তসলিমা হাসান : ১.
টরেন্টো শহরের বিশাল পিয়ারসোন বিমানবন্দরে বসে আছে লাবণ্য। হাতে তার গরম ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফি। নির্ধারিত ফ্লাইট আরও দেড় ঘন্টা পর। চেক ইন করার পর নিজেকে একটু পরিত্রান দেওয়ার জন্য ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়েছিলো সে। গত দুই তিনদিন যাবত লাবন্যের উপর থেকে অনেক ধকল যাচ্ছে। ১৫ দিনের জন্য যেহেতু থাকবে নাহ, তাই কিছু বাজার করে রেখে গেলো। এখানে মা একা থাকবে। ৯ ঘন্টা কাজ করার পর বাজার করে বাসায় এসে রান্না করা মায়ের জন্য অনেক চাপ হয়ে যাবে। এমনিতে লাবন্য থাকলে সপ্তাহান্তে মা-মেয়ে মিলে ১৫ দিনের বাজার সেরে ফেলে। তারপর মাঝে মধ্যে কোন এক রেস্তোরাঁয় বসে দুপুরের খাবার আর আড্ডা দিয়ে সময়টা উপভোগ করে তারা। এখন একা একা মা নিশ্চয়ই ওকে মিস করবে। তাই মা’র যেনো একা একা বাজারে যেতে না হয় সব গোছগাছ করে রেখে ও নিশ্চিন্ত।

ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো নিজের অজান্তে। লাবণ্য ছাড়া আর কেউ নেই লাকি চৌধুরীর। স্বামীকে হারিয়েছেন বহুকাল। অন্যের সংসারে যদি মেয়েটা সঠিক ভালোবাসা বা মর্যাদা না পায় তাই বিয়েও করেননি আবার। এক সন্তান লাবন্যকে বুকে করে মানুষ করে বাকী জীবন উত্সর্গ করে দিলেন। স্বাধীনতাও দিয়েছেন প্রয়োজন মতো। লাবন্য কোনদিন সেই স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করেনি। শুধু মা একা হয়ে যাবে বলে বিয়েতেও মত দেয়নি বহুকাল। তারপর যখন ৩০ ছাড়িয়ে বয়স বাড়তে শুরু করলো তখন মায়ের অনুরোধে কিছু কিছু প্রস্তাব বিবেচনা করতে শুরু করে। কিন্তু তখন ওর মনের মতো আর মানুষ মিল ছিলো নাহ। এছাড়াও লাবন্যর বিয়ে না করার পেছনে আরও একটা কারণ ছিলো।
সেল ফোনটা বেজে উঠলো হঠাত।
হ্যালো! রবি।
লাবণ্য! কোথায় তুমি?
ওপাশে উদ্বিগ্ন রবি’র কন্ঠটা শুনতে পেলো লাবন্য। শুধুমাত্র রবি’র এই অস্থিরতা, উদ্বেগ আর যতœটুকু পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে লাবন্য। প্রাণ ভরে উপভোগ করে রবি’র এই ভালোবাসা। তাই তো এখানে এসে রবিকে জানানোর কথা মনে থাকলেও ইচ্ছে করেই ফোন দেয়নি সে। করুক না একটু চিন্তা! ভাবুক কেউ তার জন্য। পথ চেয়ে বসে থাকুক তার রবি তার জন্য!
শান্ত আর ধীর গলায় উত্তর দিলো,
আমি এয়ারপোর্টে রবি! এতো ভাবো কেনো, বলো?
তোমার তো কথা ছিলো এয়ারপোর্টে পৌঁছে কল দেওয়ার। আমি এদিকে চিন্তায় অস্থির! যাইহোক; তোমার ফ্লাইটে উঠার আর মাত্র ৫০ মিনিট বাকী। তুমি কিউতে দাঁড়াও। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি না পৌঁছাও ততক্ষণ পর্যন্ত আমার ঘুম নেই, লাবণ্য।
বুঝেছি! এবার তুমি থামো। এক দমে কথা বলেই যাচ্ছো! আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি?
ভালোভাবে আসো। আমার ফোন সবসময় খোলা থাকবে। আর পৌঁছেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে।
জানি তো! এবার রাখো, রবি।
আমি ভালোবাসি তোমাকে, প্রিয়া।
খুব, খুব।

২.
প্রায় তিন বছর হলো রবি’র সাথে লাবন্যর পরিচয়। কত রাগ, অভিমান, দ্বিধা এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আজ ওরা সামনাসামনি হবে। মাঝে অনেক দিন লাবন্য ইচ্ছে করে রবি’র সাথে যোগাযোগ রাখেনি। প্রায় ছয় মাস! তারপর হঠাত একদিন ম্যাসেজ দিলো, ভুলে গেলে তো? এমনই হয়, জানতাম।
রিপ্লাই এলো, আজ কতদিন পর তুমি আমাকে নক করেছো, বলতে পারো?
লাবন্য একটু ভেবে বললো,
এই তো মাস ছয়েক হবে, হিসেব রাখেনি তো!
নাহ! পাঁচ মাস সতের দিন।
তাই! দিন তারিখ লিখে রেখেছো নাকি?
নাহ! বলতে পারো মোট কত দিন হয় পাঁচ মাসে?
খুব সোজা। পাঁচ গুন ত্রিশ মানে দেড়শ দিন!
নাহ! মাঝে দু’টো মাসে একত্রিশ দিন ছিলো। সে হিসেবে একশত উনসত্তর দিন।
হতভম্ব লাবন্য একটু দম নিয়ে বললো-
তুমি এতো হিসেব কিভাবে রাখলে, রবি?
খুব ধীরে নিচু গলায় রবি বলে,
আমি তোমাকে রোজ একটি করে চিঠি লিখেছি, লাবণ্য! কিন্তু পোস্ট করেনি।
যদি তুমি ছিঁড়ে ফেলো। আমাকে ভালো না বাসো কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসার অপমান করবে সেটা মেনে নিতে পারবো না, তাই তোমাকে ফোন করেও বিরক্ত করিনি আমি। অপেক্ষায় ছিলাম আর আমি জানতাম তুমি ফিরবেই।
দুই চোখ বেয়ে জলের স্রোতধারা ভিজিয়ে দিচ্ছিলো লাবণ্যর চিবুক, বুক। ভাসিয়ে নিচ্ছিলো বহুদিনের কষ্ট করে ধরে রাখা অভিমান, দ্বিধা, সংকোচ। মনে মনে বললো, আমিও তোমাকে ভালোবাসি, রবি। কিন্তু আমি চাই নাহ তুমি আমার জীবনের সাথে তোমার জীবনটাকে মিলাও। আমি চাই নাহ তোমার সাথে আমার দেখা হোক, ঘনিষ্ঠতা হোক।
এতো কিছুর পরও লাবন্য আর রবির দেখা হবে এবার। সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে পরাজিত ওরা।

প্লেন ছেড়েছে ঘন্টা খানেক হলো। এর মধ্যে লাবন্য ডিনার সারলো। তারপর ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো নিজেও জানে নাহ। পুরো দেড় দিন দীর্ঘ যাত্রা শেষে লাবন্য এসে পৌঁছালো কলকাতার সুভাসচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে। তার গন্তব্যে। আর একটু পর তার সাথে দেখা হবে রবি’র। দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার পর তারা দু’জনে মুখোমুখি হবে। মনের ভেতর আটকে থাকা অস্থিরতা আজ যেনো বাঁধ ভাঙা নদীর মতন টগবগিয়ে উঠছে। আর একটু সময়ও লাবন্য পারছে নাহ সহ্য করতে। তার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রবিকে জড়িয়ে ধরতে। অথচ গত তিন বছর এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করার সময় এতোটা অস্থির লাগেনি তার। কিন্তু আজ খুব কাছাকাছি এসে চেপে রাখা অস্থিরতার যেনো বিস্ফোরণ ঘটছে!
তারপরও যথাযথ নিয়ম এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করে লাবন্য এসে দাঁড়ালো বিমান বন্দরের বাইরে। একটু দূরে একগুচ্ছ কাঠগোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। পড়নে আকাশী রঙের সার্ট সাথে জিন্স। পাঁচ ফিট নয় হবে হয়ত। এই সার্টটা রবিকে লাবন্য পাঠিয়েছিলো তার জন্মদিনে। আজ এই সার্ট আর ওর পছন্দের কাঠ গোলাপ না থাকলে এই ভীড়ে রবিকে খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হতো লাবন্য’র। কিন্তু রবি তো বলেনি সে এই সার্ট পড়ে আসবে!
লোকটা পারেও! মনে মনে হাসে লাবন্য।
তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেই মানুষটার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে লাবন্য রবিকে দেখলেও রবি তাকে দেখতে পাইনি। রবির অস্থির আর জ্বলজ্বল করা চোখ বলে দিচ্ছিলো কতটায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে সে লাবন্য’র প্রতিক্ষায়।
রবি!
লাবন্য!
সামনাসামনি দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো দু’জনে। মুখে শুধু উচ্চারিত হলো দু’জনের নাম। হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব ঘুচিয়ে আজ ওরা হাত বাড়িয়ে ধরতে পারলেও কেমন স্তব্ধ, নির্বাক, নিশ্চল হয়ে রইলো দু’জনে। শুধু মুখ নয়, মনের ভেতরটাও যেনো আজ বাকহীন। সেখানেও ফুরিয়েছে যেনো সব কথা। শুধু পাঁজরের ভেতর আছড়ে পড়ছে উথাল-পাতাল ঢেউ। আর সেই ঢেউ এ ভেসে যাচ্ছে নাম না জানা কোন তীরে। চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আনন্দের জল লাবন্যর গালে। তীব্র তৃষ্ণার পর শীতল হলো তার পিপাসিত বুকের ভেতর।
হাত বাড়িয়ে চোখের জল মুছে দিলো রবি। এই প্রথম সে ছুঁয়ে দিলো তার ভালোবাসার মানুষকে।
কাঁদছ কেনো!
বোকা মেয়ে। চলো এবার যাওয়া যাক।

৩.
কলকাতার মোটামুটি গোছের একটা ভালো হোটেলে বুকিং দিয়ে রেখেছিলো রবি। সেখানে নিয়ে গেলো লাবন্যকে। এই হোটেলের ম্যানেজারটা রবির পূর্ব পরিচিত। তাই রাতে লাবন্য একা থাকলেও দুশ্চিন্তা থাকবে না কোন। হোটেলে পৌঁছে ফ্রেস হয়ে নিলো লাবন্য। রবি ওর অপেক্ষায় তখন বারান্দায় বসা। সদ্য গোসল করা মাথায় টাওয়েল প্যাচানো। শিশির বিন্দুর মতো চিবুকে ফোঁটা ফোঁটা জল।
এমন মোহনীয় নারীকে এক ধরনের সর্গীয় সুন্দরী লাগে। তার উপর এই রকম এক পাতলা গড়নের বেলীফুলের মতো ধবধবে ফর্সা ত্বকের নারীর দিক থেকে কোন সন্নাসীর চোখ ফেরানোও বড্ড কঠিন হয়ে যায়। আর রবি তো সাধারণ ত্রিশ উর্ধ এক যুবক। মুগ্ধ নয়নে নিবদ্ধ হলো রবি লাবন্যের সেই মাধুর্যে। লাবন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথার টাওয়েল খুলে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বললো,
সন্ধ্যা তো হয়ে এলো! চা- কফি কিছু অর্ডার করি, কি বলো?
আধা মিনিট বা কিছু বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন ওদিক থেকে কোন উত্তর এলো নাহ, তখন ফিরে তাকালো সে!
ওর নিষ্পলক চোখে চেয়ে বললো, কি দেখছো এমন করে?
সম্বিত ফিরে আসার পর নিচু গলায় বললো, কিছু নাহ, এমনিতেই!!
লাবন্য জানে, রবি খুব লাজুক প্রকৃতির ছেলে। এই এতোটা দিন সে রবিকে বিভিন্ন উপায়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে কখনও কোন দুর্বল মুহূর্তে বা আবেগে আপ্লূত হয়েও রবি তার সাথে কোন অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করেনি। কত রাত তারা ভিডিও কলে থেকেছে কিন্তু এমন কোন আপত্তিকর আবদারও সে কোন দিন লাবন্যকে করেনি। লাবন্য বাইরের দেশে জীবনযাপন করলেও কিছু কিছু ব্যাপারে সে সাঙ্ঘাতিক রক্ষণশীল। আর সেটা রবিও খুব ভালো করে জানে।
ভালোবাসার মানুষের প্রতি শারীরিক অনুভূতি আসাটা সহজাত। তাই এখানে আসার আগে লাবন্যর অনেকবার মনে হয়েছে যে, দূরে বসে দু’জনে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকলেও খুব কাছাকাছি এসে সেটা কতটুকু সম্ভব? শারীরিক আদিম অনুভূতির কাছে ওদের কি পরাজয় স্বীকার করতে হবে?
লাবন্যর মনের মধ্যে বিরাজ করা প্রশ্ন এবং অস্বস্তিগুলো দূর করে দিলো রবি নিজেই একদিন। রবি বুদ্ধিমান। হয়ত এখানে আসার আগে বিভিন্ন প্রশ্নে সে বুঝে ফেলেছিলো লাবন্য’র মনের ভেতরের অনুভূতি। কোন এক প্রসঙ্গে রবি একদিন বললো,
লাবন্য আমি হিন্দু ধর্মের। তবে খুব একটা পূজা-আর্চা করি না। ধর্মের ক্ষেত্রে আমার মনোভাব হলো, ঈশ্বর একজনই। তোমার আমার সবারই তিনি। কিন্তু আমরা তাকে বিভক্ত করে বিভিন্ন নামে ডাকি। মূল মন্ত্রও এক অভিন্ন। সত ভাবে চলা, সততা ধারণ করা। আর ঠিক ঐ জায়গায় আমি স্থির। এবং নিজেকে চেষ্টা করি একটা নীতিমালার মধ্যে রাখতে আজীবনই।
বুঝলাম! কিন্তু হঠাত আজ এসব কথা?
তুমি আমি অনেক আগেই তো এসব দ্বিধাদ্ব›েদ্বর অবসান ঘটিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি। বিয়ের পর যে যার ধর্ম পালন করবো। আর আমাদের সন্তানরা জেনে বুঝে তাদের পছন্দমত ধর্ম বেছে নিবে। সেক্ষেত্রেও আমরা কোন জোরজবরদস্তি করবো নাহ। তাহলে আজ কেনো নতুন করে এসব বলছো?
ঠিক সে কারণে নাহ, লাবন্য। এসব বলার পেছনে আমার আরেকটা কারণ রয়েছে। তুমি আর আমি বহু প্রতীক্ষার পর একসাথে হবো। ঘুচে যাবে আমাদের সব দূরত্ব। কিন্তু এবার যদি বিয়ে না করি তাহলে খুব কাছে এসেও আমরা যাতে সীমা লঙ্ঘন না করি সেদিকে তোমার আর আমার দুজনকেই নিজেদেরকে শাসনে রাখতে হবে।
প্রচন্ড ধাক্কা খেলো লাবন্য। বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওকে চুপচাপ দেখে রবি আবার বললো,
আমি কি কিছু ভুল বললাম? তুমি কিছু মনে করলে নাতো?
কিভাবে মনের কথাগুলো তুমি বুঝতে পারো, রবি? তুমি কি অন্তর্যামী?
রবি হাসে! আসলে কাছাকাছি আসলে এটা হয়টা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমি চাই না বিয়ের আগে কিছু হোক তোমার আমার, লাবন্য।
লাবন্য গাঢ় স্বরে উচ্চারণ করলো
“আমি তোমারও সাথে বেঁধেছি আমারও প্রাণ,
সুরেরও বাঁধনে।
তুমি জানো নাহ, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে…..

৪.
সন্ধ্যার মুখে লাবন্যকে নিয়ে বের হলো রবি। কলকাতার রাস্তাগুলো একধরনের শিহরণ জাগাচ্ছিল লাবন্যর মনে। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছিলো কল্পনায় দেখা বা বইয়ে পড়া শহরের অলিগলিগুলোকে। এই শহর সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ে বর্ণনা পড়তে পড়তে লাবন্য কখন যেনো এই শহরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। পাশে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে ভাবে, এই মানুষটাকেও ভালোবাসার ক্ষেত্রে সেই প্রভাবটাও ছিলো কিছুটা। যেটা অকপটে স্বীকার করে সে রবির কাছে।

গাড়ি এসে দাঁড়ালো এক পুরোনা দালানের পাশ ঘেঁষে। দরজা খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে পুরাতন দালানের দিকে তাকিয়ে লাবন্য উদ্দীপিনায় বাক হারালো। মান্নার গাওয়া সেই বিখ্যাত “কফি হাউজের” সামনে সে ওরা। কোন একদিন গল্পের ছলে সে রবিকে বলেছিলো, কফি হাউজে বসে এক কাপ কফির খাওয়ার শখ তার বহুদিনের। রবি সে কথা মনে রেখেছে। তাই তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য হোটেলে বসে কফির অর্ডার করতে বারন করে হুট করে এখানে নিয়ে এসেছে। নষ্টালজিক হয়ে গেলো লাবন্য। প্রথমবার আসলেও ভেতরে ডুকে তার মনে হলো কত কতবার সে এখানে এসেছে। সে দেখতে পেলো সুজাতা, অমল, নিখিলেশ, মঈদুল, রমা রায়, গোয়ানিস আর মান্না দে কেও। কল্পনায় হারিয়ে গিয়ে সে দেখলো বিভিন্ন টেবিলে ছড়িয়ে রয়েছে মান্নাদের গানের সেই সাতজন।

পেছন থেকে রবি তাড়া দিলো, চলো উপরে উঠে যাই। ওখানে বসলে পুরোটা দেখতে পাবে তুমি। সন্ধ্যার পর এখানে অনেক লোক আসে। তাই তখন পছন্দমত টেবিল পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। ডুপ্লেক্স কফি হাউজের দোতলায় উঠে গেলো ওরা। সন্ধ্যায় এখানে বিভিন্ন মানুষ আর পর্যটকের ভীড় জমে। টেবিলে টেবিলে আড্ডা, চা, কফি আর কাটলেটের ঘ্রানে জমে উঠেছে কফি হাউজ। সাদা শার্ট-প্যান্ট, কোমরে লাল বেল্ট আর মাথায় টুপি পড়া ওয়েটাররা ব্যস্ত তাদের গেস্টদের নির্দেশিত খাবার পৌঁছে দিতে নির্ধারিত টেবিলে। লাবন্য চোখ ঘুরিয়ে উপভোগ করছিলো সারা কফি হাউজের সবটা দেখে নিতে। ভবনটার সিঁড়িগুলো অনেক পুরনো। উঁচু সিলিং এর উপর তিন পাখার ফ্যানগুলো যেন বহুকাল আগের সব কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তালে তালে। দেওয়ালে দেওয়ালে খসে পড়া আস্তর বুঝিয়ে দেয় তার বয়স হয়েছে।

এর মধ্যে কখন যেনো রবি দু’টো কফি আর কাটলেটের অর্ডার করে দেয়। ওয়েটার এসে সেগুলো টেবিলে রেখে গেলে লাবন্য বাস্তবে ফিরে আসে।
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
কেনো? কি করলাম আবার? কফির মগটা লাবন্যর দিকে ঠেলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে রবি।
এই যে, মনে করে এখানে নিয়ে আসলে আমাকে তুমি।
তা! তোমার কল্পনার সাথে মিল পেলে কোন?
হুম! অনেকটাই। তবে আমি ভেবেছিলাম সামনে একটা বাগান দেখবো। তবে কিছু অমিল থাকাটা স্বাভাবিক! এইতো এরকম দুই একটা। কিন্তু আমার দারুণ লাগছে। আরও বেশি ভালো লাগছে তোমার এই হঠাত আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার বুদ্ধিটা দেখে।
রবি মুচকি হেসে বলে, তোমাকে মুগ্ধ করার মতো আমার আর বেশি কিছু কি আছে, বলো?
কি নেই, রবি?
তোমার মতো এতো প্রতিপত্তি, নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সার্টিফিকেট, দামী শহরে থাকার যোগ্যতা কোনটা আছে আমার, লাবন্য?
এগুলোই কি একটা মানুষের জীবনের সব, রবি?
ভালোবাসতে পারার অসম্ভব একটা ক্ষমতা তোমার আছে, সেটার বুঝি কোন মূল্য নেই? আমি অন্য ধর্মের সাথে আমার বয়সও বেড়ে গেছে অনেকটা। তাও যে তুমি আমাকে তোমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসো তার কোন মূল্য নেই। এগুলো দামী শহর, ভালো ইউনিভার্সিটিতে বিক্রি হয়?
তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো, প্রিয়া?
তোমার ভাবনার এই বিশলতায় আমি রোজ রোজ আরও দূর্বল হই।
তাই বুঝি! জানো তুমি যখন আমাকে খুব আবেগে প্রিয়া বলে ডাকো, আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় জীবনে আর কিছুই পাবার নেই বাকী! সব প্রাপ্তি বুঝি ফুরিয়েছে!
চেয়ে দেখো! একেক টেবিলে একেক জীবনের গল্প, একেক অনুভূতি, একেক চাহিদা! আর আমার গল্প শুধু তোমাকে ঘিরে, রবি। আমার চাওয়া, স্বপ্ন, আয়োজন ভালোবাসা সব তোমাকে ঘিরে। আমার বিস্ময় শুধু তুমি, রবি।
কিন্তু জানো লাবন্য, আমি তোমাকে দুর্বল করার জন্য কিছু করি নাহ। তোমাকে চমকে দিতে আমার ভালো লাগে, ভালো লাগে তোমার ঐ চমকিত চোখের বিস্ফোরণ দেখতে।
আমি সব বুঝি, রবি।
রবি মুখে কফির চুমুকটা দিতে গিয়ে ভীষণ একটা বিসম খেলো।
লাবন্য অস্থির হয়ে ওর কাছ ঘেঁষে পানিটা বোতটা এগিয়ে ধরলো।
কফি হাউজ থেকেই বের হয়ে ওরা আরও কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরলো। এরপর রাতের খাবার খেয়ে লাবন্যকে হোটেলের রুমে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো রবি। যাওয়ার সময় লাবন্যকে দরজা ভালো করে বন্ধ করে যা যা সতর্কতা নেওয়া দরকার সব মনে করিয়ে দিয়ে গেলো। পাশাপাশি এও বললো কোন অসুবিধা হলে যাতে রবিকে ফোন করে। রবি’র বাসা হোটেল থেকে বেশী দূরে নয়। কিন্তু এবার বিয়ে করবে না তাই লাবন্যর খুব আপত্তি রবি’র বাসায় থাকা। তাছাড়া রবি লাবন্যর কথা এখনো ওর বাসায় জানাইনি। তবে সে নিশ্চিত করেছে লাবন্যকে যে, ওর বাবা-মা অতটা গোড়া নয়। তারা রবি’র ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার মতো মানসিকতার মানুষ নয়। যখন বিয়ে হবে তখন জানানো যাবে। আর লাবন্য মা তো সব জানেন। সে জানে লাবন্য যথেষ্ট পরিপক্ব। এবং তার মেয়ে কোনদিন ভুল কিছু করবে নাহ।লাবন্যর প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস।

৫.
একটু একটু করে সূর্য উঠে আসছিলো। আলোকিত হচ্ছিলো বেঁচে থাকার আরেকটি দিন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস লাবন্যে’র অনেকদিনের। বিদেশে থাকলে বেশি বেলা করে ঘুম থেকে জাগার কোন উপায় থাকে না। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতেও লাবণ্যর বিছানায় গড়াগড়ি করার ইচ্ছে থাকে।অভ্যাস এমন এক কঠিন জিনিস, সে একবার শেকড় গাড়লে তাকে বাদ দেওয়া বড় কঠিন।

ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফি হাতে লাবন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে সকাল হওয়াটা দেখতে তার অদ্ভুত লাগে। কতক্ষণ জানে নাহ, ঐখানেই বসে দাঁড়িয়ে সময় কেটে যাচ্ছিলো। হঠাত খেয়াল করলো হন্তদন্ত হয়ে প্রায় ছুটে আসছে রবি। লাবন্য ভাবে,
বেচারা! মানুষটা রাতে হয়ত ঠিকঠাক ঘুমাতেও পারেনি!
দ্বিতীয় দিন ওরা চলে গেলো ৬ নম্বর দ্বারকানাথ লেনের রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। লাল রঙের সুবিশাল আকৃতির পুরাতন জমিদার বাড়ি। লাবন্য ধীর পায়ে ঠাকুরবাড়ির ঘর, সিঁড়ি আর ছাঁদে ঘুরে বেড়ালো। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো কোন পবিত্র জায়গায় এসেছে। বিনয় আর শ্রদ্ধায় ও নিবেদিত হয়ে যায়। হেঁটে বেড়ানোর সময় আনমনে দেওয়ালে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলো। ওর চোখের সামনে ফুটে উঠলো রবি ঠাকুরের ছবি, অভিনয়, সংগীত আর ভালোবাসা। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তার পথচলা সব কিছু যেনো দেখতে পেলো। লাবন্য’র হৃদয়ে বেজেই চলছে,
“এসো! এসো আমার ঘরে এসো,
আমার ঘরে….
পুরো সময়টায় একটা স্বর্গীয় অনুভূতি বিরাজ করছিলো লাবন্য’র মনে।
একটা ঘরে গিয়ে দেখতে পেলো ঠাকুরের নিজ হাতে লেখা একটি চিঠি। তার প্রিয়তমা মৃণালিনী দেবীর উদ্দেশ্যে। উপরে তার মৃণালিনীর বিশাল একটি ছবি। প্রেমি মনের অধিকারী রবি ঠাকুরের বাড়ি জুড়ে তারই সব স্মৃতিচিহ্ন। পিতলের কারুকাজ বিশিষ্ট সিঁড়ি, দরজা প্রত্যেকটা জায়গায় প্রকাশিত ঠাকুরবাড়ির রুচিবোধ।
নগ্ন পায়ে মগ্ন হয়ে হারিয়ে গেছিলো যেনো সেই ২৫ শে বৈশাখের ১৮৬১ সালের কোন এক সময়ে। ভুলেই গেছিলো লাবন্য’র সাথেও রয়েছে ওর জীবনের রবি। হঠাত পেছন ফিরে দেখে সে নেই। প্রথমে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে এদিকওদিক দেখলো। তারপর একটু দৌড়ে ছুটে দেখতে গিয়ে দম আটকানো অস্থিরতা শুরু হলো। মাথাটা ঘুরে আয়ত্তের বাইরে যেতেই এক ভদ্রলোক সাহায্যে এগিয়ে এলেন। লাবন্য নিজেকে সামলে বললো, আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবেন?
লোকটা লাবন্যকে ধরে বাইরে নিয়ে আসতেই দেখে রবি নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে আর কারো সাথে সম্ভবত উচ্চ স্বরে ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলছিলো!
লাবন্যকে দেখতে পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।
কি হয়েছে?
বলতে বলতে লাবন্য’র হাত ধরলো। ভদ্রলোক সংকুচিত হয়ে সরে গিয়ে জানালে, উনি সম্ভবত অসুস্থ বোধ করছিলেন। আমি একটু সাহায্যে এগিয়ে এসেছি মাত্র।
ধন্যবাদ!
এবার আমি আসি।
তুমি হঠাত কোথায় উধাও হয়ে গেলে, রবি? একটু দূর্বল গলায় জানতে চায় লাবন্য।
রাস্তার দিকে এগুতে এগুতেই রবি লাবন্যর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে
আমি ভাবলাম, তুমি তোমার পুরোনো প্রেমিকের সাথে নিবিড় হয়ে রয়েছো, আমি না হয় বিরক্ত না করি। যখন তোমার প্রেম শেষ হবে তখন যদি দেখতে নাও পাও, আমাকে কল করে নিবে। আমি কল্পনায় আনতে পারিনি তুমি আমাকে না দেখতে পেয়ে এমন অসুস্থ হয়ে যেতো পারো!!আমি খুবই লজ্জিত আর দুঃখিত।

এরমধ্যেই রবি একটা ট্যাক্সিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড় করিয়ে নির্ধারিত জায়গার কথা জানালো।
দ্রæত গাড়িতে উঠে পড়লো ওরা। মাঝারি গতিতে চলছিলো গাড়ি। অসুস্থতা আর ক্লান্তিতে লাবন্য ওর মাথাটা এলিয়ে দিলো রবি’র কাঁধে। রবিও সংকোচ ঝেড়ে ফেলে পেছন থেকে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলো লাবন্যকে।
তোমার খুব খারাপ লাগছে, প্রিয়া?
এখন ঠিক আছি, ওষুধটা পেটে পড়লে আরও ঠিক হয়ে যাবো।
লাবন্য’র ঘন উত্তাপ নিশ্বাস পড়ছিলো রবি’র গলায়।অদ্ভুত এক শিহরণে জাগ্রত হচ্ছিল শরীরের সব শিরা-উপশিরা। বাতাসে এলেমেলো চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে হঠাতই ঠোঁট ছোয়ালো লাবন্যর ঠোঁটে রবি। খুব কষ্ট হচ্ছিল লাবন্যর নিজেকে ফিরিয়ে নিতে। মনে হচ্ছিলো আজ সব বাঁধ ভেঙে যাক। শুষে নিক তাকে পুরোটুকু তার ভালোবাসার মানুষ। কতখানি গভীরে চলে গেছে ওরা নিজেরাও জানে নাহ। তারপর হঠাত লাবন্য ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে।
কি করছো! গাড়িতো এটা।
লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া লাবন্য’র গাল দু’টো ধরে রবি বললো, তাহলে কোথায় হবে বলো, ম্যাডাম?
হাহাহা করে হাসলো লাবন্য! ভালো শয়তান কিন্তু তুমি!
শয়তান কখনো ভালো হয়? জানা ছিলো নাহ, হেসে উত্তর দিলো সে।
হোটেলে এসে ওষুধ খেয়ে শরীরটা বিছানায় সমর্পন করলো, লাবন্য।
নরম বালিশের আদুরে আরামে লাবন্য যেনো ছোট বাচ্চা হয়ে গেলো। রবি তখন ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে পাশে বসে।
এখন কেমন লাগছে, প্রিয়া?
হুম! ভালো।
তুমি পাশে থাকলে আমার সব অসুখ সুখে পরিনত হয়ে যায়, রবি।
তাই বুঝি!
হুম!
ধীরে ধীরে রবিও তার শরীরটা লেপ্টে দিলো লাবন্যর শরীরের পাশে। উথাল-পাতাল ঢেউ যেনো লাবন্যকে বাঁধ ভাঙা নদীর মতো করে দিলো। জড়িয়ে ধরলো রবিকে। কানে কানে বললো, আমায় ছেড়ে যাবে নাতো কোনদিন।
উহু! রবি তখন ব্যস্ত লাবন্যকে পোষাক বিহীন করতে। লাবন্যর ব্রা’র হুক খুলে মুখ রাখলো তার উন্মুক্ত বুকের ভেতর। তারপর আস্তে আস্তে করে নিজেকে ঢেলে দিলো লাবন্যর পিঠ, উদর, কোমর শেষে নিতম্বে। শুরু হলো দু’টো শরীরের ওঠানামা। উদ্ধত যৌবনের কাছে পরাজিত হলো ওরা আজ।
উলঙ্গ দুটো শরীর পড়ে আছে বিছানায়। ঘুমে অচেতন রবি। ক্লান্ত লাবণ্যও একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এবার উঠে ক্লান্ত শরীর আর শ্রান্ত মন নিয়ে নিজের শরীরে কিছুটা কাপড় জড়িয়ে ঢুকে গেলো বাথরুমে। তারপর ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে ধুয়ে ফেললো সব ক্লান্তি, দ্বিধা আর কিছুটা অপরাধবোধ।
একি হলো! ও তো চাইনি এমনটা! কেনো পারলো নাহ নিজেকে রুখতে। এতোদিনের সংস্কার, নীতি ওর ব্যক্তিত্ব সব বিসর্জন দিয়ে দিলো শুধু এক ডাকে! নিজেকে খুব দূর্বল মানসিকতার মানুষ মনে হতে লাগলো। ঝর্নার পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো লাবন্যর চোখের জল।

লাবন্য ভেবেছিলো ওর অনুভূতির মতোই একই অনুভূতিতে পড়বে রবি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো ভিন্ন রূপ। দীর্ঘ সময় পর গোসল সেরে বের হয়ে দেখলো রবি তখনো ঘুমে অচেতন। অনাবৃত শরীরের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। লাবন্য চোখ সরিয়ে নিয়ে ভালো করে ঢেকে দিলো রবিকে। সেই সুযোগে রবি লাবন্যকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আসলো আবার বিছানায়।
কি হলো! এভাবে পালিয়ে গেলে কেনো আমাকে ফেলে?
নিজেকে উন্মুক্ত করতে করতে বললো,
কোথায় পালালাম, বল? বরং আরও বেশী আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গেলাম আজ!
হুম! কিন্তু যখন গোসলে গেলে তখন আমায় কেনো নিলে নাহ! সে কাজটা না হয় দু’জনে মিলেই করতাম।
নিজেকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে লাবন্য বিষন্ন হয়ে বললো, আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছে, রবি। ঠিক এমনটা হতে পারে ভেবে আমি বহুবার এখানে আসার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখো তাই হলো!
বিছানায় উঠে বসতে বসতে রবি বললো, এক কাজ করলে হয় না, লাবন্য?
কি?
চল! আজই বিয়ে করে ফেলি। তবে আপাতত কাউকে বলার দরকার নেই। পরে সব মানিয়ে বলা যাবে।
লাবন্যর বুকের ভেতর আটকে থাকা কষ্টটা যেনো নিমিষেই কমে গেলো।
কিন্তু আমার মা’কে না জানিয়ে?
এক কাজ করো, তোমার মা’ তো আমাদের ব্যাপারটা জানে। রোজ ফোনও দিচ্ছে তোমার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। তাকে না হয় ফোনে জানিয়ে আশির্বাদটা নিয়ে নাও। আর আমার বাসায় এই মুহুর্তে না। তাহলে তারা আয়োজনে বড় ঝামেলা করবে। নিয়ম নীতি, আত্মীয় স্বজন!
বোঝই তো। তারচেয়ে বরং আমি পরে সুযোগমতো যখন অনুষ্ঠান করবো তখন তাদেরকে জানাবো। দরকার হয় তখন আবার আমাদের বিয়ে হবে নিয়মনীতি মেনে।
লাবন্য চুপ হয়ে ভাবলো, তারপর বললো, চলো যাই।
কোথায়? গোসলে আবার? নাকি রেজিষ্ট্রি অফিসে?
লাবন্য মিথ্যে ধাক্কায় রবিকে খাটে ফেলে দিয়ে বললো, তুমি আসলেই শয়তান! আমি এতোদিন বুঝতে পারিনি।

৬.
দু’টো মালা, লাল শাড়ি আর কারুকাজ করা একটা পাঞ্জাবি কিনে লাবন্য আর রবি সেরে ফেললো তাদের বিয়ে।
তারপর আরও কয়েকটা দিন কতশত আনন্দ,খুনসুটি আর বেড়ানোতে কেটে গেলো লাবন্যর ছুটির দিনগুলো। ফিরে আসার নির্ধারিত দিন এসে কড়া নাড়লো দরজায়। বিদায় বেলায় রবি আর লাবন্য নিজেদেরকে খোলসের মধ্যে আটকে ফেললো যেনো। বিমানবন্দরে কারো মুখে কোন কথা নেই। যেনো এটাই স্বাভাবিক। ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে ওদের ভেতরে কোন অনুভূতি হচ্ছে নাহ। যদিও রবি একটু পর পর বলছে, আমি পারবো নাহ।
কি পারবে নাহ, রবি?
কিছু নাহ।
তাহলে একটু পরপর কেনো বলছো, পারবো নাহ,সত্যিটা সত্যিই বুঝতে পারছিলো না লাবন্য।
আবার কফি আনতে ছুটে গেলো রবি।
তারপর কফি হাতে বসে মুখোস পড়া দু’জন চাপা দেওয়া কষ্ট এড়াতে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কথায় মন দিলো।
শেষ হলো সময়। লাবন্য রবির সাথে বিদায় জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। জড়িয়ে ধরে বললো, খুব শ্রীঘই আবার আমাদের দেখা হবে, রবি।
আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া বেশি দিন থাকতে, প্রিয়া।
এতোক্ষণে লাবন্য বুঝতে পারলো রবি কেনো একটু পর পর, আমি পারবো না বলছিলো!

৭.
একটা খোলা জানালার পাশে বসা লাকি চৌধুরী। হাতে তার লাবন্যর লেখা ডায়েরি। অনেক ব্যক্তিগত কথা এখানে লিখে রেখেছিলো সে। লাবন্য এই পৃথিবী ছেড়ে গেছে আজ পাঁচ বছর। জীবনে আকন্ঠ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মেয়েটা কতটা ব্যাকুল হয়ে ছিলো। বিশ্বাস করেছিলো রবিকে।
কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর লাবন্য যেনো অন্য এক মানুষে রুপান্তরিত হয়ে গেলো। সবসময়ই উচ্ছ¡াস আনন্দে মেতে থাকতো। লাকি চৌধুরীর সকল অপূর্ণতা পূর্ণতা পেয়েছিলো মেয়ের এই সুখ দেখে। ছোট বেলা থেকে লাবন্যর হার্টে একটা ছিদ্র ছিলো। তের বছর বয়সে সেটা অপারেশন করা হয়। তবুও সবসময়ই কিছু না কিছু ওষুধ খেতে হতো। এই কারণে লাবণ্যর কর্মক্ষমতাও অনেকের থেকে কম। একটুতেই সে হাঁপিয়ে যেতো। ওর হার্টটা ওপেন করা হয়েছিলো সেই কথা সে কোনদিন গোপন করেনি কারো কাছে। বিভিন্ন বিয়ের প্রস্তাব আসলেও সে প্রথমে এটা জানিয়ে দিতো তারপর কেউ যদি আগ্রহী হতো তখন অন্য সব বিষয় গুলো যাচাই-বাছাই করা হতো দু’পক্ষেরই।
রবিকেও সে জানিয়ে ছিলো সব। রবি কোনদিন সে ব্যাপারটা পাত্তাই দেয়নি বা প্রয়োজন মনে করিনি। আসলে ওর উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। ও চেয়েছিলো লাবন্যকে বিয়ে করে টরেন্টোর মতো উন্নত দেশে পাড়ি জমাতে। তাই লাবন্যকে বশীভূত করার জন্য সে, যা যা করা প্রয়োজন সবই করেছে। রবি জানত লাবন্য’র দূর্বল দিকগুলো। ওভাবে শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে লাবন্য বিয়েতে অমত করবে না, সেটাও তার ভালো করে জানা। এদিকে রবি’র পরিবার কোনদিন একটা বিধর্মী মেয়েকে মেনে নেবে না ভেবে সে ঐখানেও চালাকি করে গোপন রেখেছে সব।

টরেন্টোতে ফিরে আসার পর লাবন্য প্রথমে রবিকে এদেশে নিয়ে আসার সব বন্দোবস্ত করতে শুরু করে। আর অন্য দিকে সে রবির কৃত্রিম ভালোবাসার সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকে প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে। যা তাকে রবিকে এদেশে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে আরও তত্পর করে। তারপর একদিন সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রবি চলে আসে টরেন্টোতে। প্রথমে লাবন্যর সাথে সংসারও শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় রবি’র প্রকৃত চেহারা। যখন বিদেশের মাটিতে তার পাক্কাপোক্ত ভাবে থাকাটা নিশ্চিত হয়, তখন সে লাবন্যকে জানায় যে, তার পক্ষে সম্ভব না এমন একটা বিধর্মী অসুস্থ রোগীর সাথে একসাথে বসবাস করা। আর তার পরিবারের কেউ লাবন্যকে মেনে নিবে নাহ। লাবন্য তখন মরিয়া হয়ে রবি’র পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু অবাক হয়ে যায় তখন যখন জানতে পারে, রবি কখনো লাবন্যর কথা তার পরিবারের কাছে বলেইনি। তারপর একের পর এক ঘাতক রবি’র গোপন করা সত্যিগুলো জানতে পারে সে।

একদিক থেকে রবি’র প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলো লাবন্য। কারণ রবি’র আসল চেহারাটা হুট করে বুঝতে পারলে সে হয়ত তখনি প্রাণ হারাতো। ধীরে ধীরে রবি’র পরিবর্তন তাকে একটু একটু করে বুঝিয়ে দিয়েছিলো আসল সত্যিটা। কপট রবি’র সত্য চেহারাটা তাই তার কাছে আর বিস্ময়কর ছিলো নাহ, ছিলো ভয়ংকর ঘাতকের রূপ।
লাকি চৌধুরীর এখন সময় কাটে নিঝুমকে নিয়ে। রোজ ওকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, বিকেলে পার্কে হাঁটতে বেড়ানো। দু’জনে মিলে ভেকশনে ঘুরতে যাওয়া। এসব করে তার আর আজকাল খুব একটা লাবন্যর কথা মনেই পড়ে না। কারণ নিঝুম যখন তার সাথে হেঁটে বেড়ায় তখন ওর ঐ ছোট হাতের স্পর্শে তিনি যেনো লাবণ্যকেই অনুভব করেন।
তসলিমা হাসান, টরেন্টো।