কবি হোসনে আরা জেমী তাঁর কবিতায় নিজের চির চেনা জগতের কথা বলেন। তাঁর এই জগতে সতত বসবাস করেন একজন সংবেদনশীল মানবিক মানুষ যিনি অবলীলায় বলে যান শিশিরে ভেজা স্নিগ্ধ সকাল আর অন্তহীন ঠিকানার দীর্ঘতম রাতের গল্প। হোসনে আরা জেমী সহজ আর প্রাঞ্জল শব্দ ব্যবহার করে আমাদের সামনে কবিতা রাজ্যের যে অপূর্ব সুন্দর এক ছবি এঁকে চলেন তা আমাদেরকে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে জীবনের ভাবনাগুলোকে আরো সুন্দরভাবে সাজানোর পথ উম্মোচিত করে তুলে। নিজের পায়ের নিচে যে মাটি, সেই মাটিতেই দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যাবার এক অসামান্য ক্ষমতা কাজ করে তাঁর কবিতার শব্দমালায়। তাঁর কবিতার উপমা এবং চিত্রকল্পে যেভাবে তিনি বারে বারে আমাদেরকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যান তাতে আমাদের হৃদয়ে ভেসে আসে এক অদৃশ্য প্রাকৃত পাখির গান। তাঁর চিত্রিত এই গানের সুর অযুত বিরূপ পরিস্থিতির সীমানা অতিক্রম করে আমাদেরকে অনন্তকালের জীবন-সংগীতের জগতে নিয়ে যায়, যা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে অনেক নিরাশার মধ্যেও এক আশাবাদী জীবনের স্রোতে পথ চলতে শেখায়।
মনিস রফিক

বগুড়ার কাঁদা জল মেখে বেড়ে ওঠা। থিয়েটার, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচী, রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ এমন বিবিধ সাংস্কৃতিক চর্চার সাথে সম্পৃক্ত মননে কৃষ্টি ও প্রগতিশীলতার অভিযাত্রিক।
ডিপ্লোমা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হোসনে আরা জেমী পরবর্তীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত জেমী পেশা বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সেবা প্রদান করে আসছেন।
আশির দশক থেকে আবৃত্তির সাথে যুক্ত থেকে বগুড়ায় গড়ে তোলেন ‘বাঙ্ময় আবৃত্তি চক্র’ পরে ঢাকায় আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বরিত’র সাথে যুক্ত। প্রয়াত আবৃত্তি শিল্পী শফিক করিমের সাথে জেমির তিনটি দ্বৈত আবৃত্তি এলবাম ‘বিশ্বাসী করতল’, ‘কথোপকথোন-৪’ এবং ‘ভালোবাসার মিথলজি’ বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল সে সময়। তিনি এখন কানাডার টরেন্টোতে আবৃত্তি সংগঠন ‘বাচনিক’ এর সক্রিয় সদস্য।
বইমেলা ২০১৯ এ জার্নিম্যান বুকস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টি করে নেবে’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্রপট’ প্রকাশিত হয় পেন্সিল পাবলিকেশন থেকে, ২০২০ এর বইমেলায়। ‘শত ভাবনায় বঙ্গবন্ধু’ তাঁর প্রথম সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশক রচয়িতা পাবলিকেশান, ২০২০। ‘বিজয়ের হাসি’ শিশুতোষ গল্পের বই প্রকাশক পদক্ষেপ বাংলাদেশ, ২০২১।

অপেক্ষা

আমি অপেক্ষায় থাকি
একটি স্নিগ্ধ সকালের
শিশিরে ঘাসে মাখামাখি।

আমি অপেক্ষায় থাকি
একটি রৌদ্র করোজ্জ্বল দুপুরের
ঘামে সিক্ত একটি অবয়বের।

আমি অপেক্ষায় থাকি
একটি বৃষ্টিভেজা দুপুরের
হারিয়ে যাওয়া, কাঁদামাটি খেলা।

আমি অপেক্ষায় থাকি
একটি বর্ণিল বিকেলের
যেখানে রংধনু খেলা করে অবিরত।

আমি অপেক্ষায় থাকি
একটি গোধূলি সন্ধ্যার
দিগন্ত যেখানে মিশেছে সাগরের নীলে।

আমি অপেক্ষায় আছি
একটি দীর্ঘতম রাতের,
শেষ না হওয়া রাতের
যে রাতের হাত ধরে
চলে যাব অনন্তের ঠিকানায়।

