শুজা রশীদ : (পর্ব ১১)
পিন্টু সদর দরজা খুলবার জন্য পকেট থেকে চাবি বের করেছিল কিন্তু সেটা ব্যবহার করবার আগেই দরজা খুলে গেল। মা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, শান্ত সমাহিত চেহারা। হাতের ইশারায় পিন্টুকে ভেতরে ঢুকতে বললেন তিনি। সে নীরবে ভেতরে ঢুকল। বোঝাই যাচ্ছে মায়ের মেজাজ ভালো নেই, কেন কে জানে কিন্তু কিছু না জেনে সে ঝট করে কিছু একটা বলে বসে পরে বিপদে পড়তে চায় না। নীতা দরজা বন্ধ করে লিভিংরুমের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলেন। সে লিভিংরুমে গিয়ে একটা সোফায় বসল। বাসার ভেতরে খুব চুপচাপ যার অর্থ বাবা বাসায় নেই। সম্ভবত মসজিদে গেছেন যেখানে ইদানীং অনেকটা সময় ব্যায় করেন তিনি। বাসায় থাকলে রাজ্যের জিনিষপত্র নিয়ে পড়েন- অকেজো বাথরুম ফ্ল্যাশ ঠিক করা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের ক্লোজেট ডোর পাল্টানো পর্যন্ত এবং সর্বক্ষণ অকারণে প্রচুর শব্দ করেন।

পিন্টুর মুখোমুখি একটা সোফায় সশব্দে বসলেন নীতা। একটা খয়েরী রঙের সুতির শাড়ি তার পরনে, কাঁচা পাকা লম্বা চুল শক্ত করে খোপা করে বাঁধা। একটা সময় ছিল যখন তার ছেলেরা তাকে প্যান্ট শার্ট পরানোর খুব চেষ্টা করেছিল, তিনি ঠিক রপ্ত করতে পারেননি। নিজের জন্মভূমি থেকে অর্ধেকটা পৃথিবী পেরিয়ে এসেছেন, তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন তার সহ্য হবে না। বারো বছর আগে যে নীতা দেশের মাটি ছেড়েছিল তিনি আজও সেই মানুষটিই রয়ে গেছেন। তিনি শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরেন না এবং ভাত এবং একগাদা মসল্লা দিয়ে রান্না করা তরকারী ছাড়া আর কিছু খান না। নিজের জীবন ধারাকে পরিবর্তন না করতে বদ্ধপরিকর তিনি।

“কি হয়েছে, মা? এতো গম্ভীর হয়ে আছো কেন? খারাপ কিছু হয়েছে?” পিন্টু নীরবতা ভেঙে জানতে চায়। নীতার মেজাজের কোন ঠিক ঠিকানা নেই, এই ভালো তো এই খারাপ।
“তোকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক ঝামেলার মধ্যে আছিস,” তাকে তী² দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন নীতা।

“আমি ঠিক আছি মা। তোমার কি সমস্যা হয়েছে তাই বল,” পিন্টু ধৈর্য ধরে বলে।
“ডিটেকটিভের সাথে তোর কথা হয়েছে?” নীতা এবার মূল বিষয়ে যান।
“মার্সেল? আজকেই আলাপ হয়েছে। কেন?” পিন্টু জানে লোকটা বাসায় ফোন করেছিল। আব্বার কাছ থেকে জেনেছে। কিন্তু মাকে সেটা বুঝতে দিল না।
“বাসায় ফোন করেছিল সে। বলেছে তুই যেন ওকে আর বিরক্ত না করিস।” ওকে বলার সময় নীপার কন্ঠে পরিষ্কার উষ্মা প্রকাশ পায়। রিমাকে তিনি কখনই পছন্দ করেননি। মিন্টুর মৃত্যুর পর সেই অপছন্দ ঘৃণায় রুপান্তরিত হয়েছে। রিমার নাম নেয়া তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন এবং এই বাসায় কেউ তার নাম নিলে ক্ষেপে যান। অধিকাংশ সময় মেজাজ ভালো থাকলে তিনি রিমার প্রসঙ্গ উঠলে ‘ও’ কিংবা ‘সে’ বলে চালান, মেজাজ খারাপ থাকলে স্রেফ গালাগালি করেন।
“কি করেছিস তুই?”

“কথা বলতে গিয়েছিলাম,” পিন্টু শান্ত গলায় বলে। “আব্বা বলেনি তোমাকে?”
“বলেছে,” নীতা বিরক্ত কন্ঠে বললেন। “তুই মিথ্যা বলেছিস কেন? ওর বাচ্চাদের তো আমি কখন দেখতে চাইনি। তোর বাবা কি দেখতে চেয়েছিল? ঐ বাচ্চারা আমাদের পরিবারের কেউ না। ওদের জন্য আমার কোন টান নেই।”
পিন্টু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। রিমার সাথে যখন কথা বলতে গিয়েছিল, বাচ্চাদের কথা ভাবছিল না সে। অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলাপ ছিল। মার্সেলের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বাচ্চাদের ব্যাপারটা ঝট করে মাথায় চলে এসেছিল।
“রবিনের জন্যও না?” পিন্টু জানতে চায়। “সে তো মিন্টু ভাইয়ের ছেলে।”
নীতা ঠোঁট বাকালেন। “সেটাতো আবার হাবা-গোবা! এটা ওর দোষ। মিন্টু যদি একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করত কক্ষন এই জাতীয় একটা বাচ্চা হত না ওর। কত করে বললাম এই বারো ভাজাকে বিয়ে করিস না” ঝট করে থেমে গেলেন তিনি, তার কন্ঠ কান্নায় বুজে এলো, দু’ চোখ পানিতে ভরে উঠল। মিন্টু যে তার কত প্রিয় ছিল সেটা জানতে কারো বাকি নেই। সে ছিল তার প্রথম সন্তান, তার চোখের মনি। তাকে হারানোর দুঃখ বর্ণানাতীত। যখনই ছেলেটার নাম নেন তার দু’ চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামে।

“প্রতিবন্ধী হলেও ঐ ছেলেটা আমাদের পরিবারের অংশ,” মিন্টু নরম গলায় বলে। কি কারণে সে রিমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সেটা মায়ের কাছে প্রকাশ করতে চায় না। শুনলে নীতা মেনে নিলেও আব্বা মানবেন না। সুতরাং দুজনার কাছ থেকেই গোপন রাখা ভালো। আপাতত।
“বাচ্চাটার কথা থাক,” নীতা রাগী গলায় বললেন। “ওকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায় সেটা নিয়ে ভাব। দেশে আমার পরিবার ছিল জমিদার। আমাদের হাজার হাজার বিঘা জমি ছিল। দশ বিশটা গ্রাম ছিল আমাদের হাতে। মানুষ আমাদের সম্মান করত, ভয় পেত। আমাদের কারো কেউ কোন ক্ষতি করলে আমরা কক্ষন এমন ভিজে বিড়ালের মত চুপচাপ সেটা মেনে নিতাম না। আমার কথা বুঝতে পারছিস তুই?”

মাকে নিজের পরিবার নিয়ে গর্ব করতে এই প্রথম শুনল না পিন্টু। বাংলাদেশে সামুদ্রিক এলাকায় কোন এক সময় তার পূর্ব পুরুষেরা অনেক ধনবান এবং ক্ষমতাশালী ছিলেন। তাদের সেই বিত্ত এবং ক্ষমতা বহু আগেই গত হয়েছে কিন্তু সুযোগ পেলে নীতা তা নিয়ে গর্ব করতে কখন ছাড়েন না। মায়ের চোখের আড়ালে গিয়ে তাই নিয়ে সে এবং মিন্টু হাসাহাসি করত।

“পুলিশ তদন্ত করছে, মা,” পিন্টু বলে, মায়ের ইঙ্গিতটা না বোঝার ভান করে। রিমার কোর্ট অর্ডার সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে সে ইতিমধ্যেই বিপাকে আছে। মার্সেল এবারের মত ছেড়ে দিয়েছে। পরেরবার ভাগ্য দেবী আর কৃপা নাও করতে পারে। কোন অবস্থাতেই জেলে যেতে চায় না ও। পরিবারের সুনাম তো নষ্ট হবেই, ব্যাবসারও বদনাম হবে।
“পুলিশ আমার মুন্ডু করবে!” নীতা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন। “ঐ ডিটেকটিভ নির্ঘাত ওর সাথে প্রেম করছে। মিন্টুর খুনের সব তথ্য-প্রমাণ ইতিমধ্যেই নষ্ট করে দিয়েছে যেন ঐ মেয়েকে কেউ দোষ দিতে না পারে। সারা দুনিয়ায় পুলিশ হচ্ছে চোর বাটপার। এই ডিটেকটিভকে আমি বিন্দু মাত্র বিশ্বাস করি না।”

পিন্টুও ঐ লাইনেই ভাবছিল। সে খুব একটা আশ্চর্য হল না। সে বরাবরই মায়ের মত। “কি করতে বল আমাকে?” জানতে চাইল। মায়ের মাথার মধ্যে ঠিক কি ঘুরছে ধরতে পারছে না।
নীতা বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে, দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। ভাবছেন। “মিন্টুর ইন্স্যুরেন্স পলিসি সম্বন্ধে খবর নিয়েছিস?”
“ইন্স্যুরেন্স?” পিন্টু সতর্ক ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকাল। “নেইনি। কেন?।”
“শুনেছি কেউ আত্মহত্যা করলে তার ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক?”
“পলিসিতে কি ধরনের শর্ত দেয়া থাকে তার উপর নির্ভর করে। কিন্তু মিন্টু ভাই আত্মহত্যা করেনি। ও দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিল না।” পিন্টু জোর দিয়ে বলে।
“জানি। আমার ছেলে কখন এমন কাজ করবে না। তুই খবর নে মিন্টু আমাদেরকে ওর বেনিফিসিয়ারি বানিয়েছিল কিনা। ঐ টাকায় আমাদেরও সমান অধিকার আছে।” নীতা চোখ তুলে সরাসরি পিন্টুর দিকে তাকালেন। “পিন্টু, আমরা সবাই জানি ও টাকার জন্য আমার ছেলেটাকে মেরেছে। এই কাজ ও আগেও করে পার পেয়ে গেছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না।”

পিন্টু মাথা চুলকাল। ঐটা নিয়ে আলাপ করবার জন্যই রিমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ইন্স্যুরেন্স পলিসিটা নিয়ে আরোও তথ্য জানতে চেয়েছিল।
“যদি ওকে একমাত্র বেনেফিসিয়ারি করে গিয়ে থাকে ভাইয়া তাহলে আমাদের আর করার কি থাকবে?” পিন্টু চিন্তিত মুখে বলল।
নীতা ভ্রূ কুঁচকালেন। “আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? একটা উপায় বের কর। সে একা একটা মেয়ে, সাথে তিন বাচ্চা। তাকে ভয় পাওয়ানোটা কি খুব কঠিন কাজ? বোঝা ওকে টাকাটা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করা ছাড়া ওর অন্য কোন উপায় নেই। তোর বাবার মুখে শুনেছি আমাদের ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মিন্টুকে তো ফেরত পাবো না। কিন্তু ওর জীবনের বদলে কিছু একটা তো পেতে হবে। ঐ ডাইনীটাকে আমি সব নিতে দেব না। বুঝতে পারছিস?”

পিন্টু মাথা নাড়ল। দেশে থাকতে সে বেশ কিছু জঘন্য কাজ কর্ম করেছে। রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকার জন্য তার কোন সমস্যা হয়নি। মিন্টু ছিল উদীয়মান তারকা। প্রতিবারই পিন্টুকে বাঁচানোর কোন না কোন একটা উপায় সে বের করে ফেলত। এই দেশে এসে তারা চেষ্টা করেছে অহেতুক ঝুট ঝামেলায় না জড়াতে। এখানে নিয়ম কানুন ভিন্ন। দুর্নীতি থাকলেও তার আকার এবং প্রকৃতি ভিন্ন। এখন পর্যন্ত রিমাকে অপদস্থ করবার জন্য যা যা সে করেছে কোন বড় ধরনের ঝামেলায় না গিয়ে তার চেয়ে বেশি আর কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
“আমাকে কি করতে বল, মা?”
“তোকেই কিছু করতে হবে সেটা কে বলেছে?” নীপা ধমকে উঠলেন। “একটা উকিল টুকিল ধর। ওকে কেসের ভয় দেখিয়ে ভড়কে দে। তোর কি ধারণা সে বছরের পর বছর কোর্টে গিয়ে কেস লড়তে চাইবে? আমার তা মনে হয় না।”

পিন্টু ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করল। বুদ্ধিটা পছন্দ হল ওর। অধিকাংশ মানুষ কোর্ট কেসের কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়বে। রিমা কঠিন মেয়ে কিন্তু তারপরই বর্তমান পরিস্থিতিতে সে নিশ্চয় দুর্বল হয়ে আছে। একটু চাপ দিলে হয়ত কাজ হতে পারে। উঠে দাঁড়াল ও। “ঠিক আছে, মা, বুদ্ধিটা আমার পছন্দ হয়েছে। আরেকটু চিন্তা করে দেখি।”
“শুধু চিন্তা করিস না,” নীতা তেঁতো গলায় বললেন, “কিছু একটা কর। জোর যার মুলুক তার, মনে রাখিস।”

মিন্টু অর্থহীনভাবে কয়েকবার মাথা নাড়ল। কিছু একটা কর বলাটা সহজ। ঝামেলায় পড়ে গেলে তখন কে সামলাবে? সে তো আর আগের সেই যুবক নেই যার দায়িত্ব বোধ বলতে কিছু ছিল না। এখন তার স্ত্রী এবং দুটি বাচ্চা আছে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর একটু বেপরোয়া হয়ে কিছু কাজ সে করেছে কিন্তু তারপরও সীমা সে পার হয়নি, মরিয়ম সেটা নিশ্চিত করেছে। মরিয়ম শান্ত স্বভাবের মানুষ, মায়া-দয়ার শরীর। এই পরিবারে তার উপস্থিতি প্রায় অদৃশ্য কিন্তু পিন্টুকে সে কোন না কোনভাবে ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে রেখেছে।
“আমার রেস্টুরেন্টে ফিরতে হবে,” পিন্টু সদর দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে। “আব্বা কখন বাসায় ফিরবে?”

“কে জানে?” নীতা তিক্ত গলায় বললেন। “নেড়ি কুত্তার মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে রেস্টুরেন্টে কেন বসিয়ে রাখছিস না?”
পিন্টু তার প্রশ্নের জবাব দেয় না। ইদানীং লাট্টু ভীষণ ধার্মিক হয়ে গেছেন এবং দিনের অধকাংশ সময় হয় তিনি মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ান নয়ত তাদের টাকা পয়সা তুলতে নানাভাবে সাহায্য করেন। জাগতীয় ব্যাপার স্যাপার থেকে খুব দ্রæত নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এখনও মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে হাজির হন কিন্তু তার হার দ্রæত কমে আসছে। পিন্টুর তাতে কোন সমস্যা নেই। রেস্টুরেন্ট সে একাই ভালো সামলাতে পারে।
“আমি তাকে বিরক্ত করতে চাই না। যা করছে করুক,” বলতে বলতে দরজা পেরিয়ে বাইরে পা রাখে সে।
“বাচ্চারা কোথায়?” তার পিছু নিয়ে দরজার সামনে আসেন নীতা। “মরিয়ম ওদেরকে সাথে নিয়ে গেছে নাকি?”
“না। ওরা স্কুলে। বাস ওদেরকে ঠিক সময়ে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ঠিক আছে মা, আমার যেতে হবে। রাতে দেখা হবে।” পিন্টু দরজাটা বন্ধ করে দ্রুত গাড়িতে চাপল। সুফির উপর তেমন আস্থা নেই। যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে ততই ভালো।
গাড়ি ড্রাইভওয়ে থেকে পিছিয়ে নিতে নিতে দেখল মা জানালার পেছন থেকে পর্দা সরিয়ে ওকে দেখছেন। গিয়ার পাল্টানোর আগে হাত নাড়ল ও, তারপর গাড়ি ছুটিয়ে দিল। আব্বা হঠাত করে এতো বাইরে বাইরে সময় কাটানো শুরু করবার পর মা অনেক একাকী হয়ে পড়েছেন। বাচ্চারা অবশ্য তাকে ভীষণ পছন্দ করে। তাদের সাথে তার আচরণ একেবারেই অন্যরকম। সাড়ে তিনটার দিকে স্কুল থেকে ফিরবে ওরা। স্কুল বাস বাসার একেবারে সামনে ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে যায়। বাসটাকে আসতে দেখলেই নীতা দরজা খুলে বাইরের আঙিনায় গিয়ে দাঁড়ান। পিন্টু এবং মরিয়মের জন্য এটা একটা আশীর্বাদের মত। ওরা দুজনে নিশ্চিন্তে রেস্টুরেন্টে কাজ করতে পারে, বাচ্চাদের নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা থাকে না।

১৬.
লিয়াকত কথা রেখেছে, দুই দিন পর ঢাকা গ্রোসারীতে এসে সে একরকম জোর করে রিমাকে নিয়ে গেছে আসমা আলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। রিমা যতদিন ধরে তাকে চেনে সে বরাবরই এইরকম। তাকে কিছু একটা করতে দিলে সেটা না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। রিমা যতদিন না মিন্টুর গাড়ী চালিয়ে সারা শহর চক্কর দিতে পারছে ততদিন পর্যন্ত সে পিছনে লেগে থাকবে।
ড্রাইভিং স্কুলটা ড্যানফোর্থ এভেনিউ আর ড্যানফোর্থ রোডের কোণে অবস্থিত, ঢাকা গ্রোসারী থেকে খুব একটা দূরে নয়। আসমা আলী মাঝ বয়েসী ধর্ম ভীরু মহিলা, হিজাবী। তার নীল রঙের হিজাব শক্ত করে মাথার চারপাশে বাঁধা, একটা চুল পর্যন্ত দেখা যায় না। একই রঙের একটা বোরখা তার পরনে, শুধুমাত্র হাত আর পায়ের পাতা বাইরে। তার স্বভাব বেশ গুরু গম্ভীর, কথা বলে কাটা কাটা। প্রথম পরিচয়ে তার কাটখোট্টা ব্যবহার তেমন একটা পছন্দ হল না রিমার।
“আগে কখন ড্রাইভ করেছ?” আসমা জানতে চাইল, রিমার দিক থেকে তার দৃষ্টি সরে গিয়ে স্থির হল সামনে রাখা একটা ছাপানো কাগজের উপর।
রিমা মাথা নাড়ে। না। তখনও ঠিক বুঝতে পারছে না লিয়াকত এতো তাড়াহুড়া করে ওকে কি ধরণের পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে। ড্রাইভিং শেখাটা তার দরকার কিন্তু খুব একটা বেশী টাকাপয়সা দেবার সামর্থ তার নেই।
“আসমা আপা, একদম চিন্তা করবেন না,” লিয়াকত ঘোষণা দিল। “ভাবী চোখের পলকে ড্রাইভিং শিখে ফেলবেন।”

“কারো কারো শিখতে অনেক সময় লাগে,” আসমা বলল। “শুরু করতে পারি। খান দুই ক্লাশ হবার পর বুঝব মোট কতগুলো লেসন লাগবে।”
লিয়াকত রিমার দিকে তাকিয়ে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিল। “বলেছিলাম না? আসমা আপা আপনাকে চোখের পলকে ড্রাইভিং শিখিয়ে দেবেন। আপা, কবে শুরু করবেন?”
আসমা ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ছাপানো কাগজটাতে আবার চোখ বোলাতে লাগল, নিশ্চয় স্ক্যাডিউল, তারপর বলল, “বুধবার দুপরে আমার ফাঁকা আছে। ১ ঘন্টা।”

রিমা মাথা নাড়ল। ঐ সময়ে ওর কাজ থাকে। আসমা তাকে আরোও কয়েকটা ¯øট দিল বাছার জন্য, শেষ পর্যন্ত বৃহষ্পতিবার বিকাল ঠিক হল। সে প্রাথমিকভাবে কেমন করে দেখার পর আসমা সিদ্ধান্ত নেবে তার কয়টি ক্লাশ লাগবে এবং কখন লাগবে। প্রত্যেক ক্লাশের পর টাকা মিটিয়ে দিতে হবে। প্যাকেজ ডিলে যাওয়া যেত। গাড়ী চালানো শিখিয়ে ড্রাইভিং টেস্টে পাশ করিয়ে তবে মুক্তি। লিয়াকত চাইছিল রিমাকে প্যাকেজ ডিলে ঢোকাতে কিন্তু আসমা খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি। হয়ত ভেবেছে রিমা একেবারে বকলম, অনেক বেশী ক্লাশ লাগবে।
বাসায় খবরটা দিতে ফায়জা অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল। “মা, তুমি ড্রাইভ করবে ভাবতেই পারছি না।”
রিমা হাসে। “কেন? তোর মনে হয় আমি পারব না?”
“যে কেউ ড্রাইভিং শিখতে পারে,” ফায়জা বলে। “তুমি কখন ড্রাইভ করতে চাও নি তো, তাই বলছি। কিন্তু তোমার অবশ্য চালানোর দরকার ছিল না। বাবাই তো ছিলৃ” মাঝপথে হঠাত থেমে যায় সে, তার দৃষ্টি রিমার দিক থেকে সরে গিয়ে হাতের বইটার পৃষ্ঠায় গিয়ে আবদ্ধ হয়।
রবিন ধৈর্য ধরে জিব্রানের পাশে বসে তার হোম ওয়ার্ক করা দেখছিল। বাবা শব্দটা তার কানে যেতেই সে দৌড়ে এলো। “বাবা! বাবা!”
মিন্টু চলে যাবার পর এই পরিবারে একেবারে দরকার না হলে তার কথা তোলা হয় না। কারণটা বোঝার বয়েস জিব্রানের হয়েছে। কিন্তু মিন্টু কেন আর বাসায় ফিরছে না বোঝার বয়েস কিংবা বুদ্ধি কোনটাই রবিনের নেই। তাকে কেউ কিছু বলে নি। বলে লাভ হত না। সে বুঝতে পারত না।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই জিব্রান বুঝল তার মনের অবস্থা। সে সামাল দেবার জন্য বলল, “রবিন, ছবি আঁকবি?”
বাসার যাবতীয় বস্তুর মধ্যে রবিনের সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে ক্রেয়ন। মেঝে এবং দেয়ালে আঁকা থেকে তাকে বিরত রাখাটা দুষ্কর কিন্তু তারপরও তাকে ব্যাস্ত রাখার জন্য ক্রেয়নের উপর আর কিছু নেই। রবিন দৌড়ে ভাইয়ের কাছে ফিরে গেল।
“দেয়ালে আঁকা যাবে না!” ফায়জা সতর্ক করে দিল।

“দেয়ালে না,” রবিন পুনরাবৃত্তি করে।
ফায়জা মুচকি হাসে ওর দিকে তাকিয়ে। “যখন বড় হবে ও ঠিক বাবার মতই হবে – লম্বা, সুদর্শন।”
রিমা মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়েটা বাবাকে ভীষণ মিস করে। চেষ্টা করলেও লুকাতে পারে না।
“মা, শুরু করছ কবে?” ফায়জা জিজ্ঞেস করে।
“বৃহষ্পতিবার বিকালে। দেখি কেমন করি।”
“কারো গায়ের উপর তুলে দিও না গাড়ী,” ফায়জা ঠাট্টা করে বলে।
রিমা হাসে। “চেষ্টা করব। এখনই ভয় লাগছে আমার।”
ফায়জা চেয়ার থেকে উঠে এসে মাকে আলিঙ্গন করে। “কিচ্ছু ভেব না। তুমি ঠিকঠাক মতই শিখে ফেলবে। তারপর তুমি আমাকে শেখাবে।”
রিমা খিল খিল করে হেসে ওঠে। “এখনই ঘোড়ায় লাগাম লাগাস না। আমার শিখতেই কতদিন লাগে!”
জিব্রান ওদের আলাপ শুনছিল। “তারপর আপু শেখাবে আমাকে,” সে সোতসাহে বলে। “আর আমি শেখাব রবকে। তাই না, রব?”
রব মাকে অনুকরণ করে খিল খিল করে হেসে উঠে ভাইয়ের কথার অনুরণন তোলে, “তাই না, রব?”