কবি মোহাম্মদ কামালের জীবনপথ পরমভাবে আলোকিত কবিতার আলোর সৌন্দর্যে। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে এক ধরনের কাব্যিক দ্রোহ, যে দ্রোহে তিনি বলে চলেন জীবনের নানা উপাখ্যান। বৈশ্বিক চক্রে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর কবিতার পংতি আবর্তিত হয় প্রকৃতি মগ্ন মানুষের কাছে। জীবনানন্দীয় স্রোতে অবগাহিত কবি মোহাম্মদ কামাল খোলা চোখে দেখে চলেন প্রকৃতি, মানুষের ভালোবাসা আর মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে।
কবি মোহাম্মদ কামালের কাব্যিক বলে চলাতে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব চিত্রপট যা মনোযোগী পাঠককে নিয়ে যায় আমাদের জীবনের বাহ্যিক ও আত্মিক ক্যানভাসের স্বরূপ উপলব্ধিতে। একটু লক্ষ্য করলেই অনুভব করা যায়, এই উপলব্ধিজাত বোধ খুব সহজেই আমাদের নিউরনে স্পর্শ করে আমাদেরকে জাগ্রত করে কবিতার সৌন্দর্যের আস্বাদ গ্রহণে।
কবি মোহাম্মদ কামাল কবিতার শ্বাশত মনোজগতে হাজার বছর হেঁটে চলা এক পথিক। তিনি কবিতাকে ভালোবেসেছেন তাঁর জীবনপথ চলার একেবারে শুরুতে। তাঁর এই ভালোবাসা প্রতিনিয়ত প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হয়েছে। সেজন্যই তাঁর কবিতায় বারে বারে খুবই সু²ভাবে ওঠে আসে পোড় খাওয়া ভূমির সব তামাটে ভূমিজ সন্তান, আর বিন্দুতে বসে বৃত্তকে বাজানো প্রকৃতি কাঁপা শিস শিখে নেয়া দোয়েলের সুর শোনার এক প্রবল আকুতি।
মনিস রফিক

কবি মোহাম্মদ কামাল, বাংলাদেশের মহানন্দা পুনর্ভবা দুই নদীর শঙ্খ পারের এক গাঁয়ে জন্ম তার মাতুলালয়ে ২২ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে। দাদা নানার বাড়ির বিভক্তি আম রেশমের নৌস্মৃতিপথ সুবর্ণস্রোতরেখা শতঘাটের এই নদী।
শৈশব কেটেছে কৈশোর ছুঁয়ে ইছামতি পারে। কৈশোর যৌবন বর্তমান পদ্মাপারে, ভেঁপু বাজা বন্দরহীন বরেন্দ্র নগরে মনোবিজ্ঞানে পড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘লাল মাটি সাঁওতাল কালো কৃষকের দেশ’ ইলা মিত্র বেদনার কবিতার ‘জোহা চেতনার মতিহার’ কাব্যভূমি তার, কবিবন্ধুর কালের মিছিল বেড়ে ওঠা। ‘এখানে অরণ্য ভয়’ প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১৯৮৮ এবং ‘এখানে অরণ্য ভয় ও অন্যান্য কবিতা’ ১৯৯৯ সালে।
প্রথম কবিতা সংগঠন রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদ। বাংলাদেশের প্রথম আবৃত্তি সংগঠন স্বনন-এর ৪০ বছর সদস্য তিনি। আবৃত্তিতে স্বনন সংবর্ধনা পান ১৯৯৫ এবং জেলা শিল্পকলা সম্মাননা লাভ করেন ২০১৬ সালে। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলী সদস্য ছিলেন সংগ্রামের অগ্নিদিনগুলিতে। কবিতায় ‘কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মারক সম্মাননা’ লাভ করেন হৃদয়পুর পশ্চিম বাংলা থেকে ২০২০ সালে। বাস মহাপদ্মাকষ্টের মানস নগর রাজশাহীতে। বড় ভালোলাগা আলোকচিত্র তোলা।
হাঁটতে হাঁটতে হাজার বছরের কবিকে অবিরাম মৌনমধুর উচ্চারণে মহাসান্নিধ্য লাভ।
বড় গৌরব পিতা ভাষাসৈনিক।

অভয় পৃথিবী দেবে কে দেবে দেবে না

ফুসফুস হাওয়ায় ফুঁয়ে ফুঁয়ে ওড়াবে বেলুন
ওড়াবে ঘুড়ির শতবর্ণ চিত্রকাঁপা জাপানী আকাশ
পৃথিবীর কোটি শিশু ওড়াবে বেলুন
ওড়াবে প্রতীকে ফুসফুস!
কে দেবে, নির্মলতা দেবে,
অভয় পৃথিবী দেবে, কে দেবে, দেবে না।
পারমাণবিক ধূম্রকুণ্ডলীর মত
দুঃস্বপ্ন মণ্ডিত মগজের অগ্নি ঝলসিত পিণ্ড অন্ধকার
মাথার ভেতরে;
হৃদয় ধ্বংস হিরোশিমা!
হৃদয় ধ্বংস নাগাসাকি!
অভয় পৃথিবী দেবে, কে দেবে, দেবে না।
বিনষ্ট বৃরে মাকড়সা ছায়াতলে মুমূর্ষু অঙ্কুর
মৃত্তিকার পোড়া স্তনে পোকা পোকা জন্মপঙ্গু ঘাস
পুষ্পের প্রজন্মে প্রেমিকের কোন পচ্ছায়া নেই
তেজস্ক্রিয়তার রাত্রি চুয়ে দূরান্তের কমলার কোষে নামে হিম
কে দেবে, আরোগ্য দেবে
অভয় পৃথিবী দেবে, কে দেবে, দেবে না।
বিকৃতি বৃদ্ধের বিনষ্টির শিহরণে দেবতারা
আঙুলে জৈবিক ভেবে, লাল বোতামের কাণ্ড দেবে
গোলার্ধের গোলার্ধের বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে
বিস্ফোরিত হৃত্পিণ্ডের তুষারপাতে অনন্তের শূন্য সৌররাত্রি দেবে;
অনন্তের শূন্য সৌররাত্রি দেবে!
অভয় পৃথিবী দেবে, কে দেবে, দেবে না।

প্রাগৈতিহাসিক

সূর্যই ফেরাতো
দশ দিগন্তের আলোকের
রক্তপায়ী সেই অন্ধকার।
তবু পৃথিবীর
দিন, রৌদ্ররূপচাঁদা শূন্য জলচর,
অস্থির। স্থবির
রাত্রি, বকঃপরমধার্মিক।
প্রকৃতির মুখ চেয়ে অস্তিত্ব সংকট।
ঐ প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যায়
সূর্যভূক ভলুকের
আঁধারের শেষ আভাটুকু লেহনের
প্রায় অন্ধকারে, বল্কলে পাতায় দীর্ঘ এক ছায়া,
ছায়ার পুরুষ, পেশীতে সুলতানের ‘ফাস্ট প্যাণ্টেশন’
বলমের জন্য ভাঙছিল কেলাসিত অরণি পাথর।
অকস্মাত
ফুলকির স্পিন্টার ফুটলো
রেটিনায়। আলোকের ফোঁটা ঝরে গেল
মূর্ত অন্ধকার। চমকিত
ছায়া মানবের হাতে ফুটলো আবার
দুই অরণির শব্দ-বজ্রে সোনার ঝলক।
ছায়ার উল্লাসে,
ছায়াদের ভিড় দেখা গেল গুহার কিনারে
প্রস্তর-বিদ্যুতে দেখা গেল মুখ প্রথম ছায়ার
আঁধার চেরাই দেখা গেল
মিলিত উল্লাস শোনা গেল…
পড়লো ফুলকি মশালে মুঠিতে ধরা
তিমির হননে কম্পমান লুপ্ত দেবতার বিলুপ্ত বলম!

এখানে অরণ্য ভয়
জোহা স্মরণে

এখানে অরণ্য ভয়, মানুষের থাবা
পাখি!
ক্যাম্পাসে থেকো না কেউ, থেকো না থেকো না।
জানি পাখি জানি মত মুগ্ধ হয়ে যায়
বৃক্ষে বৃক্ষে বহুদূর ছায়ার মাদুর রোদের ত্রিপল
চোখে রেখে এই বিরচিত সবুজের সংসার
কেউ গান তবু অনুনয় গেয়ো না এখানে
থেকো না এখানে
এক টেলিফোন কলে এঁকে দিতে পারে এসে নির্দ্বিধায়
হৃত্পিণ্ড ভাঙ্গা গলগলে স্রোতে লাল ঘাস
এখানে বন্দুক
এখানে কোনই উচ্চারণ এনো না শান্তির।
এখানে অরণ্য ভয়, মানুষের থাবা
পাখি!
ক্যাম্পাসে থেকো না কেউ, থেকো না থেকো না।
স্বীকৃত হৃদয় হয়ে শুয়ে সুনিবিড় শান্তিকর্মী
জোহা ঘুমাচ্ছেন তো কীঃ
এক টেলিফোন কলে আজো এঁকে দিতে পারে এসে
নির্দ্বিধায়
হৃত্পিণ্ড ভাঙা গলগলে স্রোতে লাল ঘাস
এখানে বন্দুক!

যদি সে বালি হাঁস
জীবনানন্দ তোমার মানব জন্মের শতবর্ষে প্রণাম

নিরঞ্জনা আমার শণিত সহা।
আমার শণিত বোধ
তার পক্ষে আন্দোলনে নামে
ধমনীতে জটিল হৃত্পিণ্ডের পথে।
তার পক্ষে অসহযোগে
স্নায়ুপুঞ্জকে টানে।
তারই পদশব্দ
গন্ধ স্পর্শ উচাটন।
তাকে ঘিরে আমার শণিত জ্ঞান
আমাকে মানে না।
ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে
আমার রহস্যময়
যাতনা ও সুখ
দুটি সহমর্মী বিপরীত
তড়িত স্রোত;
আলো ও
জোনাকী পতন মৌন অন্ধকারের মত।
সে জগতে
শিশির খেকো দানো ওঠে তপ্ত জিব।
চাঁদও হেসে উঠে
গোলমুখো পেণ্ডুলাম আকাশে গড়ায়।

কখনো কৃষ্ণ পরে অসহনীয়
এ্যাসিড লিপ্ত ক্ষয়,
দৃশ্যত লুপ্তি-
আরেকটি শুকপরে ইশারায়
অদৃষ্টবাদী অমাবস্যা কাটে;
পরেই না পূর্ণিমাকে তীব্রচূড়ায় শরত্রাত্রির
জ্যোস্নার পার্বত্য প্রপাতে পাওয়া
গহন স্বপ্নে!
স্বপ্ন-বিশ্বের মাধ্যাকর্ষণ
কেন্দ্রের মত টানে
আমাকে সে টানে
সমস্ত পতন রক্তরণের
অনিবার্য সমাধি।
তবু তার
কালো হীরক
নাত্রিক নেত্রপাত-
‘অগ্নিহত পাখি
ধূসর ছাই থেকে
যেন জেগে উঠি বারবার।’
তার আরণ্যক বাঙালি মুখ
আমাকে জন্ম জন্ম কাঁদাবে
আধিভৌতিক শূন্যতায়।
তার বৃষ্টিধনিত দোয়েল স্বর
আমাকে মৃত্যু থেকে তুলে
হিম অন্ধকারে হাঁটাবে ক‚লহীন
জন্মান্তরের আশায়।
জন্মান্তরে জন্মান্ধ হলে ব্রেইল পাঠে
তার সমস্ত শরীরী অশরীরী
আলো, লোমহর্ষ ছোঁব।
তার দেহজ যে ঘ্রাণ
আমার অ্যালসেইশ্ন্ চৈতন্যে
পৃথিবীর বাতাস শুঁকে
খুঁজে নেবো জাতিস্মর

যদি সে বালি হাঁস
শান্তিনিকেতনের অভয় ঝিলের
একল বালিহাঁসের
একটিই আদলে লুকায়-
তবু।

চূর্ণ চাঁদ

তেজস্ক্রিয়
খুলির মত
আকাশ-নেগেটিভে
ক্ষয়ী, ঝুলন্ত
চাঁদ
নীচে
কালো সমুদ্র
সিজোফ্রেনিয়ার
কালো জলের
অতল ফুঁড়ে
ভেসে ওঠে
চূর্ণ চাঁদ
কাঁপে
এত চূর্ণ কে মেলাবে
ভূতপূর্ব পূর্ণিমার মুখে!
সিজোফ্রেনিয়ার
কালো জলে
চূর্ণ চাঁদ
কাঁপে!

শেষ ভোর

মুখে লুটিয়ে পড়েছে ভোর
চোখে দ্যুতি
নিজের মৃত্যুকে দেখার পর অপলক!
করস্পর্শে
পাতাদু’টো নামিয়ে দাও
ঘুমের মত ঘুমাক।
রক্ত চলত্হীন
হিম অন্ধকার
ভেতরে নেমেছে
চোখে
কবি বরাভয় লেগে আছে,
শান্ত শেষ। চোখ তো কবিতা
নিরন্তর নানা আলোকের
অনন্তেরও অন্তিম দৃশ্য এসেছে
তাতে বরাভয়!

বরেন্দ্র ১

লাল মাটি সাঁওতাল কালো কৃষকের দেশ
মালভূমি উঁচু, নদী চিহ্নহীন
ঘাসের প্রজন্ম পুড়ে পুড়ে যায় নির্নিশেষ রৌদ্রের চিতায়
বায়ু ঘূর্ণি ভস্ম নেচে উঠে শূন্যতায় ফণা
মনে হয় ভাটা
নৈঃসঙ্গের প্রাগৈতিহাসিক রক্ত দহনের স্তরিভূত লাভা
অন্য এক মহাপ্লাবনের লাল ক্ষত, শুষ্ক, স্থির।
তবু মাটি অন্য এক পোড়া মাটি
সমুদ্রের অতিকায় ঢেউ তোলা মাঠ
এক জাঁত জল পেয়ে
যদি পায় রোদে কালো শ্রমের দরদ
এই পোড়া মাটি দেবে
আর এক মহাপ্লাবনের রঙ
শস্য দুলে ওঠা সবুজ সাগর।
লাল মাটি সাঁওতাল কালো কৃষকের দেশ।

বরেন্দ্র ২

লাঙ্গল বৃদ্ধের অমতা এঁকে রুক্ষতায় কাঁপে
কোদালের দাঁত ভাঙ্গা গান বেজে ওঠে শূন্যতায়-
ইট মুখো মাটি।
ফলে তবু কী করে যে অই
মাঠ ঢেকে শুয়ে থাকা হওয়ায় মৃদুকম্প এক
আদিগন্ত প্রজাপতি ডানার বিস্ময়
আদিগন্ত ফসল স্পন্দন
ঈশ্বর জানেন!
মানুষ জেনেছি
জন্ম ভাগ্য সাঁওতাল, তার
হাড় খাটুনির রৌদ্র নিষ্পেষিত কালো পাথরের গা চুইয়ে পড়া
তরল হীরক আগে চায়
থাক পড়ে কালো ত্বক সাদা লবণের তীব্র জমি
আগে, সব আগে চায় শেষাবধি চায়
সাঁওতাল, তার কেলাসিত কয়লায় হীরকের মত ঘাম।
এরাই জঙ্গল কেটে জঙ্গল চড়াই উত্রাই কেটে কেটে
গেরুয়া মাটির পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি সিঁড়ি জমি কেটে কেটে
বেঁধে ছিল আদি কৃষি ঘর, আদি কৃষি দেশ।
অথচ বিস্ময়
অই ফসলের ক্যানভাস কাটে খায়
টেনে নেয় আজ গুটিকয় গোলা ঘর
চির ভোগী ইঁদুরের দাঁত।
সুনীল আকাশ
নীচে দিবি ছেড়ে রেখে বেঁধেছে কঠিন
কৃষি পৃথিবীর ভূমিহীন শূন্যতার দৃশ্যহীন
বিশাল শৃঙ্খল, বাঁধা পড়ে আছে আজ
আদি এক জাতি।

বরেন্দ্র ৩

ধূর্তচু
সুড়ঙ্গচর জন্মতস্কর
মন্বন্তরের রাজা।
বুনি ধান
রক্ত সেচা লাল মৃত্তিকার ধান
অই ধান কেটে
ভরবি সুড়ঙ্গ
ভরবি গোপন গোলা তা হবে না
আমরাও সাঁওতাল
পুড়াই মূষিক
বানাই কাবাব
ঘোর শত্রু প্রিয় খাদ্য
রক্তের গলিত আগুনের জিহ্বায় কাবাব
আমরাও সাঁওতাল
ধূর্তচু
সুড়ঙ্গচর জন্মতস্কর
মন্বন্তরের রাজা;
রৌদ্র বিচ্ছুরিত কোদালে কোদালে
প্রান্তর স্পন্দিত হবে
কোন পথে কত পাতালে পালাবি
আমরাও সাঁওতাল।