পৃথিবীর নিরাময়

পৃথিবীর অসুখটা সেরে গেলে
জীবনের গল্পটা লিখেই ফেলবো ভাবছি।
গল্পে, কবিতায় কিংবা উপন্যাসে
লিখেই ফেলবো অসমাপ্ত সব কথামালা।
যেখানে ভালোবাসার চেয়ে
অবহেলা বড়ো বেশি কাঁদায়।
বুকের অলিন্দে যে কষ্টের ছাঁয়া
আবছায়া হয়ে আছে
ভালোবাসার পরশে মিশিয়ে দিয়ে
নতুন পৃথিবীতে
নতুন করে বেঁচে ফিরে
আবার ভালোবাসায় হারাবো।
জংধরা পুরোনো বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নেবো
থেমে যাওয়া সম্পর্কগুলোর কারণ জানিয়ে দেবো।

পৃথিবীর অসুখটা সেরে গেলে
সাগরের নীলে হারাবো
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তটা সেখানেই দেখবো।
খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গে
নরম রোদের পরশ ছোঁয়াবো।
গভীর রাতে সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে
তোমার হাতে হাত রেখে আকাশের তারা গুনবো।।
পৃথিবীর অসুখটা সেরে গেলে
তোমাকে লেখা চিঠিগুলো
তোমায় দিয়ে দেবো
বইয়ের মলাটে বন্দী করে রেখো
আবার লিখবো চিঠি প্রতিদিন।।
পৃথিবীর অসুখটা সেরে গেলে
সাহসী যোদ্ধাদের জড়িয়ে ধরে
ভালোবাসায় হারাবো।

লিখে রাখবো তোমাদের কথা
কবিতায়, গানে, গল্পে কিংবা উপন্যাসের পাতায়।
প্রিয় পৃথিবীকে সাজাবো নতুনরূপে
বাঁচবো নতুন আশায়।

পৃথিবীর অসুখটা সেরে গেলে
মালতীনগরের বাড়িটায়
মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদবো।
জীর্ণ করতোয়ার পাশে দাঁড়িয়ে
বলবো, ফিরে এসেছি।
পৃথিবীর অসুখটা সেরে গেলে
সব ভুলে শুধু ভালোবাসায় হারাবো।

নারী

মৃত্যুর পর আমাকে যদি প্রশ্ন করো
আবার যদি তোমাকে নতুন করে পৃথিবীতে আনি, তবে তুমি কি হবে?
আমি বলবো আবার আমি একজন নারী হয়েই জন্মাবো,
হবো মানবিক একজন নারী
ঈশ্বরের সৃষ্টিতে, শিল্পীর তুলিতে, কবির কবিতায়
কিংবা বিখ্যাত কোনো লেখকের উপন্যাসের উপাখ্যানে;
তুমি দেখে নিও।
নারী আমি পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ হয়ে সুবাস ছড়াবো।
রাতের নিঃসঙ্গতায় নিজেকে নোনাজলে ভিজিয়ে
নির্ঘুম রাত না কাটিয়ে নিজেকে করবো কঠিনে কঠিনা।

হঠাৎ যদি কখনো ফেলে আসা কোনো স্মৃতি
আমায় তৃষিত করে তোলে
তবুও আমি তৃষ্ণা মেটাবো
আমার ভালোবাসার নারীসত্তায়।
আমি তখন হয়ে উঠি মানবীয়।
গভীর রাতের শনশন শব্দে
স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয় প্রিয় মুখ,
প্রিয় গান, কবিতা, পাখির কলতান
আমার ফেলা আসা যৌবন ছুঁয়ে
কালোরাত ভিড় করে না কোনোখানে
সেখানে জোছনারা খেলা করে
প্রতিবাদের অহংকারে।
আমি নারী এই আমার অহংকার
আমি অসাধারণ, অনবদ্য কিছু দিতে পারি
আমি কন্যা, জায়া, জননী
আমি ধারন করি, বহন করি
আমি শাশ্বত, স্বাধীন; আমি নারী।

বাংলার আকাশে দীপ্তিময় তারা

সেই রেসকোর্স ময়দান আর নেই
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শিখা চিরন্তন
সেই উদ্যানে কি ছিলো সেদিন
আমার দেখা হয়নি।
সেইদিন মুক্তিকামী মানুষ দেখছিলো তোমায়
একটি কবিতায় তারা পেয়েছিল মুক্তির দিশা
এই উন্মুক্ত ময়দান থেকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র
পৌঁছে গেছে পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে
সেদিন থেকেই বাংলার আকাশের সকল পাখি
স্বাধীনতার স্বাদ নিতে শিখেছে।
মুক্তির গান গাইতে শিখেছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পলাশের ডালে বসে থাকা
টিয়ের নাচন আমি দেখেছি আজ
সেদিনও কি এমনি ছিল সেই উদ্যান,
মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলো তোমার কবিতাখানি?

সেদিনের পথশিশুটিও তোমার কবিতায় মগ্ন হয়ে
শপথ নিতে ভুল করেনি মুক্ত স্বদেশের।

স্বপ্ন দেখেছিলো নতুন মানচিত্রের,
স্বপ্ন দেখেছিলো একটি নতুন ভূখন্ডের
আগুন জ্বলেছিলো শিরায় উপশিরায়
মুক্তি পাগল জনতা তোমার একটি ডাকে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো একটি ফুল ফোটাবার জন্যে।

ফুটেছিল ফুল,
প্রতিটি মানুষের দ্রোহের আগুনে পুড়ে পুড়ে
সে ফুলের নাম বাংলাদেশ
সে ফুলের নাম শেখ মুজিব
সেই ফুল বাংলার আকাশে আজ দীপ্তিময় তারা
হাজারো তারার মাঝে।

বীরাঙ্গনা

অনেক গর্বে নাম দিয়েছিলে বীরাঙ্গনা
সতীত্ব হারানো পোশাকী নামের ভিড়ে
কেঁপে কেঁপে ওঠে অস্তিত্ব সম্বোধনে
অত্যাচারীর ভয়ংকর দিনের স্মৃতিকথা
নৃশংসতা আর পাশবিকতার কথা
রাতগুলো মনে করিয়ে দেয়
কালশিটে পড়া দাগগুলোকে
অবিরল ক্ষতবিক্ষত করে চলে দেহমন
নিঃশব্দে বহন করা সম্ভ্রম হারানো দুঃসহ স্মৃতি
আর সহজ সরল স্বপ্ন বুননের কত কথা!
বীরাঙ্গনা তুমি অন্য তুমি
চাই না আমি এই সম্মান,
চাই না আমি এই পোশাকী নাম
চাই না তুলতে তর্কের ঝড়
কোনো আলোচনা-সভায়।
ফিরিয়ে দাও আমার শৈশব
ফিরিয়ে দাও আমার ছোটোবেলা
ফিরিয়ে দাও আমার সহজ সরল স্বাভাবিক জীবন।
আর ভুলিয়ে দাও-
আমার আসামাজিক জীবন, কালোরাতের যন্ত্রণা
কালশিটে দাগ আর না-পাওয়া ভালোবাসা।

অপার ভালোবাসা

চার দেয়ালের ঘেরাটোপে প্রথম পরশে কিংবা
প্রথম দেখা টিউবলাইটের আলোয়
যে সুর তুলেছিলো সেকি তুমি শুনেছিলে?
নূপুরের রিনিঝনি ঝংকার তুলে,
বুকের বামপাশের শব্দ শুনতে পাওনি?
যখন ছুঁয়েছিলো কবোঞ্চ তোমার পেলব হাত
তখন চঞ্চল নদীতে শান্তস্রোত বয়ে গেলো উষ্ণতায়।
হিমশীতল দেহ ডুবে গেলো গভীরতম খাদে
ওই স্থির চোখে দেখলাম সাগরের গভীরতা
ওচোখে দেখেছি পাওয়ার নেশায় স্বপ্ন বোনা
পেয়েছি নির্ভরতার ছোঁয়া, আজন্ম পাওয়া বিশ্বাস।
দূরত্বটা বাড়িয়েছে কাছে আসার অমোঘ কামনা
নির্দ্বিধায় কাটাবো বুকে মাথা রেখে এক আলোকবর্ষ।
ভালোবাসোনি আমায়
শরীরিক চাওয়া কখন প্রচণ্ড ভালোবাসায় রূপ নেয়
নরম পেলব ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বনে হারায়
সেখানে ছিলো যত্নের অসীম ব্যাপকতা
অনুতাপ হয়নি হারায়ে আদিমতায়
বেনোজলে ভেসে গেছি ঠোঁটের ওমে।
সমুদ্রের নোনাজলের স্বাদে হারিয়েছি
হৃদপিণ্ডের কাতরতা কাছে এনেছে ততো
সেদিনেই বির্সজন সমুদ্রের নীল ফেনিল স্রোতে।

ভরিয়ে দিতে পেরেছি কতটুকু
তা জানে ইশ্বর আর তুমি নামক কঠিন অবয়ব।
কেন এমন হয়?
কতবার যে আমার জানতে ইচ্ছে করেছে
কঠিন অবয়বে পারিনি বলতে ভালোবাসি;
পারিনি বলতে আর একটু কাছে থাকি
নরম স্পর্শ পেতে চাই…
জানাতে চাই ভালোবাসি অপার।

অতলান্তিক বিভ্রম

যাপিত জীবনের ভালোবাসাগুলো একটু অন্যরকম
ভালোবাসি লেখা যত সহজ,
প্রকাশ ততই কঠিন, ভালোবাসা বদলায়।
সবুজ প্রান্তর ভালোবেসে, হেঁটেছি বহুদিন
নীল আকাশ ভালোবেসে ছুঁতে চেয়েছি
আর তোমাকে ভালোবেসে পেতে চেয়েছি।

জীবনকে একটু আন্যভাবে পেতে গিয়ে দেখেছি
আগুন কষ্ট, দাগের পরে দাগ
সরু, চিকন, মোটা, একটি মিশাতে
সৃষ্টি হয়েছে অন্যটি, আর একটি
দাগের পরে দাগ পরে, যে ক্ষতের সৃষ্টি
একে কী বলবে যাপিত জীবনের ভালোবাসা?

সবুজ ঘাস, ফুল, পাখি, লতাগুল্মকে
ভালোবেসে পাবে কিছু তার পরশ
বুকের কোণে, চোখের পাতায়
হয়তো তোমার কলমের আঁচড়ে
মানুষ ভালোবেসে পাবে কষ্ট, দুঃখ, ক্ষত
সব পাবে, আবার হারিয়ে যাবে
একে একে ভালোবাসার অতলান্তে।

বিষন্ন আকাশে প্রসন্ন প্রেম

সকাল-দুপুর, সারাদিন তোমাকেই ভাবছিলাম;
অবিরত, আদ্যোপান্ত মনের অতলান্তে।
তোমাকে ভাবা আমার শেষ হয় না
বইয়ের কালো অক্ষরের মাঝে ভাবি তোমায়
আত্মনিমগ্ন পাঠের মাঝে
শেষ হয় না আমার তোমাকে তালাশ!
তুমি থেকে যাও অমিমাংসিত উপাখ্যান হয়ে
তুমি থেকে যাও পদ্য বা গদ্যের সারাংশ বা উপংহারের
মতো একান্ত আমার ভাষায়..
যা কেবল আমিই বুঝি
তোমার সাথে আমার পরিচয় বইয়ের টেবিলে
কালো হরফের জ্বলজ্বলে প্রতিটি অক্ষরে
যেখানে বর্ণমালা খেলা করে কবিতা কিংবা উপন্যাসের পাতায়..
আর সেখানে ছিলো আমার সর্বনাশের আহুতি।
প্রথম কাছে আসা, পাশে বসা
একটু ছুঁয়ে থাকার ডুবসাঁতার।
তারপর আঙুলে আঙুল খেলার উষ্ণতার পরিমাপ
হৃদয় থেকে শুনতে পাই সাগরের উন্মাদ গর্জন।

সাগরের নোনা জলের স্বাদ নিতে
ওষ্ঠ ছুঁয়ে সুখানুভূতির নোনা পরশে
ডুবে যাওয়ার বাসনায় উন্মুখতা খোঁজা
একটি ছায়ার সন্ধান!
ভালোবাসার উত্তাপে আমার মুদিত আঁখি
ক্রমশ বিবশ হতে হতে
হারিয়ে যায় সমুদ্রেয় ত্তপ্ত-তটে
আর ভালোবাসা নামক সুখের ডানায় ভর করে নীল আকাশে ওড়া।
আমি তোমার বিষন্ন আকাশ ছুঁয়ে দিতে চেয়েছি আলোর পরশে;
তাই তুমি আমার কাছে বিস্ময়, কবিতা বা গদ্যকথা হয়েই রয়ে গেলে।

নিখোঁজ

একদিন ঠিক নিখোঁজ হবো
মিলিয়ে যাবো রাতপ্রহরে,
নিয়নবাতির আবছা আলোয়
খুঁজবে না কেউ এই শহরের অলিগলি।

একদিন ঠিক নিখোঁজ হবো
নীলাকাশের আলোর ভেলায়
ভাববে না কেউ, কাঁদবে না কেউ,
হরিয়ে যাবো মগ্ন-মেঘের শুভ্রতায়।

একদিন ঠিক নিখোঁজ হবো
বালিয়াড়ির বালুতটে
মাতাল হবো আকাশছোঁয়া ভালোবাসায়
প্রেমহীনতার গল্প হবো
সাগরধোঁয়া নোনাজলে
কাঁদবে না কেউ একলা অভিমানে
এই শহরের দেয়ালগুলোয় লিখবো
মিশে আছি কোনখানে–
এক শহরের ইতিকথায়।

একদিন ঠিক নিখোঁজ হবো
হাসনাহেনার ঘ্রাণমাতাল সুবাস নেবো
বৃষ্টি ভিজে বৃষ্টি হবো
দূর আকাশের তারা হবো
একদিন ঠিক নিখোঁজ হবোই।

ক্ষত

একেকটি দিন একেকটি ক্ষত
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ভ্রান্তি,
অসংলগ্নতা আর উপেক্ষার মাত্রা বাড়ায়
পরিসমাপ্তি টানা জীবনের পথে
অদৃশ্য কিছু মুখচ্ছবি
ঘুরতে থাকে এদিক সেদিক
যেমন করে হারিয়ে যায় শীতপাখি
ইচ্ছেশক্তিকে ডানায় ভর করে
উড়ে যায় দূর থেকে দূরে
অনন্ত উপেক্ষায় ফিরে আসে কিছু অদৃশ্য মুখচ্ছবি
কখনও ছুঁয়ে যাওয়া হাত ছেড়ে যায়
পাওয়া না পাওয়ার স্মৃতিতে ফিরতে চায়।

একেকটা দিন একেকটা ক্ষত
কিছু প্রশ্ন ঘুরতে থাকে চারদিক
আঁকতে থাকে হারিয়ে যাওয়া
সেইসব বিষন্ন স্মৃতি গোলপাক, তালগাছ,
ঝুমকোলতা, দেবদারু, জামগাছতলা।

একেকটা দিন একেকটা ক্ষত
হাত ধরে ছেড়ে দিয়েছে একাকীত্ব
নতুন করে বাঁচাতে শিখিয়েছে অতীত
পতিত হবার আগেই উঠে দাঁড়িয়েছি
অভিশাপমুক্ত হয়েছে প্রাণ
চেতনাকে জাগিয়েছে মহাকালের বিপরীত স্রোত
নতুন আগমনকে স্বাগত জানিয়ে
বেঁধে দেইনি পুরাতনের শক্ত শৃঙ্খল।
একেকটা দিন একেকটা ক্ষত।

অনুভবের স্পর্শ

অনুভবের স্পর্শেই ছুঁয়েছিলো ভালোবাসা
বেলি, রজনীগন্ধা ভেবে কাছে টেনেছিলে
গোলাপের সুগন্ধে কাটা আছে জেনেছিলে
ভাবতে পারোনি বিঁধবে সে গায়ে।
ঝগড়া জমে থেমে গেছে
আলিঙ্গনের উষ্ণতা উপেক্ষা করে
মৌন ভালোবাসা অথবা উদভ্রান্ত না-পাওয়া রমণ।
নীরবতা বাড়ছে, অপেক্ষারা হারিয়ে যাচ্ছে
মন ছুটছে প্রকৃতির দ্বারে
বুকের ভেতরে জমে থাকা ভালোবাসা
ওষ্ঠ ছুঁয়ে কপোল স্পর্শেই জেগে ওঠে আদিমতার ঘ্রাণ
তারপরও প্রাণপণে চেয়েছি তোমার হাত ছুঁয়ে যাক
আমার কাঁধ, ছুঁয়ে যাক আমার ঠোট
না হয় মেকিই হলো; মমতাটুকু!
জবাব চাইবো না আগের মতো
শুধু ছুঁয়ে থাকো অনুভবের স্পর্শে।

বৃষ্টিশোক

অবরুদ্ধ সকাল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,
সন্ধ্যা গড়িয়ে গহন কালো রাত।
ভেঙেছে অজস্র পাড় ও পাপড়ি,
গড়েছে অন্যকোনো তীর, অদেখা মাঠ।
বিচ্ছেদে ভেঙেছে জোয়ারের তোড়ে
মিহি বালুকণা।
আবার ভেসে গেছে নতুন আবাদি ঘর
গোধূলির বিবর্ণ বিকেলের রঙচটা বৃষ্টি।
মেঘের ফাঁকে হঠাৎ রঙধনু
কনে দেখা আলোয় নতুনের আগমনধ্বনি।
জলের সীমান্তে সূর্যাস্তের নৌকা।
রাতের জোছনায় হারিয়ে যায় গুচ্ছ তারকা।
স্বপ্নেরা জালবুনে নতুন ভোরের আশায়,
খুঁজে ফেরে মায়াঘোর।
নতুন আশা জাগিয়ে রাখে
থেমে যায় না কেউ; না মানুষ না প্রকৃতি।
পিছুটান উপেক্ষা করে, জয়ের নেশায়
এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন খেলা করে স্বল্পায়ু প্রাণিদের চোখেমুখে।

বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসে,
আমিও বৃষ্টির মতো কাঁদি, সময় হারানোর শোকে।

পরবাসী

এখন কেমন বদলে গেছে জীবন
বদলে গেছে অনেক কিছু
টিনের চালের গেরস্থালী; বৃষ্টিভেজা পিছল উঠোন
সন্ধ্যাবেলার গন্ধফুলে মন ভোলানো মাতাল শ্রাবন
বহুদূরের মেঘের মত এখন আমি পরবাসী।

এখন অনেক বদলে গেছে
শাপলা বিলের নীলাভ বিকেল
বুনো গন্ধ; সবুজ বন; বৃষ্টি শেষে পাতার ভাসান
সর্ষে রঙের আবির মাখা তোমার বুকে আলিঙ্গন
বহুদূরের মেঘের আমি এখন কেবল পরবাসী।

ভুলে গেছি পাতার বাঁশী
বিছিয়ে রাখা খয়েরী পথ
ভালবাসার স্মৃতির গায়ে জ্যোৎস্নাভাঙা তপ্ত মিলন
দীর্ঘ পথে তোমার বুকে সন্ধিবিহীন অগ্নি চুম্বন
বহুদূরের মেঘের কাছে আমি শুধুই পরবাসী।

দু’চোখ তাকায় কেবল একা
নিজের সাথে নিজের কথন
বহুতলের পেন্ট হাউজে নিভৃত এক ছায়ার গোপন
নীলের জলে পা ডুবিয়ে তোমার চোখে সুদূর বিজন
বহুদূরের মেঘের বুকে আমি যে আজ পরবাসী।

ছায়ার মানুষ ফিরে গেছে
তীব্র নেশার নতুন সুখে
আশার মানুষ পথচারী চৈত্র রঙের নীরব পার্বন
মগ্ন ধোঁয়ায় শরীর জাগে কফির মগে টিম হর্টনে
বহুদূরের শীতাশ্রমে এই আমি সেই পরবাসী।

নাগরিক নাব্যতায়

আমার শহরে নিয়নবাতি জ্বলে
আঁধার আসার আগেই
অজগর-সাপের মতো শীতল হয়ে শুয়ে থাকে পথ।
শূন্যতা ঘিরে থাকে; থমকে যায় নগর কোলাহল!

শহরের গল্প জমা থাক পথের ধারে,
জানালার কার্নিশে কিংবা নাম না-জানা
সবুজের আলাপনে। বিষাদ হারিয়ে যায়
চোখের জল ব্যথাতুর ঝরে পড়ে
বৃষ্টিজলে ধুয়ে যায় বেদনার জলছাপ;
রূপান্তর হয় শব্দমালায়। সভ্যতার নমকরণে
গল্পের প্লট বদলে যায় নতুন দৃশ্যপটে;
কৃত্রিম আলোর উৎসবে দেখি সাজানো হাসি।

আমিও নাগরিক আলোর মতো
হারিয়ে যাই বাস্তবতায়
মনে নেই শেষ কবে হারিয়েছি;
প্রতিবার হারাই; কোথায় জানি না
খুঁজেছি বহুবার পথেঘাটেমাঠে।
আবার হারাই, প্রতিবাদে হারাই
আবার কোথাও খুঁজি আমাকেই।

এই নগর জানে, আমি সবার;
অথচ আমার কেউ নেই।

শেকড়ের উপকথা

রাতগুলো মিলিয়ে যায়
পেন্ট হাউজের বারান্দায়;
আধাঁরে ঢেকে যায় দীর্ঘশ্বাস
শূন্যতায় নেমে যায় শেষরাতের তারা
কার্নিশজুড়ে পায়রার বাকুম-বাক।
কিংবা নতুনের আগমনী গান
পূবাকাশের লাল আভায় বাসন্তী বিলাপ
হঠাৎ কোলাহলে ফিরে বর্তমান।
জানালায় আটকে থাকে মুক্ত ভোর
প্রতিবাদে মুখর নানাবিধ শব্দের গল্পরা।
কথারা হয়ে যায় কবিতা,
জীবন খুঁজে রাত, অস্থিরতায় লেখা কবিতা,
গান, উপন্যাসের ঝাপসা অক্ষরে শেকড়ের উপকথা।
মাটির সোঁদা গন্ধে শেওলার মৌতাত
জমানো ক্রোধ আঁকড়ে ধরে পুরোনো ঘর।
ঘন মেঘে খুলে যায় প্রকৃত স্বরূপ
ঝড়-উত্তাপ গ্রাস করে কুচকে যাওয়া অতীত
ধীরে ধীরে উত্তরাধিকার হতে থাকে শেকড়;
ভুলে যাওয়া গল্পে অতীতের দৃশ্যপট,
ঘুম-দুপুরের বিরতিতে নতুনের আহ্বান
সমস্ত ভয়কে তাড়িয়ে পুনর্জন্ম হয় চাঁদের!
তুমি আমি আমরা মৃত্যুর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে
ছেঁড়া জোছনায় একাকীত্ব ঠেলে মিশে যাই
ব্যস্ত ট্রাফিকের লোকালয়ে; সন্তপর্ণে
আকাশ মাটির আঙিনায়।

জেমী, টরন্টো