হাসান গোর্কি : ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক স্পুটনিক নামে পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হবার পর মহাকাশ অভিযানে যে নবদিগন্তের সূচনা হয়, আজকের সভ্যতার অগ্রযাত্রা তার কাছে বিপুলভাবে ঋণী। আর পৃথিবী যে বর্তমানে একটা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে তার কমপক্ষে আধাআধি কৃতিত্ব দিতে হয় ভূ-উপগ্রহকে। ২০২০ সাল পর্যন্ত চল্লিশটি দেশ থেকে প্রায় সাত হাজার উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। কক্ষপথে আছে চার হাজার- যার মধ্যে সক্রিয় উপগ্রহের বর্তমান সংখ্যা বারোশ’র মত। বাকি ২৮০০ মেয়াদ শেষে নিস্ক্রিয় অবস্থায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কৃত্রিম উপগ্রহগুলো আসলে বড় আকারের কম্পিউটার যাতে মূলত বিভিন্ন ধরনের ধরণের শক্তিশালী ক্যামেরা, রেডিও সিগনাল গ্রহন, প্রেরণ ও স¤প্রচার প্রযুক্তি সংযোজিত থাকে। এগুলোতে কোন ইঞ্জিন থাকেনা ফলে কোন জ্বালানিরও দরকার পড়ে না। তাহলে বছরের পর বছর এগুলো ভেসে বেড়ায় কীভাবে? এ বিষয়ে একটা ভুল ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস মহাশূন্যের এমন একটা স্তর আছে যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। ভূ-উপগ্রহকে রকেটের সাহায্যে সেখানে বহন করে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে সেগুলো এমনিতেই ভাসতে থাকে। কারো কারো ধারণা পৃথিবী এবং চাঁদের দ্বিমুখী টান যেখানে শূন্য সেখানে বস্তুর ভরও শূন্য। কৃত্রিম উপগ্রহগুলো এই নিউট্রাল জোনে ভেসে থাকে। হ্যাঁ। চাঁদ ও পৃথিবীর মাঝখানে এমন একটা বিন্দু খুঁজে বের করা সম্ভব। তবে সেটা হবে চাঁদের সাথে সঞ্চরণশীল এবং পৃথিবী থেকে তিন লাখ বিশ হাজার কিলোমিটার এবং চাঁদ থেকে পঁয়ষট্টি হাজার কিলোমিটার দূরত্বে একটা মাত্র বিন্দু। সেখানে একটা উপগ্রহ স্থাপন করা গেলেও টিকিয়ে রাখা যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা চাঁদ বা পৃথিবীর দিকে রওনা করবে। এবার আমরা প্রকৃত ব্যাপারটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
কৃত্রিম উপগ্রহের ধারণাটি এসেছে প্রাকৃতিক উপগ্রহ (চাঁদ) থেকে। এবং মজার বিষয় হলো ধারণাটা প্রথম এসেছে একজন গল্পকারের মাথায়। এডওয়ার্ড ইভারেট হেল নামে একজন মার্কিন ছোট গল্পকার ১৮৬৯ সালে দ্য ব্রিক মুন নামে একটা ছোটগল্প লেখেন।
(কাকতালীয়ভাবে এর ঠিক একশ বছর পর এপোলো-১১ চাঁদে অবতরণ করে।) গল্পটা দ্য আটলান্টিক মান্থলি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায় ইট দিয়ে বানানো দুইশ’ ফুট ব্যাসের একটা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভেতরে বসে এর চালকরা ভুল বোতামে চাপ দেন। ফলে কক্ষটি নিজেই পৃথিবীর বাইরে চলে যায় এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। এর দশ বছর পর জুল ভার্ন তার দ্য বেগমস ফরচুন নামের উপন্যাসে এই ধারণার একটা উন্নত সংস্করণ প্রকাশ করেন। কোলকাতা থেকে উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় একই সময়। ধনাঢ্য এক ভারতীয় বেগমের চরিত্র থাকায় উপন্যাসটি বাঙালিদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। আগ্রহীরা এই লিংক-
(https://ia801402.us.archive.org/22/items/begumsfortune00vernrich/begumsfortune00vernrich.pdf)
থেকে ইংরেজি সংস্করন ডাউনলোড করে পড়তে পারেন। ১৯০৩ সালে এক্সপ্লরিং স্পেস ইউজিং জেট প্রপালশন ডিভাইসেস নামে একটা বই লিখে কৃত্রিম উপগ্রহের ধারণার প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন কনস্তানতিন সিলকভোস্কি। এর পরের ইতিহাসও কিছুটা সোভিয়েতদের পক্ষে ছিল। স্পুটনিক উৎক্ষেপণের পর চাঁদে প্রথম তারাই ধাতু ফলক ফেলে আসে। কিন্তু চাঁদে মানুষ নামিয়ে মহাকাশ জয়ের দৌড়ে এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র।
ছোটবেলায় ভূগোল পড়ে যখন অনেক জ্ঞান হলো তখন আমরা বন্ধুদের প্রশ্ন করতাম, “পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে কেনো?” তারা উত্তর দিতো, “পেটের দায়ে।” এই কৌতুকে লুকিয়ে থাকা গভীর প্রমোদোপকরণ আমাদের বিপুলভাবে আমোদিত করতো। তবে বাস্তবেও পৃথিবী পেটের দায়ে ঘোরে না। তার পেটে প্লেনের মতো জ্বালানি নেই। একইভাবে কোন ইঞ্জিন বা জ্বালানি ছাড়াই কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। গতি ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি পায় কোথায়? চাঁদেরও কোন ইঞ্জিন নাই। তাহলে চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে কেন? করছে একারণে যে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণজনিত বল এবং চাঁদের মুক্তিবেগ সমান। অর্থাৎ গতি জড়তার জন্য চাঁদ যে শক্তিতে বাইরে চলে যাবার চেষ্টা করছে একই শক্তিতে পৃথিবীও চাঁদকে টেনে রাখছে। ফলে একটা উপবৃত্তাকার পথে চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। কক্ষপথে চাঁদের গতি সেকেন্ডে ১.০২২ কিলোমিটার। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখলেন পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে যদি কোন বস্তুকে স্থাপন করতে হয় তাহলে তার গতি চাঁদের গতির থেকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দিতে হবে। দূরত্ব ভেদে সেটা নির্ধারণ করতে হবে। এখন থেকে ২০০ বছর আগেই বিজ্ঞানীরা এটি জানতেন; কিন্তু তাঁদের হাতে এই তত্ত¡ বাস্তবায়নের প্রযুক্তি ছিল না। এবার দেখা যাক ঠিক কীভাবে একটা কৃত্রিম উপগ্রহ শূন্যে ভেসে থাকে।
উপরের ছবিটি লক্ষ করুন। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে একটা উপগ্রহকে রকেটের সাহায্যে A বিন্দুতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেটাকে ঐ বিন্দুর জন্য প্রযোজ্য মুক্তি গতির সামান্য কম গতিতে T বিন্দু লক্ষ্য করে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ঐ গতিপথে কিছু বিচ্যুতি ঘটে। ফলে উপগ্রহটি T বিন্দুতে না গিয়ে MU বরাবর চলতে শুরু করে। আবার U বিন্দুতে পৌঁছার আগেই পৃথিবীর টানে সে NV বরাবর চলতে শুরু করে। এভাবে উপগ্রহটি পর্যায়ক্রমে NV, OW, PX, QY, RZ পথে যেতে চেষ্টা করে প্রতিবারই ব্যর্থ হয় এবং যথাক্রমে OW, PX, QY, RZ এবং (পুনরায়) ST পথে চলতে শুরু করে। ফলে কার্যত উপগ্রহটি কেন্দ্রাভিগ বল (Centripetal Force) এবং কেন্দ্রাতিগ বলের (Centrifugal Force) লব্ধি বরাবর চলতে গিয়ে একটা বৃত্তাকার পথ অনুসরণ করে। ছবিতে বাইরের বৃত্তটি হলো ভূ-উপগ্রহের কক্ষপথ। আমরা লক্ষ করলে দেখব যে A,B,C,D,E,F এবং G বিন্দুতে উপগ্রহটি ঐ বৃত্তকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটি হলো উপগ্রহটি আসলে ঐ বৃত্তের উপর দিয়েই চলছে। আমরা যদি হাজার খানেক রেখা দিয়ে ঐ গতিপথটি আঁকতে পারতাম তাহলে দেখতাম উপগ্রহটি প্রত্যেক মিলিমিটারে বৃত্তটিকে স্পর্শ করছে। এবং গতিপথটিকে মোটামুটি নিখুঁত একটা বৃত্তের মত দেখাচ্ছে। ইউটিউবে এই ভিডিওটি দেখে নিলে পরের বিষয়টুকু বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে: https://www.youtube.com/watch?v=IC1JQu9xGHQ
তাহলে কোন শহরের উপর একটা উপগ্রহকে স্থির অবস্থায় ভাসিয়ে রাখা সম্ভব হয় কীভাবে? আহ্নিক গতির জন্য আসলে পৃথিবীর কোন বিন্দুই স্থির নয়। পৃথিবী যখন নিজ অক্ষের ওপর ঘোরে তখন ঐ শহরটিও ঘুরতে থাকে। বিষুবরেখায় এই ঘোরার গতি ঘণ্টায় ১০৪১ মাইল। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ মাইল উপরে যদি কোন উপগ্রহ স্থাপন করতে হয় তাহলে ঘণ্টায় তার গতিবেগ হতে হবে ২৬১৬ মাইল। উপগ্রহটিকে যদি পৃথিবীর আহ্নিক গতির দিকে অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এই গতিতে চালিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরতে থাকবে। তাই যে শহরের সাথে এটা ঘুরছে সেই শহর থেকে এটাকে স্থির দেখা যাবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটও একটা ভূ-স্থির উপগ্রহ। এটা ১১৯ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার ভূ-সমলয় স্লটে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে এটা সবসময় 119.1° ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার ভূ-স্থির স্লটে অবস্থান করছে। নিচের ছবিটি লক্ষ করুন।
ধরে নেওয়া যাক উপগ্রহটিকে আমরা ঢাকা শহরের ঠিক উপরে স্থিরভাবে স্থাপন করতে চাই। ধরা যাক ঢাকা শহরের অবস্থান D বিন্দুতে। তাহলে উপগ্রহটির অবস্থান হবে A বিন্দুতে। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে ঢাকা একসময় E বিন্দুতে চলে আসবে। উপগ্রহটি তখন পৌঁছাবে B বিন্দুতে। আবার ঢাকা যখন F বিন্দুতে পৌঁছাবে তখন উপগ্রহের অবস্থান হবে C। ফলে ঢাকা থেকে উপগ্রহটিকে সবসময় মাথার ওপরে স্থির অবস্থানেই দেখা যাবে।
পৃথিবীর চারিদিকে উপগ্রহ ছাড়াও বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে মোটামুটি হাজার পাঁচেক বস্তু ভেসে বেড়াচ্ছে। এগুলো সবই কৃত্রিম উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষ বা ছুটে যাওয়া কোন খন্ড। এর মধ্যে দুটি ক্যামেরা, চারটি গ্লাভস এবং পাঁচটি হাতুরিও আছে। কোন নভোচারী যদি ভূ-উপগ্রহের বাইরে গিয়ে আর ফিরতে না পারে তাহলে সে-ও পৃথিবীর একটা উপগ্রহে পরিণত হবে এবং কোন জ্বালানি ছাড়াই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে।
পৃথিবীর ভর ছয় লক্ষ কোটি কোটি টন। এরকম বিপুল ভরের একটা বস্তু সূর্যেকে প্রদক্ষিণ করার সময় প্রতি সেকেন্ডে অতিক্রম করে সাড়ে আঠারো মাইল পথ। যে বিধিটি আমরা কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য ব্যাখ্যা করলাম সেই একই বিধি পৃথিবীর জন্যও প্রযোজ্য। পৃথিবীও প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করছে সরল পথে সূর্যের আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু সূর্যের আকর্ষণ সেই পথে যে বক্রতার সৃষ্টি করছে সেটা একটা উপবৃত্ত বা পৃথিবীর কক্ষপথ। বিগত সাড়ে চারশ’ কোটি বছর ধরে এ পথেই বিচরণ করছে আমাদের বর্তমান আবাস এই নীল গ্রহ। বিজ্ঞনীরা বলছেন বাকি আছে আরও সাড়ে পাঁচশ কোটি বছর। এ সময়ের মধ্যে যদি পৃথিবীর গতি কোন কারণে বেড়ে যায় তাহলে আমাদের নিয়ে পাইওনিয়ার ১১-র মত সে অনন্ত মহাশূন্যে ভেসে যাবে। বিশাল আকৃতির কোন গ্রহাণু যদি গতির অনুক‚লে পৃথিবীকে ধাক্কা দেয় তাহলে এরকম ঘটতে পারে। আর প্রতিক‚লে ধাক্কা দিলে পৃথিবীর গতি কমে যাবে। তখন আমাদের নিয়ে সূর্যের অতল অগ্নিগর্ভে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া তার সামনে পথ খোলা থাকবে না। যদি খুব বড় কোন গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী কক্ষপথে থেমে যায় তাহলে সূর্যে পৌঁছুতে আমাদের সময় লাগবে ১৫৪৮ ঘন্টা বা সাড়ে চৌষট্টি দিন। তবে শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে মোটামুটি ১০ দিন সময় পাওয়া যাবে। ভেবে রাখুন সে ইচ্ছার তালিকায় কী কী থাকতে পারে!
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।