রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

উনিশতম.
ষষ্ঠ অধ্যায়
চমকপ্রদ ঘটনার প্রত্যাশায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পরের বছর ওয়াল্টের ভায়ের ছেলে রয় ডিজনি আর ডিজনির সবচেযে বড় শেয়ার হোল্ডার সিড ব্যাস মাইকেলকে প্রধান নির্বাহী এবং চেয়ারম্যান করে কোম্পানিতে আনলেন এবং ফ্রাঙ্ক ওয়েলসকে প্রেসিডেন্ট করলেন। উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয়া এবং কোম্পানিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। (মাইকেল তখন প্যারামাউন্ট পরিচিালনা করছিলেন এবং ফ্রাঙ্ক ছিলেন ওয়ার্নার ব্রোসের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী)। তাঁরা দুজনে জেফ্রি কিটজেনবার্গকে নিয়োগ দিলেন, তিনি মাইকেলের অধীনে প্যারামাউন্টে কাজ করতেন। তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ডিজনি স্টুডিও পরিচালনার জন্য। জেফরি আর মাইকেলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডিজনি অ্যানিমেশন পুনরায় জীবন ফিরে পেল। ডিজনি ব্রান্ডের জনপ্রিয়তা ফিরে আসল। ভোগ্যপণ্য সেক্টরে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটে। তারপর তারা ডিজনির টাচস্টোন ছবি নির্মাণে অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠলেন। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমানও বাড়িয়ে দিলেন। নির্মাণ করলেন কিছু লাইভ-অ্যাকশন নন-জি-রেটেড জনপ্রিয় ছবি, যেমন রুথলেস পিপুল এবং প্রেটি উয়োম্যান।

মাইকেলের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি চাতুর্যপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তাঁর পূর্ব ধারনা ছিল ডিজনি একটা অসাধারণ মূল্যবান সম্পদের উপর দন্ডায়মান। যেটাকে এখনও তাঁরা খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে পারেননি। তাঁর মধ্যে একটা হচ্ছে ডিজনি পার্কের জনপ্রিয়তা। এমনকি তাঁরা যদি টিকেটের মূল্য সামান্য বৃদ্ধি করে তবে তাঁদের মোট আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটবে। এবং দর্শক সমাগমেও তেমন প্রভাব পড়বে না। ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডে হোটেল নির্মাণ আর একটা অনাবিস্কৃত উদ্যোগ। মাইকেলের প্রধান নির্বাহী হবার প্রথম দশকেই তিনি অসংখ্য নতুন হোটেল চালু করেন। তারপর তিনি থিমপার্ক স¤প্রসারণে মনোনিবেশ করেন। ফ্লোরিডায় নির্মাণ করলেন এমজিএম-হলিউড-স্টুডিও (এখন এটির নাম হলিউড স্টুডিও)। প্যারিসের বাইরে নির্মাণ করলেন ইউরো ডিজনি (এখন এটির নাম ডিজনিল্যান্ড, প্যারিস)।

আরও আশা জাগানিয়া ছিলো মূল্যবান আনন্দদায়ক মেধাসত্বের দোকান। পুরানো ডিজনি চলচ্চিত্রের সমাহার দিয়ে পূর্ণ ছিল এই দোকান। ওখানে বসে থেকে শুধুমাত্র টাকা পয়সা রোজগার করা। পুরানো ডিজনি চলচ্চিত্রের ভিডিও ক্যাসেট বিক্রি শুরু হলো। মা-বাবা যে সমস্ত চলচিত্র থিয়েটার হলে বসে উপভোগ করেছিলেন এখন সেগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তঁদের বাচ্চাদের দেখানোর জন্য। এটি বিলিয়ন ডলারের ব্যাবসায় পরিণত হলো। তারপর ১৯৯৫ সালে তাঁরা কেপসিটি/এবিসি অধিগ্রহণ করলেন। বিশাল টিভি নেটওয়ার্কের মালিক হয়ে গেলেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ইএসপেএনের মালিক হওয়া। তখন ইএসপিএনের দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা ছিল একশ মিলিয়নেরও বেশি। এ সমস্তকিছুই প্রমাণ করে যে মাইকেল একজন অতিমাত্রায় সৃজনশীল চিন্তাবিদ এবং ব্যাবসায়ী। তিনি ডিজনিকে আধুনিক বিনোদনের প্রানকেন্দ্রে রূপান্তর করেন।

আমাকে ডিজনির দ্বিতীয় ব্যক্তির দ্বায়িত্ব দেবার পর আমরা আমাদের দ্বায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলাম। মাইকেল ওয়ল্ট ডিজনি স্টুডিও সমূহ এবং ডিজনি পার্ক ও রিসোর্ট সমূহ প্রথমিকভাবে দেখা শোনার দ্বায়িত্ব পেলেন। আর আমি মনোনিবেশ করলাম গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক সমূহে, ভোগ্য পণ্য সমূহ এবং ওয়াল্ট ডিজনি ইন্টারন্যাশনালে। শুধুমাত্র অ্যানিমেশনে আমাকে প্রবেশাধিকার দিলেন না কিন্ত তিনি তাঁর সমস্ত সৃজনশীল চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমার বিচরণে কোন বাধা রাখলেন না। এটি বলা কখনও অতিরঞ্জিত হবে না যে তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে একটা জিনিসকে দেখতে হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে আমি কখনও ওভাবে দেখিনি। একটা থিম পার্ক কিভাবে নির্মাণ করতে হয় এবং পরিচালনা করতে হয় সেই সৃজনশীল প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা আমি কখন পায়নি। একজন দর্শনার্থীর অভিজ্ঞতা কিভাবে কল্পনা করতে হয় সে বিষয়ে আমি কখনও সময় ব্যয় করিনি। মাইকেল যখন এ পৃথিবীর কোথাও দিয়ে হেঁটে যান তখন তিনি একসেট ডিজাইনারের চোখ নিয়ে হাঁটেন। তিনি স্বভাবগতভাবে পরামর্শক নন। কিন্তু এ সময় তাঁকে অনুসরণ করলে, তাঁর কাজ করা পর্বেক্ষণ করলে মনে হতো আমি একটা শিক্ষানবিশ কাল অতিক্রম করছি।

মাইকেলের সাথে তাঁর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে কাজ করার সময় আমরা ফ্লোরিডায় ডিজনির অ্যানিমেল কিংডম, হংকং-এ হংকং ডিজনিল্যান্ড, এ্যানাহেমে ক্যালিফর্নিয়া এডভেঞ্চার শুরু করি। এগুলো শুরু করার আগে আমি তাঁর সাথে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। কিছু প্রতিষ্ঠিত পার্কেও হেঁটেছি তাঁর সাথে। একটা ধারণা পাবার জন্য যে এই পার্কগুলোতে তিনি কি খুঁজে ফেরেন। কোন গুলোর উন্নয়ন করার জন্য তাঁর এই নিরন্তর হেঁটে চলা। তিনি একটা পথ ধরে হেঁটে যেতেন, তাঁর পর দূরত্ব পর্বেক্ষণ করতেন এবং মুহূর্তের মধ্যে নির্মাণশৈলীর অতিসূ² তারতম্য খুঁজে বের করতেন। বলতেন এই স্থানে পর্যাপ্ত সবুজায়ন হয়নি। এই বেড়াটি মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে ফলে ঐ সৌন্দর্যমন্ডিত দৃশ্যটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। অথবা এই ইমারতটি পার্কের ভেতরে থাকা ঠিক নয় অথবা ইমারতটির নির্মাণ শৈলী যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন হয়নি।
এগুলো আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় মুহূর্ত। আমাদের ব্যবসা কিভাবে চালাতে হবে সে বিষয়ে অনেক শিখন হয়েছে। আমাদের পার্কগুলোতে কি ধরনের বিমূর্ত অবয়ব সমৃদ্ধ নক্সা ও সৃজনশীলতা এবং নান্দনিকতা প্রয়োজন, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিখন।

গ্লেনডেল, ক্যালিফোর্নিয়ার বিস্তীর্ণ চত্বরে অবস্থিত ওয়াল্ট ডিজনি ইমেজিনিয়ারিং এর অনেক পরিদর্শণে মাইকেল তাঁর সাথে আমাকে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। এটি আমাদের বারবাঙ্ক স্টুডিও থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। এই ইমেজিনিয়ারিং বা কল্পলোক অনেক বই ও নিবন্ধের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয় আমরা যাকিছু নির্মাণ করেছি সকল কিছুর সূতিকাগার হচ্ছে এই ওয়াল্ট ডিজনি ইমেজিনিয়ারিং। এটি শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র বা টিভি শো বা কোন ভোগ্য পণ্য নির্মাণাগার নয়। এটিকে ডিজনির সৃজনশীল ও প্রযুক্তিগত হৃদয় বলা হয়। আমাদের সমস্ত থিমপার্ক, রিসোর্ট, মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী, প্রমোদ তরী, আমাদের রিয়েল স্টেটের উন্নয়ন, সমস্ত সরাসরি স¤প্রচারকৃত অনুষ্ঠানমালা, আলোর প্রদর্শনী, গণ সমাগমের পরিকল্পনা সমস্ত কিছুর আঁতুড়ঘর এই ওয়াল্ট ডিজনি ইমেজিনিয়ারিং। অভিনয় শিল্পীর পোষাক পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে ডিজনি প্রাসাদের নির্মাণ কৌশলের নক্সা এখান থেকেই উদ্ভূত। ডিজনির উদ্ভাবকদের কল্পনাশক্তি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা আর মেধা অতুলনীয়। এদের গুণকীর্তণ করতে যেয়ে আপনি যে বাক্যই উচ্চারণ করুন না কেন, কখনও অত্যুক্তি হবে না। তাঁরা শিল্পী, প্রকৌশলী, স্থাপত্যশিল্পী, প্রযুক্তিবিদ। তাঁরা এই স্থানে বসে নিজেদের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর কোন উদভাবন কেন্দ্রের সাথে এর তুলনা করা সম্ভব না।

