ঋতু মীর : “Love is something eternal; the aspect may change, but not the essence”
১।
সাবওয়ের বগিটা আজ আশ্চর্যজনকভাবেই খালি। সত্যবতীর ঠিক উল্টা সিটে মেয়েটা বসে। যৌবনের রঙ মাখা তারুণ্যের বয়স। হাত দুটি কোলের উপর স্খলিত, দৃষ্টি বগীর জানালা ভেদ করে সুদুরের হাতছানিতে মাখামখি। বসার ভঙ্গীতে এক উদাসীন নির্জনতা। সাজগোজে বিশেষ কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি। প্রসাধনে নিখুঁত যত্নের চেষ্টা, তবু কেমন যেন অনুজ্জল ম্রিয়মান অবয়ব। পর্যবেক্ষণের নেশায় সত্যবতীর পুরো মনোযোগ এখন মেয়েটার উপর। আড়চোখে তাকায় সে। ঘুড়ি নাটাইয়ের সূতার মত তার ভাবনাটা পারিপার্শ্বিক উপাদানে মিলেমিশে গল্পের কাহিনীর মত উড়ে উড়ে এগিয়ে চলে। নড়ে চড়ে বসে মেয়েটা। সিটের পাশে শুইয়ে রাখা কাগজে মোড়ানো ফুলের বুকেটা কৌতূহলে দেখার চেষ্টা করে সত্যবতী। নিশ্চয়ই বন্ধু বা ভালোবাসার মানুষের জন্যই নিয়ে যাচ্ছে ফুল। ধবধবে সাদা এবং গোলাপির মিশ্রণে ফুলের তোড়াটা কাগজের বেষ্টনী থেকে উঁকি দিচ্ছে। ফুলের রঙের সাথে মেয়েটার পোশাকের মিল তার রুচির চমৎকার এক বহিঃপ্রকাশ। কি ফুল এটা? কেমন সুবাস এই ফুলে? বুনো অর্কিড নাকি মিষ্টি মাতাল মহুয়া? চরাচর ভাসা জ্যোৎস্নার প্লাবনে ফোঁটা গন্ধরাজ নাকি কামিনীর মাদকতা? আচ্ছা জোনাকি! উপহারের ফুলগুলো এমন কাগজ বন্দী মোড়ানো হয় কেন বলতো? কেউ কেউ আবার সুদৃশ্য র‌্যাপ দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে লাল নীল বা সোনালী রিবনে বেঁধে নিতে পছন্দ করে। এত বিরক্ত লাগে দেখতে! প্রায়শই সত্যিকারের ফুলকে প্লাস্টিকের ফুল বলে ভ্রম হয় সত্যবতীর। নাকি ফুলের মত দেখতে প্লাস্টিক ফুলগুলোই এই আদলে তৈরি? জোনাকি! জোনাকি! দ্যাখো! পৃথিবীটা কেমন নকল আর ‘রেপ্লিকা’ তে সয়লাব আজ। সব কিছুর ‘রেপ্লিকা’ হতেই হবে কেন? ফুল ফোটানোয় কি কম কষ্ট বল? সবাই কি পারে ফুলের মালি হতে? ফুলের মত ইউনিক সৌন্দর্য একটু দুষ্প্রাপ্য হবে তবেই না প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দেয়ায় আনন্দ। মনে পড়ে কোন এক ভ্যালেন্টাইন দিবসে কাজ শেষে কাউন্টারে রাখা সত্যিকারের রক্ত গোলাপ দেখিয়ে স্কুল সেক্রেটারি আন্তরিক হাসিতে বলে- সত্য! হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন! ইচ্ছা হলে নিয়ে যাও। তারও চেয়ে আন্তরিক হাসিতে সত্যবতী বলে- ‘নো থাঙ্কস! গোলাপে বড্ড কাঁটা! তাছাড়া এই কমার্শিয়াল ভালোবাসা আর বহন করি না আজ! হেসে উঠে দু’জনেই। অন্যমনস্কতায় রাস্তা ধরে হাঁটে সত্যবতী- মহিলা কি ভাবছে সত্যবতীর কেউ নেই এই ফুল দেবার? আসলেই! ভালোবেসে ঠিক এইরকম ফুল দেয়ার বা নেয়ার কেউ নেই সত্যবতীর! নতুন মনোযোগে মেয়েটাকে খেয়াল করে সত্যবতী। ট্রেনটা নির্ধারিত স্টেশনে থামতেই বিস্ময়ে হতবাক হয় সত্যবতী। ফুলের তোড়াটা বগীর মাটিতে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দ্রুত পায়ে প্লাটফর্ম অতিক্রম করে মেয়েটা। নিস্পলক তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। দেখে যতদুর দেখা যায় মেয়েটাকে। গন্ত্যব্যের নির্ধারিত স্টেশনটা মিস করে সত্যবতী। পড়ে থাকা ফুলের দিকে তাকিয়ে তার ভাবনা তখন অন্যখাতে বইছে। ফুল নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই আর। মনে মনে বলে – ভালই হয়েছে। হৃদয়ের উত্তাপহীন ‘প্লাস্টিক’ এখানেই পড়ে থাক। শুধু তুমি যেন ভালোবাসার দেশে পৌঁছে যাও মেয়ে! খালি হাতেই!

