নাদিরা তাবাসসুম : জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে দৃষ্টি ও পরিধি বাড়তে থাকে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ, দেশ, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব তখন আপন থেকে আপনতরো হয়ে ওঠে। চিন্তা-চেতনায় সারাবিশ্বের ঠাঁই হয় আপন বুকে। কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয় “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”। আজ তাই বিশ্বের যেকোন দেশে যেকোন ঘটনা-দুর্ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষকে ভাবিয়ে তোলে।
গেøাবালাইজেশন-এর প্রভাব তো রয়েছেই। আমি আমাকে নিয়ে, আমার পরিবার নিয়ে যতই ব্যস্ত থাকি না কেন “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যকে আমরা পরের তরে”। মানুষের দুঃখকষ্টে মানুষই তো কষ্ট পাবে, দুঃখ পাবে- এটাই তো স্বাভাবিক। বর্তমানে সারা বিশ্বে এবং আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে হৃদয়-বিদারক কত শত ট্রাজেডি। রোগ শোকে এবং বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু মিছিল অকল্পনীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ হিসেবে আমাদের এসব দেখে সহ্য করে যেতে হচ্ছে। আমরা হতবাক, নির্বাক হয়ে চেয়ে আছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানুষ সৃষ্ট একি দুর্যোসেই ছোট্টবেলায় প্রত্যেক মানুষ তার মা-বাবা, ভাই-বোনকে প্রথম চিনতে শেখে এবং তাদেরকে ঘিরে সুখের ঘর সুখের পৃথিবীর দৃষ্টি মাঝে খেলাধুলায় মত্ত থাকে। মনে হয় এই ঘরই আমার সব, আমার পৃথিবী। ধীরে ধীরে বয়স এবং গের ঘনঘটা। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমরা মানুষ বাকরুদ্ধ। চিন্তার খেই হারিয়ে সুধুই হাহুতাশ- আমরা কি শুধু নামেই মানুষ? কাজে-কর্মে আমরা কি প্রকৃত মানুষের কোন পরিচয় দিতে পেরেছি? স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি আমরা কতটুকু যত্নশীল অথবা সেবা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছি? আমরা ধর্মপ্রাণ মানুষেরা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার কাছে হাজারো দোয়া, হাজারো প্রার্থনা করছি।

“কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক- কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেই সুরাশুর”। মানুষের মহামূল্যবান জীবনের একি চরম দুর্দশা, মূল্যহীন এক খড়কুটোসম লুটায় রয়েছে ধুলায়। অত্যাধুনিক সভ্য বিশ্বের মানুষের জীবন আজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় ভুলুন্ঠিত। যুদ্ধবিগ্রহে হাহাকার জর্জরিত মানুষের কান্না শোনে না কেউ। ন্যায়-নীতি মূল্যবোধের অভয় বাণী নিভৃতে কাঁদে। অসহায় মানুষের নিরুপায় মর্মবেদনায়।

আধুনিক মনোবিজ্ঞানী রোলো মে তাঁর বিখ্যাত “ম্যান্স সার্চ ফর হিমসেলফ” গ্রন্থে বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে যে, বর্তমান বিশ্বে ঘটমান সমস্যা যেমনঃ যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্ব›দ্ব-হানাহানি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, আর্থিক অনিশ্চয়তা- এসব কিছুর পেছনের কারণ সম্পর্কে সাধারণত বলা হয়ে থাকে মানুষের অসুখী অতৃপ্ত মনোভাব, সিদ্ধান্ত হীনতা, জীবনের মূল্যহীনতা, হতাশা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর মতে, এর পেছনে রয়েছে যৌন তাড়িত আবেগ এবং সামাজিক রীতিনীতির মাঝে দ্ব›দ্ব যা মানুষ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। আবার অনেকে মনে করেন মানুষের মনে যে হীনমন্যতাবোধ, অতৃপ্তি, অপরাধবোধ এবং অস্তুষ্টিবোধ রয়েছে সেগুলোই মানসিক সমস্যার মূল কারণ। ১৯৩০ সালে মনোবিজ্ঞানী কারেন হর্নি -এর কারণ হিসেবে অভিহিত করেন দল এবং ব্যক্তির মাঝে বিরাজমান দ্ব›দ্বকে যা ‘কে আগে যাবে, কে পরে যাবে’ এরকম প্রতিযোগীতার সাথে সম্পৃক্ত। অন্তসারশূন্য বিংশ শতাব্দীর মানুষের মূল সমস্যা হলো- শূন্যতাবোধ। মানুষ নিজেকে শূন্য ও অসহায় বোধ করে। অনেকেই জানেনা তারা আসলে কী চায়। তাদের চাওয়া-পাওয়ার সুনির্দিষ্ট কোন অভিজ্ঞতা নেই। দুর্বল, শক্তিহীন ও দুঃখবোধের সাথে তাদের ভাবনা ও অনুভূতিগুলো সর্বদাই দোদুল্যমান। এর কারণ হলো, মানুষ নিজেকে শূন্য মনে করে। প্রেম ভালোবাসা বঞ্চিত মানুষ, বিবাহিত পারিবারিক জীবনে অসূখী মানুষ, আর্থিক সঙ্কটাপন্ন হতাশাগ্রস্থ মানুষ নিজেই জানে না সে কী চায়? মানুষ নিজের সম্পর্কে যখন বলে যে সে চায় লেখাপড়ায় বড় বড় ডিগ্রী অর্জনের সাফল্য, একটি ভাল চাকুরী, প্রেম-ভালোবাসায় সফলতা এবং বিবাহিত জীবনের সুখময়তা। এত কিছু বলার পরও তার কাছে মনে হয় সে যা চায় তার সবই হলো- সমাজ, পরিবার, অধ্যাপক-শিক্ষক, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এবং চারিপার্শ্বে অবস্থিত সকল মানুষের তার নিকটে প্রাপ্য প্রত্যাশা ছাড়া আর কিছু নয়। আশেপাশের সকলেই তার কাছে প্রত্যাশা করে, তার নিজস্ব কোন চাওয়া নেই। সে বুঝতে পারে তার বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন কেউই তার প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম নয়। মানুষের এইযে শূন্যতাবোধ, নিজের পাওয়া সম্পর্কে জানতে না পারার অক্ষমতা এর কারণ হলো আমরা অনিশ্চয়তার যুগে বসবাস করছি। কোন বিষয়েই আমরা নিশ্চিত নই। যুদ্ধ, মারামারি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, আর্থিক দৈন্যতা ও নিরাপত্তাহীন ভবিষ্যৎ মানুষের মাঝে শূন্যতাবোধের সৃষ্টি করে।

সাইকোলজিকাল যত ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন আমরা জানি যে, মানুষ চিন্তাশীল বিবেকবান প্রাণী হিসেবে কখনই সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বাইরে কোন কাজ করতে পারে না, সেইসাথে ধর্মীয় অনুশাসন তো রয়েছে। আর আমরা এও জানি যে, দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্মবিষয়ক জ্ঞানচর্চা মানুষকে চিন্তাশীল আর বিবেকবান হতে সাহায্য করে। নীতিবোধ ও মানবতাবোধ মানুষের বেলাতেই প্রযোজ্য, আর তাই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মহাবিশ্বের একমাত্র পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের বসবাস আর একমাত্র মানুষই পারে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। (চলবে)