ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ২৮তম ভার্চুয়াল আসরটি জুলাই মাসের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়।

১৯ শতকের বিখ্যাত বিজ্ঞান ভাবুক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন, ‘অণুবীক্ষণ নামে একরকম যন্ত্র আছে; তাহাতে ছোট জিনিসকে বড় করিয়া দেখায়, কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত বড় জিনিসকে ছোট দেখাইবার জন্য নির্ম্মিত যন্ত্রস্বরূপ। আমাদের দেশের মধ্যে যাহারা খুব বড় বলিয়া আমাদের নিকট পরিচিত, ঐ গ্রন্থ একখানি সম্মুখে ধরিবামাত্র তাহারা সহসা অতি ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে। এবং এই যে বাঙালীত্ব লইয়া আমরা অহোরাত্র আস্ফালন করিয়া থাকি, তাহাও অতি ক্ষুদ্র ও শীর্ণ কলেবর ধারণ করে। এই চতুস্পার্শস্থ ক্ষুদ্রতার মধ্যস্থলে বিদ্যাসাগরের মূর্ত্তি ধবল পর্বতের ন্যায় শীর্ষ তুলিয়া দণ্ডায়মান থাকে, কাহারও সাধ্য নাই যে, সেই উচ্চ চূড়া অতিক্রম করে বা স্পর্শ করে। … বস্তুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এত বড় আর আমরা এত ছোট, তিনি এত সোজা আর আমরা এত বাঁকা যে, তাঁহার নাম গ্রহণ আমাদের পক্ষে বিষম আস্পর্ধার কথা বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না। কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়, মানব-ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপনে কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন। … সেইজন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি-সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। … আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণজীবিত ছিলেন।’

১৯ শতকের বাংলার জাগরণের প্রাণপুরুষ, বাংলা গদ্যের জনক, ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহুমাত্রিক প্রতিভাময় সত্তা বাঙালির জীবনকে, মননকে, চিন্তাধারাকে, সাহিত্যকে যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ করেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষে, মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল’ এর বিদ্যাসাগরকৃত বাংলা উপাখ্যান ‘শকুন্তলা’ নিয়েই ছিল এবারের পাঠশালার আসর। ‘শকুন্তলা’ নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।

আলোচক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় শর্মা। বিদ্যাসাগর ছিল তাঁর উপাধি। বিদ্যাসাগরের কাজ অজস্র। লেখালেখি তাঁর কাজের অতি ক্ষুদ্র অংশ। ভারতবর্ষে ১৮৫৫ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের আগের বছর, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আইন ইংরেজরা করে। ভারতবর্ষে বিধবাদের সমস্যা মুসলিম সমাজে ছিল না এবং হিন্দুদের অনেক অন্ত্যজ সমাজেও ছিল না, যেমন দক্ষিণ ভারতে। শুধু ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই কড়াকড়ি বন্ধ করার জন্য বিদ্যাসাগর এই আইন প্রবর্তনের আগে থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। এই বিষয়ে তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেন সংস্কৃত পুস্তক ঘেঁটে। যেহেতু তাঁর বিদ্যা ছিল তাই দিয়ে তিনি অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সাথে লড়েছেন। এটাই হচ্ছে মর্মকথা। আমরা জানি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আইন প্রনয়ণের পেছনে বিদ্যাসাগরের কতটা পরিশ্রম ছিল। এই আইনের প্রায় ৩০ বছর আগেই বেন্টিং এর সময় ১৮২৯ সালে সতীদাহ নিবারণের আইন ইংরেজরা করেছিল। আর বিদ্যাসাগরেরটা এর প্রায় ৩০ বছর পরে। এটাই তাঁর খ্যাতির উৎস। কিন্তু তিনি অন্য একটা খ্যাতিতে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি ছিলেন তখন ভারতে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর। ইংরেজদের অধীনে তিনি চাকরি করতেন। তিনি এসেছিলেন মেদিনীপুরের একটা নৈষ্টিক ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। সেই গল্প আমরা সবাই জানি। বাবার সঙ্গে আট-নয় বছর বয়সে তিনি যখন কোলকাতার দিকে আসছিলেন তাঁকে তখন দামোদরসহ দুটো খরস্রোতা নদী পার হয়ে আসতে হয়েছিল। এগুলো পার হয়ে এবং পরে হাঁটায় যে তাঁর কষ্ট হয়েছিল সেসবের উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরই লেখা ‘বিদ্যাসাগরচরিত’-এ। তিনি আত্মজৈবনিক একটা প্রবন্ধে লিখেছিলেন মাইলস্টোনে লেখা দেখে ইংরেজি অক্ষর শেখার গল্প যাতে তাঁর মেধার প্রকাশ, ছাত্র হিসেবে প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।

সলিমুল্লাহ খান বলেন, কিন্তু কোলকাতায় এসে তাঁর বাবার লক্ষ্য ছিল তাঁকে প্রচলিত টোলে, সংস্কৃত টোলে ভর্তি করার। আত্মীয়স্বজনেরা বলে তাঁকে হিন্দু কলেজে পড়াতে। কারণ ১৮১৬-১৭-তে হিন্দু কলেজ তৈরি হয়েছিল, যেখানে ইংরেজি শিখতে পারবে। কিন্তু বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় তাঁর ছেলেকে টোলের শিক্ষক করতে চান, সংস্কৃত কলেজে পড়াতে চান। তাই বিস্যাসাগর হিন্দু কলেজে না পড়ে সংস্কৃত কলেজে পড়েন। এবং তৎকালের নিয়ম অনুযায়ী তিনি অনেকগুলো শ্রেণি যেমন ব্যাকরণ শ্রেণি, স্মৃতি শ্রেণি, দর্শন শ্রেণি, অলঙ্কার শ্রেণি, ন্যায় শ্রেণি এসব উত্তীর্ণ হয়ে ১২ বছর পড়ার পর সেখান থেকে স্নাতক হন ১৮৪০ সালের দিকে। পড়া শেষে তিনি ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে চাকরি পান। সেইখানে চাকরি নেওয়ার পর তিনি প্রায় ২০ বছর বয়সে ইংরেজি শেখেন এবং যে ইংরেজি শেখেন সেটা অতি উচ্চমানের। এই হচ্ছে বিদ্যাসাগরের বিদ্যা। তিনি বাংলা শিখেছেন, তারপরে সংস্কৃত পণ্ডিত হয়েছেন। বারো বছর না পড়লে কেউ পূর্ণ পণ্ডিত হয় না। তিনি খুব মেধাবী ছিলেন বলেই পণ্ডিত হতে পেরেছেন। তারপরে তিনি ইংরেজদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান কারণ তাদের সংস্কৃত পণ্ডিত দরকার ছিল। ইংরেজদের সংস্কৃত পড়ানোর পাশাপাশি তিনি কিন্তু নিজেও ইংরেজিটা শিখে নেন। এই শেখার ফলস্বরূপ তিনি পরবর্তীকালে সরকারি স্কুলসমূহের ইন্সপেক্টর জাতীয় চাকরি পান। সেসময় তিনি অনেকগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করেন বিভিন্ন অঞ্চলে, অনেক বড়ো এলাকা জুড়ে। নারীদের জন্যও তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চেষ্টা করেন। একটা কিংবদন্তিতূল্য গল্প আছে। একবার কোলকাতার দক্ষিণে একটা স্কুলে তিনি ভিজিট করতে যান ইন্সপেক্টর হিসেবে। সেখানে ক্লাসের ছাত্রদের তিনি জিজ্ঞেস করেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। ছাত্ররা বলে, আমাদের এখানে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, এটাইতো দেখা যায়। তখন তিনি বুঝতে পারেন, এরা তো কিছুই বিজ্ঞান শিখছে না এবং এখানে এই শিক্ষাই দেওয়া হয়। বাংলার বহু অঞ্চলে তখন শিক্ষার অবস্থা এমনটাই ছিল।