২।
ওমেনস কলেজ হসপিটাল থেকে বের হবার মুখেই পড়ে পাথরের জুয়েলারি সপটা। পৃথিবীর সমস্ত পাথরে সত্যবতীর এক দুর্দমনীয় আকর্ষণ। মনে আছে একবার প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ভেসে আসা পাথর পাগলের মত কুড়িয়ে বোঝার কারণে ফেলেই আসতে হয়েছিল। কি সুন্দর নানা বর্ণের, বিভিন্ন আকৃতির সেই পাথর! তার রাশি স্টোন ‘ডায়মন্ড’ শুনে বড় বোন ঠাট্টা করে তাঁকে ‘এক্সপেন্সিভ লেডি’ নাম দিয়েছিল। ডায়মন্ড! কি ভীষণ দৃষ্টি ভেদী আলোর ছটা! কি ভীষণ স্ফটিক স্বচ্ছ পরিস্কার! আহা! মানুষের ভিতরটা যদি এমন স্বচ্ছতায় দেখা যেতো! নাহ আজ কিছুতেই দোকানে ঢুকবে না সত্যবতী। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছেই মোহগ্রস্ত সে। কিছুদিন আগেই না নিউজিল্যান্ডের সমুদ্র ভাসা ‘পুয়া শেল’ এর ইয়ারিং আর লকেট নিয়ে গেলো! পড়ে না তেমন, অথচ কাছে রাখতেই যেন একরাশ আনন্দ। ছোট্ট দোকানটার এক কোণে দাঁড়ানো বৃদ্ধর দিকে তাকায় সত্যবতী- বাহহ! সুন্দর পাথরের নেকলেসটা কেমন চট জলদি কিনে নিল- তাইতো! ভ্যালেন্টাইন যে দরজায় কড়া নাড়ছে! মধ্যবয়সী মহিলা নিজের এবং বান্ধবীর জন্য একরকম দুইটা পাথরের মালা ঝটপট কিনে নেয়। মুখের হাসিতে কিনতে পারার গৌরব। বিক্রেতা মেয়েটাকে বলে – তোমার দোকান আমার মাথাটা সত্যি খারাপ করে দেয়। এবার সত্যবতীর পালা। আনমনে মুন, টোপাস, গারনেট এবং সবুজাভ এমেথিস স্টোন বসানো পছন্দের লকেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে সত্যবতী। বিক্রেতা মেয়েটা কাছে এসে খুব সুন্দর করে হাসে। বিক্রির বাণিজ্যিক হাসি নয়- বলে এর দাম পরিশোধে হয়তো তুমি ‘comfortable’ নও, বেশ! আমি যথাসাধ্য কমিয়েই রাখব, নিজেকে দাও এই উপহার। কাল ভ্যালেন্টাইন ডে আছে না? নেশা লাগা এক ঘোরে প্রভাবিত হয় সত্যবতী। দাম শোধ করে বের হয়ে আসে। হাঁকডাকে স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সে। জানালা ভেদ করে সকালের সোনালী রোদ তখন বিছানা ছুঁয়ে ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। নীল বাক্সে রাখা লকেটটা স্বামীর হাতে দিয়ে বলে- হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন! দেখোতো কেমন হোল? উপহারটা কিনে আনলাম তোমার জন্য! আমাকে দেবে বলে! সদা চুপচাপ নীরব মানুষ মুহূর্তেই মনের কোন নিভৃতের অন্তরালে হারিয়ে যায়। লকেটটা গলায় পড়ে সত্যবতী- কি অসাধারণ নিখুঁত সুন্দর! একদম ন্যাচারাল! (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto. Ritu.mir9@gmail.com