হিমাদ্রী রয় : বিশুদ্ধ বাতাসে উত্তরের প্রকৃতি জীবনকে আলিঙ্গনের ডাক দিয়েছে। বারান্দার সামনে গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে আছে হাইড্রেনজিয়া ঢেলে দিয়েছে বুকের সুগন্ধ, ঘরবন্দী মানুষ উষা কালের বাসা না ছাড়া পাখির মতো আলো ফোটার অপেক্ষায়, নাজিমের চোখে মুক্তির বাসনার মতো ‘গাছে গাছে পাখির কাকলি পাখা মেলে উড়তে চায়, জানলা বন্ধ টান মেরে খুলতে হবে’। আলো এসে পড়ছে উত্তরের জনপদের মিলনের সেতুতে, দেখা হবে দীর্ঘদিনের জমানো কথা আর ব্যাকুলতার সাথে।
লকডাউন শেষ হলো বুঝি? প্রশ্নের পাহাড়ে সান্ত¡না খুঁজি। আবার ব্যাস্ত হবে পৃথিবী, ব্যাস্ততাকে আরো বেশি ব্যাস্ত করে তুলতে। অন্তরের লকডাউন উঠবে কিনা সে জানে অন্তর্জামী।
শুধু নামের সাথে নাম জুড়ে ফলোয়ার্সের পাহাড়, হ্যাসট্যাগ আর ইমোজিতে হাসি রাশি রাশি, অন্তরে ক্ষোভ ময় বেঁচে থাকা। বাস্তবতা দিনের শেষে ‘ম্যে অউর মেরা মোবাইল আকসার…’ কাম্য নয় তবু মানুষের মৃত্যুর মিছিল, এত শূন্যতা পূরণ করে ‘তবু অনন্ত জাগে’ বলার শক্তি নেই।
আসলে আমরা বড় একা, অস্থির, একাকিত্ব দ্বারা আমরা নিয়ন্ত্রিত। হাতের ডিজিটাল যন্ত্রটির উপর বড় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। একঘন্টা ডিভাইস থেকে দূরে থাকলে বুঝা যায় কতটা বোরিং জীবন, যেন অবসাদে ছেয়ে আছে। আসলে আমরা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে হাঁটছি না, যন্ত্রটি আমাদের নিয়ে হাঁটছে। যেমন করে শব আমাদের গন্তব্য দেখায় আর আমরা ভাবি শব বহন করে গন্তব্যে নিয়ে যাই।
ছেলে বেলায় বৈরাগী আসতো বাড়িতে, কয়েক মুষ্টি চাল আর কটা আলু বেগুন ঝুলিতে ঢেলে শুনিয়ে যেত কীর্তন ‘যন্ত্র যদি পড়ে থাকে লক্ষজনার মাঝে যন্ত্রী বিহনে যন্ত্র কেমন করে বাজে’। সরলতার সেই দিনগুলো হারিয়ে ডিজিটালের ইমারতে ইচ্ছাবাস। যন্ত্র এখন আমাদের বাজিয়ে চলেছে অহর্নিশ। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড জীবন এখন অনেক বড়, কর্পোরেট বাজার, ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন বিলবোর্ডে রঙিন। তবে চেহারা আর আয়নার মাঝখানেও এক অদৃশ্য দেয়াল থাকে যা আশা ভংগের অভিশাপ উঠে দাঁড়ায়।
ইন্টারনেট থেকে অফলাইন হয়ে, সেই জীবন আর সেই প্রিয়জনকে খুঁজি, কাছের কিংবা দুরের, কারো সাথে পরিচয় হয়তো অন্তর্জালে, যাদের কাঁধে মাথা রাখা যায় নির্ভরতায়। ‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়’ গ্রহণ করে স্নেহ মমতায়।
নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি, যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক জীবনে আমিও নোটিফিকেশনের বাইরে নই, নিজেকে নিজে সময় দিয়ে আনন্দ দেওয়া খুশি করা এতটা সহজ নয়। তবে মনের মাটিতে যে বাগান আছে তাতে মায়ের পরিচর্যা টের পাই, যখন মাটির কাছে যাই। মাটিই একমাত্র পারে ডিজিটাল যন্ত্রটিকে দুদন্ড বিচ্ছিন্ন করে রাখতে। যখন নিজ হাতে বাগানের বেগুন ছুঁয়ে দেখি, কুমড়ো ফুলে হাত রাখি, নুয়ে পড়া লাউটিতে চোখ রাখি, মায়ের যতœ টের পাই টলমল মনে।
ডিজিটাল জীবনে সম্ভাবনা আমি অস্বীকার করছি না তবে তা যেন হয় মাটি ছুঁয়ে।