শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
২.
মনিরা মনোযোগ দিয়ে হাতের কাজগুলো সাড়ছিল, ১১টার মধ্যে আবার মাসিমার রুমে যেতে হবে ডাক্তার এসেসমেন্টে সাহায্য করার জন্য। হঠাৎ ফোনটা বেজে ঊঠল, কলার আইডি না দেখেই ফোনটা তুললাম। ক্লায়েন্ট এঞ্জেলার রিনরিনে গলার চিৎকার শোনা গেল… এঞ্জেলার রুমে ডাক পড়ল, বুঝলাম আজকে দিনটাই খারাপ যাবে, কোন কাজই ঠিক মত হবে না। ১০.১৫ বাজে ১১টার মধ্যে ৮০২ নাম্বার রুমে থাকতে হবে। হাতের কাজ বন্ধ করে দৌড়ালাম এঞ্জেলার রুমে। প্রায়ই তার ঘরে গিয়ে চঝড দের নিয়ে আমাকে বিভিন্ন রকমের বিচার আচার করতে হয়। এই হোমে এঞ্জেলা ৭ বছর ধরে থাকছে। সব সাহায্যকারীদের সাথেই তার সমস্যা। এঞ্জেলা সাদা কেনেডিয়ান। জন্ম ১৯৩৫ সালে, বয়স ৭২। এঞ্জেলার ২জন ছেলে মেয়ে। তাদেরও বয়স ৫০শের বেশি। এঞ্জেলার মেয়ের সাথে এঞ্জেলার সম্পর্ক একেবারেই ভাল না। খুব অল্প বয়সে এঞ্জেলা বিয়ে করেছিল, ঠিক বিয়ে নয়, ব্যাপারটা জটিল। একটু পূর্বকালীন ব্যাখ্যা না দিলে বিষয়টা ঠিক বোঝানো সম্ভব না।
হ্যালিফাক্সের ছোট্ট একটি শহরে একটি গোড়া ক্যাথালিক পরিবারের মেয়ে সে কিন্তু নিয়ম না মানাতেই এঞ্জেলার আনন্দ ছিল বেশি, উশৃঙ্খলতা যেন ওর রক্তে মিশে ছিল। সুন্দরি ছিল বলে ছেলে মহলে ওর খুব কদর ছিল। ১৬ তে এঞ্জেলা প্রেগনেন্ট হয়ে যায়। বয়ফ্রেন্ড জেমেস যার কোন চালচুলোর বালাই ছিল না সে পরামর্শ দিল পালিয়ে যাবার জন্য। অনেক ভাবাভাবির জন্য সময় ছিল না খুব একটা। এডভেঞ্চারের আনন্দে একদিন জেমসের সাথে পালিয়ে টরন্টোতে চলে আসে এবং অথৈ সাগরে পড়ে দুজনেই। বাসে ওঠার আগ পর্যন্ত তেমন কোন চিন্তা ছিলনা কিন্তু অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ভবিষ্যত নিয়ে ভাববার অনেকটা সময় পেল এঞ্জেলা। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। এঞ্জেলা সমানে কান্নাকাটি করছিল বলে জেমস রেগে যাচ্ছিল। হিসেব করে দেখল দুজন মিলে যা টাকাকড়ি নিয়ে এসেছিল তাতে ১ সপ্তাহের মত চলবে দুজনার। টরন্টোতে এসে যখন বাস থেকে নেমেছিল তখন বিকেল প্রায়। দুজনেই ক্ষুধার্ত, বাস স্টপের সাথেই ছিল ছোট একটা ডাইনার। দুজনে সেখানেই ঢুকে অর্ডার করেছিল স্যুপ আর সাথে রুটি ফ্রি। প্রথম সমস্যা মিটে যাবার পরে আসল সমস্যা নিয়ে শুরু হয়েছিল দুশ্চিন্তা; কি করে চলবে, কোথায় থাকবে ইত্যাদি। খাবার দিতে এসে ওয়েট্রেস শুনেছিল ওদের আলোচনা। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসেছিল ডাইনারের মালিককে নিয়ে। ইটালিয়ান মালিক এসে চেয়ার টেনে বসেছিল ওদের কাছে এবং ঘটনা জানবার জন্য ছোট ছোট প্রশ্ন করে আসল সত্য বের করে ফেলে ওদের কাছ থেকে। মালিক দান্তে ওদের বাস থেকে নামতে দেখেছিল। এত অল্প বয়সি ছেলে মেয়েরা সাধারণত একা একা এভাবে ট্রাভেল করত না। দান্তে তখনই সন্দেহ করেছিল। আসল ঘটনা জানবার পরে দান্তে জানতে চেয়েছিল এঞ্জেলা বাড়ি ফিরে যেতে চায় কিনা। এঞ্জেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেছিল সে বাড়ি ফিরতে চায় না কারণ ওর বাবা খুব কঠিন হৃদয়ের মানুষ এবং এঞ্জেলাকে সে ক্ষমা করবে না। দান্তে তখন প্রস্তাব করেছিল যে সে এঞ্জেলাকে ওয়েট্রেস হিসেবে কাজ দেবে আর জেমস কাজ করবে কিচেনে, ডিস ওয়াস, বাজার আর মালিকের ফুট ফরমাস খাটবে। ডাইনারের উপর তলায় দান্তের সংসার বউ লুসিয়াকে নিয়ে কিন্তু ওদের কোন সন্তান নেই। দান্তে এও বলল যে উপর তলায় একটা রুম খালি পড়ে আছে এবং ওদের দুজন কে রুমটা ভাড়া দিতে রাজি। এঞ্জেলা আর জেমস যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিল। রাতে ঠাই হয়েছিল উপর তলার সেই রুমে।
শুরু হয়েছিল এঞ্জেলার কঠিন -কঠোর জীবন। পরদিন থেকে দান্তের বউ লুসিয়া যে কিনা ডাইনারে একজন ওয়েট্রেস, এঞ্জেলাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল সব কিছু। প্রেগনেন্সির তখন ৪ মাস চলছিল। বাইরে থেকে খুব একটা বোঝা না গেলেও এঞ্জেলা টায়ার্ড হয়ে যেত খুব অল্পতেই। সারাদিন কাজ করে রাতের বেলা চলত জেমসের সাথে ঝগড়া। আল্পদিনেই জেমসের বাবা হবার সাধ মিটে গিয়েছিল, সব কিছুর জন্য জেমস এঞ্জেলাকে দায়ী করতে শুরু করল। এঞ্জেলাও সমানে চেঁচামেচি করত। মাঝে মাঝে দান্তে এসে ধমক দিয়ে যেত ওদের আবার কখন মিমাংসা করার চেস্টা করত। ডাইনার জীবনের ৪ মাস পেরিয়ে এঞ্জেলা তখন ৮ মাসের প্রেগনেন্ট একদিন সকালে আবিষ্কার করল জেমস কোথাও নেই এবং সেই সাথে জেমসে সব কাপড় এবং ব্যাগ উধাও। এঞ্জেলা বুঝেছিল যে জেমসের সাথে ওর আর দেখা হবে না এবং এই যুদ্ধ ওর একার। সেদিন উপড় থেকে নামেনি এঞ্জেলা, সারাদিন কেঁদেছিল। দান্তের বউ লুসিয়া এসে ওকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল। আধাবেলা কিছুই খায়নি সে কিন্তু দুপরের পরে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছিল।
এঞ্জেলা বুঝেছিল যে বাচ্চার খাবার প্রয়োজন এবং সাথে এও বুঝেছিল যে কান্নাকাটি করে কিছুই হবে না তাই বেশ করে খেয়ে দেয়ে বাকি দিনটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালে উঠে জেমসকে দেখতে না পেয়ে এঞ্জেলার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছিল, পৃথিবীতে সে একদম একা হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়েই ফ্রেস হয়ে কাজে লেগে গেল সে।
এই ডাইনারেই ওর মেয়ের জন্ম। লুসিয়া আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিল সোফিয়া। জন্ম থেকেই সোফিয়ার প্রতি ওর অবহেলা, রাগ। জেমস যে ভাবে ওকে সব কিছুর জন্য দায়ী করত এঞ্জেলা ঠিক তেমনি করে সোফিয়াকে সব কিছুর জন্য দায়ী করতে শুরু করল। লুসিয়াই সোফিয়াকে বড় করেছে বলা যায়। ১৭ বছরের “টিন মা” এঞ্জেলা যে কিনা নিজেই এখনো নিতান্ত বালিকা। সোফিয়ার জন্মের পরে এঞ্জেলার ভালবাসা হয় পলের সাথে। পল বয়সে এঞ্জেলার থেকে বেশ বড় ছিল, তাতে এঞ্জেলার তেমন কোন সমস্যা ছিল না কারন পল লোকাল বাস ড্রাইভার ছিল এবং কামাই খারাপ ছিল না।
