আতোয়ার রহমান : নেতা তার সরকারি বাসভবনের বড় ড্রয়িংরুমের দামি সোফার এক পাশে বসে সেগুন কাঠের টেবিলের উপর পা ছড়িয়ে বসে তার লেটেস্ট আইফোন এস মোবাইল থেকে কয়েকজনের সাথে কথা বলছে আর টেলিভিশনে নির্বাচনের ফলাফলের সংবাদ দেখছে। অন্য পাশে এক কোণে বসে রোজকার খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে চলেছেন তার স্ত্রী। তাজমহলের সামনে একটা সাদা পাথরের বেঞ্চে বসে স্ত্রীর সঙ্গে তার তোলা ছবিটা জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবির পাশে পেরেক দিয়ে লাগানো আছে।

চারিদিক থেকে পরাজয়ের সংবাদ আসছে। নেতা-কর্মীরা কেঁউ হাউমাউ করে, কেঁউ আবার ফুপিয়ে কাঁদছে। এইভাবে কেঁদে ভাসিয়ে দিতে থাকা এই সমস্ত লোকের এটা প্রথম নির্বাচনী হতাশা। কারণ এর আগে তারা এভাবে কখনো হারেনি। ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরা নিয়ে ছোটাছুটি পরিবেশটাকে আরও বিষাদময় করে তুলেছে। টিভিতে যা দেখাচ্ছে তাতে দলের বাঘা বাঘা নেতারাও গো-হারা হারছে, যেমন কাল বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় শতবর্ষই শিরিষ গাছের ডাল।

একজন টেলিভিশন সাংবাদিক এক যুবকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। নেতা কল্পনা করে তার ছেলেও এর মতো একদিন হতে পারতো। ছেলেটি দু:খের হাসি হাসছেন এবং ক্যামেরা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন যেন তিনি কোনও স্মৃতি অনুসরণ করছেন। “নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হয় আপনি যে মেয়েটিকে এতদিন ধরে ভালোবাসেন সে যেন আজ সাকিব খানের হাত ধরে হাঁটাচলা করছে।” ছেলেটি এই বলে সাংবাদিকের নিকট তার অনুভূতি প্রকাশ করল।
“নেতাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এটা অবিশ্বাস্য, আমি টাকার বাজি ধরব যে লোকগুলি বিরোধীদলের বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল করে গলাফেটে চিৎকার করেছে, তারা আমাদের ভোট দেয় নাই।” তিনি টেলিভিশনের দিকে ফিরে ফিরে চিৎকার করলেন। তিনি টেবিলে বসে টীভি দেখছেন এবং স্ত্রীর সাথে ফিরে কথা বলার সাথে চা পান করেন এবং নিজের আগ্রহের ভান করেন, চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

স্ত্রী নেতাকে সান্তনার সুরে বলেন, যে দিকে হাওয়া, সে দিকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা, অন্য দলকে ভোট দেওয়া মানে ভোট নষ্ট। নির্বাচনের আগে জনতার একাংশের মনে এমনই চিন্তাধারা চলতে থাকে। আর এই হাওয়াটাকে আরও জোরালো করে এক শ্রেণির গণমাধ্যম।
“ঠিকই বলেছো। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সবখানেই ক্ষোভ রয়েছে। এমনকি চটগ্রামে দাঙ্গার খবর পাওয়া গেছে।” নেতা স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন।

প্রার্থীদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে কম খারাপ কে? কারই বা দুর্নীতি একটু কম? বর্তমানে মানুষের কাছে প্রার্থী বাছাইয়ের মানদণ্ড এগুলিই। নেতাকে উদ্দেশ্য করে স্ত্রী বললেন।
নেতা চুপ করে রইলেন।

কফি খাওয়ার পরে এবং পর্যাপ্ত সংবাদ শোনার পরে নেতা তার ঘরে ফিরে গিয়ে দেয়ালের সাথে, জানালার সাথে, কোণে বসা পোষা বিড়ালের সাথে জোরে জোরে কথা বলেন। প্রচন্ড হতাশ হয়ে গেলে বা বিপদে পড়লে তিনি সাধারণত এই কাজটি করেন।

