কবি ঋতুশ্রী ঘোষ খুবই সরলভাবে তাঁর কাব্যিক চোখ দিয়ে দেখে যান তাঁর আশপাশের জগত আর জীবনের স্তরে স্তরে জমে থাকা সব আবেগ আর অভিজ্ঞতাকে। তাঁর কাব্যিক চোখে ভীড় করা এই সব দৃশ্যপট অতি চমৎকার আর সাবলীলভাবে উপস্থাপিত করেন কবিতাপ্রেমী পাঠকের কাছে। তাঁর কবিতার বলে যাওয়া এই গতিতে এক অদ্ভুত লয় আছে, যা আমাদেরকে অনিন্দ্য সুন্দর কবিতার স্বাদ নিতে সাহায্য করে। ঋতুশ্রী ঘোঘ তাঁর জীবনের কথা বলেন কবিতায়, সেই সাথে নিজের আবেগ ও অনুভবের বার্তা এমনভাবে আমাদের সবার সামনে তুলে ধরেন, যাতে আমাদের বারে বারে মনে হয়- তিনি আমাদের জীবনযাত্রার একান্ত পরম সঙ্গী যার চোখ তী² রশ্মির মত প্রক্ষেপিত হয় আমাদের আত্মিক রাজ্যে। বাংলার কোমল মাটিতে জন্ম নেয়া প্রবাস জীবনে যাপিত জীবন কাটানো কবির শব্দমালায় যেমন উঠে আসে প্রবাস জীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ; তেমনি উঠে আসে নিজ মাতৃভূমির প্রতি হৃদয়ের প্রেম ও ভালোবাসা। সেজন্য তাঁর কবিতায় যেমন উঠে আসে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, তেমনি উঠে আসে নিজের মায়ের স্মৃতিময় প্রেম-অনুভবের উপাখ্যান। কবি ঋতুশ্রী ঘোষ ছোট ছোট শব্দমালায় তাঁর কবিতায় যে রূপকল্পের ছবি এঁকে চলেন তা কবিতার মনোযোগী পাঠকের কাছে এক পরম পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে পাঠক বারে বারে নিজেকে অবলীলায় তাঁর কবিতার সাথে লীন করে নেয়।

মনিস রফিক

ঋতুশ্রী ঘোষ-এর জন্ম বাংলাদেশের খুলনায়। জীবনের প্রথম পর্যায়ের শিক্ষা শেষে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে হিসাব বিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক সম্পন্ন করেন। কলকাতায় বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত প্রাণ বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচয় ঋতুশ্রীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা কবিতা প্রেমের অগ্নি অনেক বেশি প্রজ্বলিত করে। সেই সব নিবেদিত প্রাণদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, বাংলা সাহিত্যের প্রথা বিরোধী নমস্য কবি বিনয় মজুমদার।
ঋতুশ্রী ঘোষ প্রথম দিকে বাংলাদেশে স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পরবর্তীতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তিন বছর পাক্ষিক ‘উত্তর ২৪ পরগনা বার্তা’ এবং সাপ্তাহিক ‘বাংলা খবর’-এ সাংবাদিকতা করেন। টরন্টোর মূলধারার ‘বাংলা কাগজ’ ও ‘আজকাল’সহ বিএলআরসি সাহিত্য পত্রিকা, নীলকমল, চিন্ময়ী, ছেঁড়া পাতা এবং অঞ্জলি’তে নিয়মিতভাবে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখার প্রধান অনুপ্রেরণা হচ্ছেন তাঁর বাবা।
ঋতুশ্রী ঘোষ-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন্ত আতশ কাঁচ’ প্রকাশিত হয় ভারত থেকে, ২০০৮ সালে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আকালিক উপাখ্যান’ প্রকাশ করে “কাশবন প্রকাশন” ২০১১-এর “ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা”য় এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘একনিষ্ট মৃত্যু’ প্রকাশ করে “অনন্যা প্রকাশনী” ২০১৮ সালের “ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা”য়। কবিতা ছাড়া তিনি গল্প ও প্রবন্ধ লেখেন।
ঋতুশ্রী ঘোষ কানাডার টরন্টো শহরে বাস করেন।

