ইউসুফ কামাল : ছয়.
ছেলে বেলায় শুনেছি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে। হাজারো জ্ঞানী গুণী মানুষেরা এখান থেকে লেখা পড়া করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছেন। চিন্তা করতেই মনের মধ্যে একটা গর্ব বোধ করতাম।
কলা ভবনের নীচ তলায় সামনের দিকে ডান দিকেই শিক্ষক দের কমন রুম আর তার পাশেই ছিলো ছাত্রীদের কমন রুম। ভবনের পিছনের অংশে নীচ তলায় সোশীওলজী ডিপার্টমেন্ট আর ঐ ডিপার্টম্ন্টের সামনেই কেনো জানি সব সময় ই একটা ভীড় লেগেই থাকতো।
ছোটো খাটো মারামারিও মাঝে মাঝেই দেখতাম। সোশীওলজীর সোজা সুজি উপরে চারতলা তেই আমাদের ডিপার্টমেন্ট তাই বেশী চেচামেচি হলে নীচে তাকালেই সবাইকেই দেখা যেত ।
সেদিন বোধ হয় এমনি একটা গোলমাল হয়েছে , বেশ হৈচৈ হচ্ছে সমস্ত কলা ভবন জুড়েই।
ছাত্রলীগের ভিতরে প্রকাশ্যেই বরিশাল গ্রুপ আর ময়মনসিংহ গ্রুপের মধ্যে একটা ফ্যাসাদ লেগেই থাকতো। এমনি একটা ঝামেলা বোধহয় হয়েছিলো ৬৯’ আন্দোলনের পয়লা কাতারের নেতা ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার আব্দুল কুদ্দুস মাখনের ছোট ভাইয়ের সাথে অন্য অন্য কারো । কতক্ষন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চল্লো।
সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম আই ই আর এ সময় কাটিয়ে আসি। ধীরে ধীরে নীচে নেমে কলা ভবনে ঢোকার সিড়ি দিয়ে নামতেই কে যেন বল্লো ভিসি স্যার আসছেন। বাম সিঁড়ির মাথাতেই একেবারে সামনা সামনি পড়ে গেলাম ভিসি স্যারের। রেজিষ্টার ভবন থেকে হেটে মাঝের মাঠ পেরিয়ে সোজা কলা ভবনে ঢুকবেন। পিছনে ৪/৫ জন কর্মকর্তা। প্রথম সেই দেখলাম আব্দুল মতিন চৌধুরী কে। প্রখর ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন একটা মানুষ যাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। দৃঢ? পায়ে চলে গেলেন শিক্ষকদের কমন রুমের দিকে।
জনাব মতিন চৌধুরী তৎকালীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ছিলেন তা সত্বেও কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই দলীয় বক্তব্য রাখেন নি। বিশ্বাসী হলেই যে সর্বত্র দলীয় লেজুড়পনা করতে হবে এটা তিনি কখনোই বিশ্বাস করতেন না। এখানেই ব্যাক্তিত্বের পরিচয়। এখনকার ক্যাডার ভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ভিসিদের কর্মকান্ড দেখলে সত্যি ওদের দিকে তাকাতেই ইচ্ছা করে না। নিজেরই লজ্জা লাগে।
বন্ধু সেকেন্দার চৌধুরী এস এম হলে থাকতো। থাকতো বল্লে ভূল হবে , একটা সিট ছিলো। মাসের প্রথম সাত দিন রুমে পাওয়া যেতো তারপর তাকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা সে নিজেও বলতে পারতো না। সাতদিন না মূলত: ৪ দিন হলে পাওয়া যাওয়ার কারন ঐ কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ী থেকে মানে রংপুরের ভুরুঙ্গামারি থেকে ওর বাবা ওঁকে টাকা পাঠাতেন। মাসের প্রথম কিস্তির টাকা ।
মানি অর্ডারটা আসা পর্য্যন্ত সুবোধ বালকের মতে হলে থাকতো তারপর তার আর কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় পাওয়া যেতো না। ক্লাশে হয়তো বা পাওয়া যেতো তারপর হাওয়া। আমরা ওর চালচলনে বুঝে ফেলতাম পকেটের টাকা এখনো ফুরায় নাই।
মাসের ৪/৫ রাতে আমার বাসায় এসে হাজির হতো হাতে ২/৩ প্যাকেট ব্রিষ্টল সিগারেট , আর পানের খিলি কাগজে মোড়া , রাজকীয় চাল , মুখে হাসি । এটা তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
ষ্টেডিয়ামের প্রভিন্সিয়ালের বিরিয়ানী খেয়ে রিক্সা নিয়ে হলে না যেয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসতো – নিজের থেকেই কৈফিয়তের সুরে বলতো , গল্প করতে এলাম।
বয়সে একটু ছোট হলেও আমার সকল বন্ধুর সাথেই জিল্লু সহজ ভাবেই মিশে যেতো। ভালো ছেলে , ঢাকা কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসোফিতে অনার্স পড়তো। আমার নিকটাত্মীয় এবং এক রুমেই আমাদের দুইটা পাশাপাশি বিছানা।
সেকেন্দার কে এত রাতে দেখেই ও বুঝে ফেলেছে এখানেই আজ তার রাত্রিবাস। জিল্লু তাড়াতাড়ি ফ্লোরে একটা এক্সট্রা বিছানা করে ফেলতো তারপর শুরু হতো ম্যারাথন গল্প যার কেনো শেষ নেই ।
শেষ সিগারেট টা শেষ করে রাতের শেষ প্রহরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার কিছুক্ষন পরেই পুরোন ঢাকার চারিপাশ থেকে শুরু হতো ফজরের আযান। পুরান ঢাকার ফজরের আজান শোনার ভাগ্য যার হয়েছে সে জানে কত রকমের কন্ঠস্বরের আজান হতে পারে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা