নাদিরা তাবাসসুম : রিজুর খুউব আনন্দ হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে নানাবাড়ী যাবে ঈদুল আযহা (কোরবানী ঈদ) পালন করতে। সবাইকে বলেছে ‘কি মজা আমরা এবারের ঈদে বাংলাদেশে যাবো। বাবা বলেছে যে, আমরা নতুন জামাকাপড় বাংলাদেশ থেকে কিনবো। কিন্তু রিজুর বড় বোন রিমার মন খারাপ। কানাডার বান্ধবীদের ছেড়ে বাংলাদেশে ঈদ করতে যেতে চাইছে না। মাকে রিমা বলেছে ‘মা এবারের ঈদে বাংলাদেশে না গিয়ে বরং আগামী ঈদুল ফিতর অর্থাৎ সেমাই ঈদে যাই। আমার কিছুতেই এবার যেতে ইচ্ছে করছে না’। মা জবাব দেয় ‘তোর নানু খুব অসুস্থ। আমাদের অনেকবার করে বলেছে এবারের ঈদে দেশে যেতে। তোর বাবা ভয় পাচ্ছে এবার না গেলে যদি কিছু হয়ে যায়, তোর নানুর সাথে আমাদের আর কখনও যদি দেখা না হয়। তাই তোর আব্বু টিকিট বুকিং দিয়ে ফেলেছে’।
-মা তুমি তো জান যে বাংলাদেশে কোরবানী ঈদে কিভাবে প্রকাশ্যে গরু ছাগল জবাই করে। রাস্তা ঘাট মাঠ প্রান্তর রক্তাক্ত হয়ে থাকে। আমার এসব দেখলে ভীষণ কষ্ট হয় আবার কান্নাও পায়। কানাডায় গরু ছাগল কোথায় জবাই হয় আমরা দেখি না সেটাই বরং ভালো।
– ঠিক আছে তোমার যখন কষ্ট হয় তখন ঈদের কয়েকটা দিন না হয় ঘরে বসে থেকো। তারপর রক্তগুলো ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেলে বাইরে যাবে।
– আমি জানি ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরবো, মজার মজার খাবার খাবো আর সবাই মিলে ঘুরে ফিরে বেড়াবো। সেখানে গরু-ছাগল জবাই করা চোখের সামনে তাদের কাটাকাটি করা আমার কাছে খুউব খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে।
– বুঝেছি ছোটবেলা থেকেই তোর এরকম মনের অবস্থা। হাঁস-মুরগী জবাই করতে গেলেই কতবার তোর বাবার কাছে কান্নাকাটি করেছিস যাতে জবাই না করে। তোর বাবা কত বুঝিয়েছে। এখন তুই বড় হয়েছিস কলেজে পড়ছিস। ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে তোকে ভালভাবে জানতে হবে।
– তা জানি কিন্তু জ্যান্ত জীব-জন্তু চোখের সামনে জবাই করে মেরে ফেলবে এটা আমি দেখতে চাই না। একবার চিন্তা করে দেখো মানুষ আর জীব জন্তুর মধ্যে কি কোন শারীরিক পার্থক্য আছে? ওদের শরীর, মাথা, বুক, পাকস্থলী, লিভার, শরীরগত সকল সিস্টেম মানুষের মতো। আবার বাচ্চাও জন্ম দেয় মানুষের মতো। শুধু ওরা কথা বলতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না আর নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তাই মানুষ তাদের অধীনে রাখে এবং তারাও মানুষের অনুগত থাকে; যখন যেভাবে চালায় সেভাবে চলে।
– আমরা যেহেতু ইসলাম ধর্মের অনুসারী সেহেতু ইসলাম ধর্মের প্রতিটি বিধিবিধান আমাদের মেনে চলা উচিত। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ আছে সেটা তো জানো নিশ্চয়ই যেমন – কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত। আর হজ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কোরবানী দেওয়া। এজন্যে আমি সবসময় বলি পবিত্র কোরআন শরীফ অর্থসহ পড়ো। কোরআন হাদিস পড়লে এবং তা নিয়ে গবেষণা করলে অনেক বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানতে পারবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আমি আপনাকে (রাসুল (সাঃ) কে) কাওসার প্রদান করলাম, অতএব আপনি আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন ও কোরবানী করুন” (সূরা কাওসার : আয়াত ১-২); “আর উটকে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করলাম, তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ আছে। সুতরাং তোমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাতে আল্লাহর নাম লও, তা ভূপাতিত হলে খাও এবং আহার করাও ধৈর্য্যশীল ও যাঞ্চাকারীদের অভাবগ্রস্থকেও, এভাবেই তা তোমাদের অধীন করলাম, যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হও। “আর আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তার গোশত ও রক্ত, পৌঁছে শুধু তাকওয়া। এভাবেই তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিলেন, যেন এ হিদায়াতের কারণে তোমরা তাঁরই মহত্ব প্রচার কর। নেককারদের সুসংবাদ দাও” (সূরা হাজ্জ : ৩৬-৩৭); “আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করেছেন পবিত্র কাবাকে, পবিত্র মাসকে, কোরবানীর জন্তুকে ও চিহ্নিত (গলায় মালা পরিহিত) পশুকে যেন তোমরা জান যে, আসমান যমীনের সবকিছু সম্মন্ধে আল্লাহ জানেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন” (সূরা মায়েদাহ : আয়াত ৯৭)।
রিজু মায়ের এবং বোনের সব কথা শুনেছে। ভাবে আপুটা কি বোকা এত চিন্তা কেউ করে নাকি। ঈদে দেশের বাড়ি যাবো। নানা-নানী, দাদা-দাদী, মামা-মামী, চাচা-চাচী তাদের ছেলেমেয়েরা আছে সবার সাথে ঈদ করা কত আনন্দের ব্যাপার হবে। রিজু বলে, আম্মু আমাদের বেশীর ভাগ আত্মীয় স্বজন তো বাংলাদেশে থাকে। ওখানে ঈদ করতে গেলে আমাদের বেশি মজা হবে। আপু তুমি চিন্তা করো না। তুমি ঘরে বসে ঈদ করবে আর আমরা মজা করে আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বাসায় ঘুরে বাড়াবো।
– হ্যাঁ বাবা, আমাদের আত্মীয় স্বজনরাও আমাদের দেখতে চায়, আমাদের কাছে পেতে চায়। কত বছর ধরে আমাদের দেশে যাওয়া হয়নি। তাছাড়া তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আত্মীয় স্বজনের সম্পর্ককে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করা উচিত নয়। পবিত্র কোরআনে আত্মীয় স্বজন-এর হক বা প্রাপ্য বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। “নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করেন সুবিচার, সদাচরণ ও আত্মীয় স্বজনদেরকে দান করার আর নিষেধ করেন অশ্লীলতা ও সীমালংঘন করতে। উপদেশ দেন যেন তোমরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর” (সূরা নাহল : আয়াত ৯০); “নিকট আত্মীয়কে তার হক দাও; মিসকিন ও পথিককেও তাদের হক দাও। আর তোমরা অপব্যয় থেকে বিরত থাক” (সূরা বণী ইসরাইল : আয়াত ২৬)।
[এমন সময় দরজায় কলিং বেলের শব্দ বেজে উঠলে রিজু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় এবং দেখতে পায় তার বাবা ব্যাগ ভর্তি শপিং করে নিয়ে বাসায় ফিরেছে]
– আম্মু দেখ, আব্বু কত কিছু নিয়ে এসেছে।
– কই দেখি (মা এবং মেয়ে রিমা ছুটে এসেছে দেখার জন্য)
– ওমা এত কিছু। কিন্তু তোমার মেয়ের ভীষণ মন খারাপ। বান্ধবীদের ছেড়ে বাংলাদেশে গিয়ে ঈদ করতে ওর ইচ্ছে করছে না।
– কেন ওখানেই তো ওদের বেশি আনন্দ পাওয়ার কথা, সব আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হবে। ওর খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফুতো ভাইবোনেরা ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
– তোমার মেয়ে বলে যে, বাংলাদেশে গরু, ছাগল ঈদের দিনে মাঠে ঘাটে যেখানে সেখানে যখন জবাই করা হয় তখন ওর নাকি খুব কষ্ট হয়।
– ও, এই কথা। কিন্তু মামনি তুমি এতদিনে জেনেছো নিশ্চয়ই যে, এটা আমাদের ধর্মীয় বিধান এবং এটা আমাদের মানতেই হবে। আসলে ‘কোরবান’ শব্দের অর্থ হলো- নৈকট্য লাভ বা আত্মত্যাগ। আমাদের নবী হযরত ইব্রাহিম (আঃ)- এর কোরবানী করার উদ্দেশ্যই ছিল আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা; আর সেজন্যেই তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে আল্লাহর আদেশে কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সেই থেকেই আজ পর্যন্ত এ বিধান মেনে চলা হচ্ছে। পবিত্র কাবাগৃহে হজ্বের পাশাপাশি কোরবানী দেওয়া অবশ্য পালনীয়। আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াতে বলেছেন “আর আল্লাহর জন্য হজ্ব ও ওমরা পূর্ণ কর। যদি তোমরা বাধা প্রাপ্ত হও, তবে সহজলভ্য কোরবানী কর। কোরবানীর পশু নির্দিষ্ট স্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত মাথা মুণ্ডন করো না। তোমাদের মধ্যে যে রুগ্ন অথবা যার মাথায় রোগ থাকে, তার জন্য রোযা বা সদাকা অথবা কোরবানী “ফিদিয়া” হবে। যখন তোমরা নিরাপদ হও, তখন হজ্বের ওমরাহও পালন করতে আগ্রহী হলে সহজলভ্য কোরবানী করবে।”
– আচ্ছা তুমি কি টিকিট নিশ্চিত করে ফেলেছো?
– আমি তোমাদের সাথে ওই কথাটাই এতক্ষণ বলবো ভেবেছিলাম। মাঝখানে রিমা মামনিকে কোরবানী দেয়ার গুরুত্ব বিষয়ে বলতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি। আর সেটা হলো, বাংলাদেশে বর্তমানে ‘কভিড-১৯’ অর্থাৎ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, যেকোন সময় আমাদের ফ্লাইট বাতিল হয়ে যেতে পারে। তুমি জানো কয়েকদিন আগেও আমাদের কিছু বন্ধু ও প্রতিবেশীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে। সারা বিশ্বজুড়ে মহামারীর আতংক। এর মধ্যেও তোমার মায়ের মূমূর্ষ অবস্থা শুনে আমরা ভেবেছিলাম যাবো কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়ে গেলাম।
– আমার মনে হয় টিকিট ক্যানসেল করে দাও। কারণ ছেলেমেয়ে নিয়ে এ মুহূর্তে ভ্রমণ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
– তোমার মায়ের যে মূমূর্ষ অবস্থা তাতে যদি পরবর্তীতে আর কখনও দেখা না হয়।
– কি করবো বলো, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি যদি বাঁচিয়ে রাখেন তবে পরিস্থিতি ভালো হলে আমরা দেশে যাবো।
– সেই ভালো। এখন যে বিপদআপদ চলছে তাতে আমাদের ধৈর্য্য ধারন করতে হবে। মানুষের জীবনে সব সময় এক অবস্থায় কাটে না। কখনও মানুষের কর্মফলের কারণে কখনও বা প্রকৃতির নিয়ম-নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে নেমে আসে দুর্যোগ, মহামারী ইত্যাদি। তবে এসবই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে। এতে তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে কারা সহনশীল এবং কারা ধৈর্য্যহারা বা দুর্বল ঈমানের অধিকারী সে পার্থক্য করে নেন। পবিত্র কোরআনে বিপদআপদে ধৈর্য্যধারণকারীদের জন্য সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, “কোন বিপদই আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া আসে না, যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, তিনি তার মনকে হেদায়েত দেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞাত” (সূরা তাগাবুন : আয়াত ১১); “আর তোমাদের উপর যেসব বিপদ আপতিত হয় তা তোমাদের কৃতকর্মের ফসল; আর তিনি অনেকগুলো তো মাফ করেন” (সূরা শূরা : আয়াত ৩০); “পৃথিবীতে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় অবতীর্ণ হয় তা আমি সংঘটিত করার পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। নিশ্চয়ই এটা খুবই সহজ আল্লাহর পক্ষে” (সূরা হাদীদ : আয়াত ২২)। অতএব এসো, রিমা, রিজু আমরা সবাই এখন থেকে নিয়মিত নামাজ পড়ি, ধৈর্য্য ধারণ করি আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি খুব শীঘ্রই আমাদের সকল বিপদআপদ থেকে মুক্ত করে দেন।