আতোয়ার রহমান : আমিরুদ্দিন হক। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাকে আমিরুদ্দি বলে ডাকে। বয়স পঁচাত্তর কিম্বা আশি। কেউ জানে না। হাড় জিরজিরে বুড়ো। হাতের মতো মুখের উপরও নানা রেখার কাটাকুটি খেলা স্পষ্ট। মুখের চামড়ার ভাঁজগুলি অতীতের মানসিক চাপের প্রমাণ দেয় ঠিক যেমন ক্ষেতের খাদগুলো লাঙলের ফলার প্রমাণ। তার শরীর যেন একটি জীবন্ত স্মৃতি বা ইতিহাসের একটি নির্ধারিত স্থান।

বাঁশের বেড়া দেয়া ঘর, উপরে টিনের ছাউনি। ঘরের মেঝেয় মাটির শানকি, জলের কলস, টিনের গ্লাস, এতটুকু একটা চুলা, আর একপাশে দেয়াল ঘেঁষে একটা চৌকি, তাতে একটা চিটচিটে কাঁথা বালিশের বিছানা। ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে স্ত্রীর এন্তেকালের পর ওই চৌকিটাতে শুয়ে বসেই জীবনের শেষ কুড়িটি বছর কাটিয়ে দিলেন। ছোট মেয়ে তার শোবার কষ্ট জানার পর তার জন্য নতুন দড়ির খাটিয়া, লেপ, তোষক, বালিশ, চাদরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রাতের বেলা ইঁদুর, তেলাপোকা ঘরে ঢুকে খসর খসর আওয়াজ তোলে। দিনের বেলা গাছের শুকনো পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের চিকন নরম আলো এসে পড়েছে চৌকির ওপর। তার আভায় দেখা যাচ্ছে উঠোনে লেজের মধ্যে মাথা রেখে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে দুটো দেশি কুকুর। বাড়ির সামনে খড়ের ঢিবি, তার চারিদিকে ছাগলের কালো নাদি। জড়বৎ আমিরুদ্দি দীর্ঘক্ষণ ঢিবির পাশ দিয়ে আধা-অন্ধ চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মলিন আকাশের দিকে।

গাছপালা-ঘেরা ঘরটার চারিদিকে আগাছা, জংলি গাছ আর লতাগুল্মে বোঝাই। প্রকৃতি কৌতূহলী শিশুর মতো তার জানালা-দরজার কাছে উঁকি মারছে। বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায় তাতে কত রকম পাখির বাস। সারাক্ষণ কিচিরমিচির লেগেই রয়েছে। ঐ সব দেখেও বেশ সময় কেটে যায়। দম বন্ধ করা ছায়া চারপাশে। কিন্তু এখানের এই জঙ্গলকে ত্রিশ বৎসর আগের জঙ্গলের তুলনায় জঙ্গল বলাটা সঠিক নয়, কারণ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের পূর্ব পাশের রাস্তায় মানুষ ও ছোট যান চলাচল ষ্পষ্টই দেখা যায়। জঙ্গলের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে, সূর্যের আলোও ঢোকে এখন গাছের ফাঁকেফাঁকে। ত্রিশ বৎসর আগের জঙ্গলের ভিতর দুপুরে ঢুকলে মনে হতো সন্ধ্যা, তিন হাত দূরের লোকটা জঙ্গলের ভিতর অন্ধকারে সহসা হারিয়ে যেত। পাকা বাঁশের ফুটোয় বাতাস লেগে শিস ওঠে, বাঁশে-বাঁশে ঘর্ষণে একধরণের ক্যাওও-ওঁওয়া আওয়াজ ওঠে। নির্জন দুপুরে বা রাতে মনে হয় কেউ কাঁদছে। গা শির শির করে।

বাড়ির সামনে একটা ছোট ফাঁকা ধানের মাঠ। তার কোণায় একটি মাথাভাঙ্গা আমগাছ। আধমাইল দূরে রুপালি এক চিতল মাছের পেট সদৃশ ঘাঘট নদী। জঙ্গলের পাশের ডোবাটায় একজোড়া ডাহুক পাখি থাকে, রাতের বেলা ঘর থেকে তাদের ডাক শোনে আমিরুদ্দি। এছাড়া টিয়া, শালিক, ঘুঘু, বুলবুলি, মুনিয়া, দোয়েল, বউ কথা কও, হাড়িচাঁচা কত পাখির কলরব! আমিরুদ্দি কোনটা কী পাখি, তার স্বভাব-চরিত্র, কোথায় বাসা বানায়, ক’টা করে ডিম পাড়ে সব বলতে পারে; কোথায় কোন গাছে কখন কী ফল হবে সব তার জানা। বাড়িতে গাছপালা থাকলে, পাখি প্রজাপতি উড়ে আসে, এতে বাড়ির জন্য মায়াও বাড়ে। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলে শত কষ্টের মধ্যে থাকলেও গাছপালা, পাখি, ককুর আর এই ফসলের মাঠ নিয়ে বাঁচি আছি বাহে। অ্যাটেকোনা ছাড়া মোর কোণ্ঠেও ভালো নাগে না।

এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। হরহামেশাই ঘটে। গ্রামবাংলার নিত্যদিনের কাহিনী। বাবা-মা বুড়ো হলে তাদের অনেকের জায়গা আর ঘরের ভেতর হয় না। কীভাবে হবে? একটা ঘর আর এক চিলতে বারান্দা নিয়ে তাদের অনেকের জীবন চলে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। কিন্তু আমিরুদ্দির জন্য এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমিরুদ্দির দুই ছেলে, এক মেয়ে। সগির, কবির আর গোলাপি। সগির জন্মাবার দশ বছর পর কবির জন্মায়, তার দুই বছর পর গোলাপি। আমিরুদ্দি সম্পন্ন গেরস্ত চাষী না হলেও যা জমিজিরাত ছিল, তার ফসল-ফলন দিয়ে ভালভাবেই চলত তার সংসার। নিজ হাতে চাষ আবাদ করত সে। গোটা দিন ক্ষেতেই পড়ে থাকত। স্ত্রী রাবেয়া খাতুন দুই হাত দিয়ে সংসার সামলাতো। এলাকায় আমিরুদ্দির মোটামুটি প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল।

আমিরুদ্দি বারান্দায় রোদবৃষ্টিতে ভিজেই বেশ থাকে। আর তার সার্বক্ষণিক সাথি হিসেবে রয়েছে তার দু’টো পোষা কালো কুকুর। ভোররাতের দিকে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে পেশাব পায়খানা করতে ঘরের পেছনের ঝোপঝাড়ে বসে, মশার কামড়-টামড় খেতে খেতে কুকুরের খেলা দেখে, বাইরে বের হলেই কুকুর দু’টি তার সাথে খেলায় মেতে ওঠে। তাদের ডাকলে তারা খুব উৎসাহ পায়। লেজ নাড়ে। আমিরুদ্দির একাকিত্ব কেটে যায় এবং বেশ একটা ফুর্তির ভাব আসে। অবসরে খুনসুটিতে মাতে একে অপরের সঙ্গে, কেটে যায় তার নিবিড় সময়। তাদের খুনসুটি উপভোগ করে শিমুল গাছটি। নতুন মানুষ দেখলে ঘেউ ঘেউ করে। অচেনা কুকুর দেখলে হামলে পড়ে। কুকুর দুটির মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব। তবে ছোট কুকুরটি বদরাগী। মাঝে মাঝে বিনা কারণে ঘেউ ঘেউ করে।

জীবনযাপনে কোনই অভিযোগ নেই তার। লোকজন জানতে চাইলে শুধু ফিক করে হেসে দিয়ে বলে, “এইতো মুই বেশভালো আঁছো। আর কয়টা দিনেবা থাকমো। “দু’পা হাঁটার শক্তি নাই গায়ে। রোগশোক হলে শুয়ে থেকেই সারে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

“মুক্তিযুদ্ধ করে আপনার কী লাভ হল?” এমন প্রশ্নে আমিরুদ্দি বলে, “দ্যাশটা দোকান, নাকি যুদ্ধটা ব্যবসা, যে লাভ খুজিম?”

আমিরুদ্দি লক্ষ্য করে স্কুল যাওয়া আসার পথে ছেলের বউরা তার সাথে নাতিদের কথা বলতে দেয় না। জানালার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে খাবার-টাবার, ফল-ফলারি তার দিকে ছুঁড়ে দেয়, কুকুরের মুখে হাড্ডি ছুঁড়ে দেওয়ার মতো করে। যেন সে সার্কাসের জন্তু! খাবারটাও ঠিক মতো দেয় না, সেবা শুশ্রূষা দূরের কথা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবারের সকলের কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে গেল সে। বয়স্ক হওয়ার বিষয়ে মজার বিষয় হলো, আপনার দৃষ্টি শক্তি দুর্বল হতে পারে, তবু আপনি মানুষের ভেতরটা আরও ভাল দেখতে পান। চোখে তেমন দেখতে না পেলেও আমিরুদ্দিও তার ছেলে বউদের ভেতরটা ভাল দেখতে পায়।

যুদ্ধের সময় এই পাকা রাস্তাটা ছিল না। ছোট একটা এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তা ছিল তখন। গাড়িঘোড়া চলত না। এদিকটায় বড়ো কেউ একটা আসতোও না। দিনের বেলায় বুনো শুয়োর, শেয়াল, গুই সাপ বাড়ির পেছনের ঝোপজঙ্গল থেকে বের হয়ে ঘুরে বেড়াত। মরে পচে যাওয়া পশুপাখির দুর্গন্ধ চারিদিকে। বৃষ্টির পর এইখানে একটা মধুর গন্ধের মদিরতা দেখা দিতো। ফুলের সঙ্গে সোঁদামাটি আর শুকনো পাতার ওপর বৃষ্টি পড়ে এরকম গন্ধ হয়। গন্ধটি মায়াময়। এ গ্রামের চেয়ে অন্য কিছু আমিরুদ্দি এত ভালভাবে জানে না। তার বুকের পাঁজরের মতো জানা এই গ্রামের জমাজমি ও তার বসতভিটা। এ গ্রাম ও এর আশেপাশে যা কিছু আছে, কোথায় কী ঘটছে, সবকিছু তার মুখস্ত, তার নখদর্পণে।

ফেলে আসা পুরনো সময়ের বহু স্মৃতি, এক পূর্ব-পুরুষের আত্মত্যাগ, তাঁদের স্বপ্ন, বর্তমান পরিস্থিতি-সবকিছুই আলাদা। সেই নিরালা নির্জন পল্লীগ্রাম এখন আর নেই। আমিরুদ্দির চোখের সামনে গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি এলো, আলবাঁধা স্কুলের পথে বিরাট ট্রান্সফর্মার বসলো, টেলিফোনের লাইন এলো। রংপুর নতুন বিভাগীয় শহর হওয়ায় এটি সিটি কর্পোরেশনের দক্ষিণ দিকের শেষ সীমানার মধ্যে পড়েছে। অনেকের পাকা বাড়ি হয়েছে, দু-তিন চাকার গাড়ি হয়েছে, শহুরে বিলাস সামগ্রী এসে ঘর রোশনাই করে আছে।

একাত্তর সালের মার্চ-এপ্রিল মাস। দেশের অবস্থা ঘোরালো হয়ে ওঠে। এর উত্তাপ উত্তরের এই জনপদেও এসে পড়ে। যুদ্ধের শুরুতেই লোকজন বাঁশের লাঠি, তীর ধনুক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে; সে আক্রমণের অগ্রভাগে আমিরুদ্দিও ছিল। বুক ধনুকের মতো টান টান, লক্ষ্য স্থির। তার চোখে মুখে পুরো অবয়বে তখন একটা প্রতিশোধস্পৃহার বিচ্ছুরণ, সাহসী কন্ঠে বিজয়ের আঘ্রাণ। তীর ছোঁড়ার মতো দৃষ্টি এদিক ওদিক ছুঁড়ে দিয়েছিল শত্রæ সেনার খোঁজে। পাক সেনার মেশিনগানের গুলিতে কয়েক শত লোক মারা পড়েছিল সেদিন। চারিদিকে জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়ে যায়। শহরের লোকজন বিচলিত হয়ে পড়ে। শহর থেকে আমিরুদ্দির গ্রামের দুরত্ব মেরেকেটে পনেরো কিলোমিটার। জায়গাটা শহরের কাছে অথচ দুর্গম হওয়ায় অনেকে তাদের স্ত্রী পরিজনদের এ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। আমিরুদ্দির বাড়িতেও অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত পালিয়ে আসা মানুষদের অভয় দিয়ে, সাহস যুগিয়ে আমিরুদ্দি বলে, “ভয় করব্যান নান, ভয় করি লাভ কী? হামরা তো আছি!” সবাই জানে গ্রামে মিলিটারি আসার সম্ভাবনা কম, তবুও তারা ছাদে চাঁদতারাখচিত সবুজ ও সাদা রঙের পতাকা উড়িয়ে রাখে। বৃদ্ধ-জরাগ্রস্ত অতিকায় এক কালা শকুন তীক্ষ্ণ চক্ষু নিয়ে বড় শিমুল গাছের মগডালে বসে ডানা ঝাঁপটায়। দেশের অবস্থার দ্রæত পরিবর্তন হতে থাকে, পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে যায়। দিনের বেলা মাথার উপর খুব নিচ দিয়ে যুদ্ধবিমান উড়ে যায়। রাতে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। দূরে মানুষ আর শেয়ালের অস্পষ্ট শোরগোল–তা আর্তনাদের মতো ভয়ার্ত। চারদিক থেকে প্রচুর আতঙ্কের খবর আসছে। মৃত্যুর মতো আতঙ্ক, অতর্কিত আক্রমণের সর্বগ্রাসী ভয়। মানুষ পালাচ্ছে দেশ থেকে সীমান্তের ওপারে। আমিরুদ্দিও ছেঁড়া গামছা আর লুঙ্গি পরে যুদ্ধে চলে গেল। সীমানা পেরিয়ে ওপারের কোচবিহারে যুদ্ধের ট্রেনিং নিল।

যুদ্ধ শেষ হলে বিজয়ীর বেশে গ্রামে ফিরে এল আমিরুদ্দি। শুরু হল আর এক যুদ্ধ। দেশগড়া আর সংসার গড়ার যুদ্ধ। দুই ছেলের সঙ্গে রোজ ঝগড়া হয় আমিরুদ্দির। বাবাকে এরা বাবা তো দুরের কথা, মানুষ বলেই মনে করে না। চাকরবাকরদের মতো ব্যবহার করে। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা উপযুক্ত, বেশ জোয়ান জোয়ান। দুই ছেলে সগির ও কবির বিভিন্ন সময় বুড়ো বাবা-মাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে জোর করে অনেক ধানি জমি তাদের নামে লিখে নেয়।

সগির স্ত্রী সন্তান নিয়ে শহরে থাকে। ভ্যান চালায়। কবির বাবার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকে। নেশা ভাঙের অভ্যাস আছে। কিন্তু সেইসব জমির বেশির ভাগই তারা বিক্রি করে দিয়েছে। এখন শেষ সম্বল একবিঘা জমির ওপর ঘর করে স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে বসবাস করে আসছিল আমিরুদ্দি। চুয়াত্তুরের দুর্ভিক্ষের সময় বুড়ি এন্তেকাল করেছেন।কিন্তু বৃদ্ধের দুইছেলে সগির ও কবির ওই জমিটুকু নিজেদের নামে লিখে নিতে অনেক দিন ধরে তার ওপর মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছে। এখনো একই অন্নে বসবাস।

সেদিন মেম্বার বলল, “এখানকার অবস্থা ভাল নয়।প্রোমোটার থাবা বাড়িয়ে আছে এই জায়গাটার দখল নেওয়ার জন্য।মাছের দোকানের সামনে ওঁত পাতা বিড়ালের মতো প্রোমোটারের দালালেরা ঘুরঘুর করছে গ্রামটার চারপাশে। শপিংমল-টলগুলো এখন মফস্বল গঞ্জকে গিলে নিচ্ছে। এখানে হয়তো বড় বহুতল-টহুতল হবেনা, কিন্তু গুদামঘর হতেই পারে।আমরা অনেকে প্রতিবাদ জানাতে তারা আপাতত চলে গিয়েছে।তবে আবার আসতে কতক্ষণ!”

কবিরের মাথায় ঢোকে বিদেশে যাওয়ার ভূত। কিন্তু বিদেশ মানে কুয়েত যাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয়। ওখানে যেতে পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে। চাকরি করার জন্য লাগে এনওসি। কবিরের দৌড়ঝাঁপের অন্ত থাকে না। শেষপর্যন্ত এক ট্রাভেল কোম্পানি আশ্বাস দেয়। কবির বাপকে তোষামোদ-খোষামোদ করে বাড়ি ভিটের এক কানি জমি তাকে লিখে দিতে বলে। আমিরুদ্দি রাজি হয়না।

শিমুলগাছের ডালে একটা কাক ডানা ঝাঁপটায়, অনেকক্ষণ থেকে কা-কা করছে; আমিরুদ্দির কানেও আঘাত করছিল আওয়াজটা। ঘরের পেছনের বুনো ঝোপে শেয়াল থাকে।একটা মুরগি পোষার উপায় নেই, ওঁৎ পেতে থাকে চব্বিশ ঘণ্টাই, মুরগি পেলেই হলো, ঝপ্?করে মুখে তুলে নেবে। দুপুরের চড়া রোদের তেজ এখন বিকেলের কুমড়ো ফুলের মতো মিইয়ে পড়েছে। কুকুরগুলো বাড়ির বাইরের উঠোনে ঘোরাঘুরি করছে।আমিরুদ্দির চোখে একটু ঘুমের ঘোর এল।একটা তক্ষক ডেকে যায়। হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে ঘুমের ঘোরে ভাবল, কি জানি, মুরগি তো নেই বাড়িতে! ওদিকে চার শেয়াল ঝোপের সরু পথ দিয়ে ঘরের দিকে আসছে। ভ্যাপসা বাতাস, মানুষের বিষ্ঠার ঝাঁজালো গন্ধ-মাখানো। শেয়ালগুলোর জুতোর তলায় গাছগাছালির ঝরা শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। তারা দ্রæত এসে আমিরুদ্দির ঘরে ঢুকল। এদের দুই শেয়াল হল তার দুই পুত্র আর এক শেয়াল হল প্রোমাটারের দালাল। একটা শেয়াল এসে ছেঁড়া ময়লা একটা গামছা জোর করে গুঁজে দিল আমিরুদ্দির মুখে। হাত-পা নেড়ে গোঙাতে থাকল। ব্যথায় কাতরাতে থাকলো। আধা-অন্ধ চোখে বাইরে তাকালো, মনে হচ্ছে লম্বা সুপারি গাছগুলি আরও লম্বা হতে হতে আকাশের ছাদ ছুঁয়ে ফেললো।

নেশায় আচ্ছন্ন চোখ তুলে একদৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে থেকে আমিরুদ্দির ছোট ছেলে জমি লিখে নেয়ার দলিলটা তার সামনে দিল সই করার জন্য। বলল, “বাড়িটা ভালোয় ভালোয় হামার দুই ভাইয়ের নামে নেখি দ্যাও। তোমাক শহরের ভাড়া বাসাত নিয়া যামো, অটেকোনা হামার সাথে থাকমেন।” একজন ইঁদুরের চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।একজন তাকে মাটিতে চেপে ধরে রাখলো, আর একজন তার মুখে গামছাটা আর একটু গুঁজে দিয়ে ধরে রইল আর তৃতীয়জন জমির দলিলটা তার সামনে তুলে ধরল। আমিরুদ্দি ভাবলেশহীনভাবে বলল, “মুই এ ভিট্যামাটি ন্যাখি দিবান নাও, মুই এ ঘর ছাড়ি কোন্ঠেও নড়ব্যান নাও।”
আতঙ্কে হয়তো তখুনি অক্কা পেত। তবে সেতো মুক্তিযোদ্ধা। ত্রাসে দম আটকে এলেও সে চেয়ে রইল। অসহায় বোধ করলেও ভীত হয়ে পড়ল না। তীব্র যন্ত্রণায় একবার কঁকিয়ে উঠল। কুকুর দু’টো রুখে দাঁড়াল, পাগলের মত ছোটাছুটি করতে লাগলো। প্রোমোটারের দালাল শেয়ালটার পায়ে দৌড়ে গিয়ে কামড় দিল একটি কুকুর। কুকুরের দাঁত শেয়ালের মোটা জিন্সের প্যান্ট ভেদ করতে পারলনা। পাশের বাড়ির মুরগিগুলো এসে ওদের ঠোকরাচ্ছিল। এমন অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ায় ভয় পেয়ে যায় শেয়ালগুলো। হতভম্ব হয়ে বুঝতে চেষ্টা করে পরিস্থিতি।কুকুরের ঘেউ ঘেউ তীব্র চিৎকার, ঘন ঘন নিঃশ্বাস আর গোঙানির আওয়াজে গ্রাম ভেঙে এলো তার ঘরের সামনে, ঠিক যেভাবে মৌমাছির চাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি এসে জড়ো হয়। ছেলেপুলের দল চেঁচামেচি, হৈ হট্টগোল করতে থাকে। শেয়ালগুলো সতর্ক হয়, শিথিল করে আমিরুদ্দির গলা। মার খাওয়া বেড়ালের মতো আমিরুদ্দি ছোট ছেলেটার দিকে একবার তাকায়। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বুক খালি করে বেরিয়ে এলো। আমিরুদ্দি একটু ধাতস্ত হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে একদলা থুথু ছুঁড়ে দেয় শেয়ালগুলোর দিকে। উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হলো। শেয়ালগুলো ঝোপের সরুপথ দিয়ে মাঠে নেমে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আর পায়ের শব্দ। কুকুর দু’টো অনবরত ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত দৃষ্টিসীমা থেকে শেয়ালগুলোর প্রস্থান হলো।

