শুজা রশীদ : (পর্ব ১২)
আসমার সাথে প্রথম ড্রাইভিং সেশনটা যাচ্ছেতাই হল। জীবনে প্রচুর সাহস এবং দৃঢ়তা দেখালেও ড্রাইভিং করতে গিয়ে নিজের ভীরুতা দেখে একটু আশ্চর্যই হল রিমা। গাড়ি চালানো ব্যাপারটা হয়ত খুব কঠিন নয় কিন্তু রাস্তায় হাজারো গাড়ি, দানবীয় বাস, আচমকা বাইসাইকেল আর বেখায়ালী পথচারীদের ভীড় ভাট্টার মধ্যে নার্ভ ঠিক রাখাটাই তো এক বিশাল সমস্যা। ড্রাইভারের পাশে বসে থাকলে বোঝাই যায় না গাড়ি চালানো কত ঝামেলা। মিন্টু রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামলেই অন্য ড্রাইভারদেরকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে তাই গালাগালি করত। রিমা তাই নিয়ে সবসময় বকাবকি করত। প্রথম লেসনের পরই অভিমত একেবারেই পালটে গেল। তার মনে হল টরন্টোর রাস্তাগুলো ছেয়ে গেছে রাজ্যের পাগল-ছাগলে, যার যেভাবে ইচ্ছা চালাচ্ছে, অন্যের ভালোমন্দ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই।
প্রায় শূণ্য রাস্তায় সে যখন নিজের লেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটা গাড়িকে প্রায় লাগিয়ে দিয়েছিল, আসমা তাড়াতাড়ি সেদিনের মত অনুশীলন শেষ করল। প্যাসেঞ্জার সাইডে দ্বিতীয় ব্রেকটা চেপে এবারের মত একটা মারাত্বক দূর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে সে। কিন্তু তাই বলে রিমাকে কথা শোনাতে ছাড়েনি। দশ বছর ধরে গাড়ি চালানো শেখাচ্ছে সে, রিমার মত এমন দিশেহারা হতে সে নাকি আর কাউকে দেখেনি।
আসমা তাকে ক্রিসেন্ট টাউনে নামিয়ে দিয়ে, ত্রিশ ডলার নিয়ে, পরবর্তি লেসনের সময় ঠিক করবার জন্য শীঘ্রই ফোন দেবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল। ঐরকম একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেবার পর আসমা আবার তাকে নিয়ে রাস্তায় বের হবে সেই বিশ্বাস রিমার ছিল না।
“তোমাকে দেখে এমন মন খারাপ মনে হচ্ছে কেন?” ফায়জা ভ্রূ কুঁচকে জানতে চায়।
“মহিলা খুব বকাবকি করে,” রিমা অনুযোগ করে।
“কেন? কি করেছ তুমি?” ফায়জা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়।
“আরেকটা গাড়িকে প্রায় লাগিয়ে দিয়েছিলাম,” রিমা অপরাধী মুখে বলে।
ফায়জা চোখ উল্টালো। “সে ট্রেইনার। তুমি ভুল করলে বকাবকি করবে নাতো কি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে?”
রিমা কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহায়ভাবে হাসে। “গাড়ি চালানো অত সোজা না। বুকটা এমন ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। আর মহিলা এতো গম্ভীর হয়ে থাকে যে কথা বলতেই ভয় লাগে। ভাবছি মিলাকে বলব আমাকে শেখাতে।”
“না!” ফায়জা তীক্ষ্ণ কন্ঠে আপত্তি জানায়।
“না কেন?” রিমা অবাক হয়ে বলে। “আমার তো ধারণা ছিল তুই ওকে পছন্দ করিস।”
ফায়জা কাঁধ ঝাঁকায়। “করি কিন্তু তোমার উপর তার প্রভাবটা খুব একটা ভালো না।”
রিমা দাঁত বের করে হাসে। “গাঁজার জন্য বলছিস?”
“সেই তো তোমাকে নেশাখোর বানিয়েছে,” ফায়জা রাগী গলায় বলে।
“কথাটা ঠিক না,” রিমা প্রতিবাদ করে। “বার দুই তিন টেনেছি, এই যা। কসম। নেশাখোর হয়ে যাইনি। তাছাড়া, এসব তো এখন লিগাল।”
ফায়জা মুখ কুঁচকাল। “জাস্টিন ট্রুডোর কেরামতি। এখন যেখানেই যাই গাঁজার উটকো গন্ধে প্রাণ যায়। স্কাংয়ের মত গন্ধ। বিচ্ছিরি লাগে। আরেকটা কথা কি জান মা, আমার বান্ধবীরা কেউ যদি শোনে তুমি ঐসব টানো ওরা সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আমাদের সমাজের মানুষেরা এখন এইসব ভালো নজরে দেখে না।”
রিমা স্বীকার করে নিল। দেশীদের ভেতরে এটা এখনও নিষিদ্ধ বিষয়। “ভাবিস নারে, মা। তোর অপমান হয় এমন কিছু আমি করব না।”
ফায়জা কাঁধ ঝাঁকাল আবার। “দেখা যাবে।”
জিব্রানের হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য লাগবে। বোনকে ডাকাডাকি করছে। ফায়জাকে বাধ্য হয়ে যেতে হল।
রিমা হাঁড়িতে চাল চাপিয়ে দিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা ফুলকপি বের করল, চওড়া কাঠের কাটিং বোর্ডটার উপর রেখে সাবধানে কাটতে শুরু করল। এক পর্যায়ে তার হাতের ছুরি থেমে যায়, মাথায় ভর করে ভিন্ন এক চিন্তা। তারও রয়েছে একটা ভাই, মাত্র তিন বছরের ছোট। শেষবার যখন তাকে দেখেছিল সে ছিল এক লম্বা, হ্যাংলা ছেলে যার মাথা ভর্তি ছিল কোঁকড়া বড় বড় চুল। বছর দশেকের উপর হয়ে গেল তার সাথে কথা হয়নি ওর। তাকে কখন ক্ষমা করতে পারবে কিনা জানে না।
১৭.
তলপেটে সামান্য একটা ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভাঙল রিমার। প্রায় অন্ধকার ঘরে নিজের বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস চালানোর চেষ্টা করে ও, বোঝার চেষ্টা করে ঠিক কোথায় ব্যাথাটার উৎস। স্থানটা ব্যাথায় টিস টিস করছে কিন্তু ব্যাথাটা আবার এমন বেশিও নয় যে হাসপাতালে যেতে হবে। বছর দুয়েক আগে ডাক্তার ফাতিমার অফিসে প্রথম যখন গিয়েছিল তাকে বলা হয়েছিল তার ওভারিতে একটা বেনাইন সিস্ট আছে। তেমন বড় নয় যে অপারেশন করা যাবে। ডাক্তার ফাতিমা তাকে অনেকগুলো টেস্ট করতে বাধ্য করেন এবং সব রিপোর্ট দেখে শুনে ব্যাপারটা তখনকার মত সেভাবেই রেখে দেন। কিন্তু তাকে বলে দেন সবসময় খেয়াল রাখতে। যদি অস্বাভাবিক কোন কিছু ঘটে তাহলে যেন সাথে সাথে তাকে জানান হয়। এটাকে কি অস্বাভাবিক বলা যাবে? তার বেনাইন সিস্ট কি শেষাবধি খারাপ কিছুতে রুপান্তরিত হচ্ছে? ভাবতেই তার বুকটা ঠান্ডা হয়ে আসে। কোন কারণে তার যদি হঠাত মৃত্যু হয় তাহলে তার তিনটা ছেলেমেয়ের কি হবে? কে দেখবে তাদেরকে? সরকার কি তাদেরকে দত্তক দিয়ে দেবে? ভাবতেই তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামে।
কষ্ট করে হলেও বিছানা থাকে নামে রিমা, কোনরকমে ওয়াশরুমে যায়। মিন্টুর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর থেকে এই সমস্যাটা শুরু হয়েছে। সবসময় মনে হয় দুনিয়ার যাবতীয় খারাপ ব্যাপারগুলো এসে হামলে পড়বে ওদের উপর। ক্যানসারের দুশ্চিন্তাটা তারই ফল, নিজেকে বোঝাল ও।
ওয়াশরুমের আলো ছায়ায় টয়লেট সিটে বসে দুই হাতের তালুতে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে ও। যতই চেষ্টা করুক মাথা থেকে কিছুতেই অশুভ চিন্তাটা তাড়াতে পারে না। কত মানুষ ক্যানসার ধরা পড়ার পর মাস ঘুরতে না ঘুরতে মারা যায়। তার তেমন কোন পরিণতি হবার আগেই ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার দিকটা তাকে যেভাবেই হোক নিশ্চিত করতে হবে, সংকল্প করে সে।
হাতের তালু থেকে মাথা উঁচিয়ে অন্ধকারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রিমা, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। সময় এসেছে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর সাথে আবার যোগাযোগ করার। অতীতে অনেক কিছু ঘটেছে, ভুল্ভ্রান্তি হয়েছে সব পক্ষেরই, কিন্তু এখন সময় এসেছে সেই সব ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করার। তার প্রিয় জনেরা কখন তার বাচ্চাগুলোকে পথে ফেলে দেবে না, রিমার প্রতি তাদের যতই রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ থাকুক না কেন।
দরজায় টোকা পড়ছে। মুহূর্তের জন্য রিমা ভেবেছিল বোধহয় সেই নিশুতি রাতের দুর্বৃত্ত আবার এসেছে জ্বালাতে। ফায়জার গলা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। “মা! মা! ঠিকঠাক আছো?”
রিমা টয়লেট থেকে উঠে ফ্লাশ করে, মুখ ধোয়, ওয়াশরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে মুখোমুখি হয় ফায়জার। মেয়েটার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
“এতো তাড়াতাড়ি উঠেছিস কেন?” রিমা জানতে চায়।
“শুনলাম তুমি গোঙাচ্ছ। তারপর উঠে ওয়াশরুমে গেলে। বিশ মিনিট হয়ে গেছে বের হচ্ছ না।”
রিমা মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। “যা, শুয়ে পড় আবার। আমি ঠিক আছি।”
“সত্যিই?” ফায়জার দুশ্চিন্তা কাটে না। “খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে নাকি?”
“মনে হয়। এবার যা, আরেকটু ঘুমা।”
রিমা ফায়জাকে তার কামরায় পাঠিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নেয়, তারপর যায় বেলকনিতে, ভোর না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই মেঝেতে চুপচাপ বসে থাকে।
পরদিন দুইটার দিকে দোকানের কাজটা শেষ হওয়ার পর মিলাকে ফোন করে রিমা। জানত ওর ব্যাথা হচ্ছে শুনলেই সব কিছু ফেলে ছুটে আসবে মিলা। বাস্তবে তাই-ই হল। মিলা কাজ থেকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে গাড়ি নিয়ে এসে ওকে দোকান থেকে ঝট করে তুলে নিয়ে ডাক্তারের অফিসে নিয়ে গেল। ডাক্তার ফাতিমার সারাদিনের শিডিউলে কোন ফাঁকা ছিল না কিন্তু তারপরও রিমার জন্য একটুখানি সময় বের করলেন তিনি। কিছু টেস্ট করতে বললেন, কয়েকটা ওষুধের জন্য প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন।
“ভয় পেও না,” তার স্বভাবজাত স্নেহার্দ্র কন্ঠে বললেন ডাক্তার ফাতিমা। “বেনাইন সিস্টও মাঝে মাঝে ব্যাথা করতে পারে। তোমার মত এতো কম বয়েসে ক্যান্সারাস সিস্ট হবার কথা নয়।”
রিমা তার কথা বিশ্বাস করেনি। হয়ত তাকে মানসিকভাবে জোর দেবার জন্য হালকা করে বলেছেন ডাক্তার ফাতিমা। তার বয়েস ষাটের একটু বেশি, মাথা ভর্তি সাদা চুল আর চোখে পুরু কাঁচের চশমা। তার চেহারায় সব মিলিয়ে যেন একটা দ্যুতি আছে। সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, তার কথা শুনেই রিমার মনটা ভালো লাগে।