আলোচক বলেন, এসব বলার কারণ, বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনায় শুধু বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালে চলবে না। আরো কয়েকটি জিনিসের দিকে তাকাতে হবে। তাঁর পাঠক কারা ছিল? তাঁর নিয়োগকর্তা কারা ছিল? তখন দেশের শাসনটা কেমন ছিল? শিক্ষাবিদ হিসেবে বিদ্যাসাগরের কী পরামর্শ ছিল? শুরু করা যাক ভাষা দিয়ে। বিদ্যাসাগর বলেন, শিক্ষাবিস্তারে মাতৃভাষার চেয়ে কোনো ভালো উপাদান আর নাই। যদি আমরা মনে করি সংস্কৃতের মাধ্যমে দেশের সবাইকে শিক্ষিত করতে পারব, সেটা যেমন ভুল তেমনি ইংরেজির মাধ্যমেও যদি সারা দেশকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়, সেটাও ব্যর্থ হবে। ‘বোধোদয়’ নামে একটা পাঠ্যবই তিনি লিখেছিলেন। সেই বইয়ের ‘বাক্যকথন – ভাষা’ অধ্যায়ে তিনি লেখেন – ‘ইংরেজরা আমাদের দেশের রাজা ছিল। সুতরাং ইংরেজি আমাদের রাজভাষা ছিল। এই নিমিত্ত সকলে আগ্রহপূর্বক ইংরেজি শিখিত। কিন্তু অগ্রে মাতৃভাষা না শিখিয়া পরের ভাষা শিক্ষা কোনো মতেই উচিৎ নহে।’ তিনি সংস্কৃত থেকে সংকলন করেছেন, অনুবাদ করেছেন অনেককিছুই, শুধুমাত্র আজকের আলোচ্য ‘শকুন্তলা’ না। সংস্কৃত বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা যায় তাঁর লেখা ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামের প্রবন্ধের উপসংহার থেকে – ‘ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবেক, ভারতবর্ষীয় সর্ব্বসাধারণ লোক বিদ্যানুশীলনের ফলভোগী না হইলে তাহাদের চিত্তক্ষেত্র হইতে চিরপ্ররূঢ় কুসংস্কারের সমূলে উন্মূলন হইবেক না; এবং হিন্দী, বাঙালা প্রভৃতি তত্তৎ প্রদেশের প্রচলিত ভাষাকে দ্বারস্বরূপ না করিলে সর্ব্বসাধারণের বিদ্যানুশীলন সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু সংস্কৃত না জানিলে, কেবল ইঙ্গরেজী শিখিয়া আমরা যে ঐ মহোপকারক গুরুতর বিষয় সম্পন্ন করিতে পারিব, ইহা কোনও মতে সম্ভাবিত নহে।’ এই প্রবন্ধ তিনি ‘শকুন্তলা’ প্রকাশের কাছাকাছি সময়ে, ১৮৫৩ সালের দিকে লেখেন। বিদ্যাসাগরের বাংলা নিয়ে অনেকে অভিযোগ করেন যে, বিদ্যাসাগরীয় বাংলা কঠিন বাংলা কিন্তু তা সবসময় সত্য না। তবে তিনিও সময় সময় গুরুচণ্ডালিতে আক্রান্ত। কোথাও তিনি সহজ ক্রিয়া লিখেছেন আবার কখনো লম্বা লিখেছেন। বিদ্যাসাগর একসময় রসিকতা করে বলেছিলেন, আমি তো সংস্কৃত কথাগুলো সংস্কৃত অর্থেই লিখি কিন্তু বঙ্কিম সংস্কৃত কথাগুলো ভুল অর্থে লেখেন।

অধ্যাপক খান বলেন, বিদ্যাসাগর শিক্ষক হিসেবে অপূর্ব। বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের মতো শিক্ষক থাকলে, নিরক্ষরতা দূরীকরনের কাজটি বেগবান হতো। লেখক হিসেবে তাঁর যেই কাজ সেটা তাঁর শিক্ষাদানের উপযোগী। বিদ্যাসাগরের লেখা পড়লে মনে হয়, তাঁর সাথে কথোপকথন করছি। ভালো লেখকের গুণ মনে করি, যখন তাঁর কথা এবং লেখার মধ্যে পার্থক্য সামান্যই থাকে।

সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিদ্যাসাগর নিজেই বলেছেন যে তিনি ‘শকুন্তলা’ সঙ্কলন করেছেন। ‘শকুন্তলা’র ভূমিকা খুব আনন্দদায়ক। সেখানে তিনি বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের লেখায় রসবোধ অসাধারণ। বিতর্কমূলক লেখায় যেই বাংলা তিনি লিখেছেন সেটা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কিংবা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র যে গদ্যকাঠামো প্রায় তার কাছাকাছি। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা আছে কিন্তু মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, তাঁর গদ্য ছিল প্রাঞ্জল। লম্বা সাধু ভাষার ক্রিয়া ব্যবহার করলেই সেটি মন্দ বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তিনি যেখানে যা প্রযোজ্য মনে করেছেন সেভাবেই লিখেছেন। তবে এটা মনে রাখতে হবে, তাঁকে পথ হাতড়ে বেড়াতে হয়েছিল। সেজন্য তিনি বলেছেন, বাংলা ভাষা এখনো পুরোপুরি উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। ‘শকুন্তলা’ বইটি নিয়ে আলোচনার সময় এটা মনে রাখতে হবে, বিদ্যাসাগর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। ১৮৫৪ সালে প্রথম তাঁর অনূদিত ‘শকুন্তলা’ প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত ভাষায় এর মূল লেখক কালিদাস। কালিদাসের কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ঐক্যমত নেই। খৃষ্টীয় সাল শুরু হবার ১০০ বছর আগেই বিক্রমাদিত্য রাজার আমলে নবরতœ সভায় কালিদাস ছিলেন সভাকবি। এটা হচ্ছে কিংবদন্তি। আবার কেউ কেউ বলেন, উনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের যা খৃষ্টীয় ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত এসেছে। তবে এটা বলা যায়, তিনি কমপক্ষে ২০০০ থেকে ১৫০০ বছর আগের কবি। তাই সেই সময়ের পরিবেশ অনুসারেই ‘শকুন্তলা’ নাটকটি লেখা হয়েছে।

আলোচক বলেন, বিদ্যাসাগর কেন ‘শকুন্তলা’ অনুবাদ করলেন? কারণটা হচ্ছে – এটা ইউরোপিয়রা পুনরাবিষ্কার করেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে। স্যার উইলিয়াম জোন্স, যিনি ফারসি ভাষা সংস্কৃত ভাষা শেখেন এবং যিনি ইন্দো ইউরোপিয় ভাষাসমূহের ঐক্য আবিষ্কার করেন তিনি ১৭৮৯ সালে ‘শকুন্তলা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদ ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষাসহ অন্যান্য ইউরোপিয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ইউরোপের প্রায় সব ভাষায় এটা অনূদিত হয়েছে। এবং জার্মান কবি গ্যেটে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই বই পড়ে অভিভূত হয়ে কিছু মন্তব্যও করেন। সেটির ওপর রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন, বিদ্যাসাগর করেন, বঙ্কিমচন্দ্রও করেন। বিদ্যাসাগরের অনুবাদকে প্রভাবিত করে ইউরোপে এই বইয়ের যে প্রশ্রয় ইউরোপিয় পণ্ডিতেরা দিয়েছিলেন সেটা। ‘সংস্কৃত সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগর লেখেন – এই বইটা আমাদের দেশের লোকের তো ভালো লাগবেই, যেহেতু আমরা সংস্কৃতে পড়তে পারি। কিন্তু ইউরোপীয়দেরও ভালো লেগেছে অনুবাদের অনুবাদ পড়ে। নিশ্চয়ই বইটা খুবই ভালো হবে। ‘সংস্কৃত ভাষায় যত নাটক আছে, শকুন্তলা সেই সকল অপেক্ষা সব্বাংশে উৎকৃষ্ট, তাহার সন্দেহ নাই। এই অপূব্ব নাটকের, আদি অবধি অন্ত প্য্যন্ত, সব্বাংশই সব্বাঙ্গসুন্দর। যদি শত বার পাঠ কর, শত বারই অপূব্ব বোধ হইবে। এই নাটক সাত অঙ্কে বিভক্ত। ইহাতে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে। প্রথম অঙ্কে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার সাক্ষাৎকার, তৃতীয় অঙ্কে উভয়ের মিলন, চতুর্থে শকুন্তলার প্রস্থান, পঞ্চমে শকুন্তলার দুষ্মন্তসমীপগমন ও প্রত্যাখ্যান, যষ্ঠে রাজার বিরহ, সপ্তমে শকুন্তলার সহিত পুনম্মিলন।’