এঞ্জেলা নির্ভরশীলতা খুঁজছিল। পলের সাথে ডেটিং করল প্রায় ৪ বছর। এরপরে পল বিয়ের প্রস্তাব দিল; বিয়ের গল্প বলতে বলতে এঞ্জেলা এখনো আবেগি হয়ে যায়। কখনো ভাবেনি সে জেমসকে ভুলে সে আবার সুখী হতে পারবে।
বিয়ের পরে এঞ্জেলা উঠে গেল পলের এপার্টমেন্টে। ডাইনার থেকে হাটা পথ, তাই কাজটা ছাড়ল না এঞ্জেলা। সোফিয়ার তখন বছর ৪ বয়স। সোফিয়া লুসিয়াকেই বেশি পছন্দ করত। সন্তানহীনা বলে দান্তে আর লুসিয়া সোফিয়াকে অনেক ভালবাসত আর ঠিক ততটাই দূর দূর করত এঞ্জেলা কিন্তু পল সোফিয়াকে পছন্দ করত, ভালবাসত।
এঞ্জেলা যখন পলের সাথে চলে যাচ্ছে দান্তে আর লুসিয়া সোফিয়াকে রেখে দিতে চেয়েছিল, দত্তক নিতে চেয়েছিল কিন্তু পল রাজি হয়নি বরং সে দান্তে আর লুসিয়াকে বলেছিল তোমরা সোফিয়ার গ্র্যান্ড-পা আর গ্র্যান্ড-মা হয়ে থাকবে সব সময়ের জন্য। শুরু হয়েছিল এঞ্জেলার নতুন জীবন কিন্তু গলার কাঁটা হয়ে ছিল সোফিয়া। আমি জানতে চেয়েছিলাম “অতটুকু একটা বাচ্চা কি ক্ষতি করেছিল তোমার?” এঞ্জেলার চোখে জলে ভরে গিয়েছিল, ভাঙ্গা গলায় বলেছিল; সোফিয়াকে দেখলেও ওর জেমসের কথা মনে হত আর ওর ফেলে আসা জীবনের কথা মনে হতেই ওর মনটা বিষিয়ে যেত। কেন যেন কিছুতেই ও সোফিয়াকে আদর করতে পারত না। সোফিয়াও পারতপক্ষে এঞ্জেলার সামনে পড়ত না। ও বুঝতো পল ওকে ভালবাসে তাই আস্তে আস্তে পলের দিকে ঝুঁকে গেল, যা প্রয়োজন পলের কাছেই চাইতো। পলকে পাপা বলে ডাকত। বিয়ের দুবছরের মাথায় আবার প্রেগনেন্ট হল এঞ্জেলা। এবার এল ছেলে; জন। এঞ্জেলার ৬ বছরের ছোট জন। সোফিয়ার জন্য জমাকৃত ভালবাসাগুলো যেন জনের উপরে ঢেলে দিল এঞ্জেলা। সোফিয়া দূর থেকে দেখত এঞ্জেলা কিভাবে জনকে আদর করত, যতœ করত। আগে সোফিয়া আঞ্জেলাকে ভয় পেত কিন্তু এখন ঘৃণা করতে শুরু করল। এঞ্জেলার সাথে সাথে সে ভাই জনকেও ঘৃণা করত। এঞ্জেলার বাড়িতে কখন যেন আনন্দের সূর্?্য ওঠেনি, কখন যেন হাসির ফোয়ারা বয়নি; কোথাও না কোথাও যেন মেঘে ঢেকে থাকত সবসময়। পল চেস্টা করত সব দিল সামাল দিতে পেরে উঠত না। সোফিয়া যত বড় হতে লাগল সমস্যাও বাড়তে শুরু করল, সে যেন মায়ের উশৃঙ্খল জীবনকেই বেঁছে নিল। ১৮ হতেই সোফিয়া বাড়ি থেকে চলে গেল এবং যেটুকু যোগাযোগ রইলো সে পলের জন্য। পল রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় যখন তখন জনের বয়স ২০ আর সোফিয়া ২৬। সদ্য একটা ভাল চাকরিতে ঢুকেছে জন, সুন্দরি একটা রাশিয়ান গার্লফ্রেন্ড নিয়ে খুব ব্যাস্ত সব সময়। পল মারা যাবার পরে এঞ্জেলা মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পড়ল, ক্রনিক ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে গেল সে এবং ভীষণ ভাবে জনের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেল। বেচারা জন; মা আর গার্লফ্রেন্ড সামাল দিতে গিয়ে গার্লফ্রেন্ড্রের সাথে ব্রেকাপ হয়ে গেল। জন নিজেও কিছুদিন মন খারাপ করে থেকে একসময় ভাড়ার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে মায়ের বাড়িতে উঠে এল। সবকিছু ঠিক ঠাকই চলছিল তারপরে হঠাৎ করে এল সেই কাল রাত্রি। (ক্রমাগত)