কাজে মিলার পরবর্তি ব্রেক নেবার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। দুজনে আশেপাশে কোথাও কোন কফির দোকানে গিয়ে বসবে বলে স্থির করেছে। চারদিকে অনেক কফি শপ। মিনিট দুয়েক হাঁটলেই পড়ে টিম হর্টন। রিমাকে বলল একটুক্ষণ অপেক্ষা করতে। মিলাকে পরবর্তি রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের অফিসের দিকে যেতে দেখে রিমা ওয়েটিং রুমে একটা শূন্য চেয়ারে জাঁকিয়ে বসল। এখানে এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া সাধারণত ঢোকা যায় না। কামরাটাতে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ। স্বভাববশতঃ চারদিকে নজর বোলায় রিমা। এক কোণে তিনজন মাঝবয়েসী দেশী ভদ্রমহিলা ঠেসাঠেসি করে বসে, অন্য পাশে একজন দেশী ভদ্রলোক একাকী বসে আছে। তার পরনে টাই ছাড়া কালো স্যুট, কালো জুতা, কিঞ্চিৎ লম্বা চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো, পরিষ্কার করে শেভ করা। স্পোর্টস ইলাসট্রেটের একটা সংখ্যা মুখের সামনে মেলে ধরে গভীর মনযোগে কিছু পড়ছে লোকটা। ওয়েটিং রুমে একটা টেবিলের উপর গাদি করে রাখা অনেকগুলো পুরানো সংখ্যা রয়েছে পত্রিকাটার, সেখান থেকেই একটা তুলে নিয়েছে নিশ্চয়। পত্রিকার আড়ালে তার মুখটা মূলত ঢাকা থাকলেও কেন যেন তাকে ভীষণ পরিচিত মনে হল।
রিমা চোখ সরিয়ে নিল, মনে করার চেষ্টা করল কয়েকটা মুহূর্ত, তারপর আবার ঘুরে তাকাল আরেকবার ভালো করে দেখার জন্য। ক্ষতটা নজরে পড়ল এবার। লোকটার বা দিকের কপালের উপর থেকে বা কানের মাঝামাঝি পর্যন্ত- তিন ইঞ্চির একটু বেশিই হবে। সময়ের সাথে সাথে ক্ষতটার উৎকটতা অনেকখানি কমে এসেছে কিন্তু তারপরও তাকালেই চোখে পড়ে। ঐ ক্ষতটার একটা ইতিহাস আছে। এবং ঐ মানুষটার একসময় রিমার প্রতি ছিল অসম্ভব আসক্তি। বহু দিন আগের কথা কিন্তু তার কাছে সবকিছু এখনও এতো জীবন্ত যে মনে হয় যেন মাত্র সেদিনের কথা।
রিমা যখন চোখ ফিরিয়ে নিল না, ভদ্রলোক ম্যাগাজিনের পাতা থেকে নজর তুলে উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরল। এক জোড়া শান্ত চোখে ভালোমানুষী উষ্মতা। কয়েকটা নীরব মুহূর্ত পেরিয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে তার পুরুষ্ঠু ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে পড়ে এক টুকরো বিশাল হাসি, তার মুখটাকে উজ্জ্বল করে তোলে এক শিশুসুলভ নিষ্পাপতায়- ঠিক যেভাবে তাকে মনে আছে রিমার।
“নোমান ভাই!” রিমা একরকম চিৎকার করে ওঠে। নোমান ওর চেয়ে বছর দশেকের বড় ছিল, ঢাকায় যে পাড়ায় রিমারা থাকত দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ওদের পাশের বাসাতেই থাকত সে।
“রিমা!” সে শান্ত কন্ঠে বলে যদিও তার চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে আনন্দে এবং বিস্ময়ে। রিমার মনে আছে লোকটা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির ছিল।
“কত বছর পর দেখছি তোমাকে!” রিমা উত্তেজিত কন্ঠে বলে। “দশ বছর তো হবেই, না?” মনে মনে দ্রæত হিসাব করে সে। কানাডা আসার আগে শেষবার তাকে দেখেছিল ও। ফায়জা তখন তিন, জিব্রান কোলে। দশটা বছর! মনে হয় না এতোটা সময় পেরিয়ে গেছে। সেই আগের মতই দেখতে আছে মানুষটা, শুধু মাথায় চুলের ঘনত্ব কিছুটা কমেছে, ওজনটা একটু বেড়েছে। কিন্তু সেই সুদর্শণ মুখ, শিশুসুলভ আচরণ আর নিষ্পাপ সেই হাসিটা এখনও সেই আগের মতই রয়ে গেছে, একটুও পালটায়নি।
নোমান তার চোখে চোখ রেখে বোকার মত কয়েকবার উপরে নীচে মাথা দোলায়, তার পর হঠাৎ লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজের হাতের উপর নজর রাখে। “দশ বছর? কেমন ছিলে?”
রিমা ঘাড় ঝাঁকাল। “যতটুকু ভালো থাকা যায়। আর তুমি? কানাডা কবে এসেছ?”
“বছর চারেক আগে,” নোমান বলে, চোখ তুলে আবার রিমার দিকে তাকায়।
মুচকি হাসে রিমা। সেই প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল এখনও সেই রকই আছে সে। রিমা ছিল ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্রী আর নোমান গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা কম্পিউটার ফার্মে সিনিয়র প্রোগ্রামার হিসাবে কাজ করছিল। তাদের পরিবার মাত্র কিছুদিন হল রিমাদের পাশের বহুতল এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে বড় সড় একটা চার বেডরুমের এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে এসে উঠেছিল।
রিমা প্রথম কয়েক মাস তাকে লক্ষ্যও করেনি। যখন হঠাৎ করে বাসায় ফুল আসা শুরু হল তখন তার টনক নড়ে। প্রথমে বুঝতেও পারেনি কে পাঠাচ্ছে। যখন ফুলের সাথে সাথে টেক্সট মেসেজ আসতে শুরু করল তখন প্রথম খেয়াল করে তাকে। এরপর যত্রতত্র তার দেখা মিলতে লাগল। কি করবে বুঝতে পারছিল না রিমা। তার চেয়ে বয়েসে এতখানি বড় একজন পুরুষের এমন ছেলেমানুষি আগ্রহ আর আসক্তি দেখে বিরক্তই হচ্ছিল। সেই সময়ে ঘটকালীর বিয়েতে বছর দশেকের পার্থক্য হয়ত তেমন অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না কিন্তু জেনেশুনে একটা অল্প বয়স্ক মেয়ে বয়েসী একটা ছেলের প্রেমে পড়বে সেই সম্ভাবনা কমই ছিল। লোকটার প্রতি রিমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। সে শুধু চাইত লোকটা কোন একভাবে তার জীবন থেকে চিরতরে উধাও হয়ে যাক। ফুল সে চায় না, টেক্সট মেসেজ চায় না, সে যেখানে যায় সবখানেই তার উপস্থিতি সে চায় না।
“তারপর?” রিমা হাসিমুখে বলে, লোকটাকে আরোও কিছু বলার জন্য উৎসাহ যোগানোর চেষ্টা করে। তার ভাবতেও অবাক লাগে এমন একটা সময় ছিল যখন এই লোকটাকে দেখলেই তার সমস্ত শরীর রাগে জ্বলে উঠত, সে যদি বাসের নীচেও চাঁপা পড়ে মরত সে হয়ত বিন্দুমাত্র কষ্ট পেত না। কিন্তু তখনও এই মানুষটাকে তার চিনবার সুযোগ হয়নি।
“একটা ইনস্যুরেন্স কম্পানীতে টেকনিকাল লিড হিসাবে কাজ করছি,” নোমান যোগ করে। তারপর আবার নীরব হয়ে যায় যেন তার যা যা বলার ছিল সব বলা হয়ে গেছে। তারপর লাজুক দৃষ্টিতে তার দিকে বার দুয়েক তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেই একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ওকে লক্ষ্য করে। “ডাক্তারের কাছে কেন এসেছ? সব ঠিক আছে তো?”
তার দৃষ্টিতে উদ্বেগটুকু দেখে ভালো লাগে রিমার। সে জানে তার প্রতি এই মানুষটার ভালোবাসায় কোন কৃত্রিমতা নেই। মাথা নাড়ে। “তেমন খারাপ কিছু না। এবডোমিনাল সিস্ট আছে। ডাক্তার বলেছে আপাতত চিন্তার কোন কারণ নেই। কিন্তু তুমি এখানে কি করছ? তোমার স্ত্রীর কোন সমস্যা?”
“না, এক আত্মীয়ার জন্য এসেছি। আমাকে এসে একটু খোঁজ খবর নিতে বলল।” হঠাৎ বিষয়বস্তু পালটে বলল, “তোমাকে আবার দেখে খুব ভালো লাগছে। একাই এসেছ?”
“হ্যাঁ!” রিমা বলে। “আমার বান্ধবী কাজ করে এখানে। ও-ই গিয়ে নিয়ে এসেছে।” নোমানের জীবন নিয়ে আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ওর বউয়ের কথা, বাচ্চাদের কথা, কোথায় থাকে ইত্যাদি। কিন্তু নোমানের আচরণ দেখে মনে হল ঐ সব ব্যাপারে কথা বলার আগ্রহ তার খুব একটা নেই। সে যদি স্থানীয় কাগজ পড়ে আর স্থানীয় টিভি চ্যানেল দেখে তাহলে রিমার সম্বন্ধে সে ইতিমধ্যে সবই জেনে গেছে।
মিলা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। “চল,” রিমাকে লক্ষ্য করে বলে।
রিমা নোমানের দিকে তাকাল। “আমার যেতে হবে” কিন্তু এভাবে এই আচমকা সাক্ষাতের পরিসমাপ্তি টানতে চাইছিল না ও, এই মানুষটার কাছ থেকে এভাবে বিদায় নেয়াটা যথাযথ মনে হচ্ছিল না। আরোও কত কথা বলার ছিল। কিছুই তো বলা হল না।
নোমান মাথা দোলায়। “রিমা, এভাবে তোমার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল।”
রিমা দ্বিধান্বিতভাবে উঠে দাঁড়ায়। আশা করেছিল নোমান হয়ত ওর ফোন নাম্বার চাইবে কিংবা নিজের একটা বিজনেস কার্ড ওকে দেবে যেন পরবর্তিতে যোগাযোগ করতে পারে। নোমান কিছুই করে না। রিমা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে মিলার দিকে কয়েক পা এগোয়, থামে, মন স্থির করে নিজের সেল ফোনটা বের করে আবার হেঁটে নোমানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। “নোমান ভাই, তোমার ফোন নাম্বারটা দাও। আমি তোমাকে একটা মিস কল দেই। তাহলে আমার নাম্বারটাও তোমার কাছে থাকবে।”
নোমান মনে হল একটু বিব্রত বোধ করল। বিড়বিড় করে নিজের ফোন নাম্বারটা বলল। রিমা নাম্বারটা ডায়াল করল, নোমানের ফোন বেজে উঠতে লাইন কেটে দিল। নোমান দ্রæত নাম্বারটা সেভ করল। হাসল রিমা। “আসি এখন।”
“এসো,” নোমান নীচু কন্ঠে বলে।
রিমা আড়চোখে লক্ষ্য করল নোমানের হাতে কোন বিয়ের আংটি নেই। সব বিবাহিত পুরুষেরা অবশ্য আংটি পরে না। শুধু ঐটা দেখে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছান যায় না।
মিলার পিছু পিছু ডাক্তারের অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে আবার পিছু ফিরে তাকায় রিমা, ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল নোমান, ওকে তাকাতে দেখেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে পত্রিকায় মুখ গুঁজল। মনটা খারাপ হয়ে গেল রিমার। ওর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মানুষ ছিল নোমান। ওদের সেই বন্ধুত্বের ইতিহাস লিখতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। তার সাথে এতো খাপছাড়াভাবে বিদায় নেয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু নোমানকে দেখে মনে হয়েছে সে যেন ইচ্ছে করে দূরত্ব বজায় রাখছে।
মিলা বলল, “কে রে লোকটা?”
“ওর নাম নোমান,” রিমা নীচু স্বরে বলে। “আমরা খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলাম। ওর সাথে ভীষণ একটা অন্যায় করেছিলাম। ক্ষমার অযোগ্য।”