আজ বিকেলে এক পশলা ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ঝড় উঠলে কোনও কোনও গাছের হাত-পা ভাঙে। কেউ আবার গোড়া থেকে উপড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ব্যালকনিতে বসে আহত ও নিহত গাছগুলিকে দেখছিলেন নেতা। বিকেলের ঝড়ের ফল। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, ভাঙা গাছগুলোরও কি জয়-পরাজয়ের আশা-বেদনা ছিল!

ঘরের চারদিকের দেয়ালজুড়ে টাঙানো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে এরপর সে জরাগ্রস্তের মতো জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে খোলা আকাশের দিকে তাকাল। নেতার স্ত্রীর কপালের মধ্যেও চিন্তার ভাঁজ। এবার দল ভোটে জিততে পারবেতো?

আচ্ছা তুমি গতবছর রাজন কে দল থেকে বহিস্কার করলে কেন? ওর মত ডাইন্যামিক ও ক্যারিস্ম্যাটিক তরুণ নেতার দরকার ছিল এবার। নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে না পারলে দলের জন্য তথা গন্তন্ত্রের হন্য খারাপ।

লেকচার দিওনাতো। নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে দিলে দলে আমাদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়ে যাবে। ওকে বহিস্কার না করলে ভবিষ্যতে ও আমার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতো। সাপের বাচ্চা ডিমের ভেতরেই মেরে ফেলতে হয়। ডিম একবার ফেটে বের হলে তখন মারতে গেলে বা ঘাড় মটকে দিতে গেলে কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফুলের কুঁড়ি থাকতেই ছিঁড়ে ফেলতে হয়, ফল হতে দেওয়া যায় না। রাজনীতির এসব মারপ্যাঁচ তুমি বুঝবে না।
তুমি কী বলো? ও সবে একটা জেলা কমিটির নেতা ছিল। ও কীভাবে তোমার জন্য হুমকি হয় আমার মাথায় আসে না।

কী করে আসবে? তুমি কখনও মাঠের রাজনীতি করেছো? রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখতে হয়, রাবেয়া। ওর বাবা ওসমান চৌধুরী ছিল দলে আমার চির প্রতিদ্বন্দি। সেবার কাউন্সিলে দল থেকে প্রায় আমাকে বের করে দিচ্ছিল। দলে আমার বিরুদ্ধে একটা বড় গ্রুপ তৈরি করেছিল। চিটাগাঙ্গের শওকত আলি আমার পক্ষ নেওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে গেছি। তা না হলে আজ আমাদের কী হতো? কল্পনা করা যায়!

আচ্ছা তুমি দেশের কাজ কখন করবে? তুমি যদি এসব দলাদলি নিয়ে সদা ব্যস্ত থাক।
দেশের কাজও করতে হবে, পথের কাঁটাও সরাতে হবে। কোনটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজনীতি করতে হলে শেয়ালের মতো চতুর আর সিঙ্ঘের মতো সাহসী ও শক্তিশালী হতে হয়। এটা আমার কথা নয়, বিখ্যাত দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলির কথা। তুমি এসবের কী বুঝবে?

আমি ভালই বুঝি। তোমার চেয়ে কোন অংশে কম বুঝি না।
তুমি কিছুই বুঝনা। ওইসব তরুন তুর্কীদের উত্থ্যান বন্ধ না করলে আমাদের ঢাকা পড়তে হতো। আর আজকের এরকম পরিস্থিতির জন্য তুমিও তো কিছুটা দায়ী। তুমি যদি আমাকে একটা সন্তান উপহার দিতে পারতে, তাকে তৈরি করে রাখতাম, আমার অবর্তমানে দলের হাল ধরতে পারত।
সন্তান না হওয়ার জন্য কি আমি দায়ী? ডাক্তারের কাছে তো কখনো যাওনি। ডাক্তার কি কখনো একথা বলেছে?

যাক ওসব কথা এখন রাখোতো। কে দায়ী তা নিয়ে কি কাঁটাছেড়া করার সময় এখন?
তুমি তো প্রসঙ্গটা ওঠালে, তাই বললাম। যাক আর বলবো না।বিরোধী পক্ষের দিকে দেখ। তোমার সঙ্গে চার চার বার ভোটে হেরে গেল। কিন্তু এবার দলে তরুণ নেতা। তাকে এতদিন তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, রাজনীতিতে শিক্ষিত করে তুলেছে। এবার সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারে চষিয়ে বেড়িয়েছে। দেশবাসীর দৃষ্টি এখন তার দিকে নিবদ্ধ। অথচ তুমি কত কিছুই না করলে দেশের জন্য। আমার মনে হয় না এবার দল জিতবে। দল না জিতলে আমাদের কী অবস্থা হবে তা ভাবতেও আমার ভয় হচ্ছে।

অকৃতজ্ঞ জাতি। দ্রুত সব ভুলে যায়। সারাটা জীবন ব্যয় করলাম দেশের জন্য। তবুও ওদের মন ভরাতে পারলাম না। তা ভোটে হারজিত আছে। হারলে আমরা বিরোধী দলের নেতা হব। এতে তোমার এত ভয় পাওয়ার কী আছে?

ভয় পাই কারন আমাদের দেশে বিরোধী পক্ষের নেতাদের গ্রেফতার করে জব্দ ও হয়রানি করার জন্য সব সরকারেরই হাত নিশপিশ করে।
আসলে ক্ষমতার বৈশিষ্ট্যই হল আগ্রাসন। সে যাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে গণ্য করে, তাকে হেয় করে সে যেন এক ধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করতে চায়।
তোমরাও কি ওদের কম নাজেহাল করেছো? তাছাড়া তোমার বয়স কতো হয়েছে, খেয়াল করেছো? গত নির্বাচনের সময় তোমার বয়স ছিল পচাত্তর। এখন আশির কম হবে না। এখন তো তুমি একটা কলাগাছ। এখন কি আর ঝক্কি ঝামেলা সামলাতে পারবে? তরুন বয়সে জেল খেটেছো, জেল থেকে বেরিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছো। এখন কি আর তা সম্ভব।
কি সব আজেবাজে কথা বল। মাহাথির মোহাম্মদ যদি ৯৫ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, আমি কেন পারবনা।

তুমি মাহাথির না, আর দেশটা মালয়েশিয়া না।
যাক ভয় পেও না। অত ভয়কাতর হলে একজন রাজনীতি করা মানুষকে বিয়ে করেছো কেন? সময়ে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। এতা জোয়ার ভাটার দেশ। নদীর জল কখন কোন দিকে গড়ায় কেউ বলতে পারে না। রাজনীতিকদের প্রাণ হল কৈ মাছের প্রাণ।
দরজায় কড়া নাড়লো সুরেশ।
আমাকে ডেকেছেন স্যার? ভেতরে আসবো স্যার?
হ্যাঁ, ডেকেছি। বসো।
কাল সারা রাত ঘুমান নি, স্যার? আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
কঠিন সময়, সুরেশ, নেতা বলল, পুরু চশমাটা খুলে দুচোখ মুছে আবার পরল। বড়ই কঠিন সময়।
পরিস্থিতি যে এরকম হবে আপনি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন, স্যার?

কিছুটা আচ করতে পেরেছিলাম। এরকম বিপর্যয় একটা ঘটবে জানতাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে সেটা ঘটবে তা আঁচ করতে পারিনি। বয়সে আমার এতো ছোট একটা ছেলে কিভাবে আমার সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে আমার বুঝে আসেনা। তা তোমার কি ধারণা এ বিষয়ে?
আপনি কি কম করেছেন। তলাবিহিন ঝুলির দেশ থেকে দেশকে উন্নত দেশের কাঁধ ছুয়ে চলার পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। বেকার সমস্যা দূর করেছেন, দুর্নীতি দূর করেছেন। তবে এখনও কিছু দুর্নীতি হচ্ছে। তা ওরকম দুর্নীতি ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও হয়।
হ্যা, দুর্নীতি হবেই না, এমন গ্যারান্টি কোনও দেশের কোনও সরকারই দিতে পারেনা, বুঝলে সুরেশ।

জি স্যার। সেবার এত বড় বন্যায় হাঁটু পানিতে নেমে সারা দেশে ত্রান বিতরণ করলেন। বিদেশি পত্রিকায় প্রশংসিত হলেন। গত বছর করোনার মহামারি। গায়ে আপনার অভ্যস্ত সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি, পায়ে সেকেলে চপ্পল, বাড়ির বাইরে মুখমণ্ডলে আত্মরক্ষার মাস্ক, হাতে গ্লাভস। কখনেও ছুটছেন, কখনেও প্রেস ব্রিফিংয়ের মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব রেখে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার সকৌশল, সুদৃঢ় আর সহমর্মী সজল উচ্চারণ জনমুখী নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার ইতিহাসে অদ্বিতীয় নজির হয়ে থাকবে। এতসবের জন্য আপনার নাম গিনেস বুকে ওঠা উচিৎ।
প্রশংসা বাক্য শুনে নেতার গায়ের পশম খাড়া হয়ে যায়। খুশিতে গদগদ হয়ে তৃপ্তির হাসি নিয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়।

ঠিকই বলেছো সুরেশ। এই একজনমে একটা মানুষ আর কত কী করতে পারে? চিন্তা কর স্বাধীনতার আগে চাকরিজীবী বাবার বদলিসুত্রে তার সাথে গলাচিপার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আগমণ, ফকিরের পুলে গরম পানির গলির মেসে থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, ছাত্র রাজনীতি, ঠিকাদারি, পরবর্তীতে নেতার আনুক‚ল্যে দলের যুব সংগঠনের প্রধান। কী নাটকীয় উত্থ্যান! কল্পনা করা যায়…
আসলে তোমার জেদ আর একগুঁয়েমির কারনে আজ দলের এ অবস্থা। এ কয়েক বছরে আরো কতজন সম্ভানাময় নেতাকে দল থেকে বহিস্কার করলে তা একবার ভেবে দেখেছো? এসবের জন্য তোমাকে আরো অনেক পস্তাতে হবে, নেতার স্ত্রী রাগ চেপে রেখে শুকনো গলায় বলল।
নেতা মাথা নিচু করে তার কথা শোনে।

তুমি সফল নেতা ছিলে, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাই বলে তুমি সারা জীবন সফল, জনপ্রিয় থাকবে এমন নিশ্চয়তা তুমি দিতে পারনা। তার উপর সময় বলে একটা কথা আছে। অন্যকে আঘাত করে এবং তোমার অসারতা, আকাঙ্ক্ষাগুলি এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিয়ে জীবনে পরিচালিত করে পরবর্তীকালে তোমার উপার্জিত খ্যাতি নষ্ট করে দিয়েছো।
নেতা বিষন্ন মনে স্ত্রীর কথা শোনে। মাঝে মাঝে সন্মতিসুচক মাথা নাড়ে।
তুমি উত্তরসূরির চাষ না করে আশি বছর বয়সে অফিসের জন্য সর্বশেষ দৌড়ে গেলে এবং খারাপভাবে হেরে গেলে। তোমার অবস্থা হয়েছে সে ব্যবসায়ীর মতো যে আজীবন তার নিজের সফল ব্যবসা চালানোর পরে তার সমস্ত সঞ্চয় একটি ছদ্মবেশি অনলাইন বিনিয়োগ সংস্থায় ফেললো, যা হঠাৎ অচল হয়ে পড়ল। বুঝলে, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নেই।
লেখক : গল্পকার। সমাপ্ত