দেশের জন্য বুক পেতে খান সেনাদের গুলি খাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার শেষ স্মৃতিকে মুখ লুকোতে হবে কতগুলো লোভী শেয়ালের জন্য! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলনা মেম্বার।নম্র মৃদুভাষী মেম্বারের ভিতর থেকে যেন কথা বলে উঠল আর কেউ।তার ভেতরকার উত্তপ্ত অস্থিরতা তীব্র স্বরে বেরিয়ে এলো। সে বলে উঠল, “বাড়ির এই পৈতৃক ভিটেমাটিটুকু আমিরুদ্দির অস্তিত্বের, পরিচয়ের অংশ। সে সারা জীবন তার নিজের মানুষের সঙ্গে বড় হয়েছে, গাছপালা, মাঠ সবই তার অস্তিত্বের অংশ। এ বাড়ি ভিটে বিক্রি হবে না। আমি স্পষ্ট বলে যাচ্ছি, প্রয়োজনে মাটিতে শুয়ে জান দেব, বুকের রক্ত দেব তা-ও ভাল। তবুও এই জমি কাউকে দেবনা। তিনি দেশের মাটি রক্ষা করেছিলেন প্রাণ দিয়ে, তাঁর ভিটেমাটিটুকু রক্ষা করার প্রয়োজনে আমরাও তা-ই করবৃ।”

এখন পর্যন্ত একাধিকবার কুকুর দু’টো তার জীবন বাঁচিয়েছে।সেবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর আমিরুদ্দি যাতে অচেতন হয়ে না পড়ে, সে জন্য তার হাত-মুখ চাটতে থাকে কুকুরগুলো। এরপর তাকে টেনেহিঁচড়ে ফোনের কাছেও নিয়ে যায়।কুকুর দু’টোর সাহায্যের পরই চিকিৎসকদের ফোন করতে সক্ষম হয় আমিরুদ্দি। ছেলেদের দুর্ব্যবহারে সে যখন অবসাদে ডুবে গিয়েছিল, সে সময় কুকুর দু’টোই তার পাশে থেকেছে। তাকে সঙ্গ দিয়েছে। তাই সেও আগলে থাকতে চায় কুকুর দু’টোকে। এখন আশেপাশের সবাইকেই কুকুর মনে হতে লাগল তার কাছে। এমনকি তার নিজেকেও কুকুর মনে হতে লাগলো।

ছেলেদের এমন আচরণে রাগে আক্রোশে ক্ষুব্ধ আমিরুদ্দি পরদিন থানা ভুমি অফিসে গিয়ে কুকুর দু’টোর নামে তার বাড়িভিটে লিখে দিলো। আমিরুদ্দি মারা গেলে কুকুর দু’টোর যার কাছে থাকবে, সে জমিটুকু ভোগ করবে।ছেলেরা এ খবর জানতে পেরে দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়ে। তারা মেম্বারের বাড়িতে যায়। বাড়ি ভিটের জমিটুকু তাদের নামে লিখে দেয়ার জন্য আমিরুদ্দিকে বুঝিয়ে রাজি করাতে মেম্বারের কাছে আকুতি জানায়। ছেলেদের কাকুতি-মিনতিতে অনিচ্ছাসত্তে¡ও মেম্বার আমিরুদ্দিকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করলো। পরদিন আমিরুদ্দি ভুমি অফিসে গিয়ে কুকুরের পরিবর্তে তার গ্রামের এতিমখানার নামে বাড়িটা লিখে দিলো। ভ্যানরিকশায় করে বাড়ি ফেরার পথে অর্ধেক রাস্তায় এসে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল আমিরুদ্দি। লোকজন লাশ নিয়ে এসে বাড়ির পেছনে কবর দিল। কুকুরটি প্রতিদিন অনেকটা সময় কবরের পাশে বসে থাকে। রাতভর তার কবর পাহারা দেয়। মধ্যরাতে বিষণ্ণ ও আর্ত স্বরে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।
সমাপ্ত