কামাল কাদের : নাম তার, আদনান জাহাঙ্গীর। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম অনুসারে তার নাম, সে জন্য বন্ধুরা তাকে আদর করে ডাকে সম্রাট। আদতে তার পকেট রমনার মাঠ। অর্থাত পকেট শূন্য। সে বেকার। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজ বিজ্ঞানে এম,এ, পাশ করে চাকরি খুঁজছে। চাকরির খোঁজার সুবাদে বাস্তব জীবনে পদার্পন করে সে বুঝতে পারলো যে, ছাত্র জীবনটা যতটা সহজ, বাস্তব জীবনটা তার বিপরীত। জীবনের অনেক কিছু দেখার এবং শেখার আছে।

বাড়ির বড় সন্তান। বাবা পুরানো ঢাকার হাই স্কুলের শিক্ষক। ভাই-বোন চারজন, আর মা। গতানুগতিকভাবে সংসার চলছে। সংসারের নানা অভাবের ফলে তাদের জীবনে আবদার বা পছন্দসই শব্দ দুটির কোন অবস্থান ছিলো না। এম,এ পাস করার পর তার মনে হলো, এবার এই শব্দ দুটি তাদের জীবনের অভিধানে জায়গা করে নিতে পারবে। কিন্তু তা আর হচ্ছে না।
একটা যথাযোগ্য চাকরি পাওয়া মানেই, সোনার হরিণের পিছনে ধাওয়া করা। লোকে বলে, সোনার হরিণ পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকিং না থাকলে একটা চাকরি জোগাড় করা সোনার হরিণের চাইতেও দুর্লভ। হতাশায় জীবন ভরে উঠছে। দুই-তিনটা টিউশনি করে জীবন কাটিয়ে নিচ্ছে। আর নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে এই ভেবে, জীবনে হয়তোবা কোনোদিন মা-বাবা, ভাই-বোনদের সে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারবে না। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করছিলো, বিএ, এম,এ পড়ে ভুল করেছো। একটা টেকনিক্যাল লাইনে লেখাপড়া করলে এতদিনে একটা চাকরি হয়ে যেত। এই যেমন গাড়ি মেরামত করা, কম্পিউটার, টিভি রিপেয়ার করা ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের সমাজ তো অন্য রকম, একজন স্কুল শিক্ষকের ছেলে কার মেকানিক? এ কেমন কথা। আদনানের মাঝে মাঝে মনে হয় আজ এ কথা ভেবে কি বা লাভ? তবুও কেন জানি সময় অসময়ে মনে হয় পিছনের জীবন কি আর ফিরে পাওয়া যায় না? গভীরভাবে ভাবলে আদনানের বুকের ভিতরে একটা চাপা ব্যথা জেগে উঠে, বিশেষ করে যখন চাকরির দরখাস্ত করতে করতে মন মেজাজ কিছুই ঠিক থাকে না।

একদিন হঠাত করে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতোই একটা চাকরির ইন্টারভিউ পেয়ে গেল। ইন্টারভিউ মানেই তো চাকরি পাওয়া নয়, এতো জানা কথা। তবুও সে আশায় বুক বাঁধলো। ইন্টারভিউয়ের দিন সে নিজেকে খুব স্মার্ট করে সাজালো। বন্ধুরা বলে থাকে, ও নাকি খুবই সুদর্শন, নাটকে অভিনয় করলে ওকে অনায়েসে মেয়ে চরিত্রে সাজানো যেত। ইন্টারভিউয়ের দিন, গুটি গুটি পায়ে সে ইন্টারভিউয়ের রুমে ঢুকলো। ভিতরে পিন ড্রপ সাইলেন্স, রীতিমত ভয় পাওয়ার ব্যাপার। একটা বিরাট টেবিলের অপরদিকে তিনজন মধ্যেবয়সী কর্তা-ব্যক্তিগণ গম্ভীরভাবে বসে আছেন। দুজন পুরুষ, আর একজন মহিলা শ্বেতাঙ্গিনী। মহিলাটি কোম্পানীর সাউথ-ইস্ট এশিয়ার রিজিওনাল ডিরেক্টর। মার্কিন অধিবাসী। করাচীর রিজিওনাল হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকায় এসেছেন ইন্টারভিউ প্যানেলের চেয়ারম্যান হিসেবে। বাকি দুজন স্থানীয় বাঙালি। প্রথমেই বাঙালি ভদ্রলোকটি ইংরেজিতে একটি প্রশ্ন করে আদনানকে বিপদে ফেলে দিল। তিনি বললেন, “চাকরিটা হলো, মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভে – কাম – ফার্মাসিউটিক্যাল এডভাইজের”, একটু হেসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই চাকরিটা সায়েন্সের ছেলেদের প্রযোজ্য, আমাদের কাছে অনেক সাইন্স এবং ফার্মেসীর গ্রাজুয়েট প্রাথী রয়েছে, এখন তুমি বল কেন তোমাকে আমরা এই চাকরিতে নিয়োগ দিব?” তাই তো, প্রশ্নটি শুনে প্রথমে আদনান হকচকিয়ে গেল। রাগে তার মাথাটা গরম হয়ে উঠলো। সে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। ভাবলো যা হবার তা হবে। পরক্ষণেই মনে পড়লো ছোট বেলার এক গল্পের কথা, “দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দুঃখ কিসের?” তারপর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে গড় গড় করে ইংরেজিতে বলে গেল- “স্যার, তাহলে এ কথা জেনেও আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য কেন ডেকেছেন, কেন এই ছেলে খেলা। এভাবে আপনারা আমাদের মতো শিক্ষিত যুবকদের জীবন নিয়ে আর কত ছিনিমিনি খেলবেন? এই লোক দেখানো ইন্টারভিউয়ের আয়োজন না করলেই কি হতো না। আমাদের মত গরীব হতভাগা ছেলেদরেকে আর কতদিন এভাবে অপদস্ত করবেন? এ জীবনে তো অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করেছেন। প্রতিদিন একসাথে কয়টা মুরগীর মাংস খেতে পারবেন, আর প্রতিদিন একনাগাড়ে কয়টা গাড়িতে চড়ে হাওয়া খেতে বেরুবেন? আমাদের মত গরীব শিক্ষীত যুবকদের জন্য কিছু করুন স্যার। পরিণামে আমরাও হয়তো আমাদের প্রজন্মের জন্য কিছু করতে পারবো। স্যার, আপনারা যদি কোনো দৃষ্টান্তমূলক কিছু না করেন, তাহলে আমাদের মত যুবকদের ভবিষ্যত কি হবে?” কথাগুলি একনাগাড়ে বলে আদনান ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কাউকে কোন মন্তব্য করার সুযোগই দিল না।

রুম থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই আদনান তার বাস্তবতায় ফিরে এলো। সে এ কি করলো। কেন এমনটি হলো। বাড়িতে মা-বাবা চাতক পাখির মত নিশ্চয়ই তার ফেরার পথপানে চেয়ে আছে। তাদের মনে কত আশা, তারও তাই ছিল। চাকরিটা হয়ে গেলে জীবনটা বদলিয়ে ফেলতে পারতো। সে আর হলো না। ইচ্ছে করেই এদিক ওদিক ঘুরে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলো। উদ্দেশ্য, বাসার সবাই জানুক, ইন্টারভিউ ভালো হয়নি। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু বাবা, যিনি তার অকৃতিম বন্ধু জেগে ছিলেন। আদনানের চাহনিতে তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন তার অবস্থা। তাই বিজ্ঞ লোকের মত তিনি আর আদনানকে কোনো প্রশ্ন করলেন না।

কিছদিন পর “এংলো-আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি” অর্থাত যে কোম্পানিতে আদনান ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো, সেখান থেকে একটা চিঠি এলো। সে ঘৃণায় চিঠিটি খোলার কোনো উত্সাহ বোধ করলো না। চিঠিতে কি লেখা থাকবে তাতো তার জানাই আছে। কয়েক দিন পরে চিঠিটি ফেলে দেবার আগে, সে খুললো। খোলার পর সে একি দেখছে।
“প্রিয় মিস্টার জাহাঙ্গীর, আমাদের রিজিওনাল ডিরেক্টর ডেবরা হ্যারিস তোমার কথাবার্তায় এবং তোমার সাহসিকতায় মুগ্ধ।
তাই আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, তোমাকে আমাদের কোম্পানির ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। করাচীতে আমাদের রিজিওনাল হেড অফিসে এই ট্রেনিংয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কোম্পানীর খরচে এই ট্রেনিং তিন মাস পর্যন্ত চলবে।
ট্রেনিং-এ পাস করার পর কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী পার্মানেন্ট নিয়োগ পত্র দেয়া হবে। যত শীঘ্র সম্ভম পাসপোর্ট, ভিসা প্রভৃতি জন্য আমাদের পার্সোনাল ম্যানেজার মিস্টার আশরাফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
বিনীত : মিস টি, আহমেদ, (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্সোনাল ম্যানেজার)

বিশেষ দ্রষ্টব্য : তুমি ইন্টারভিউয়ের সময়ে যে পয়েন্টগুলি আলোচনা করেছো সে ব্যাপারে ম্যানেজমেন্ট অতি সহানুভূতির সাথে খতিয়ে দেখবে।
ব্যাপারখানা আদনানের কাছে খটকা মনে হলো। সত্যতা যাচাই করার জন্য সে কোম্পানীতে ফোন করলো। উত্তর ঠিকই পেলো।
বরং ভর্সোনার সুরে অপরদিক থেকে বলা হলো, যারা সিলেক্ট হয়েছেন, তাদের সবারই করাচী যাবার আয়োজন প্রায় শেষ পর্যায়ে শুধু আপনিই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার বাকি রয়ে গিয়েছেন। শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল, তাই আদনান করাচী যাবার প্রস্তুতি শুরু করে দিল।

ট্রেনিংয়ের জন্য ঢাকা থেকে করাচী যাচ্ছে সাতজন শিক্ষানবিশ। দল থেকে ছয় জনকে নেয়া হবে, আর এক জনকে বাদ দেয়া হবে। তার মানে ব্যাপারখানা প্রতিযোগিতামূলক। আদনান ভয় করছে, সে কি সেই সাত নম্বর, যে প্রতিযোগিতায় বাদ পরে যেতে পারে?! করাচীতে যাবার দিন ঘনিয়ে এলো। এক মনোরম সন্ধ্যায় পি,আই,এ প্লেনে চড়ে করাচী অভিমুখে রওয়ানা হল। জীবনে প্রথম প্লেনে চড়া, সে এক অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। করাচীর কেন্দ্রস্থলে “হোটেল জাবিস” নামে বড় এক হোটেলে তাদের থাকার বন্দোবস্ত হল। হোটেল থেকে অদূরেই আরব সাগর। হেঁটেই যাওয়া যায়। সাগরের বেলাভূমিতে এবং তার আশেপাশে নানা ধরনের মেলার সমাবেশ। যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু-কিশোর সবার জন্যই মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রথম দিনেই হোটেলের ডাইনিং রুমে রাজকীয়ভাবে প্রাতরাশ করা হল। পরে সময়মতো কোম্পানীর একটা মাইক্রোবাস এসে ওদেরকে নিয়ে গেল কোম্পানীর বিরাট ফ্যাক্টরির অঙ্গনে। অনেক জায়গা জুড়ে রয়েছে কোম্পানীর অবস্থান। সেখানে রয়েছে প্রশাসনিক অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফ্যাক্টরি প্লান্ট এবং কর্মচারিদের জন্য বড়সড়ো এক ক্যান্টিন। তাদেরকে দেখা-শুনার ভার দেয়া হল এক এংলো-পাকিস্তানী মহিলাকে। তার নাম জীন জনসন। খুবই স্মার্ট মহিলা। তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। বয়সে সবাই তরুণ, স্বভাবতই জিনের প্রতি সবার একটা কৌতূহল থাকারই কথা। তাই এ বিষয়ে তারা একমত যে, জিনের সমন্ধে কোনো ব্যাপারে আলোচনা করলে, জীন না উল্লেখ করে, পরী উল্লেখ করা হবে, তা হলে ওর বোধগম্য হবেনা যে ওর সম্বন্ধে তারা আলোচনা করছে। প্রথম দিনে তাদের সবাইকে কোম্পানীর মানাজেমেন্টদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল। এই যেমন ,কোম্পানীর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ,মেডিকেল ডিরেক্টর, পার্সোনাল ডিরেক্টর , সেলস ডিরেক্টর প্রভৃতি গণ্যম্যান্য লোকদের সাথে। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর যিনি তিনি বাঙালি।বাংলাদেশের পাবনার লোক। ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপ নিয়ে করাচীর ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনারিং পড়তে এসেছিলেন। লেখাপড়া শেষে বাংলাদেশে না ফিরে করাচিতেই রয়ে গেলেন। ভালো ছাত্র হওয়ার ফলে কোম্পানীর খরচে ইংল্যান্ডের লীডস ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে “এংলো -আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীতে ” থেকে গেলেন। পরে যোগ্যতা এবং মেধার জোরে আজ তিনি কোম্পানীর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। আরো পরে জানা গেলো যে ,তিনি একজন উর্দুভাষী কলেজ লেকচারারকে বিয়ে করে যথারীতি সংসার ধর্ম পালন করছেন। বাঙালি হিসাবে উনার এতবড়ো পদমর্যদা দেখে আদনান এবং তার সহযোগীরা নিজেদেরকে অনেক গর্বিত ভাবছিলো।

দুপুরে লাঞ্চের সময় হল।কোম্পানীর বিরাট ক্যাফেটেরিয়াতে জীন তাদেরকে নিয়ে গেল। সেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষ খাওয়া দাওয়া করছে। আদনানদের লাঞ্চের ব্যবস্তা ভি ,আই, পি রুমে করা হয়েছে। সবাই মিলে এক কোনে বসে পড়লো। আদনান সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকছে , এতবড়ো চাকরীটা আবার না হারিয়ে যায়। কিছুক্ষন পর আদনান লক্ষ্য করলো যে অনেকগুলি সুন্দরী মহিলার মাঝে একমাত্র শাড়ী পরা মেয়েটি ঘুরে ফিরে তার দিকে তাকাচ্ছে। সে মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি লজ্জায় চট করে তার সুন্দর মুখখানি ঘুরিয়ে নিল। সে কিছুটা রোমান্স অনুভব করলো। কিন্তু তার বাবার আদেশ ,” ভালোমত ট্রেনিং -এ পাস্ করে এস। জীবনে এরকম সুযোগ সব সময় আসবেনা “। তবুও কেন জানি তারুণ্য বা অন্য কোনো কারণেই হউক , আদনান মেয়েটার প্রতি কৌতুহল হয়ে উঠলো। মেয়েটি খুবই সুন্দরী। গায়ের রং যেন দুধে আলতা মেশানো। বয়স ২৫ /২৬ হবে। এতগুলি সালোয়ার -কামিজ পরা মেয়েদের মাঝে সেই একমাত্র শাড়ী পরা মেয়ে।

দিনের পর দিন ট্রেনিংয়ের লেখাপড়ার চাপ বেড়েই চলছে, আর প্রতিদিন দিন লাঞ্চের সময় মেয়েটির সাথে ক্যান্টিনে দেখাও হচ্ছে। তবুও দুজনের মাঝে কথা বলার জন্য কেও এগুতে পারছিলোনা। মেয়েটির সম্মন্ধে আদনানের অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছে
করছে। কিন্তু সেই সাথে যখন ক্লাস শেষ করে হোটেলে ফেরে তখন তার বাবার দেয়া সেই আদেশবাণী মনে পরে যায় ,” মনযোগ দিয়ে ট্রেনিং শেষ কর , তা না হলে সাত নম্বরের মধ্যে তুমিই একজন হয়ে বাদ পরে যাবে “।
সপ্তাখানিক পর হোটেলের বেয়ারা আদনানকে একটা চিঠি দিয়ে গেল। চিঠিটিতে খামের ওপর তার নাম বাংলাতে লেখা। সে একটু অবাকই হল। এই উর্দুভাষী দেশে কে তাকে বাংলাতে চিঠি লিখতে পারে! খামটা খুলে সে চিঠিটি রুদ্রস্বাসে পড়তে শুরু করলো।” প্রিয় আদনান , তোমাকে আমি “তুমি” বলে সম্বোধন করছি বলে কিছু মনে করোনা। আমি তোমার নাম, তোমার “নেম ব্যাজ ” থেকে সংগ্রহ করেছি। কিছুদিন আগে আমার বাবা রাতে খাবার টেবিলে বসে বলছিলেন যে ,একদল যুবক বাংলাদেশ থেকে আমাদের কোম্পাণীতে ট্রেনিংয়ের জন্য এসেছে। তারপর তোমাদের দলকে সেদিন প্রথম অফিসের ক্যান্টিনে দেখলাম। সবার মাঝে তোমার সুদর্শন চেহারাখানি দেখে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু লজ্জায় সুযোগ করে নিতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে আমি লক্ষ্য করলাম তোমাদের দলের মাঝে তুমি ছাড়া আর সবারই চোখে মুখে হাসিতে ভরা। তাই তোমার জন্য করুনা হচ্ছিলো। এতো সুন্দর চেহারায় এতো বিষন্ন মুখ মানানসই দেখাচ্ছিলোনা। আমার বাবা বাঙালি , এই কোম্পানীর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। মা কাশ্মীরের ,উর্দু ভাষী। বাড়ীতে আমরা সবাই উর্দুতে কথা বলি। ঘরে উর্দু বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছি, যদিও বাবা একজন বাঙালি শিক্ষক রেখে আমাকে বাংলায় লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমি করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মেসীতে ডিগ্রী নিয়ে এই কোম্পানীতে রিসার্চ এসিট্যান্ট হিসাবে কাজ করছি। আমি একজন বাঙালি বন্ধু খুঁজছি। তুমি কি আমার সেই বাঙালি বন্ধুটি হবে ? আমার বাবা সবসময় বাংলাদেশের কথা ভাবে , তাই আদর করে আমাকে একটা বাঙালি নাম দিয়েছেন । আমার নাম ” ভাবনা ” তোমার কি আমার নামটা পছন্দ হয়েছে ?,,,,, ইতি ভাবনা।

চিঠিটি পড়ে আদনান ভীষণ অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করলো। টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের মেয়ে , অতিশয় ধনী লোক। তার সাথে মেলামেশা করা কি ঠিক হবে ? এই ভেবে সে সারা রাত ঘুমাতে পারলোনা। পরদিন অফিসের ক্যান্টিনে ভাবনার সাথে দেখা করে আদনান বললো ,” তোমার চিঠি পেয়েছি ,তোমার প্রশ্নের জবাব এখনো খুঁজে পায়নি ,সারা রাত জেগেছিলাম “। মৃদু হেসে ভাবনা বললো ,” তুমি কিছু না বললেও আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছি। আদনান জিজ্ঞাসা করলো ,” তাই নাকি ” ? “হু ” বলে একটা অস্পষ্ট শব্দ বেরিয়ে এলো ভাবনার মুখ থেকে।

সেদিনই আদনানের ক্লাস শেষ করে তারা দুজনে আরব সাগরের তীরে ঘুরে বেড়ালো। সূর্য ডুবা দেখলো। দেখলো লাল সিঁদুর মাখা সূর্র্যের আলো ধীরে ধীরে ডুবে গেলো সমুদ্রের নীল অতল জলে। সাথে সাথে আদনানের সেই ভয়টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো , ” আমার এই অভাগা জীবনে এত সুখ সইবে কি !!”

দিন এলো দিন গেলো। দেখতে দেখতে প্রায় তিনমাস অতিবাহিত হলো । এরই মধ্যে ওরা মনে প্রাণে একে অপরের বেশ কাছা কাছি এসে পড়েছে। এবার ট্রেনিং এর ফাইনাল টেষ্টের পালা। সবগুলি পরিক্ষাতে আদনান ভালো রেজাল্ট করেছে ,এখন ফাইনাল পরীক্ষাটা ভালো হলেই ভালো। ফাইনাল পরীক্ষা আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে ,তাই দুজনে ঠিক করলো , আপাতত কিছুদিনের জন্য তাদের দেখা-সাক্ষাত বন্ধ থাকবে। তথাস্তু। আদনান পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠলো । মনোবল ও বেড়ে গেল। পরীক্ষার আগের দিন অতিমাত্রা পড়াশুনার জন্য আদনানের মাথাটা ভার ভার লাগছিলো ,তাই পড়ন্ত বিকেলে সে সমুদ্রের পারে বেড়াবার জন্য বেড়িয়ে পড়লো। হাটতে হাটতে সে সমুদ্রের কাছে এসে পড়লো। কিছুক্ষন আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তারই চিহ্ন সমুদ্রের বেলা ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বেশ কিছুদূরে আদনানের নজরে পড়লো ,ভাবনা তার বান্ধবীদের সাথে সমুদ্র সৈকতে ডেক চেয়ারে বসে গল্প গুজবে মত্ত। ভাবনাকে চিনতে তার মোটেই কষ্ট হয়নি ,কারণ সেই একমাত্র শাড়ী পরা বাঙালি ললনা। আদনানকে দূর থেকে দেখে ভাবনা হাত নাড়লো ,আদনান তার হাত নেড়ে প্রতি উত্তর জানাল। সমুদ্রের সৈকতে কিছুক্ষন হাঁটার পর আদনান সামনে নোঙ্গর করা একটা ছোট জাহাজের উপর উঠল। জাহাজের উপর কিছু লোক ডেক চেয়ারে বসে সমুদ্র জলের কলতান উপভোগ করছে। সে ও পাশ থেকে একটি ডেক চেয়ার নিয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বসে পড়লো। ঠিক সেই সময়েই হঠাত করে পা পিছলিয়ে ডেক চেয়ার সহ সমুদ্রের নোনা জলের মধ্যে সে পড়ে গেল।

তার সমুদ্রে পড়ে যাবার শব্দে জাহাজের উপরে বসা লোকজন কি হলো দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে জলের দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই ভাবছিলো সে বুঝি ডুবে গেল। যখন ভুস করে তার মাথাটা জলের ভিতর থেকে উঠালো ,তখন সবাই দেখলো যে ,সে ডুবে নাই। সে সাঁতার কেটে তীরে আসলো ,আর দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলি বুঝতে পারলো যে সে একজন ভালো সাঁতারু,এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা হয়তো এটা জানেনা যে , একজন বাঙালি ছেলের ,কাছে সাঁতার জানাটা একদম ডাল-ভাত। অবশ্য শার্ট ,প্যান্ট পড়ে সাঁতার কাটা টা চাট্টি কথা ছিল না। ওদিকে ভাবনা কোলাহলের মধ্যে শুনতে পেল ” একঃ বাঙালি বাবু পানি মে গির গিয়া “। কাছে এসে দেখলো আদনান ভেজা কাপড়ে শির শির করে কাঁপছে। সে ভর্সোনার সুরে আদনানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো ,” চলো তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। আদনান একটু হেসে বললো ,” তা আর বলতে ! তুমি তো একেবারে দেবদূত হয়ে আমার এ দুঃসময়ে এসে পড়েছো। ” ভাবনা রেগে গিয়ে বললো ,” থাক আমার আর মন গলাতে হবে না। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে ,কাল তোমার ফাইনাল টেস্ট ” ।শেষ মেশ ভাবনা তার ছোট্ট ফিয়াট গাড়ীতে করে আদনানকে হোটেলে পৌঁছে দিল। হয়তো অনেকক্ষন ভিজা কাপড়ে থাকার ফলে মাঝ রাতে আদনানের তীব্র জ্বর শুরু হল। ভোর রাতে জ্বরের তীব্রতা কমে এল। কিন্তু নিজেকে অনেক দুর্বল মনে করলো। ভাবলো আজই ফাইনাল টেস্ট না হলোই কি হতো না? এই জীবনে নদীর পাড়ে , সমুদ্রের পাড়ে ,জাহাজের উপরে কতই না সে ঘুরেছে। এ দুর্ঘটনা এখন কেন হল ? একই বলে ভাগ্য। যথা সময়ে টেষ্টের জন্য হলে ঢুকল।
রাতের জ্বরের তীব্রতার জন্য তখন ও মাথাটা তার ভারী মনে হচ্ছিলো। প্রশ্নপত্র দেখলো ,সবাই কমন পড়েছে। কিন্তু উত্তর লিখতে গিয়ে সব কিছু গুলিয়ে ফেললো। বিকেলে টেষ্টের পর ভাবনাকে ব্যাপারখানা খুলে বললো। ভাবনা জানাল ,” আমি যদি বাবাকে বলি ,তাহলে কোম্পানী তোমাকে এলাও করে নিবে। তুমি তো জান বাবা এই কোম্পানীর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ,বাবার এই কোম্পানীতে অনেক ইনফ্লুয়েন্স আছে “। ” বিষয়টি আনফেয়ার হয়ে যায় ” শুষ্ক মুখে আদনান বললো। যথা সময়ে রেজাল্ট বের হল ,চার নম্বরের জন্য শেষ ব্যক্তিটির কাছে আদনান হেরে গেল। অর্থাত ছয় নম্বর ব্যক্তির কাছ থেকে আদনান চার নম্বর কম পেয়েছে। আদনানের মনের মাঝে আবার পিছনের দুশ্চিন্তা গুলি ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো। সেই বেকারত্ব জীবন। সেই মানসিক যন্ত্রনা। ঘটনা ক্রমে এক সুন্দরীর ভালোবাসা পেয়েছিলো,কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছিলো ,সে তার ভালোবাসার ম?্য্যদা দিতে পারলোনা। ভাবনা বললো ,” তুমি থেকে যাও এখানে ,আমরা দুজনে মিলে নুতন করে জীবন শুরু করবো “। আদনান বললো , “তা হয়না ভাবনা ,নিজের পায়ে মর্যদার সাথে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, তা আর হয়ে উঠলোনা”, নিজের অজান্তে চাকরীটা হাত থেকে ফস্কে গেলো “। ” আমার কথাটা কি একটুও ভাববেনা ” ? ভাবনার প্রশ্ন। ” তোমার কথাই ভাবতে ভাবতে আমার ভাবনা আরো বেড়ে যাচ্ছে। দেশে আমার অনেক রেসপনসিবিলিটি রয়েছে। পরিবারের সবাই আমার আশার উপরই বেঁচে আছে। ” আদনানের সোজা উত্তর।

সেদিন করাচী এয়ারপোর্ট ছাড়ার দিন ছিল । ভাবনার চোখের অশ্রু তার গাল বেয়ে অবিশ্রাম গতিতে গড়িয়ে চলছে। তাকে তখন খুবই অসহায় মনে হোচ্ছিল , আর আদনানের অবস্থা সে এ জগতে থেকে ও যেন নেই। জীবন তো আর থেমে থাকেনা কি আর করা। বাসায় এসে তার দুঃখের কথা কাকে বলে ? চাকরীটা হাত ছাড়া হওয়ার কথা তার অকৃত্রিম বন্ধু বাবা জানতে পেরে বললেন ,” হতাশ হয়ো না , আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এখানেই পৃথিবীটা শেষ নয়। জীবনটা অনেক সুন্দর। এই সুখ -দুঃখ নিয়ে তো জীবন। পরাজয়কে সব সময় চেলেঞ্জ মনে করবে ,তাহলেই দেখবে জীবনের প্রতি আর কোনো বিতৃষ্ণা আসবেনা “।
যথারীতি সেই আগের বেকারিত্ব জীবনে ফিরে গেল। হঠাত করে ” এংলো -আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী থেকে ” একটা চিঠি এলো। হঠাত ই বলা যায়, কারণ ওই কোম্পানী থেকে আদনান কোনো করেসপন্ডেন্স আশা করছিলোনা। তাই কিছুটা অবাক হয়ে এক ঝটিকায় চিঠিটা খুলে ফেললো। চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। ” প্রিয় মিস্টার জাহাঙ্গীর, তোমাদের সাতজনের মাঝে যে ছেলেটি দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলো তার স্নাকোত্তর ডিগ্রী খানা ভুয়া ছিল। যদিও সে টেস্টে ভালো রেজাল্ট করেছিল তবুও আমরা আমাদের কোম্পানীর সুনামের জন্য একজন অসত লোককে একটা দায়িত্বশীল কাজে নিয়োগ দিতে অপরাগ হয়েছি। এমতবস্থায় কোম্পানী তোমাকে নিয়োগ -পত্র দিতে স্বীকৃত হয়েছে। আগামী মাসের ৫ তারিখে আমাদের ঢাকা অফিসের কার্যালয়ে এসে তোমার কার্যভার গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানানো হলো। ইতি :– শফিকুর রহমান , পার্সোনাল ম্যানেজার ,করাচী হেড অফিস “। ঘটনাটা বাড়িতে বলার আগেই পাশের বাসার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ই-মেইল করে আদনান ভাবনাকে ব্যাপারখানা জানিয়ে দিল। ভাবনা তক্ষনাত ই-মেইল করে আদনানকে জানালো ” আমি তোমার ই -মেইল পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছি। পাঁচ বছর বয়সে আমি আমার বাবার সাথে ঢাকায় গিয়েছিলাম। ঢাকার কথা কিছু মনে আছে ,কিছু মনে নাই। আজ এই ২৫ বছর বয়সে আবার ভীষণ করে ঢাকার কথা মনে পড়লো। অর্থাত তোমাকে আমার আবার নুতন করে মনে পড়লো। এক সময়ে ভয় হয়েছিল হয়তোবা কোনোদিন আর তোমার সাথে দেখা হবেনা। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি ঢাকায় আসছি। সাথে আমার বাবাও আসছে। আমার সাথে বাবার আসার কারণ হল , এবার আমার বাবা তোমার বাবার সাথে দেখা করবে। কি ভাবছো ? ,
ইতি :— ভাবনা।
ই-মেইল পড়ে আদনান মনে মনে ভাবলো , সে আর কি ভাববে ? যত ভাবনা ছিল। শেষ