অভিজ্ঞ গৃহ

এক.
আনমনে পিছুটানহীন হেঁটে হেঁটে
পথটাকে করেছি অনেকটা দীর্ঘ।
পথ যতই দীর্ঘ হোক না কেন
তার শেষ নেই, সীমাহীন সে পথ।

পথহারা পথিক, তুমি হবে কি গৃহবাসী?
কোন সে গৃহ চাই, সুপ্ত বিশ্বাসের প্রাণান্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই।
নিতান্ত বাতিকগ্রস্ত গৃহই
ক্রমাগত হয়ে ওঠে সতৃষ্ণ সংসার।

পিপাসিত পানশালা, যাপিত প্রহর, বিশ্বাসের পেন্ডুলাম,
অকষ্যাৎ বৃষ্টি, চেতনানাশক ঘুম, সম্পর্কের দৈর্ঘ্য,
পাহারায় শাসিত স্বঘোষিত সংসার।
হে গৃহবাসী, গৃহ কি শুধুই ছলনা?
আর অভিবাসন মানে – রবাহূত যন্ত্রণা,
দূরত্বের নাগপাশ, বিরহের ব্যবচ্ছেদ,
উজাড় – পিতৃত্ব, মাতৃত্ব, ভ্রাতৃত্ব।
সংসার মানেই -স্বপ্ন ভাঙার একনিষ্ঠ আঁতুরঘর।

গৃহহীন, তোমার পথকে যতখুশি দীর্ঘ করো
গৃহীবাসীর পূর্ব পদক্ষেপ অবধি।

দুই.
অভিজ্ঞ মুখের রেখা বলে দিতে পারে
সুখ-দুঃখের হিসেব-নিকেশ
বিশ্বাস অবিশ্বাসের টানাপোড়েন
পাওয়া না-পাওয়ার লাভক্ষতি।

হিসেব কষে মুখের রেখার ভাঁজে খাঁজে,
বৃষ্টিহীন মেঘেরা তারস্বরে চিৎকার জোড়ে
তাপহীন রোদ্দুরের চৌকষ আলোতেই।
স্বঘোষিত ছদ্মবেশী দেউলিয়াকে ঈশ্বরও
অলক্ষীর বরে ভরিয়ে দেয় কখনো সখনো।

অভিজ্ঞ নাবিকও কালো বরফে হোঁচট খায়,
হুড়মুড়িয়ে অগ্রসর হয়
অপেক্ষারত ফিরে না আসা
জাহাজের সখ্যতায়।

তোমার স্বপ্ন ভাঙা সংসার নির্বাক হয়
অভিজ্ঞ মুখের সংকুচিত মুখের অন্তরালে।

ছায়া

অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ
সবারই একটা নিজস্ব এলব্যাম থাকে।
তার কাছে বেশি সমৃদ্ধশালী
কোন জলরং, কোন বিমূর্ত স্মৃতি।

তার সন্তান, পিতা আর সে
একে অপরের ছায়াকি ফেলে পরস্পর?

কোনো কোনো ছায়ার আকর্ষণ অবাঞ্চিত বা মৃত
ফেলে দেওয়া ঘড়ির মহাকালের শব্দের মত।

তোমার বিস্ময়কে-তুমি হাতের মুঠোয় রাখো,
পদ্ম পাতার পরে রাখো,
কম্পিত পেণ্ডুলামে
স্বাধীন কর সময়কে,
আর আয়নার সামনে দাঁড় করাও
ছায়াদের কালক্ষেপন।
তোমার মনোযোগ
বিরতিহীন পানযোগ্য ঝর্ণার জলে নিবদ্ধ করো।
কালের বিবর্তনে ছায়াদের প্রতিধ্বনি শোনো
জলছবির লেপ্টে যাওয়া সিঁদুরে।
জাতির পিতার পুনর্জন্ম

ভাঙ্গনের সুর তুমি শোননি?
বোঝনি ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল!
সন্তানের ইতস্তত হৃদয়ের ক্রীতদাস মনোভাব আর
অঙ্কুরোদগমের আদিসত্বায় মরণব্যাধির বিষাক্ত বীজ!

দিনতো চলেই যায়
প্রতিটি কালরাতের পিছুটানে।
রাতের আঁধারের বুকচেরা রক্তস্রোত,
রক্তাক্ত কালসিটে দাগ!

কোনো কালি দিয়েও যাবে না ঢাকা সেই কালিমা।
একটা পুনর্জন্ম হলে
হতে পারত নতুন ভাগ্যলেখা –
আমার জন্মভূমি, জাতির পিতা আর বাংলা জাতকের।

সব ভুল শুধরে –
বঙ্গবন্ধুর মহান আর উদার মনোবৃত্তির পরিশোধনে
আর একটু কুটনৈতিক আর সুদুরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গিতে
করা যেত সাধারণ ক্ষমার অবধারিত পাপমুক্তির অবসান।

কত স্বপ্ন দিয়ে এঁকেছিলে- মহাদিগন্ত ছোঁয়া
জন্মভূমি- লাল সবুজের বাংলা মাকে।
আমার বাংলাদেশ।
তোমার বজ্রকন্ঠের আহ্বানেই –
কোটি কোটি আত্মজ হলো একত্র।

অথচ আজ তোমার সমস্ত বিফলতা
জেঁকে বসেছে আরো বেশি।
সারা শরীরের দগদগে ঘা’তে বাসা বেঁধেছে
দুর্দান্ত মরণব্যাধি।

ক্রোধান্ধ আর স্বার্থান্ধ বিবস্ত্র ঢেউয়ে
তোমার নিষ্ঠুর, নির্মম হত্যাকারীরা
আজ আরো উঠেছে ফুঁসে।

হে জাতির পিতা, আর একবার জন্ম নাও –
আমার জন্মভূমিতে,
যা আজও মাতৃভূমি হয়ে উঠতে পারেনি;
তোমার গণতান্ত্রিক সন্তানের।

হে জাতির পিতা, আর একবার জন্ম নাও –
আমার জন্মভূমিতে,
শক্ত হাতে শাসন কর –
দেশের বখে যাওয়া
স্বৈরাচারী পাপপুষ্ট রক্তবীজের
অবমানবগুলোকে … … … … …

তোমার জন্য নষ্ট গান

এই শহরে তৃষিত হৃদয় জুড়ে
একটি গোলাপ আর … কষ্টবৃক্ষ মুখোমুখি
চিরন্তনী পথের হিসেব কষে
জীবনের নৈশগাড়ির জ্যোস্নাবন্দনায়।

এখানে মানুষ স্মৃতি ও সত্তায় মামুলি
আত্মচরিত রচনার আর্তি জানায়
ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি আর ভারতবর্ষের কবির
সহবাসী শত কবিতার সাথে।

হে ষোড়শী যদি তুমি না-ই আসো
তবে আমিও শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি
আর সত্যশয্যা নষ্টের গান ঋতুমতী বর্ষাপাড়ায়
যেখানে ছিলার মতো ফুল ফুটেছে কবিতার আতুর ঘরে।

পুরাণ ঘেঁটে লাভ নেই, অনন্ত অসুখে
মনোভৌগোলিক বোধঘুড়ির পদচ্ছাপ
অপ্রাপ্তির আলো দেখে অন্তহীন ক্ষতের গভীরে
নদীকাহিনীর একবিংশ জন্মদিনে।
যদি বলি তন্দ্রার ভেতরে – সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল,
তাই নিবিড় বৃষ্টিতে আজ ঘরকুনো কবিরা ব্রা²ণ হয়।
তবে কৈফিয়তে বলবে- এভাবে হয় না
দীর্ঘ কবিতায় সবুজের চাষাবাদ।

প্রবাস নাকি মৃত্যু

প্রথম যেদিন –
এয়ারপোর্টের কাঁচ ঘেরা বিচ্ছেদের এপারে চলে এসেছিলাম,
২টা ২৩ কেজির ল্যাগেজ আর ১টি ৮ কেজির হাত ব্যাগ।
কত কিছুই না রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম,
কত কিছু, কত স্মৃতি।
মায়ের স্নেহের আঁচল, বাবার আশ্রয়ী বুক,
বোনের খুনসুটি, বন্ধুদের গুমরে থাকা বেদনা।
এই আড়াইখানা ছোট্ট ব্যাগে কতটুকুইবা আনা যায়, কতটা!
এপার থেকেও স্পষ্ট দেখেছিলাম –
বিচ্ছেদের কাঁচের ওপারে –
বাবা-মায়ের বুক চাপা স্পষ্ট কান্না।

আমার উন্নত ভবিষ্যতের তীব্রতায়
ক্রমে দূরে চলে যায়, ঝাপসা হয়ে যায় –
মা; আমার মা
আর আমার মাতৃভূমি!

প্রবাস! প্রবাস মানে মৃত্যু,
জীবনের অন্বেষণে অজানুলম্বিত মৃত্যু,
শরীরের আগেই আত্মার মৃত্যু।
স্বর্গের কাছাকাছি, উন্নত দেশে – প্রবাস জীবন।

অফুরন্ত সময়ে, সময়ের বড্ড অভাব এখানে –
বাবা-মায়ের জন্য।
স্বর্গের কাছাকাছি আমি!
আমি থেকে, আমার প্রবাস থেকে –
দায় ও দায়িত্বের দূরত্ব অনেক বেশি।
স্বর্গের কাছাকাছি, উন্নত দেশে – প্রবাস জীবন।

আমার মা

হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করে,
কঁকিয়ে ওঠে অসহ্য যন্ত্রণায়।
অপারেশন হওয়া সাড়ে দশ ইঞ্চি কাটা পেট,
অপারেশন হওয়া সাড়ে দশ ইঞ্চি কাটা পেট
(যেখানে হয়েছিল আমার আগমনের প্রথম বীজ বপন,
যেখানে ১০ মাস ১০ দিন পরম নিশ্চিন্তে আমার বেড়ে ওঠা,
যেখানে হয়েছিল আমার প্রথম আবির্ভাব।)
আর জলভরা ঝাঁপসা চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে –
নার্সের চোখের উপেক্ষিত দৃষ্টিতে।
তার কাঁদো কাঁদো মন –
খুঁজে ফেরে একরাশ সন্তান আলাপন।
এক গা জ্বর আর রোদ – ঝড় – বৃষ্টি,
এক গা জ্বর আর রোদ – ঝড় – বৃষ্টি মাথায় –
বাজারের থলি হাতে, বাবা –
নিত্য হেঁটে যায় সান্ধ্য বাজারে।
যে হাতে ধরা থাকত আমার ছোট্ট হাত।
আমার ছোট্ট হাত, বাবার শক্ত হাতের মাঝে –
আমার ছোট্ট হাতের দারুন আশ্রয়।
আমার সেই ছোট্ট হাত
হয়েছে বাবার হাতেরই সমান।
তাই শূন্য তার হাত, শূন্য আমার বাবার হাত।
মাস শেষে পেনশনের টাকায়
টেনেটুনে চলে যায় দুজনের সংসার,
চালাতে হয়।

জীবনের সমস্ত সঞ্চয়ে –
তাদের সন্তান – স্বর্গের কাছাকাছি,
স্বর্গের কাছাকাছি আমি।
আমার অর্জিত মূল্যবান ডলারে
জমতে থাকে আমার ভবিষ্যৎ,
আর খরচ হয় শ্যাম্পেনের উচ্ছসিত ফোয়ারা।

চশমার একটা হাত ভেঙে গেছে বহুদিন,
দ্বিতীয়টারও স্ক্রু গেছে খুলে,
লাল-সাদা পাকানো সুতোয় চলে যায়
চশমার ডাটার কাজ।
আমার চোখের স্মার্ট লেন্সের
থাকে না ভাঙা বা হারিয়ে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা।

কাঁপা শীর্ণ হাতের জলের গ্লাস পড়ে যায় মাটিতে।
ভগ্ন কোমর।
তবুও জীর্ণ কাপড়ে মুছে নেয় শেষ জল কণাও,
মুছে নিতে হয়।
শুধু শতবার মুছেও শেষ হয় না –
দু’কপল বেঁয়ে নেমে আসা অশ্রæ ধারা।

ব্যস্ত জীবন আমার।
উন্নত দেশের উন্নত জীবন আমার।
ওয়াশিং মেশিন, ডিস্ ওয়াসার, মাইক্রোওয়েভ, ভ্যাকুম ক্লিনারের
বদান্যতায় – নির্ঝঞ্ঝাট ব্যস্ত জীবন আমার।

ফুলটাইম জব আর পার্টটাইম পড়াশুনা,
দিন শেষে কয়েক পেগ আনন্দ
উইকএন্ডের জমজমাট পার্টি,
উন্মত্ত হুইস্কির দুর্দান্ত চিয়ার্স
আর শ্যাম্পেনে মায়াময় নিশিযাপন।
স্বর্গের কাছাকাছি, উন্নত দেশে – প্রবাস জীবন।

সন্তানের বিচ্ছেদে, সন্তানের অবহেলায়
শেষ বয়সের একাকী উপেক্ষিত জীবন; বাবা-মায়ের।

প্রবাস মানে সম্পর্কের মৃত্যু, অনুভব এর মৃত্যু,
প্রবাস মানে- স্বর্গের কাছাকাছি মানুষগুলোর চিরাচরিত মৃত্যু।

সময় চলে যায় বড্ড অসময়ে।
রাতে যখন ঘুমাতাম-
মায়ের গল্প না শুনলে ঘুমই হতো না,
কিংবা বাবার গলা জড়িয়ে ধরা।

বাবা-মার এত বয়স হয়েছে-
আজকাল সব নাকি ভুলেও যায়,
তবু সে কথা নাকি ভুলে নি আজও।
আজ নাকি আমাকে ছাড়া সব শূন্য মনে হয়

আমি ঠিক সময়ে; ঠিক মত খেলাম কিনা,
ঠিক মত পুষ্টিগুণ হল কিনা –
তা নিয়ে বাবা ছিল বড্ড হিসেবী,
মায়ের কথায়- ‘আদিখ্যেতা ’।

অথচ সেই মাকে ফোন করলেই
প্রথমে জিজ্ঞাসা করে-
‘সোনা খেয়েছিস? রান্না করতে পারিস!’
মাকে আজও বোঝাতে পারি না-
ফুড ডেলিভারীর পিতজা, বার্গার, এর সহজ লভ্যতায়
এখানে রীতিমতো খাদ্য-রসিক আমি।
তুমুল হুল্লোড় জীবন আমার।
মা সেই ব্যাকডেটেডই রয়ে গেল আজও।

তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
আমার সুবিধার্থে, বাড়ি ছেড়ে
ইউনিভার্সিটির পাশেই
বাড়ি ভাড়া নিল বাবা।
বরাবরই দেখেছি-
রাতে ঘুমালে তিন-চারবার উঠে বাবা চেক করে
মশারির পাশে আমার হাত-পা পড়েছে কিনা
তবে মশা কামড়াবে। (ক্রমশ)

সত্যিই বাড়াবাড়ি।।

এখনো সুযোগ পেলেই জানতে চায়-
তোদের ওখানে তো বলিস মশা নেই,
তবুও একটু কষ্ট করে মশারিটা টানাতেই পারিস,
একটা দুটো তো নিশ্চয়ই কামড়ায়,
একটাও মশা নেই, তা আবার হয় নাকি?

ধোঁয়ায় বাবার কষ্টটা বাড়াবাড়ি হয় ; শ্বাসকষ্টটা।
কিন্তু মশার যন্ত্রণাও সহ্য হয় না আর –
এই বয়সে, এই শেষ বয়সে।
কিন্তু মশার যন্ত্রণায় কয়েল জ্বালানো
রীতিমতো বাধ্যতামূলক ওখানে।
তাই এখানে আসার খুব ইচ্ছে তার।

যত সব প্যানপ্যানানি, ফেড আপ আমি।
আমার উন্মুক্ত স্বাধীনতায়
নিরন্তর ব্যাঘাত, নিরন্তর পিছুটান,
আমার জীবনে অনাহুতের নিরন্তর হস্তক্ষেপ।

মায়ের আবার ক্লস্ট্রোফোবিয়া, অ্যাক্রফোবিয়া।
উচু বিল্ডিং এ থাকতে ভয়, দরজা বন্ধ করলে ভয়,
ভয় ভয় আর ভয়,
আমাকে নিয়েও ভয়।
অথচ আমার যত্ন করার জন্য
এখানে আসতে ব্যতিব্যস্ত সে।

২৬ ঘণ্টার ফ্লাই।
আমার বোধগম্য নয় –
সহস্র ফুট উচ্চতা আর বদ্ধতার ভয়
আজ কোথায় তার!

এটা কি বাৎসল্যতার বাড়াবাড়ি
নাকি –
প্রবাস মানেই আবেগ এর মৃত্যু,
প্রবাস মানেই মানবিকতার মৃত্যু!

