ইচক দুয়েন্দে : ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেন ইচক দুয়েন্দে। জীবনের অধিকাংশ সময় বসবাস করেছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পদ্মা-বিধৌত নগরী রাজশাহীতে। কাজ করেছেন কৃষি খামার পরিচালক, গ্রন্থ সম্পাদক এবং ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক হিসেবে। ইচক দুয়েন্দে’র অন্য বই: We Are Not Lovers (ইংরেজি উপন্যাস) এবং টিয়াদুর (মহাগপ্প)।
১১.
‘মা, আপনার নাম জানতে পারি কি?’ সবিনয়ে প্রশ্ন করে লালু পাঞ্জুমম। তাদের ঘরের সামনে আরেকটি ঘর। দু’টো ঘরের মাঝে চার ফুট করিডোর। সামনের ঘরটির গরাদ-দরজার উপরে লেখা ‘পুরুষ’। ঐ ঘরটায় আছে শুধু একজন, সে এক বালিকা। লালু-র প্রশ্নটি তার উদ্দেশে। ইতোমধ্যে সান্ত্রি বদল ঘটেছে। নয়া সান্ত্রিকে কিছু বখশিশ দিয়ে লালু এই কথা বলবার অধিকার লাভ করেছে।
‘মেরা নাম তিঞ্জি খর্খর, আমি একটা গিরগিট্টি টিকটিকি,’ হি হি হেসে বালিকাটি উত্তর করে। সে লম্বায় হবে দুই হাত। চুল ঝাঁকড়া লাল। গায়ের রং হলুদাভ লালচে ফর্সা। পুষ্ট গোলগাল শক্তিশালী দেহ। চোখ টলটলে স্বচ্ছ দীপ্ত। গালে টোল। কপালে টিপ সোনালি। পরিধানে তার কী ছিল বলা শক্ত।
লালু পাঞ্জুমম ব্যাকুল স্বরে তিঞ্জি খর্খরকে বলে, ‘আপনেরে আমি খুব পছন্দ কর্ছি এবং আমি নিশ্চিত আমার বউও আপনেরে দেখবেন এবং পছন্দ কর্বেন। অনেকদিন ধইর্যা আমরা একটা বাচ্চা খুঁজিচ্চি। আমাদের কোনো বাচ্চা নাই। আমাদের বাচ্চা হইয়্যা যান আপনে। আমি জানলাম আপনের কোনো বাপ মাউ নাই। অথবা থাকলিউ বাস্তবিক তারা আপনের কোনো খোঁজখবর রাখেন না। আপনি পড়ালিখা কর্বেন। ইশকুলে যাবেন। ভালোমন্দ খাবেন। টিভি দ্যাখবেন। আমাক আব্বা বলে ডাকবেন, আর আমার বউরে মা কবেন। আমাদের জান ভইর্যা যাবে।
‘শুধু একটা কথা। কথার কথা। যা আমি শুনছি। এবং এক কান দিয়া শুনিয়া আরেক কান দিয়া বাহির কইর্যা দিছি। তবু জিজ্ঞাস কর্তি হয়, তাই কর্যা। এরা কওয়া কওয়ি করে যে আপনে একটা খুন কর্ছেন। যদিও আমি তাতে পেত্যয় যাই না। আসলেই আপনে কি একটা খুন কর্ছেন? আমি শুধু একবারের তরে শুনতে চাই, আপনি সত্যি করে কয়ে দেন, ‘না আমি কোনো খুন করি নাই’,’ লালু পাঞ্জুমম অবশেষে থামে।
‘খুন আবার কী? সে কী গায়ে মাখে না চুলে দেয়?’ বিস্ময়জড়িত কণ্ঠে তিঞ্জি খর্খর বলে।
প্রায় হাততালি দিয়ে ওঠে লালু পাঞ্জুমম, ‘আমি বুঝিছি। আমি বুঝিছি। মা, আপনে খুন করেননি। আপনে তৈরি হন। চলেন আমার সঙ্গে। আমি এখন থেকি আপনের আব্বা।’
‘আমার আব্বা হল বিরগিট্টি, তুই আমার আব্বা না। মেরা নাম তিঞ্জি খর্খর। ভাগ্,’ তিঞ্জি খর্খর বলে।