চমকপ্রদ কোন কিছু কল্পনা করা এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দেবার তাঁদের যে ক্ষমতা তা দেখে আমি ক্ষণে ক্ষণে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। হতভম্ভ হবার মতো বিশাল কিছু আমি অনুভব করি। ইমেজিনিয়ারিং পরিদর্শণ করতে যেয়ে দেখেছি মাইকেল কিভাবে ছোট বড় প্রকল্পগুলোর সমালোচনা করেন। স্টোরিবোর্ড পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যালোচনা করতে দেখেছি। অদূর ভবিস্যতে নির্মাণ করা হবে এমন একটা ক্রুজশীপের হলরুম কেমন মনোমুগ্ধকর হবে তার নক্সার সমালোচনা করতে দেখেছি। আসন্ন জনসমাগম কেমন হবে তার উপস্থাপনা শুনতে দেখেছি। একটা নতুন হোটেলের লবি কেমন হবে তার পর্যালোচনা করতে দেখেছি। আমার শিখন প্রক্রিয়ায় মরাত্মক আঘত করে তাঁর একটা বড় ছবি পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা দেখে। বড় ছবি দেখার পাশাপাশি তিনি ঐ ছবির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশও পর্যবেক্ষণ করেন। আবার একটি অপরটিকে কিভাবে প্রভাবিত করে তার বিশ্লেষণ করতে দেখেছি। এটি আমার শিখন প্রক্রিয়ায় এক অমূল্য সম্পদ।

মাইকেল নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেনে, আগামী বছরগুলোতে তাঁকে নিপীড়নকারী খুঁতখুঁতে স্বভাবের ব্যাবস্থাপক বলে দোষারোপ করা হবে। অথবা বলা হবে উনি ছোট বড় সকল কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চান বা বলবেন মাইক্রোম্যানেজার। তিনি বলবেন, ‘মাইক্রোম্যানেজাররা নি¤œ মানের হয়ে থাকেন।’ আমি তাঁর সাথে সম্পূর্ণ একমত না। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার আছে। রুন আরলেজের জন্য যে বছরগুলোতে আমি কাজ করেছি সে বছরগুলোর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কাজেই এ বিষয়ে আমাকে বিশ্বাস করানোর প্রচেষ্টা বৃথা। কোন কাজের সফলতা বা ব্যার্থতা হুরুম করে সবিস্তারে আকাশ থেকে পড়ে না। মাইকেল এমন কিছু দেখেন যা অন্যরা দেখেন না। তারপর তিনি এগুলো ঠিক করে দিতে বলতেন। এটিই মূলত তাঁর আর কোম্পানির এতসব সফলতার মূল কারণ। নির্মাণের প্রতিটি স্তরে মাইকেলের ঘাম ঝড়ানোর যে ঝোঁক তার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা আছে। এটি প্রমাণ করে যে তিনি কি পরিমানে যতœবান ছিলেন যা একটা ব্যতিক্রম উদাহারণ সৃষ্টি করেছে। তিনি ভালোমত বুঝতেন যে বড় কিছু আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক কিছুর সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়। তিনি এই নিগুঢ? রহস্যটি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করেছিলেন।

মাইকেল তাঁর মাইক্রো ব্যাবস্থাপনার জন্য নিজে গর্ববোধ করতেন। এ কথা তিনি মানুষকে ফলাও করে বলতেন, স্মরণ করিয়ে দিতেন। এতেকরে মানুষজন তাঁকে ক্ষুদ্র ও ছোট মনের মানুষ ভাবতেই পারেন। আমি একবার তাঁকে একটা হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে দেখেছি। তিনি প্রতিবেদককে বলছেন, ‘ওখানে ঐ বাতিগুলো দেখছেন না, ওগুলো আমি পছন্দ করে কিনেছি।’ একজন প্রধান নির্বাহীর মূখে এ কথা মানায় না। (আমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, আমিও এ সমস্ত কথা বলতে যেয়ে কয়েকবার ধরা খেয়েছি। জেনিয়া মুচা আমাকে বলেছিলেন, ‘বব, আপনি জানেন আপনি এটি করেছেন কিন্তু পৃথিবীর সেটি জানার দরকার নেই, এখন মুখ বন্ধ করুন।’ এমন কথা শুধুমাত্র তিনিই মুখের উপর এমন ভাবে বলে দিতে পারেন।)

২০০১ সালের গোড়ার দিকে প্রত্যেক গণমাধ্যম ও বিনোদন কোম্পানি টের পাচ্ছিল পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে কিন্তু কেউই বুঝে উঠতে পারছিল না কোন দিকে দৌড় দিতে হবে। প্রযুক্তি খুব দ্রুতই সবকিছু বদলে দিচ্ছিল। সবকিছু অচল করে দেবার মত প্রভাব অবধারিত হয়ে পড়েছিল। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছিল। একই বছরে মার্চ মাসে অ্যাপেল বাজারে ছাড়ল তার সিডি রেকর্ডার নাম রিপ. মিক্স. বার্ন.। এটার বিক্রি বৃদ্ধির জন্য প্রচারাভিযানে বলা হচ্ছে – একবার আপনি কোন সঙ্গীত কিনলেন তো সেটি আপনার, এটি কপি করা আপনার এখতিয়ারভুক্ত, আপনার খেয়াল খুশি মত ব্যবহার করা আপনার অধিকার। মাইকেল সহ অনেকেই দেখলেন এটি গানের ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা প্রাণঘাতী হুমকি। যেটি অচিরেই টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র জগতকেও হুমকির সম্মুখীন করবে। মাইকেল কপিরাইট অধিকারের সবসময় একজন কট্টর রক্ষক। পাইরেসি ইস্যুতে তাঁকে অনেক বার কথা বলতে শুনেছি। অ্যাপলের বিজ্ঞাপন সত্যিই তাঁকে বিরক্ত করেছে। তাই তিনি প্রকাশ্যে অ্যাপেলকে আক্রমণ করে কথা বলেন। সিনেট কমার্স কমিটিতে তিনি প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন অ্যাপেল স্পষ্টভাবে কপিরাইট আইনকে অমান্য করেছে এবং পাইরেসিকে উৎসাহিত করছে। স্টিভ জবের জন্য এটি মানায় না।

এটা একটা আকর্ষণীয় সময় আমি পার করে এসেছি। এটি পর্যবেক্ষণ করা আমার খুব আগ্রহের বিষয় ছিল। সনাতনী গণমাধ্যমের শেষের শুরু এখান থেকেই। প্রত্যেকটি গণমাধ্যম পরিবর্তিত পৃথিবীতে তার অবস্থান কোথায় তা খুঁজে দেখার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। সাহসের পরিবর্তে আতঙ্ক নিয়ে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সনাতন গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার জন্য রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু খুব শীঘ্র সমুদ্রের ঢেউ তা ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।

স্টিভ জবস ছাড়া অন্য কেউ এই পরিবর্তনকে এত স্পষ্ট করতে পারেন নি। তিনি সে সময় অ্যাপল পরিচালনার পাশাপাশি পিক্সারের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। পিক্সার আমাদের সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ ও সফল অংশিদার। ‘৯০এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডিজনি পিক্সারের সাথে একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারা তাদের পাঁচটি চলচ্চিত্র যৌথভাবে উৎপাদন করবে, বাজারজাত করবে এবং বিতরণ করবে। টয় স্টোরি ১৯৯৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল, এটি আগের চুক্তির ফলাফল। এটি ডিজিটাল অ্যানিমেশন দেয়া প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র। এটি সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে ভূমিকম্পের মতো আলোড়িত করেছিল। সারা বিশ্ব ব্যাপী এ ছবির বাজার ছিল। এ ছবি বিক্রির মোট আয়ের অঙ্কটি ছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলার। টয় স্টোরির হাত ধরে আরও দুটি চলচ্চিত্র ব্যাপক সফলতা পায়। ১৯৯৮ সালে এ বাগস লাইফ এবং ২০০১ সালে মনোস্টারস, ইনক.। এই তিনটি চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে বাজারজাত করে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় হয়। এই তিনটি ছবিই পিক্সারকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। একই সময়ে ডিজনি অ্যানিমেশনের অধঃপতন শুরু হয়। এবং এই অধঃপতনই ডিজনিতে অ্যানিমেশনের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। (চলবে)