শুজা রশীদ : (পর্ব ১৯)
২৭.
নোমান ফিরে এলো ট্রেতে দুইটা পানিনি এবং দুই কাপ কফি নিয়ে। এর আগে একবার পানিনি খেয়েছে রিমা। মন্দ নয়। বাইরে তার খুব একটা খাওয়া হয় না। মিন্টুর সাথে পরিচয় হবার পর কয়েকটা মাস খুব বাইরে খাওয়া হত। মিন্টুই খাওয়াত। নতুন গার্লফ্রেন্ডকে একটু চমক দেয়া। ভালো লাগত রিমার। খাওয়ার ব্যাপারে ওর কখনই তেমন কোন আগ্রহ ছিল না, ওর ভালো লাগত মানুষটার সঙ্গ আর রেস্টুরেন্টের পরিবেশ। বিয়ের পর ওর পরিবারের সাথে সমস্যা হবার পর ওদের জীবন অনেকখানি পালটে গিয়েছিল। সেই সব চিন্তা মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিল রিমা। স্মৃতি রোমন্থন করতে ওর ভালো লাগে না। নিজেকে অপরাধী মনে হয়, ছোট মনে হয়। ওকে বিয়ে করেই মিন্টুর জীবনটা বরবাদ হয়েছে ভাবতেই মনটা ব্যাথায় ভরে ওঠে। পরে জেনেছে বাংলাদেশের জনৈক প্রভাবশালী ব্যাক্তির একমাত্র মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ের কথাবর্তা বলছিলেন মিন্টুর বাবা-মা। স্বার্থক হলে তাদের পারিবারিক মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পেত, দেশে তাদের খুঁটির জোরও বেশ বাড়ত। তারা এই দেশে বাস করলেও তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল আবার নিজ দেশে ফিরে যাওয়া বিজয়ীর বেশে।
নোমান সাবধানে টেবিলের উপর ট্রে টা নামিয়ে রেখে ওর মুখোমুখি বসল। “পানিনি আমার খুব প্রিয়। ভাবলাম তুমিও হয়ত পছন্দ করবে।”
পানিনি নিয়ে রিমার বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নেই, কিন্তু ওর এটা ভেবে ভালো লাগল যে নোমান নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে তার ভালো লাগা কিছু একটা রিমাকে নিবেদন করেছে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই দু’ জনার মধ্যে গড়ে ওঠা সুদীর্ঘ বিরতির শীতলতা ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট।
কিছুক্ষণ দু’ জনে নীরবে খেল। টোস্ট করা গরম গরম পানিনি বাস্তবিকই খুব সুস্বাদু। কাঁচের প্যানেলের পাশে বসে দুপরের সুর্যের উষ্ণ রোদে নাইতে নাইতে সামনে বসে থাকা নোমানকে দেখছিল ও। মাথা নীচু করে এমন লাজুক ভাবে খাচ্ছে যেন চোখ তুলে রিমার দিকে চাইলে খুব একটা পাপ হয়ে যাবে। পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। একেবারেই পালটায় নি। কেমন করে যেন দুজনে বার বার পরস্পরের জীবনে চলে আসে। ওর দৃষ্টি নোমানের কপালের কাটা দাগটার উপর গিয়ে স্থির হল। ক্ষতটা শুকিয়ে গেলেও চিহ্নটা এখনও রয়ে গেছে। সে আরেক কাহিনী। সেদিন লাভলু ওকে বেদম মারলেও তার শরীরে তার কোন চিহ্ন ছিল না যদিও পরবর্তি কয়েকটা বছর দূর্বল দৃষ্টি শক্তি এবং মাথা ব্যাথা জাতীয় নানা ধরনের সমস্যায় ভুগেছিল। রিমার জন্যই বেচারীর এতো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। ভাবতেও অপরাধবোধে জর্জরিত হয় রিমা।
শরীরের ওজনটা এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরিয়ে নোমানের মুখের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রিমা, আলাপ শুরু করবার তাগিদ অনুভব করে। আজকের এই সাক্ষাৎ তার অনুরোধেই হয়েছে, সুতরাং আলাপ চালানোর দায়িত্বটা এক রকম তারই। নোমানের কোন ধারনাই নেই কেন রিমা হঠাৎ তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।
“ঐ দিন ক্লিনিকে ঠিক কথা বলার সুযোগ ছিল না,” শেষ পর্যন্ত বলার মত যথাযথ কিছু একটা খুঁজে পায় রিমা। “ভাবলাম কোথাও এক সাথে হতে পারলে গল্প সল্প করা যাবে।”
নোমান মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। “আমিও খুব চাচ্ছিলাম। তুমি নিজের থেকে উদ্যোগটা নিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছ।”
“সত্যি কথা বলতে কি তুমি আমার সাথে নিজের থেকে যোগাযোগ করবে ভাবি নি,” রিমা স্বীকার করে।
নোমান হেসে ফেলে। “তুমি আমার নাড়ী নক্ষত্র জান।”
রিমাও হেসে ফেলে। “তুমি যে কানাডায় সেটা তো জানতামও না।”
“আমার স্ত্রীই আসতে চেয়েছিল। জানোই তো ইদানীং ঢাকার কি অবস্থা। চারদিকে বদ্ধ অবস্থা, রাস্তায় ভয়ানক জ্যাম, ধুলা বালি – ওকে দোষও দেব না।” ক্ষনিকের জন্য থামল, মনে হল যেন হঠাৎ তার মনটা দূরে কোথাও চলে গেছে। একটা সময় ছিল যখন মানসচক্ষে পুরানো শহরটাকে দেখতে পেত রিমা। কিন্তু আজ আর পারে না। সেই শহরের স্মৃতি খুব দ্রæত ক্ষীন হয়ে চলেছে।
“আংটি পর না কেন?” রিমা নোমানের হাতের দিকে ইশারা করে বলে।
নোমান ওর চোখে চোখ রাখল। “খেয়াল করেছ!”
রিমা হাসে, একটু লজ্জাও পায়। “রমণীয় কৌতূহল!”
“পরতাম আগে,” বাঁ হাতের অনামিকা দেখাল। হালকা চক্রাকার দাগ দেখেই বোঝা যায় একসময় আংটি পরা হত। “ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”
রিমা ফ্যাঁকাসে হয়ে পড়ে। “আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। জানতামই না।”
কাঁধ ঝাঁকাল নোমান। “দুঃখ করার কিছু নেই। আমি ভালোই আছি। বাবা মা শুনলে খুব মন খারাপ করবে। তাই তাদেরকেও জানাইনি। আমি আবার তাদের একমাত্র ছেলে।”
“ওনারা কেমন আছেন?” রিমা জানতে চাইল। “কোথায় থাকেন এখন?”
“ঢাকায়, শহর থেকে একটু দূরে একটা বাড়ী কিনেছি আমরা। সেখানেই থাকে তারা। আমার বোনেরা কাছাকাছিই থাকে। তাদের বাচ্চা কাচ্চাও আছে। আসা যাওয়া করে সবসময়।”
“তোমার নিজের কয় জন?” রিমা প্রশ্ন করে।
“বাচ্চা? একটাও না,” নোমান মাথা নাড়ে। “বেঁচে গেছি। বাচ্চা কাচ্চা থাকলে ডীভোর্সের সময় এক হাজার একটা সমস্যা হয়।”
মানুষটার জন্য রিমার খারাপই লাগে। তার মত ভদ্র, বিনম্র একজন মানুষের জীবনটা আরোও অনেক আনন্দময় হওয়া উচিৎ ছিল। “কি হয়েছিল? চলে গেল কেন? যদি বলতে আপত্তি না থাকেৃ”
আবার ঘাড় ঝাঁকায় নোমান। “জানি না, ঠিক হয়েছিল। কিন্তু দু জনের মধ্যে তেমন যোগাযোগ তৈরীই হয়নি। যাক সে সব। তোমার কয় জন বাচ্চা কাচ্চা তাই বল।”
“আপাতত ৩ জন,” রিমা বলে। “ফায়জা আর জিব্রানকে নিশ্চয় মনে আছে। একদম ছোটটার নাম রবিন। মিন্টুর। বয়েস পাঁচ। সবসময় জিব্রানের সাথে লেপটে থাকে। আমার কাছে বলতে গেলে আসেই না। কিন্তু মেজাজ মর্জি যখন ভালো থাকে তার তখন অনেক মজা হয় ওকে নিয়ে।”
“আমার ফায়জাকে খুব মনে আছে,” নোমান উত্তেজিত কন্ঠে বলে। “কি টুকটুকে ছিল!”
“তোমার কথা বলব ওকে। এখন দেখে আর চিনতে পারবে না। খুব পড়ুয়া আর মেজাজী। ওর ভয়ে আমরা সবাই তটস্থ হয়ে থাকি।” রিমা জোরে হেসে ওঠে, আশে পাশের মানুষেরা ফিরে তাকায়। দ্রæত হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে রিমা, কিন্তু হাসি থামাতে পারে না।
“ওর সাথে তাহলে তো আমার দেখা হতেই হয়,” নোমান বলল। “একটা সময় ছিল যখন পকেটে ওর একটা ছোট ছবি নিয়ে ঘুরতাম আমি। মনে আছে তোমার?”
রিমা মাথা দোলায়। “আছে। তুমি ওদের দুজনের জন্যই পাগল ছিলে। ভেবে অবাক লাগছে যে তোমার নিজের কোন ছেলেমেয়ে নেই।”
নোমান কাঁধ ঝাঁকায়। “আমি চেয়েছিলাম। আমার প্রাক্তন স্ত্রী আবার ভীষণ ক্যারিয়ার সচেতন ছিল। দেশে থাকতে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিল। এখানে আসার পর তার মনের মত কোন কাজ পায় নি। খুব মন খারাপ করে থাকত। বাচ্চা কাচ্চার প্রসঙ্গ ওর কাছে তুলতেই ভয় হত।”
“এখন কোথায় সে?” রিমা কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারে না।
“আমেরিকায়। ঢাকায় থাকতে যে বিষয়ের উপর রিসার্চ করছিল সেই রকম একটা কিছু পেয়ে যায়।”
“আমেরিকার কোথায়?” চকিতে ওর মাথার মধ্যে একটা চিন্তা এলো। হয়ত সে নোমান এবং তার প্রাক্তন স্ত্রীকে আবার একজোট করতে পারবে। যদি পারে তাহলে তার অপরাধবোধটা কিছুটা হলেও কমবে।
ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল নোমান। হাসল। “এতো খুশী হবার কিছু নেই। জানি তোমার মাথার মধ্যে কি চিন্তা ঘুরছে। তোমার আগে আরোও দু একজন সেই চেষ্টা করেছে। কোন লাভ নেই। সে আবার বিয়ে করেছে।”
নিজের খাবার শেষ করল নোমান। রিমার প্লেটের দিকে অংগুলী নির্দেশ করল। “তুমি তো প্রায় কিছুই খেলে না। ভালো লাগেনি?”
কাঁধ ঝাঁকায় রিমা। “তুমি তো জানোই, আমি কখনই খুব একটা খেতাম না। তবে পানিনিটা মজার।” তার দৃষ্টি কব্জীতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চলে গেল। ইতিমধ্যেই দেড়টা বেজে গেছে। সময় কিভাবে যায়! দুইটার মধ্যে দোকানে না ফিরলে শেফালী কথা শোনাতে বাদ রাখবে না।
নোমান তার অস্থিরতা লক্ষ্য করল। “ফিরতে হবে?”
“হ্যাঁ,” মাথা দোলায় রিমা। “একটা গ্রোসারী স্টোরে কাজ করি। এক ঘন্টা ছুটি নিয়েছিলাম। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
“ড্রাইভ কর?”
“এখনও না। একটা উবার ডেকে নেব।” রিমা ফোনটা বের করল।
“আমি গাড়ী নিয়ে এসেছি,” নোমান বলে। “তোমাকে দোকানে নামিয়ে দেব?”
রিমা মাথা নাড়ল। “না, না, কেউ দেখলে উল্টো পালটা কথা বলবে। এই মুহুর্তে তোমার সাথে আমাকে এক গাড়ীতে দেখাটা ভালো হবে না। অযথা হয়রানী হবে।”
নোমান মাথা দোলাল। “বুঝেছি। তোমার স্বামীর মৃত্যুতে আমি সত্যিই কষ্ট পেয়েছি।”
মিন্টুর আত্মহত্যা নিয়ে আলাপ করতে রিমার এখনও সমস্যা হয়। আত্মহননে সঙ্গীর মৃত্যুর পর জীবিত পতি বা পত্নীর বেঁচে থাকার চেয়ে কষ্টকর বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। অপরাধবোধ, আত্ম নিপীড়ন এবং রাজ্যের মানুষের দোষারোপ মাথায় নিয়ে পথ চলা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে।
নোমান ওর সাথেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। “ফায়জাকে আমার কথা বল কিন্তু!”
“নিশ্চয় বলব,” রিমা কথা দেয়। “কোন একদিন বাসায় চলে এসো না।”
“নিশ্চয় আসব। টেক্সট করে ঠিকানাটা জানিও।”
রিমার রাইড শেয়ার এসে গেছে। দ্রুত গাড়িতে উঠে নোমানকে লক্ষ্য করে হাত নাড়ল। প্রত্যুত্তরে নোমানও হাত নাড়ে।
২৮.
নোমানের সাথে সেদিন দেখা করবার পর থেকে হঠাৎ করেই যেন রিমার অতীতের একটা বদ্ধ কবাট উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং বন্যার পানির মত ছুটে আসে অসংখ্য স্মৃতিরা, যে সমস্ত স্মৃতি ও বিস্মৃত হতে চেয়েছে। ফায়জা তার মায়ের আচার আচরণ দেখেই বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কিছু জানতে চায়নি। ওর মায়ের যখন সময় হবে তখন সে নিজেই তাকে বলবে।
নোমানের কথা ফায়জাকে এখনও বলে নি রিমা। বুঝতে পারছে না মেয়েটা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা। জানে যত কৌশল করেই ফায়জাকে নোমানের কথা বলুক না কেন, মেয়েটা ঝট করেই বুঝে ফেলবে তাদের দুজনার মধ্যে সম্পর্কটা শুধুমাত্র পুরানো বন্ধুত্বের নয়। রিমা ভাবছিল একদিন নোমানকে রাতে বাসায় খেতে ডাকবে। তখনই বাচ্চাদের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু পরবর্তিতে পরিকল্পনাটা আপাতত স্থগিত রাখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফায়জা হয়ত ভেবে বসতে পারে তার মা ইতিমধ্যেই তার বাবার স্মৃতি ভুলে গেছে, দোকলা খুঁজতে লেগে গেছে। তার কাছে এটা বিশ্বাসঘাতকতার মত মনে হতে পারে। আপাতত মেয়েটাকে নোমানের কথা কিছু না বলারই সিদ্ধান্ত নিল ও। নোমান কোথাও চলে যাচ্ছে না। এতো তাড়াহুড়া করার কিছু নেই।
ফায়জাকে বলেছিল ভোকেশনাল কোর্সে ভর্তি হবার জন্য কি ধরনের কাগজপত্র লাগবে খোঁজ খবর নিতে। ফায়জা ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে ওকে জানিয়েছে আবার পড়াশুনা করতে হলে আগের সার্টিফিকেট আর ট্রান্সক্রিপ্টগুলো লাগবে। তার কাছে সেসবের কোন কিছুই নেই। বহু বছর আগে ফায়জাকে হাতে ধরে আর ছোট্ট জিব্রানকে বুকে নিয়ে যখন ও আচমকা দেশ ছেড়েছিল ওর সাথে ছিল শুধু কিছু জামাকাপড়। সেই মুহুর্তে পড়াশুনা নিয়ে ভাবছিল না ও। একটা সুযোগ এসেছিল। দ্রæত সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন ছিল। দেশে তার ভবিষ্যত হয়ে উঠেছিল অর্থহীন, বিপদজনক। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা ও শেষ করে নি। কিন্তু ওর ঙ ষবাবষ এবং অ ষবাবষ এর সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্ট পৈত্রিক বাসাতেই রয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে বাসায় কারো সাথে বছর দশেকের উপর ওর কথা হয় নি। এর চেয়ে দুঃখজনক বুঝি আর কিছু হতে পারে না। ওর জীবনে যে তিনজন মানুষকে ও সবচেয়ে ভালো বেসেছিল তারা এমন একটা পথ বেছে নিয়েছিল অতীতে যে তাদের জীবন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নেয়া ছাড়া ওর আর কোন উপায় ছিল না।