মণিজিঞ্জির সান্যাল : সোশ্যাল মিডিয়ায় সন্তানকে নেশাগ্রস্ত করার পেছনে বাবা এবং মায়ের অবদান ঠিক কতোটা? প্রশ্নটা মনের মধ্যে একটু হলেও কিন্তু দোলা দেয়।
বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তো বটেই।
ধীরে ধীরে যদি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করি তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল করোনা পরিস্থিতি বা লকডাউন বা অন লাইন ক্লাস ইত্যাদি পর্বকে একটু সরিয়ে রেখে বিষয়টি নিয়ে অন্যভাবে একটু আলোচনা করা যাক।
আসলে কিছু কিছু বিষয় নিজের কাছেই রাখতে হয়, নইলে ব্যক্তিগত বলে আর কিছুই থাকে না। যেমন কিছু অনুভূতি, কিছু ভালোলাগা একান্ত আপন। যেমন পারিবারিক ছবি বা পারিবারিক মুহূর্ত অনেকেই বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে দ্বিধা করেন না। শিশুদের মানসিক গঠনের শুরুটাই হয় বড়দের দেখে দেখে। পরিবারে মা, বাবা কিম্বা অন্যান্য সদস্যদের জীবনধারার প্রভাব পড়ে একটু শিশুর ওপর মারাত্মক ভাবে।

একেবারে শিকড়ে প্রবেশ করলে দেখা যায় একটি শিশুর জন্মের পর থেকে ধাপে ধাপে শিশুটির ছবি বা ভিডিও করেন অভিভাবকরা শৈশবের সেই মুহূর্ত গুলোকে ধরে রাখতে। আসলে প্রত্যেক বাবা, মায়ের কাছেই তাদের সন্তানরা সবচেয়ে আদরের, তাদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত অত্যন্ত আবেগের। এসব কথা নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কিছু কিছু অভিভাবক সঙ্গে সঙ্গে সেই মুহূর্ত গুলোকে তুলে ধরেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। অন্যের প্রশংসা, বা অন্যের বাহবার জন্যে। নিজেদের সুন্দর মুহূর্তগুলো নিজেদের কাছে যতেœ লালন করার চাইতেও কখন অন্যদের কাছে সেগুলো তুলে ধরব সেই চিন্তাটাই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

নিজেদের জীবনকে বাইরের জগতের কাছে তুলে ধরার মধ্যে কি এমন কৃতিত্ব আছে? সবকিছু সবাইকে দেখাতে হবেই বা কেন?
আসলে দেখানোটা একটা অভ্যেস। এই অভ্যেস কিছু মানুষের চিরন্তন। কিছু কিছু পরিবারের অভিভাবকরা বাচ্চাদের ওপর মানসিক চাপ দিয়ে থাকেন চেতনে বা অবচেতনে। তাদের অনিচ্ছাসত্তে¡ও বাড়িতে কেউ আসলেই ‘একটা নাচ দেখাও, গান শোনাও, কবিতা বলো।’
আসলে আমার বাচ্চা কি জানে বা কতোটা জানে সেটাই মূল কথা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় বাচ্চাকে নেশাগ্রস্ত করার পেছনে কিছু বাবা- মা’ও কম দায়ী নয়।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে কিছু অভিভাবক শিশুদের একের পর এক প্রশ্ন করছেন,আর ছোট্ট বাচ্চাটি গরগর করে তোতাপাখির মতো উত্তর দিচ্ছে। তারপর সেই প্রশ্ন উত্তরের পর্বগুলোকে ভিডিও করে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে কিছু সাংবাদিক বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে বা সেই ভিডিও বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে ইউটিউবরা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন। একবারও চিন্তা করছেন না সেই বাচ্চাটির মধ্যে কতখানি প্রভাব ফেলছে এই ঘটনাগুলো।
সন্তানের প্রতিটি সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি ধরে রাখতে ভিডিও করলেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরার আগে একটু ভাবনাচিন্তা করে নেওয়া ভীষণ ভাবে প্রয়োজন।

একটি বাচ্চা নাচ করছে, গান করছে সঙ্গে সঙ্গে সেই ভিডিও বাবা, মায়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন, ধীরে ধীরে বাচ্চাটি যখন বুঝতে শিখছে সবকিছু, তখন সস্তায় এই যে প্রচার, এই যে লাইক, কমেন্টের বিষয়গুলো ধীরে ধীরে তাকে এই জগতের প্রতি নেশায় পরিণত করছে, আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে এই ভার্চুয়াল জগতের প্রতি। জীবনের আসল যে রূপ, ছন্দ, গন্ধ, আমাদের চারপাশের গাছপালা, মাটি, জল, প্রকৃতি, বাতাস ইত্যাদির বাস্তব রূপ থেকে ধীরে ধীরে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে একটা স্মার্ট ফোনকেই বন্ধু হিসেবে বেছে নিচ্ছে তার প্রতিদিনের যাপনে। এই সস্তা প্রচার, এই একসাথে সবকিছু পেয়ে যাওয়া, এই ভার্চুয়াল বন্ধুর জগৎ বাচ্চাটির জীবন বোধকে পালটে দিচ্ছে। কারণ সে ধীরে ধীরে শৈশব ছেড়ে সময়ের হাত ধরে আরো কিছুদূর এগিয়ে এসেছে। সস্তা প্রচারে সে এখন অনেক বেশি অভ্যস্ত।
একজন মা এবং বাবা ফেসবুকে তাদের বাচ্চার ছবি প্রতিদিন পোস্ট করছেন, কখনো নিজেদের ভালোলাগা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করছেন, সেই নির্দোষ কাজটি কি কখনো কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে? অথবা সেটা কতটুকু ঠিক?

ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার মোটামুটি সবাইকেই অনুপ্রাণিত করে। অন্যের মনোযোগ বা গুরুত্ব আমাদের সব সময় একধরনের উৎসাহ জোগায়।
মনোবিজ্ঞানের একটি সূত্র হলো, যে কাজে অন্যের উৎসাহ বা মনোযোগ বাড়ে, সেটা আমরা বেশি বেশি করতে উৎসাহিত হই।
অনেক মা-বাবাই বাচ্চাদের ছবি, ভিডিও, নিয়মিত পোস্ট করেন। নিজের অন্যতম ভালোলাগা ও ভালোবাসার জায়গা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যুক্ত থাকা অন্যতম কারণ। অনেক সময় অন্যদের কাছ থেকে ভালো উপদেশ, উৎসাহমূলক কথা শোনা, ভালো কাজে অনুপ্রাণিত হওয়া ছাড়াও এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের ক্ষেত্রবিশেষে নিজের একাকিত্ব কম বোধ করতে সাহায্য করে বা অন্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুভূতি জাগায়। অনেক সময় বাবা-মায়েরা আনন্দ থেকেই শিশুর প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড এমনকি বাচ্চার স্নান, খাওয়া, ঘুম,শিশুর নানা পারফরম্যান্সের ভিডিও, লাইভ প্রচার করেন।এ ছাড়া দেখা যায় শিশুদের বা বাচ্চাদের যে কোনো পোস্ট ফেসবুকে সহজেই জনপ্রিয়তা পায়।

মা–বাবা তাঁদের অনুভূতি বা আনন্দ নিয়ে নির্দোষভাবে কোনো ছবি পোস্ট করলেও যাঁরা দেখছেন অনেকক্ষেত্রেই অনেকের মধ্যে নানা নেগেটিভ অনুভূতি কাজ করতে পারে।
বাচ্চাদের নিয়ে যেকোনো পোস্ট তার একান্ত নিজের হওয়া সত্তে¡ও এ ক্ষেত্রে মূলত বাচ্চার হাতে কিছু থাকে না। বাচ্চাটি আসলেই চাইছে কি না, বা পছন্দ করবে কি না, সেটা ঠিক আমরা ভাবি না। নানাভাবেই জন্মের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অংশগ্রহণ অনেকখানিই নির্ধারিত হয় মা-বাবার একান্ত ইচ্ছায়।

অনেক সময় শিশুর ব্যক্তিগত ছবি,যেমন তাদের স্নানের ছবি, খালি গায়ের ছবি ইত্যাদ মা-বাবা পোস্ট করলে সন্তানের ঠিক এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু এসব ছবিতে শিশুর প্রাইভেসি নষ্ট হওয়া ছাড়াও অনেক সময় শিশুদের এসব ব্যক্তিগত ছবি পেডোফিলিক ব্যক্তিদের অর্থাৎ যারা শিশুদের প্রতি যৌনাকর্ষণ বোধ করেন, তাদের নেগেটিভ নজরে আসতে পারে।
বাচ্চাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্ভরশীলতা অনেকের জীবনেই নেগেটিভ প্রভাব পড়তেই পারে।

ছোটবেলা থেকেই শিশুদের এসব সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুকে নানাভাবে জনপ্রিয়তা বা তথাকথিত তারকার খেতাব পাওয়া ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে বাচ্চাদের মনোজগৎকেও প্রভাবিত করে। ভাচ্যুয়াল জগতে অনেকের মনোযোগ বাচ্চাকে নিজের সম্পর্কে একধরনের ভ্রান্ত ধারণা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাকে বাস্তব জগতের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। অন্যের চোখে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মানসিকতা এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বাচ্চাদের নিজের মতো করে বড় হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভার্চ্যুয়াল জগতে তার যে গ্রহণযোগ্যতা, সেটাই অবচেতনভাবে সে চারপাশ থেকে প্রত্যাশা করার মানসিকতা তৈরি হয়।
এরপর আরো একটি বিষয় হচ্ছে, একটি বাচ্চা কখন কোথায় যাচ্ছে, তার অবস্থান, স্কুল, ক্ষেত্রবিশেষে তার নিরাপত্তার জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

শিশু বা বাচ্চাদের যে বিষয়গুলো সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া উচিত —
প্রথমত- ছোট বাচ্চাদের একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, আদর করার দৃশ্য ইত্যাদি যদি বন্ধুদের দেখাতেই হয় তাহলে পাবলিক না করে ক্লোজড গ্রুপে দেওয়া ভালো।
দ্বিতীয়ত– শিশু যত ছোটই হোক, শরীরের কিছু অংশ যদি উন্মুক্ত থাকে এমন ছবি প্রকাশ না করা ভালো।
তৃতীয়ত— অন্যের শিশুর ছবি পোস্ট করার আগে তাদের মা-বাবার অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন।
চতুর্থত– সন্তান একটু বড় হলে তার ছবি, ভিডিও বা তার কোনো গল্প প্রকাশ করার আগে সন্তানের অনুমতি নেওয়া উচিত। মনে রাখা উচিত, তার শরীর বা তার কোনো কর্মকাণ্ড একান্তই তার নিজের। তার কতটুকু সে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবে, সেটার সিদ্ধান্ত তার নিজের।
অর্থাৎ সন্তানের সব ধরনের ছবি কখনোই ফেসবুকে পোস্ট করা উচিত নয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করা এখন রীতিমতো একটি নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে বুঝে না বুঝে আবেগের বসে অনেক স্পর্শকাতর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে থাকেন। কিন্তু এটি মোটেই ঠিক নয়। আর আপনার পারিবারিক ছবি বিশেষ করে সন্তানের কিছু ছবি রয়েছে যা সহজেই মানুষের নজর কাড়ে। এমন ছবি কখনোই ফেসবুকে পোস্ট করতে নেই।
অনেকেই নিরন্তর নিজেদের ছবি পোস্ট করেন। বাইরে ঘুরতে যাওয়া থেকে শুরু করে নিজের সন্তানের ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা— ছবির পর ছবি, বাদ যায় না কিছুই। জানেন কি, আপনারই পোস্ট করা বেশকিছু ছবি অনায়াসেই চলে যেতে পারে বাইরের মানুষের কাছে বা সাইবার হানাদারদের দখলে। পরে সেগুলোই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা সাইটে। সচেতন থাকতে দেখে নিন সন্তানদের কোন ছবিগুলো প্রকাশ্যে পোস্ট করা উচিত নয়।
যেমন – শিশুর স্তন্যপানের ছবি একেবারেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা উচিত নয়। স্তন্যপান করানোর মধ্যে কোনও অনৈতিক কিছু নেই।

কিন্তু বেশকিছু সোশ্যাল সাইট এই ধরনের ছবি প্রোফাইল থেকে হ্যাক করে নেয়, পরে সেগুলো ভিডিও আকারে পর্ন ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে দেয়।
বয়স এক মাস হোক বা এক বছর, কখনোই সন্তানের আপত্তিকর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে নেই। অনেকেই জানেন না, এসব ছবি নিয়ে শিশুদের ওপর পর্নোগ্রাফি ফিল্ম তৈরি করে সাইবার অপরাধীরা? বর্তমানে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সবসময় সচেতন থাকতে হবে।
আপনার সন্তানকে পার্কে বা খেলার মাঠে নিয়ে যান। ছুটির দিনে ইনডোর গেমস খেলুন। সমবয়সীদের সঙ্গে তার খেলাধুলা ইত্যাদি ছবি পোস্ট করতেই পারেন। তবে এমন কোনো ছবি দেওয়া উচিত নয় যেখানে ছেলে হোক বা মেয়ে এই ধরনের ছবি অ্যাকাউন্ট থেকে হাতিয়ে নেবার জন্য বসে থাকে হ্যাকাররা।

ফেসবুক খুললেই প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চাদের আপত্তিকর করে স্নান করানোর ছবি পোস্ট করছেন অভিভাবকরা। সেসব ছবিতে আবার বিস্তর লাইক এবং নানা ধরনের কমেন্ট-পাল্টা কমেন্ট। ছবি দিতেই পারেন কিন্তু শিশুদের অনাবৃত শরীরের নয়। অনেক সময় আবার দেখা যায় অভিভাবকরা সন্তানদের সব সময় নিজেদের সঙ্গেই ছবি তুলতে বাধ্য করেন। এমন করলে শিশুদের মনের ওপর প্রভাব পড়ে। আপনি নিজে সতর্ক থাকুন। আর সন্তানদেরও স্বনির্ভর হতে দিন।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত