ইউসুফ কামাল : শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তের লেখাপড়া সাধারণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই এর আকর্ষণটাও একটু অন্য রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার ধরনই ভিন্নতর, এখানে নিজের তাগিদেই পড়াশুনা করতে হয়। পিতামাতার প্রত্যক্ষ তাগিদ নাই, সকাল বিকাল নিয়ম বেধে পড়তে বসার ব্যাপার নাই শুধু নিজের সচেতনতা ও তাগিদই কাজ করে। ক্লাসে শিক্ষকের পড়ানো অনুসরণ করা ও লাইব্রেরিতে বসে নোট করে সেটা অনুসরণ করেই পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসা, ব্যাস।

আমার কাছে শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে এসএসসি পরীক্ষা। সব চেয়ে সহজ মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। মোটামুটি নিয়মিত ক্লাস করা আর বিষয়ের উপর নোট করার অভ্যাস চালু রাখলে ফলাফল ভালো হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কিছুই আমাদের দেখতে হয়েছে। লাল সূর্যের লালিমায় যাদের ত্যাগ তারাই সরাসরি আমাদের অংশ হয়ে গেলো। যারা মুখ উঁচু গর্ব করে বলতে পারে এ স্বাধীনতার লাল সূর্য তো আমার জন্য, সর্বস্ব দিয়ে পেয়েছি এই নব সূর্য। যুদ্ধাহত যোদ্ধা যেমন পেয়েছি পাশে বসে ক্লাশ করতে, বীরাঙ্গনা নারীকে নি:সংকোচে হেঁটে যেতে দেখেছি ক্লাস রুমের দিকে যেতে।

কেনো যেনো মনে হতো আমাদের সহপাঠী কুমিল্লার অজন্তা বৌদির সিথির সিঁদুরের রংও বুঝি মিশে গেছে ঐ রংয়ের সাথে। হাজারো স্বামীহারা নারীর কান্নার ভার যেনো আমাদের জীবনকে থমকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ভারী হয়ে গেছে ক্লান্ত সূর্যটা। ঘড় থেকে স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো সন্ধানই মেলেনি তার। সবাই ধরে নিয়েছে নাই, কিন্তু তবুও মনের কোনে একটু আশার আলো তো থাকেই। সুন্দর মানুষটা হয়তো নিজের মনের গভীর ক্ষতটা ভুলে থাকার জন্যই বন্ধুদের নিয়ে গল্পে মেতে থাকে। সাদা শাড়ী কালো চিকন পাড়ের শাড়ীর সাথে কালো চিকন স্লিপার বৌদির প্রাত্যহিক পোশাক। যথেষ্ট রুচিবান সব দিক থেকেই। কথা বলতেন নিম্ন স্বরে, কাছে থেকে না শুনলে হয়তো শোনাই যাবে না। সামাজিকভাবে নিয়ম মেনেই জেলার নাম করা পরিবারের গৃহবধু হয়েছিলেন।

প্রথম দিকে নাসির, হারিস, মমতা, মান্নান এরাই মোটামুটি এক সাথে থাকতো। ক্লাস শেষে সবাইকে একসাথেই লাইব্রেরি, টিএসসিতে দেখতাম। সাম্রাজ্য দখলের মতোই ব্যক্তি বিশেষের মন দখল করার মাধ্যমেই তাদের মধ্যেও আবার উপদল হয়ে গেল। বিভক্তি সৃষ্টি করে ফেল্লো সাভারের মান্নান মমতাকে কুক্ষিগত করে, নিজেদের কাল্পনিক সাম্রাজ্য গড়ায় ব্যাস্ত হয়ে গেলো। ছোট হয়ে গেলো ওদের প্রাত্যাহিক আড্ডার সদস্য সংখ্যা। সেই কবে ছেড়ে এসেছি ছাত্র জীবন, বন্ধুত্বের মধুময় দিনগুলো। দেখা হয় না ফেলে আসা বন্ধুদের সাথে কয়েক যুগ তবু যে কেউ ভোলেনি কাউকে সেটা নতুন করে জানলাম সেদিন। এলাকার ছোট ভাই লাল এর মাধ্যমে। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেই বুঝলাম পুরোনো বন্ধুত্ব সহজে যায় না। ধানমন্ডির শংকরে বড় ছেলের জন্য বাসা ভাড়া নিতে যেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নাসিরের বাড়িতেই হাজির হয়েছিলো লাল। দেশের বাড়ি রাজবাড়ী, আর আমি পরিচিত জানাতেই আর দ্বিতীয় কথা বলতে হয়নি। বন্ধুত্বের স্মৃতিময় ভালোবাসা বোধ হয় সারাজীবন এমনি নির্মল আনন্দময় হয়। যে যেখানে আছে ভালো থাকো বন্ধুরা।

’৭৩-এর সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্ব পূর্ণ অধ্যায়। ’৭০ এর নির্বাচনের নির্বাচিত এম এন এ ও এম সি এ-রা ডিসেম্বর এর পর দেশে ফিরতে শুরু করেন। যুদ্ধে জয়ী তরুণ মুক্তিযাদ্ধাদের সবার বুকে তখন সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার লাল সূর্য চোখে মুখে গৌরাবান্বিত আলোকচ্ছটা। সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এর মধ্যেই অবৈধ পন্থায় হাতড়াতে শুরু করলো অবাঙালি ও হিন্দুদের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ। সময় গড়িয়ে চল্লো সময়ের গতিতে। পাওয়া না পাওয়ার হতাশা, বেদনা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে জেগে উঠতে শুরু করলো। আরো সংগোপনে জেগে উঠতে লাগলো মানুষের লোভ, যুবকদের মধ্যে বাড়তে শুরু করলো নেশায় জড়িয়ে পরার প্রতিযোগিতা। সারা দেশে একই চরিত্রের ছড়াছড়ি, ব্যাতিক্রম খুবই নগণ্য। ভালো মানুষের পরিমাণ কেনো যেনো কমতে শুরু করলো।

নতুন দেশের প্রয়োজন নতুন সংবিধান, নতুন মন্ত্রীসভা, নতুন পার্লামেন্ট। যুদ্ধবিধ্ধস্ত দেশ গড়ে তুলতে নতুন সরকারকে শক্ত ভ‚মিকা নিতে হবে। ভংগুর অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে দরকার ত্যাগী মানুষের, কিন্তু কোথায় সেই ত্যাগী মানুষ? বঙ্গবন্ধুকে বলতে শুনেছি, ‘সবাই পায় তেলের খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি’। কত মর্মান্তিক ব্যাপার।
প্রায় দুই বছর দেশের মানুষ সঠিকভাবে চাষাবাদ করতে পারে নাই। গোলায় নাই খাদ্যশস্য। অবাঙালি, রাজাকার লুট করে নিয়ে গেছে ঘড়বাড়ী, গরু ছাগল। কঠিন অবস্থায় মানুষ, কি ভাবে আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে? বঞ্চিত ক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে মুলত: মুক্তি যোদ্ধাদেরকে সামনে রেখে গড়ে উঠলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা সংক্ষেপে জাসদ। কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষের একটা দাঁড়ানোর জায়গা। কিছু সুবিধাবাদী আওয়ামী নেতৃস্থানীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে গ্রহণীয় করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রথম প্রথম দু’দিকেই তাল রাখা শুরু করলো। সর্বত্রই যেন এক খেলা শুরু হয়ে গেলো। নিজেকে উভয় দলের জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব প্রমাণ করানোই মূল উদ্দেশ্য যেনো। দেশের ভেংগে পরা অর্থনীতিকে চাংগা করতে সরকার সারা দেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে মানুষের গবাদী পশু, ঘড় বিনির্মাণ বিভিন্ন খাতে অর্থ সাহায্য শুরু করলো। সে খানেও চুরি শুরু হয়ে গেলো। সর্বত্র দুর্নীতির কালো থাবা চরম আকার ধারন করলো।

ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু এলাকার সংসদ সদস্যদেরকেও এহেন কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলো। তাদেরকেও সংসদ সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। ত্রাণের টাকা বিতরণ না করে ব্যাক্তি হিসাবে জমা করার অপরাধে ও অনুরুপ ঘটনা ঘটতে দেখা গেলো। সরকার ’৭৩ সালের ৭ই মার্চ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলো। স্বাধীন দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজবাড়ী-১ ও রাজবাড়ী-২ দুই আসনেই প্রার্থী পরিবর্তন হয়ে গেলো। জোরেশোরে নির্বাচনী কার্যবিধি শুরু হয়ে গেল। রাজবাড়ী-১ আসনে ডা: এস এ মালেক, রাজবাড়ী-২ আসনে নুরুল ইসলাম।

এর মধ্যেই ’৭৩ এর ১লা জানুয়ারি ভিয়েতনাম সংহতি দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের করে ছাত্র ইউনিয়ন। মিছিলের গন্তব্য ছিলো আমেরিকান তথ্য কেন্দ্র। ঢাকা প্রেস ক্লাবের বিপরীতে তখন আমেরিকান তথ্য কেন্দ্র ছিলো। ঐখানে প্রতিবাদ করা অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন পাংশার তৎকালীন সাংসদ মোসলেম উদ্দিন মৃধা সাহেবের তৃতীয় সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মতিউল ইসলাম।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা