মুরশাদ সুবহানী : ” কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাতৃভূমিতে ফিরে আসা এবং বৈবাহিক জীবন নিয়ে আলোচনার শেষার্ধে উল্লেখ করবো।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার আধুনিক রূপায়নে ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। ‘মেঘনাবধ’ ব্যাতিরেকেও ‘বীরাঙ্গনানা কাব্য’সহ বহু কবিতায় আধুনিক রূপায়ন ঘটেছে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাবধ’ কাব্যে রাবণ চরিত্রের বিনির্মাণ করে তাঁর বিদ্রোহী শক্তির সাহসী প্রকাশে স্বকীয়তা পেয়েছে। তিনি ‘বাল্মীকিকে বন্দনা করে তাঁর রচনা শুরু করেন। রচানাকালে বারংবার স্মরণ করেছেন, হোমার, মিল্টন, দান্তে, ভাজিলের মতো পাশ্চাত্যের কবিকুল শিরোমনিদের কথা।’

‘মেঘনাবধ’ কাব্য রচনাকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তখন একজন যশস্বী লেখক।
মোহিতলাল মজুমদার ‘মেঘনাবধ’ কাব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি এই গ্রন্থে মেঘনাদবধ কাব্যের বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি, তার কারণ উহাই মধুসূদনের একমাত্র কাব্যকীর্তি-যাহা শুধুই তাঁহার কবি প্রতিভার নয়, তাঁহার কবি-জীবনের, বা তাঁহার অন্তরস্থ সেই কবি-পুরুষের পূর্ণ পরিচয় বহন করিতেছে।” আবার তিনি অন্যত্র বলেছেন, “মধুসূদনের মেঘনাদবধই তাঁহার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কীর্তি তাহার পূর্বে ও পরে তিনি যাহা কিছু রচনা কয়িাছিলেন, তাহাতে তাঁহার কবি-মানসের কাব্যকলা-কুতূহল প্রকাশ পাইয়াছে।”এই দুই কাব্যের (অর্থাৎ ব্রজাঙ্গনা ও বীরাঙ্গনার) ভাব-কল্পনা খুব গভীর নহে- কাব্যকলার সংষ্কার ও সমৃদ্ধিসাধনই ইহাদের একমাত্র সার্থকতা।”

একজন যশস্বী কবি ও কাব্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যসমূহ নিয়ে সমালোচনা এবং মতামত। তবে অধিকাংশ বিদগ্ধজন কবি মধুসূদন দত্তের বাংলা-ইংরেজি কবিতার অনেক প্রশংসা করেছেন। তাঁর কবি আত্মার বিদ্রোহী রূপের কথা বলেছেন। তবে অধিকাংশই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
এই মহাকাব্যে কবি প্রচলিত মিথ ভেঙ্গেছেন অনেক স্থানে। তাঁর সবটা আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। বোদ্ধা পাঠক এটি জানেন অথবা জেনে নেবেন।
মেঘনাদবধ ১৮৬১ খ্রী: প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত ।চরিত্র-চিত্র হিসেবে রয়েছেন : রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমুখ। তিনি তাঁর কাব্যকে অষ্টাধিক স্বর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশও করেছেন। এই কাব্য প্রকাশিত হওয়ার পরে বহু বছর পার হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। দুই বাংলার কাব্য-প্রেমী, সুধি পাঠক, সমালোচকেরা ‘মেঘনাদবধ’-কে অবেহলা করতে পারেননি। যতদূর জানা যায়, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজনারায়ণ বসু ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রথম সমালোচক। সমসাময়িক সময়ে সমালোচকরা দুই বাংলার ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে গিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এই মহাকাব্যের প্রশংসা এবং নিন্দা দেশের পাঠক সমাজে এক কৌতুহল এবং কাব্যটি পাঠে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি করে। এখানেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনেক বড় প্রাপ্তি। সেই সময়ে দুইভাগে বিভক্ত সমালোচকদের মধ্যে অধিকাংশই এই কাব্যের প্রশংসা করেছেন। অধিকাংশের মতামতই গ্রহণযোগ্য। শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় এই কাব্যেকে অভিনন্দিত করে লিখেছেন, “বাঙ্গালা সাহিত্যে এক প্রকার কাব্য উদিত হইবে, বোধহয়, সরস্বতীও স্বপ্নে জানিতেন না।” ৃলোকে অপার ক্লেশ করিয়া জলধি-জল হইতে রত্ন উদ্ধারপূর্বক বহু মানে অলঙ্কারে সন্নিবেশিত করে। আমরা বিনা ক্লেশে বিনা ক্লেশে গৃহমধ্যে প্রার্থনাধিক রত্ন লাভে কৃতার্থ হইয়াছি। এক্ষণে আমরা মনে করিলে তাহারে শিরোভূষণে ভূষিত করিতে পারি এবং অনাদর প্রকাশ করিতেও সমর্থ হই।”

এ কথা হয়তো সবাই জানেন, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনাকালে অনেক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শ্রী রাজনারায়ণ বসুকে, যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন, তার বিচার-বিশ্লেষণ করলে কবি মনের মানসিক অবস্থার পরিচয় বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। তিনি রাজনারায়ণকে ১৮৬০ খ্রী: ১৪ জুলাই লিখলেন, “It is not that I am more industrious than my neighbors, I am at times as lazy a dog as ever walked on two legs, but I have fits of enthusiasm that come on me occasionally, and then I go like the mountain-torrent!….. I never drink when engaged in writing poetry, for if I do, I can never manage to put two ideas together.’’

‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের দ্বিতীয় স্বর্গের দুইশত পংক্তি লেখা শেষ করেছেন, এই সংবাদও তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন।
ষষ্ঠ স্বর্গের সমাপ্তির সংবাদ দিয়ে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রাজনারায়ণ বসুকে, লিখেছিলেন, ‘A few hours after we parted, I got a severe attack of fever and was laid up for six or seven days. It was a struggle whether Meghnad will finish me or I finish him. Thank Heaven, I have triumphed.

এই পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে সুধি পাঠক খুব সহজেই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনার সময় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র মনো জগতের এক গভীর অনুরণন অনুধাবন করতে পারছেন। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনাকালে তিনি প্রবলভাবে আবেগ তাড়িত হয়েছেন। মেঘনাদের মৃত্যুর বর্ণনা কবি’র মন –মননে, কবি সত্তাকে কিভাবে নাড়িয়েছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়।
‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রথম স্বর্গ শুরু করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই ভাবে-
সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে- অজেয় জগতে-
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)
যবে খরতর শরে, গহন কাননে,
ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,
তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।
….
(তৃতীয় সর্গ -সমাগম)
প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে-কাতরা যুবতী।
অশ্রæআঁখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায় রে যেমনি
ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী।
[…………………………..]
ষষ্ঠ সর্গ
{কুশাসনে ইন্দ্রজিৎ পূজে ইষ্টদেবে নিভৃতে; কৌশিক বস্ত্র,কৌশিক উত্তরি, চন্দনের ফোঁটা ভালে, ফুলমালা গলে। পুড়ে ধূপ দানে ধূপ; জ্বলিছে চৌদিকে পুত ঘৃতরসে দীপ; পুস্প রাশি রাশি, গন্ডারের শৃঙ্গে গড়া কোষা কোষী, ভরা হে জাহ্নবি, তব জলে, কলুষনাশিনী তুমি; পাশে হেম-ঘন্টা, উপহার নানা হেমপাত্রে; রুদ্ধ দ্বার;— বসেছে একাকী যমদূত, ভীমবাহু লক্ষণ পশিলা মায়াবলে দেবালয়ে। ঝনঝনিল
…..
অষ্টম সর্গ
ভূপতিত যথায় সুরথী
সৌমিত্রি, বৈদেহীনাথ ভূপতিত তথা
নীরবে; নয়নজল, অবিরল বহি
ভ্রাতৃলোহসহ মিশি, তিতিছে মহীরে.
গিরিদেহে বহি যথা, মিশ্রিত গৈরিকে,
পড়ে তলে প্রস্রবণ; শূন্যমনাঃ খেদে
রঘুসৈন্য,– বিভীষণ বিভীষণ রণে,
কুমুদ, অঙ্গদ, হনু, নল, নীল, বলী,
শরভ, সুমালী, বীরকেশরী সুবাহু,
সুগ্রীব, বিষন্ন সবে প্রভুর বিষাদে;
নবম সর্গের নাম ‘সংক্রিয়া’।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ মহা কাব্যের সমস্ত কবিতা নিয়ে আলোচনা সল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আমাদের আলোচনায় মেঘনাদবধ কাব্যকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর কবিতার নব রূপায়নের প্রতি আলোকপাত করাই মূখ্য উদ্দেশ্য।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শ্রী রাজনারায়ণ বসুকে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নিয়ে পত্র অনেক লিখেছেন। এর কারণ সুষ্পস্টভাবে জানা যায়নি। তবে রাজনারায়ণ বসু এই কাব্যটির দোষ-গুণ ‘খুঁটিয়ে’ বিচার করেছেন। সমালোচনার শুরুতে তিনি সাদামাটাভাবে প্রশাংসা করেছেন-
‘‘ বর্ণনার ছটা, ভাবের মাধুরী, করুণ রসের গাঢ়তা, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার নির্বাচন-শক্তি ও প্রয়োগ-নৈপুণ্য অনুধাবন করিলে, তাঁহার ‘মেঘনাদবধ’ বাঙ্গালা ভাষার অদ্বিতীয় কাব্য বলিয়া পরিগণিত হইবে।’

‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের দোষ-গুণ বের করতে গিয়ে শ্রী রাজনারায়ণ বসু যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, তা বর্তমান সময়ে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। ‘ তাঁর বিস্তৃত আলোচনায় মেঘনাদবধ কাব্যটির ক্ষেত্রে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য কল্পনা শক্তি, অভিনবত্ব এবং কবির জীবনবোধের আধুনিকতা বিষয়ে একটি মন্তব্যও করেননি। তিনি এই কাব্যের প্রধান যে কয়টি দোষের উল্লেখ করেছেন, তা উল্লেখ করলেই দেখা যাবে কাব্যটির গভীরে না গিয়ে তিনি একান্তভাবে বাইরের দিক থেকে কাব্যটির বিচার করেছেন, অবহেলা করেছেন বাঙ্গলা কাব্যের নক রূপায়নের শুরু, মৌলিকত্ব, কবি কল্পনার অসাধারণ শক্তিকে অবহেলা করেছেন। বিজ্ঞজনেরা তাঁর এই সমালোচনা মনে করেননি। এটি আসলে নিন্দালোচনায় পরিনত হয়েছে । শ্রী রাজনারায়ণ দত্ত মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যে সনাতন হিন্দু শাস্ত্রের মিথকে ভেঙ্গে দেওয়ায় তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে এই নিন্দা করেছেন। কবি-কল্পনার একটি কাব্য রচনা হিসেবে মূল্যায়ন করেননি।
শ্রী রাজনারায়ণ বসু এই কাব্যটি নিয়ে ‘বাঙ্গালাভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতায় এই কাব্যটিকে দু দিক থেকে আক্রমণ করেছিলেন-
এক। “জাতীয় ভাব বোধহয় মাইকেল মধুসূদনেতে যেরূপ অল্প পরিলক্ষিত হয়, অন্য কোন বাঙালী কবিতে সেরূপ হয় না। তিনি তাঁহার কবিতাকে হিন্দু-পরিচ্ছদ দিয়াছেন বটে, কিন্তু সেই হিন্দু পরিচ্ছদের নি¤œ হইতে কোট পান্টুলন দেখা দেয়। আর্যকুলসূর্য রামচন্দ্রের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ না করিয়া রাক্ষসদিগের প্রতি অনুরাগ ও পক্ষপাত প্রকাশ করা, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে হিন্দু জাতির শ্রদ্ধাস্পদ বীর লক্ষণকে নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় আচরণ করানো,খর ও দূষণের মৃত্যু ভবতারণ রামচন্দ্রের হাতে হইলেও তাহাদিগকে প্রেতপুরে স্থাপন, বিজাতীয় ভাবের অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে এই তিনটি এখানে উল্লেখিত হেইতেছে।’
দুই। “মাইকেল মধুসূদনের রচনাতে প্রাঞ্জলতার অত্যন্ত অভাব। কবির রচনাতে প্রাঞ্জলতা না থাকিলে তাহা মধুর হয় না। সকল শ্রেষ্ঠতম কবির রচনা অতিশয় প্রাঞ্জল।’
এই অভিযোগ গুরুতর। হিন্দু সনাতন মতে বিশ্বাসীদের মনে আঘাত করেছেন, কবি মাইকেল মধুষূদন দত্ত। কোন মনোভাব নিয়ে কেন তিনি রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন না করে রাবণ-ইন্দ্রজিৎ প্রমুখ রাক্ষসদের বর্ণনায় উল্লসিত হয়েছেন তা ভেবে দেখবার মত।
“কবি আপন জীবন-জিজ্ঞাসা ও কল্পনার বিশিষ্টতার সহযোগে তার যে রূপদান করেন তাই সাহিত্য।’’

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি মিথকে ভেঙ্গেছেন, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে এ কথা ঠিক। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য ব্যাতিরেকেও তাঁর আরো রচনা আছে। সব মিলিয়ে বিশেষ করে বাংলা কবিতায় এক নব রূপায়ণ করে গেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্য নব যুগের সূচনা হয়েছে।
তাঁর ১৪৮তম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সাহিত্যের সেবক অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, পাবনা, বাংলাদেশ । ফ্লোরিডা, ইউএস প্রবাসী )