‘আপনের আব্বা তো পচা। তিনি তো আপনের কোনো খোঁজখর্বর লন না। এই যে আপনে লালঘরে আছেন, তিনি তো কোনো খোঁজ লইলেন না। এই দিকে আমি আপনেরে দেখছি, আর আমার মনে মায়্যা পইড়্যা গেল। আমি ভাবি আর ভাবি কিসে আপনের মঙ্গল হয়। মা চলেন। আপনে খুব ভালো মেয়্যা, আমি বুইজ্ঝা গেছি,’ লালু পাঞ্জুমম বলে।
‘আমার আব্বু বিরগিট্টি বির্রাশি হাত লম্বা। এক লাফে পার হয় এক খাল। দুই লাফে পার হয় এক নদী। আমি গিরিগিট্টি টিকটিকি অর গায়ে বেড়াই সুরুত সুরুত। অর চুলে আমার বাসা। ঘুমাই নাকুস নুকুস মজা। অক্ চিমটি কাটায় হয়েছে আমার সাজা। ফুস ফা। আমার আব্বু দুই আঙুল দিব এই দরজার ভিত্তর ত্তো সগ শিক হইয়া যাব বাঁকা, আমার এক কান ধরিয়া মারিব টান তো আমি পগাড় পাড়। তুই অযথা ইচ্ছা করস না পিলপু উজ্জিরের বেটা। তোর রান দিয়া কাবাব বানাব। দেখ আমার সিনা,’ তিঞ্জি খর্খর এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে লালু পাঞ্জুমম ও তার সঙ্গীরা চোখ বন্ধ করে।
‘তুই জানিস আমার চল্লিশ পোলা আর পঞ্চাশ মাইয়া। এক হাঁক পাড়ব তো সক্কল হাজির। তোক খায়া ফেলাব। হি হি হি হি। তুই হজাম হয়্যা যাবি। লিচি পালচি উলা যা,’ এই কথাগুলি বলার পর তিঞ্জি খর্খর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
ঠিক ঐ সময়ে দুই গরাদ-দরজার মাঝখানে করিডোরে হাজির হয় তিন সান্ত্রি। সেখানে উপস্থিত সান্ত্রিকে তারা বলে তিঞ্জি খর্খরের গরাদ-দরজার তালা খুলতে। তারা তাকে আদালতে নিয়ে যেতে এসেছে।
যেইমাত্র লালু পাঞ্জুমম ঐ সান্ত্রিগুলির উদ্দেশ্য বুঝতে পারে, সে হৈ হৈ হাউহাউ করে ওঠে। ‘টাকাগুলা দেন,’ বলেই সে মিয়ান টিনটুই-এর কাছ থেকে সবগুলো টাকা প্রায় কেড়ে নেয়, যা উল্লাস ছাপ্পান্ন দিয়েছে মিয়ানকে।
লালু পাঞ্জুমম টাকাগুলি সান্ত্রিদের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, ‘দয়া করে এই টাকাগুলি নেন। আমার মেয়েটাকে নিয়ে যাবেন না। সে আমার আপন মেয়ে। আরো টাকা লাগে পরে দিব। জমি বিক্রি কইর্যা দিব।’
‘এই মেয়েটার মাথায় ছিট, জানতাম,’ বলে সান্ত্রিদের মধ্যে থেকে একজন। ‘ইতিমধ্যে আমাদের পুরা ডিপার্টমেন্টে প্রর্চার হয়ে গেছে আপনারা বেআক্কেল লোক। আপনি কী মনে করে আমাদেরকে টাকা দিতে যাচ্ছেন? যখন হুকুম হইছে, দুনিয়া উল্টে গেলেও এ্যাক আমরা নিয়া যাব আদালত। লাখ টাকা দ্যান, কোটি টাকা দ্যান, কোনো কাজ হইব না। বেআক্কেল।’
‘আপনারা সব পারেন,’ অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে আবেগভরে বলে লালু পাঞ্জুমম। ‘আপনারা ফাঁসির আসামির বডি চেঞ্জ কইর্যা বাঁচাইয়া দিতে পারেন। নিরীহ লোককে ফাঁসির আসামি বানাইতে পারেন। আমার মেয়েটাক এখানে রাখে যান। আমি ইনার সব কাগজপত্র পরিষ্কার করি নিব। ইনি অত্যন্ত খাঁটি মিয়া। না জেনে, না শুনে, তিনি বলে ফেললেন আমার আব্বার নাম ‘পিলপু উজির’। ইনি আমার মা, ইনি আমার কন্যা। ইনাক আমি বাঁচাব। ইনি আমার জীবন। ইনিই আমার ভবিষ্যৎ। আমি আমার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ইনাক বাঁচাব।’