বিজয়ের দাগ

হতে পারে – আমি এখনো ঘুমের মাঝে স্বপ্নে আছি,
যা কিছু অনুভব – তা শুধু কল্পনার ধিকিধিকি,
যাকে আমি সূর্যোদয় ভাবছি তা হয়ত সূর্যের অস্তগমন,
প্রভাতি সুরে বিজয়ের যে গান আওড়াচ্ছি তা হয়ত মনের দাগ।

এ স্বাধীনতা আমার নয়,
এ সুর বিজয়ের নয়,
এ দেশ কাঙ্খিত নয়,
এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত নয়,
এ আনন্দ আন্তরিক নয়,
এ কান্না সমাপ্তির নয়,
এ দীর্ঘশ্বাস উত্তরসুরীর নয়,
এ কবিতাও বিজয়ের নয়।

পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা আমার অস্তিত্বকে
তুমি স্বাধীনতা বল!
নিজ ঘরে পরবাসী অধিশ্বরের চেয়ে প্রবাসে ক্রন্দিত স্বেচ্ছা নির্বাসন
অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য আমার কাছে।

লাল পেড়ে সাদা শাড়ির নিচে
আজও অনাকাঙ্খিত হাতের স্বেচ্ছাচারিতা নির্দ্বিধায়।
জাত,ধর্ম,বর্ণ,গন্ধ আজও নিষ্পেসিত
ঝুটা নামধারী স্বাধীনতার গর্বিত ছত্রছায়ায়।

আমার কোনো গন্তব্য নেই,কোনো স্থিতি নেই,
আমার বোধগম্য বোধে –
কাঙ্খিত স্বাধীনতার কোনো স্পর্শ নেই,
নেই বিজয়ের অনুভুতি।

শোষণ আর স্বেচ্ছাচারিতার সন্ধিক্ষণে
কে তুমি মৌনপুরুষ!
এ ঘৃণিত স্বাধীনতা আমার কাম্য নয়,
এ তামসিক বিজয় আমার মায়ের নয়।

হে মৌনপুরুষ,
তুমি যদি স্বাধীনতার অধিশ্বর হও;
আর যদি আমার স্বাধীনতায় স্বাত্তি¡কতা না এনে দিতে পার,
তবে বরং
নির্দ্বিধায় নির্লিপ্তি নির্বাসন বা ক্রন্দনরত শৃঙ্খল দাও –
বিজয়ের খোলসধারী পরাজিত আমাকে।

সম্মোহিত পুরুষ

অক্লান্ত গালে হাত,মূল্যবোধের ধুম,
আগে পিছে সব মিছে, সম্মোহিত ঘুম।

অবুঝ অমাতৃত্বের দাগ পড়ে আর্য বা ব্রাত্যয়,
যাপিত ভালোবাসা মুছে যায় আত্মজের আত্মায়।

অনাবাদী অন্ধকার ঘুমের দায় শুধুই আজন্ম মাতৃত্বের,
বাজা পুরুষে সে দায় অস্বীকৃত – রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মননে প্রকাশ্যে।

অসংলগ্ন শাড়ির ভাঁজে ঘৃণিত সবুজ মরুভুমি,
ছেঁড়া-কাটা জিন্সের একটু ওপরেও উঁকিমারে
একই মৃগনাভির সুসজ্জিত সুগন্ধ।
হে অবিন্যস্ত দীর্ঘশ্বাস সম্বলিত নারী –
হয়ত তোমার জন্যও কোনো প্রশস্ত বুকে জমা আছে
প্রবহমান কান্নার গুন্ঠিত স্রোত
অতীত তাচ্ছিল্যের অব্যক্ত ভালোবাসার নিদারুন তাগিদে।
মাত্র একটা জন্মে উদ্ধত ভাগ্যনিয়ন্ত্রক পুরুষকে দাও
ভ্রূণ ধারণের ক্ষমতা,আত্মজ বহন ও জন্মদানের
অবর্ণনীয় আত্মস্থ অনুভূতি।

মূক ও বধির নারীর আত্মভগ্নতার স্তব্ধ শব্দ
আজীবন নিরুদ্দেশ দায়বদ্ধতার চিরন্তন আঁচলে।
বিন্দু বিন্দু উপেক্ষা যে প্রতি পদক্ষেপে দ্রোহ ও দহনের জন্মদেয়-
দাম্ভিক পুরুষকে তা অন্তত একটি জন্মে জানতে দাও।