতাসের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তখন পালে বাতাস পাইয়াছে… পৃথিবীতে কে কাহার!’
পৃথিবীতে কে কাহার অত্যন্ত সত্যি কথা হলেও আমরা ‘পাল ও বাতাস’ রেস্তারায় পৌঁছে ইন্টারনেট সংযোগ পাবার সাথে সাথেই কন্যা ও জামাতার খোঁজ নিলাম। তারা যথা সময়ে ভ্যালেন্সিয়ায় পৌঁছে হোটেলে চেক-ইনও করে ফেলেছে। আমাদের ফোনালাপের মর্মার্থ খানিকটা অনুধাবন করেই বোধহয় পেপে বললো, ‘ওদের এখানে চলে আসতে বলো। হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়।’ শুরুতেই অপু-আনিকার ভ্যালেন্সিয়ায় আসার কথা জোসেফ অরবিয়লকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, জোসেফ সানন্দে ওদের আসতে বলে দিয়েছে। এমনিতেই বিষয়টা নিয়ে একটু বিব্রত ছিলাম। তাই আর উদ্বোধনী নৈশভোজে ওদের আর আসতে বলিনি। তাছাড়া দীর্ঘযাত্রা শেষে ওরা একটু কান্তও ছিল। পেপেকে সে কথা বলেই থামালাম।
‘সেইলস এ্যান্ড উইন্ড’এর রেস্তোরাটি খুব বড় নয়, কিন্তু পরিবেশটা চমৎকার। কিছু জায়গায় ঢুকে পড়লে এক ধরনের আন্তরিকতা অনুভব করা যায়, এই রেস্তোরাটি তেমনি। কোনো জাকজমক নেই, পরিবেশনকারিদের অপ্রয়োজনীয় ছোটাছুটি বা হুলুস্থুল নেই। উৎসব পরিচালক জোসেফ অরবিয়লের সাথে পত্র যোগাযোগ চলছে কয়েক মাস ধরেই, কিন্তু সরাসরি দেখা হলো এই প্রথম। বড় মাপের একটি ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টর তাঁর যাবতীয় ব্যস্ততার মধ্যেও নিজেই প্রত্যেকের সাথে পরিচিত হয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন। কৌতুক প্রিয়, হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা জোসেফ পানাহারের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে জানিয়ে দিলেন ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ আগামী পরশু অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে সকালে ভ্যালেন্সিয়া থেকে বত্রিশ কিলোমিটার দূরে সুয়েকায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দেখানো হবে আর একই দিন বিকেলে জেন্ডার ইকুইটি সম্পর্কিত দুটি ছবি নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে একটি সেমিনার। সেমিনারের প্রামাণ্যচিত্রগুলোকে মূল প্রতিযোগিতার বাইরে রাখা হয়েছে। মিছে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আসলে ছোটদের কাহিনি চিত্রের একটি বড় উৎসব। তবে মূল প্রতিযোগিতার বাইরে বেশ কিছু ডকুমেন্টারিও দেখানো হয়ে থাকে। বিষয়টি আমি আগেই জেনেছিলাম, তাই বিস্মিত হলাম না। যখন জানলাম সুয়েকায় যে দুটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হবে তার একটি একটি ভারতের ছন্দিতা মুখার্জির তৈরি, তখন খুশিই হলাম। ছন্দিতা পুনার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে আমার এক বছরের সিনিয়ার। প্রায় ত্রিশ বছর পরে দেখা হবে ছন্দিতার সাথে।
বেহালা এবং চেলোর সুরের সাথে বিয়ার এবং রঙিন পানীয় শেষ করার পরে দীর্ঘ করতালি দিয়ে বাদকদের অভিনন্দন জানানো হলো। উল্লেখ করা যেতে পারে বাদক দলের পাঁচজনই ছিলেন নারী। এরপর থিম কান্ট্রি ভারত হলেও বাংলাদেশি এবং ভারতীয়দের হতাশ করে বুফে ডিনারে রোস্ট-পোলাও-মুর্গিমুসল্লম-তন্দুরি-টিকিয়ার পরিবর্তে যা পরিবিশিত হলো, তা স্বাস্থ্যসম্মত, সুস্বাদু এবং উপাদেয় হলেও বাঙালির জন্য এ সব নেহায়েতই নাস্তা। গভীর রাতে ডিনার শেষ করে পেপে যখন বললো, ‘চলো তোমাদের হোটেলে পৌঁছে দিই।’ তখন জানতে চাইলাম, ‘রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে নিরাপদে পৌঁছাতে পারবে তো?’
হাসতে হাসতে পেপে বললো, ‘শুধু তোমার বউ নয়, আমার বউও গাড়িতে আছে। মহিলাদের নিরাপদে পৌঁছে দেয়া আমাদের প্রথম ও পবিত্র দায়িত্ব।’
পেপে তার গাড়িতে আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল।
চলবে…