‘ঐ সবই গুজব। ডাহা মিথ্যা কথা। আমরা হুকুমের দাস। আইনের নিয়মে আমরা বাঁধা। হাকিম নড়ে, কিন্তু হুকুম নড়ে না। দরজা খোল। কোর্টের টাইম যায় যায়,’ সান্ত্রিটি তার বা তাদের পুরোপুরি অপারগতা প্রকাশ করে।
লালু পাঞ্জুমম আরো বিভিন্নভাবে তাদেরকে অনুরোধ করে। তার কথাবার্তা ক্রমে অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। তার কথাবার্তায় সান্ত্রিরা হয়ে ওঠে ভীষণ অসন্তুষ্ট। অবশেষে লালু পাঞ্জুমম যখন দেখে তার কথা রাখা হচ্ছে না ও গরাদ-দরজা খুলে তিঞ্জি খর্খরকে নিয়ে সান্ত্রিরা চলে যাচ্ছে, হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে মিয়ান টিনটুইকে জড়িয়ে ধরে।
‘লিচি পালচি উলা যা,’ যাবার সময় তিঞ্জি খর্খর এই কটি শব্দ বারবার আউড়ায়।’
তিঞ্জি খর্খর ও সান্ত্রিরা চলে যায়।
সেখানে প্রহরারত সান্ত্রিতখন মুখ খোলে, ‘আপনাদের কথাবার্তা বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে আপনারা এই দেশের মানুষ না। ঐ যে উনি, যিনি ঐ মেয়েটাকে দত্তক নিতে চাইলেন, মেয়েটার সঙ্গে এমনভাবে আপনি টাপনি করে কথা বলতে লাগলেন যে আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেছি। উনার চেয়ে বয়সে কতো ছোট, হয় তুই, না হলে তুমি বলবেন। কিন্তু কী ঢং। আপনারা সত্যি করে বলেন তো, আপনারা কি এই দেশের নাগরিক, না প্রতিবেশী দেশ থেকে এসেছেন? রিমান্ডে নিলে সব বেরিয়ে যাবে। (এ-সময়ে মিয়ান টিনটুই তার দিকে চা খাবার জন্য কিছু মুদ্রা বাড়িয়ে দেয়)। আচ্ছা, আচ্ছা, আপনারা প্রফেসর, অতিরিক্ত পড়ালেখা করে মাথা খারাপ করে ফেলেছেন।’
‘বুঝলেন। অর্ডার। অর্ডার হল, আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অর্ডার হল, আমি ঘুমালাম। অর্ডার হল, আমি খালাম। অর্ডার হল, আমি বদলি হলাম। অর্ডার হল, আপনাক ধরলাম। অর্ডার হল, আপনাক কোর্টে চালান দিলাম। অর্ডার হল, আপনাক জেলে রেখে আলাম। অর্ডার হল, আপনাক ছাড়ে দিলাম। আমাকে কে অর্ডার দিল? আমার বস দিল। তাকে কে অর্ডার দিল? তার বস দিল। তাকে কে অর্ডার দিল? তার বস দিল। তাকে কে অর্ডার দিল? তার বস দিল। তার বসকে কে অর্ডার দিল? তার বস। সকলেই বলল, ইয়েস স্যার।’
‘অর্ডার হইল, ফাঁসি হইল। অর্ডার আসিল, ফাঁসি থামিয়া গেল। অর্ডার হইল, বডি চেঞ্জ হইল। ফাঁসির আসামি বাঁচিয়া গেল। আপনার বডিতে গাঞ্জা পাওয়া গেল। অর্ডার হইল, যদু মিঞার বডিতে গাঞ্জা বাহির হইল। অর্ডার হইল, আপনারা পড়িলেন ধরা, অর্ডার হইল আপনারা পাইলেন ছাড়া।’
‘অর্ডার, অর্ডার। অর্ডারই সব। অর্ডারই মা-বাপ। যে-দিন অর্ডার কম হয়, যে-দিন কোনো অর্ডার আসে না, মনে হয় সব ফাঁকা। খাবার বিস্বাদ। খামাকা। অর্ডার হইব। খাড়াক দাঁড়াইব। স্যালুট দিব। বলিব, ইয়েস স্যার।’
‘কিন্তু সবই নিয়মের মইদ্যে। এক চুল নড়িবার উপায় নাই। আপনারা প্রফেসর। কিন্তু এই বিষয়গুলি আপনারা বুঝেন না, আমি আশ্চর্য হইয়া যাই। যাই।’
১২.
‘দেখুন, দেখুন, এরা হল মানুষ গড়ার কারিগর, প্রফেসর,’ চুলে ঝুঁটিবাঁধা, পাঞ্জাবি ও জিনসপরা এক ভদ্রলোক আঙুল তুলে তার সঙ্গীদের দেখায় হাজত ঘরে আটক এগারজনকে। চুলে ঝুঁটি’র সঙ্গীরা, যারা হবে সংখ্যায় ছয়-সাতজন, বিস্মিত-আনন্দিত ঘনিষ্ঠ চোখে তাদেরকে দেখে। ‘হুম! আপনারা শিক্ষক। ছাত্রদেরকে কী শেখাবেন বা শেখাচ্ছেন তার চমৎকার নমুনা দিলেন।’
‘হুম! আমরা সরাসরি এসি সাহেবের চেম্বার থেকে আসছি। উনি বললেন, যদি বিশ্বাস না হয়, যান আপনারা নিজের চোখে দেখে আসেন, কাদেরকে হাতেনাতে ধরে ফেলছি। তাই না এসে পারলাম না।’
‘আপনাদের মতো লোকদের কারণেই আমাদের সমাজটা অধঃপতনে চলে যাচ্ছে। আমার সুস্পষ্ট পরামর্শ, যখন কোনো শিক্ষিত লোক এ-ধরনের অপরাধ করবে, তাদেরকে প্রকাশ্য মাঠেগুলি করে হত্যা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এরকম অপরাধ করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে না পারে।’
‘আমি সব সব শুনেছি, আপনাদের নিজেদের সাফাই আর গাইতে হবে না। ’
‘মদ খেয়ে, মাতাল টইটম্বুর হয়ে নদীর চরে আপনারা হৈহল্লা, নাচগান করছিলেন।’
‘সুন্দর বিকেল। পরির মতো অপরূপ দুই ষোড়শী এসেছে নদীতীরের সুশীতল বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ নিতে। তারা ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির মতো। মনে তাদের স্বপ্ন, দেখবে তারা স্বর্গীয় সূর্যাস্ত।’
‘কিন্তু তারা জানে না, সুসভ্যের ছদ্মবেশে একদল বর্বর, তাদের পিছু নিয়েছে।’
‘ঐ বর্বর, মানবতার দুশমনদের অধিকাংশের গায়েই নেই কোনো জামা, একজন এমনকি উলঙ্গ হয়ে পড়েছে।’
‘ষোড়শী দু’টির সাহসের আমি প্রশংসা না করে পারি না। দেশে যে বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি চলছে তার মধ্যেও তারা প্রকৃতির আনন্দ অবগাহন করতে একটুও পিছপা নয়।’
‘তারা লক্ষ্য করল একদল জংলি তাদের অনুসরণ করছে, না তবুও তাদের বুক একটুও কাঁপল না। তারা ভান করল, যেন তারা দেখতেই পাচ্ছে না, জংলিগুলোকে।’
‘ষোড়শী দু’টো দুই প্লেট ফুচকা অর্ডার করল। ধীরেসুস্থে চারিয়ে চারিয়ে তারা ফুচকা খেল। জংলি বর্বরগুলো সেখানেও হাজির। তারাও অর্ডার করল ফুচকা। এবং হাভাতের মতো খেল।’
‘ফুচকা খেয়ে ষোড়শীদ্বয় মনের আনন্দে পরস্পরের সঙ্গে বকবক করে চলেছে, তারা ঢলে পড়ছে একে অপরের গায়ে।’
‘তাদের দেখাদেখি ঐ বেহেড মাতালগুলি, ঐ জংলিগুলি, ঠিক ঐ কাজটিই শুরু করল। একে অপরের গায়ে ঢলাঢলি করতে লাগল।’
‘যখন দুই ষোড়শী একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে, যখন দুই পুষ্প শাখা একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে, সৃষ্টি হয় এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যের। কিন্তু যখন কিছু জংলি বুরবক তথাকথিত যুবক সেই একই কাজ করে, তা হয়ে ওঠে জঘন্য, দৃষ্টিপথে তা ঠেকে বিদ্ঘুটে।’
‘ঠিক তাই ঘটেছিল, আমাদের এসি ভাইয়া ল্যুইস নারা-র চোখে। তিনি নদীতীরে এক নৌকার গলুইয়ে বসে দূরবিন চোখে নিসর্গ দেখছিলেন। কিন্তু সত্যিই তিনি নিসর্গের সৌন্দর্য দেখছিলেন না। তিনি নদীতীরে গিয়েছিলেন একটা সিক্রেট মিশন নিয়ে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে।’
‘দূরবিনে তিনি আকাশের পাখিদের দেখলেন। দেখলেন দূরের নৌকাদের। চরে ছুটোছুটি করা বাচ্চাদের দেখে তার মনে পড়ে গেল তার শৈশবের কথা।’
‘এভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎই ল্যুইস ভায়ের চোখে পড়ে গেল দুই ষোড়শী। আর তিনি দেখতে পেলেন একদল নির্মম গুণ্ডা তাদেরকে ঘিরে ফেলবার পথে।’
‘তাঁর রক্তটা টগবগ করে উঠল। ভাবলেন, বৃথাই আমি ট্রেনিং নেইনি। এই নদীচরের পবিত্রতাকে এক সঙ্ঘবদ্ধ চক্র কলুষিত করে চলেছে। আজকে তিনি তাদের দেবেন সমুচিত শিক্ষা।’
‘দূরবিনে ওদের অবস্থান আবারো তিনি ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর খালি চোখে ওদের অবস্থান বুঝে নিলেন। তারপর খালি হাতে চরে নেমে একটু হালকা শরীরচর্চা সেরে নিয়ে, মনে মনে দ্রæত পরিকল্পনা ছকে নিয়ে, তাঁর বাহিনীকে তলব করে, ল্যুইস ভাইয়া অকুস্থলের দিকে ধাপ বাড়ালেন।’
‘আপনারা প্রফেসরের ছদ্মবেশী মানবতার দুশমনরা জানতেন না, আপনাদের যম রওনা হলেন অভিযানে।’
‘এসি ল্যুইস ভাই অকুস্থলে পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ষোড়শীদ্বয় তখনও একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করে মনের আনন্দে চরের মধ্যে দিয়ে নেচে নেচে চলেছে। একদল ধেড়ে শয়তান যে তাদেরকে অনুসরণ করছে, এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।’
‘এসি ল্যুইস নারা একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ সুযোগ্য অফিসার। তিনি বুঝতে পারলেন ঐ ষোড়শীদের মধ্যে একটা আত্মরক্ষা কৌশল কাজ করছে। ওরা ভাবছে, ওরা নিরুদ্বিগ্ন থাকার ভাব করলেই, আক্রমণকারী বা ঘাতকরা ওদের পেয়ে বসবে না।’
‘কিন্তু এসি ল্যুইস ভাই জানতেন, পেশাদার অপরাধীদের এভাবে থামানো যায় না। ওরা তাদের লক্ষবস্তুতে আঘাত হানবেই। তাই তিনি দ্রুত এগুলেন।’
‘কাছাকাছি পৌঁছে তিনি শুনলেন, ঐ জংলিগুলো গান গাচ্ছে, উদ্দেশ্য দুই ষোড়শীর মনোরঞ্জন। সবচেয়ে যেটি ছিল মারাত্মক, ষোড়শীদ্বয়ের সম্ভাব্য গতিপথে তারা একটা পিরামিড বানিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পিরামিডটার প্রথম ধাপে ছিল ৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ২ জন, এবং শীর্ষে এক জন। ঐভাবে পিরামিড বানিয়ে তারা শিস দিচ্ছিল, চিলচিৎকার করছিল, অশ্লীল, মুখে আনা যায় না এমনসব বাক্য বলছিল ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিল।’
‘কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার, ষোড়শীদ্বয় তখনও ভ্রূক্ষেপহীন, চরে প্রস্ফুটিত একগুচ্ছ নীল ফুলের গন্ধ শুঁকছে।’
‘এসি ল্যুইস ভাই মনে মনে আলেক্সান্ডারের মতো বললেন, ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’ যা বুঝবার তিনি বুঝে গেলেন। মামলাটা দাঁড়াবে না। শিকার প্রশ্রয় দিচ্ছে শিকারীদের।খুব খারাপ। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কর্তব্য পালনে তিনি পিছপা হবেন না।’
‘আপনাদের এগারজনের সামনে গিয়ে এসি ল্যুইস ভাই দাঁড়ালেন। তাঁর কাছে দু’টি রিভলভার। একটি বাহিনীর ও আরেকটি তাঁর ব্যক্তিগত প্রিয় মাউজার।’
‘তিনি ইচ্ছা করলে, দুই হাতে দুই রিভলভার ধরে তক্ষনি আপনাদের ধরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি ঝুঁকি নিলেন না। আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আপনাদেরকে ব্যস্ত রাখলেন। বাহিনী এসে গেল, আপনারা গ্রেফতার হয়ে গেলেন।’
‘এসি ল্যুইস ভাই, পায়েল ও দোয়েলকে, হ্যাঁ, ষোড়শীদ্বয়ের নাম, বললেন কোনো ভয় নাই। তারা অভিযোগ করুক তিনি সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ওরা কিছুতেই রাজি হল না। ওরা শুধু হাসে। শেষে এসি ল্যুইস ভাই, ঐ পায়েল-দোয়েলকে নিজ খরচায় দুই প্লেট ফুচকা খাওয়ালেন। তারপর তাঁকে ধন্যবাদ-টন্যবাদ দিয়ে, ‘ভাইয়া আবার দেখা হবে,’ ইত্যাদি বলে তারা চলে গেল।’
চুলে ঝুঁটি ভদ্রলোকের গল্প শেষ হয়।
‘ডাহা মিথ্যা। সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমরা ঐ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত ছিলাম না,’ রজেট চিনচুই বলে।
‘আইনের হাতে পড়লে, প্রথমে সক্কলেই এমন অস্বীকার করে। কিন্তু যখন উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দেখা দেয়, তখন সকল সাধুই বাপ-বাপ বলে সব স্বীকার করে ফেলে। মহিলাদের উত্যক্ত করা খুব মারাত্মক অপরাধ। বিরাট শাস্তি হয়ে যেতে পারে। আপনাদের চাকরিবাকরি শেষ,’ বলে চুলে ঝুঁটি ভদ্রলোক।
‘আপনি কি সাহিত্যিক?’ ফিজ ফ্যাল প্রশ্ন করে।
‘না। আমি একজন সাংবাদিক,’ চুলে ঝুঁটি ভদ্রলোক বলে।
(চলবে)