অধ্যাপক খান বলেন, রবীন্দ্রনাথ শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এইসব নিয়ে আলোচনার সময় রাজার নাম লিখেছেন দুষ্যন্ত। এটা হলো বঙ্গীয় সংস্করণ। বিদ্যাসাগর অনুসরণ করেছেন কাশ্মিরী সংস্করণ। দুষ্মন্ত কাশ্মিরী সংস্করণের চরিত্রের নাম। শকুন্তলার এমন ছয় ধরনের সংস্করণ আছে। ধরে নেওয়া যায় বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত কিছুটা বঙ্গীয়করণ হয়েছে। বিদ্যাসাগর প্রথম অঙ্কে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার সাক্ষাৎকারের কথা লিখেছেন কিন্তু দ্বিতীয় অঙ্কের কথা লিখেননি। তবে আমরা জানি, শকুন্তলাকে দেখার পর রাজার মাথায় গোলমাল দেখা দেয়। তিনি দ্বিধান্বিত নগরে ফিরে যাবেন নাকি ছল করে আবার তপোবনে ফিরে যাবেন। এই নিয়ে মাধব্যর সঙ্গে পরামর্শ করেন। সেই সময় তাকে তপোবনের দুই ঋষিকুমার এসে উদ্ধার করে? ওরা বলে যে দৈত্যের অত্যাচার ঠেকাতে রাজাকে দরকার। ফলে তিনি তপোবনে থাকার সুযোগ পেয়ে যান। তিনি ফিরে আসেন ২য় অঙ্কে। তৃতীয় অঙ্কে তাঁর উদ্দেশ্য, মনোকামনা পূর্ণ হয়। তিনি গান্ধর্ব রীতিতে প্রেম করে বিয়ে করেন। তৃতীয় অঙ্কে উভয়ের মিলন, চতুর্থ অঙ্কে শকুন্তলার প্রস্থান। কারণ কর্ণ মুনি ফিরে এসে দৈববাণী পান যে শকুন্তলা শুধু বিয়েই করেনি সে সন্তানবতীও। কাজেই বাবার বাড়িতে তো সে আর থাকতে পারে না। উল্লেখ্য, রাজা কিন্তু বিয়ে করার আগে শকুন্তলার বংশ পরিচয় জেনে নেন। কন্ব মুণির তো কন্যা থাকার কথা না। তখন জানা যায় অন্যের মেয়ে সে, বিশ্বামিত্র-মেনকার সন্তান। এসব গল্প জানার পরে সংস্কৃত রীতিতে যে জাতিভেদ সেটা মেনেই রাজা তাকে স্পর্শ করেন। এরপর শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা। এটাই আমরা বেশি পড়েছি। তখন তপোবনের সবাই কাতর হয়। শকুন্তলার প্রিয় শস্য, পুষ্প, ঘাস, উদ্যানলতা, হরিনশিশু সব। এর অপূর্ব বর্ণনা আছে ‘শকুন্তলা’য়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – অসাধারণ কালিদাসের কীর্তি এখানে। তিনি কোনো রূপক না করে, মুখ দিয়ে কথা না বলিয়ে প্রকৃতির ভাব দিয়ে কথা বলিয়েছেন এবং সেটা একটা চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছেন, এখানে প্রকৃতিও একটা চরিত্র। সে সর্বত্র আছে। তবে প্রকৃতির সঙ্গে শকুন্তলাকে এক করে দেখার আধুনিক ব্যাখ্যা করা যায়। একে বলে স্যাভেজিং।

আলোচক বলেন, এরপর শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা করে। কন্বের আদেশে সঙ্গে যান গৌতমী ও ঋষিকুমাররা। কিন্তু রাজার কাছে যাবার পথে শকুন্তলার অজান্তে তাকে রাজার দেওয়া অঙ্গুরীয় হারিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে। চতুর্থ অঙ্কে আরেক অতিথি দুর্বাসা মুনি আসে শকুন্তলার কাছে। কিন্তু শকুন্তলা তার স্বামীর চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিল যে অতিথির ডাক শুনতে পায় না। দুর্বাসা ছিলেন খুব রাগান্বিত মানুষ। তিনি অভিশাপ দেন ‘তুমি যার চিন্তায় এত মগ্ন হয়ে অতিথি সৎকার থেকে বিরত হলে তিনিই তোমাকে ভুলে যাবেন।’ অর্থাৎ তারা গান্ধর্ব বিয়ে করে যে প্রকৃতির সীমা লঙ্ঘন করেছে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেনি, সেইজন্য এই শাপ। এটা সাধারণ ব্যাখ্যা। শকুন্তলার সখি অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে এক শর্তে দুর্বাসা রাজি হন – শকুন্তলা যদি কোনো অভিজ্ঞান দেখাতে পারে তাহলে রাজা স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবেন। এই সেই বিখ্যাত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল’ এর অভিজ্ঞান মানে অঙ্গুরীয়। এখানে বলে রাখা দরকার, এই গল্পটা কালিদাস উদ্ভাবন করেননি। এটা আগেই ছিল মহাভারতে। যদিও মহাভারতে অঙ্গুরীয়র কাহিনিটা নেই। নেই জেলের জালে ধরা পড়া রোহিত মৎস্যের পেটে অঙ্গুরীয় যাবার কাহিনিও। এসব কালিদাসের অপূর্ব আবিষ্কার। এখানে মৌলিক অর্থে অপূর্ব। শুধু আবিষ্কার নয়, এতে নাটকের ব্যঞ্জনাও বেড়েছে।

গল্পটা হলো এই – শকুন্তলা পতিগৃহে যায় ৫ম অঙ্কে এবং পতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা হয়। শুধু প্রত্যাখ্যাতা নয়। তখন রাজা বলেন, তিনি তো প্রজাপালনের ধর্ম পালন করেন, তাই শকুন্তলাকে তার বিয়ে করতে আপত্তি হতো না। শকুন্তলা যে দাবি করছে সে রাজার স্ত্রী এবং সন্তানসম্ভবা তাতেও রাজার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু সে যে সন্তানসম্ভবা এটা তো অন্যের সন্তানও হতে পারে। এই অবস্থায় শকুন্তলাকে তার বিয়ে করা উচিত হবে না। তখন শকুন্তলা রেগে গিয়ে রাজাকে পরিণত নারীর মতো বলে – আপনার চরিত্র নিষ্পাপ আপনি বলছেন কিন্তু এটা আমি বিশ্বাস করি না। আপনি নিজের চরিত্র আমার ওপর আরোপ করছেন। আপনি লোকজনকে ঠকিয়ে থাকেন আর আমাকে কিনা বলছেন আমি ঠকাতে এসেছি। এ অবস্থায় শকুন্তলার পিসি গৌতমীও তাকে অস্বীকার করেন এবং শকুন্তলাকে বলতে হয়, হে ধরণী দ্বিধা হও। তখন তার মা মেনকা এসে তাকে রক্ষা করে নিয়ে যান। এটা হচ্ছে নাটকের কৌশল। ষষ্ঠ অঙ্কে আমরা দেখি শকুন্তলা নেই। রাজা খুব বিরহে ও অনুতাপে ভুগছেন। ঐ সময় জেলের মাছের পেটে পাওয়া সেই অঙ্গুরীয় তার সামনে উপস্থাপন করা হয়। অভিজ্ঞান হাজির হওয়ায় রাজার মনে পড়ে সব।

লক্ষ্য করার বিষয় – প্রথম অঙ্কে যেমন রাজার সঙ্গে শকুন্তলার মিলন হয়, সপ্তম অঙ্কেও তাই। তবে এটা পৃথিবীতে না, স্বর্গে, মারীচের বনে। এইজন্য বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা বলেছেন, এই নাটকটাকে দেখলে ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো দেখায়। এক আর সাতে মেলে, দুইয়ে আর ছয়ে মেলে, তিন আর পাঁচে মেলে আর চারটা হলো একক। চার হলো টার্নিং পয়েন্ট। প্রথমে শকুন্তলার সঙ্গে রাজার দেখা হয়, দ্বিতীয়তে রাজা বিরহকাতর হন, তিনে তাদের মিলন হয়, চারে শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা করে। পঞ্চম অঙ্কে তার আবার রাজার সাথে দেখা হয়। তিনের মত পঞ্চমেও দেখা হয় তবে তিনেরটা ছিল আনন্দের আর পঞ্চমেরটা বিষাদের, রাজা প্রত্যাখ্যান করেন তাকে। দুইয়ে রাজা একা ছিলেন। ষষ্ঠেও রাজা একা। সপ্তমে তাদের আবার মিলন হয়। সেটা পরিপূর্ণ মিলন। যেখানে তারা উভয়েই পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের জন্য সক্রিয় হন। সেখানে ভূমিকা পালন করে তাদের সন্তান। এই সন্তানই পরে ভরত নামে পরিচিত হয়।

কালিদাসের এই ‘শকুন্তলা’ নাটকের এত প্রশংসা লোকে করেছে যে খোদ বিদ্যাসাগর বলেছেন – ‘এই সকল স্থলে কালিদাস স্বীয় অলৌকিক কবিত্বশক্তির একশেষ প্রদর্শন করিয়াছেন। উত্তম সংস্কৃতজ্ঞ সহৃদয় ব্যক্তি ঐ সকল স্থল পাঠ করিলে, অবশ্যই তাহার অন্তঃকরণে এই দৃঢ় প্রতীতি জন্মিবেক যে মনুষ্যের ক্ষমতায় ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রচনা সম্ভবিতে পারে না। বস্তুত, কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল অপূব্ব পদার্থ। ভারতবর্ষীয়েরাই যে, স্বদেশীয় কাব্য বলিয়া, শকুন্তলার এত প্রশংসা করেন এমন নহে; দেশান্তরীয় পণ্ডিতেরাও শকুন্তলার এইরূপ, অথবা ইহা অপেক্ষা অধিক, প্রশংসা করিয়াছেন। নানাবিদ্যাবিশারদ, অশেষদেশভাষাজ্ঞ, সুবিখ্যাত সর উইলিয়ম জোন্স শকুন্তলা পাঠ করিয়া এমন প্রীত হইয়াছিলেন যে কালিদাসকে স্বদেশীয় অদ্বিতীয় কবি শেক্সপিয়রের তুল্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন; এবং জার্মান দেশীয় অতি প্রধান পণ্ডিত ও অতি প্রধান কবি গ্যেটি শকুন্তলার স্যার উইলিয়াম জোন্সকৃত ইংরেজি অনুবাদের ফস্টরকৃত জার্মান অনুবাদ পাঠ করিয়া লিখিয়াছেন যদি কেহ বসন্তের পুষ্প ও শরতের ফললাভের অভিলাষ করে, যদি কেহ চিত্তের আকর্ষণ ও বশীকরণকারী বস্তুর অভিলাষ করে, যদি কেহ প্রীতিকর ও প্রফুল্লকর বস্তুর অভিলাষ করে, যদি কেহ স্বর্গ ও পৃথিবী এই দুই এক নামে সমাবেশিত করিবার অভিলাষ করে তাহা হইলে হে অভিজ্ঞান শকুন্তল আমি তোমার নাম নির্দেশ করি এবং তাহা হইলে এই সকল বলা হইলো। যদি বিদেশীয় লোক অনুবাদের অনুবাদ পাঠ করিয়া এত প্রীত ও চমৎকৃত হইতে পারেন তবে স্বদেশীয়রা যে সেই বিষয়ে মূল পুস্তকে পাঠ করিয়া কত প্রীত ও কত চমৎকৃত হইবেন তাহা সকলেই অনুভব করিতে পারেন।’ এটা অনেকটা আমাদের জন্যও বলা। আমরা সংস্কৃত না জানলেও বিদ্যাসাগর জানেন যে আমরা জানি না। এইজন্য বিদ্যাসাগর একটা মন্তব্য করে অনুবাদ করেছেন। সেটা খুব মজার। সেটির মর্মকথা এই – তাঁর অনুবাদ বা সঙ্কলন পাঠ করে যেন কালিদাসকে দোষ দেওয়া না-হয়। যদি দোষ হয় সে তাঁর কিন্তু মূল আরো ভালো। মূল যারা পড়েছেন তাঁরা বলেছেন এখানে কিছু অংশ সংস্কৃত ভাষায় লেখা আর কিছু অংশ বিশেষ করে নারীদের ধীবরের উক্তিগুলো প্রাকৃত ভাষা অর্থাৎ তৎকালীন লোকভাষায় লেখা। এটাও একটা পরিবর্তনের চিহ্ন। এইজন্য কেউ কেউ মনে করেছেন ‘শকুন্তলা’ গুপ্তযুগের লেখা যখন প্রাকৃত ভাষার চলটা বেড়েছে। বিদ্যাসাগর ‘শকুন্তলা’র ভূমিকায় লিখেছেন – ‘ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান কবি কালিদাসপ্রণীত শকুন্তলা সংস্কৃত ভাষায় সর্ব্বোৎকৃষ্ট নাটক। এই পুস্তকে সেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট নাটকের উপাখ্যান ভাগ সঙ্কলিত হইল। এই উপাখ্যানে মূল গ্রন্থের অলৌকিক চমৎকারিত্ব সন্দর্শনের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে না। যাঁহারা সংস্কৃতে শকুন্তলা পাঠ করিয়াছেন এবং এই উপাখ্যান পাঠ করিবেন চমৎকারিত্ব বিষয়ে এ উভয়ের কত অন্তর তাহা অনায়াসে বুঝিতে পরিবেন এবং সংস্কৃতানভিজ্ঞ পাঠকবর্গের নিকট কালিদাসের ও শকুন্তলার এইরূপে পরিচয় দিলাম বলিয়া মনে মনে কত শত বার আমার তিরস্কার করিবেন। বস্তুতঃ বাঙ্গালায় এই উপাখ্যান সঙ্কলন করিয়া আমি কালিদাসের ও শকুন্তলার অবমাননা করিয়াছি। অতএব হে পাঠকবর্গ! আপনাদের নিকট আমার প্রার্থনা এই আপনারা যেন এই শকুন্তলা দেখিয়া কালিদাসের শকুন্তলার উৎকর্ষ পরীক্ষা না করেন।’

সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিদ্যাসাগর প্রথমে অঙ্ক লিখেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে এসে পরিচ্ছদ লিখেছেন। অর্থাৎ কালিদাস থেকে তিনি খানিকটা স্বাধীন হয়েছেন। যেহেতু শকুন্তলা একটা উপাখ্যান, তাই এখানে অঙ্ক লেখার প্রয়োজন নেই। ভাষার ক্ষেত্রে কালিদাসও তখন আরো অগ্রসর কালে এসে গেছেন। রাজার মুখে যেটা মানায় অর্থাৎ সংস্কৃত সাধুভাষা প্রয়োগ করেছেন আর সাধারণ মানুষের মুখে যেমন ধীবরের মুখে তিনি প্রাকৃত ভাষা দিয়েছেন। বিদ্যাসাগরও তদনুযায়ী ধীবরের মুখে একদম লোকের ভাষা দিয়েছেন। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আমাদের যে সংস্কার সেটা হচ্ছে – তিনি যেন সবসময় গুরুগম্ভীর সংস্কৃতবহুল বাংলা লিখেছেন। কিন্তু এইরকম তিনি সব জায়গায় করেননি এটা বুঝতে হবে।

আলোচক বলেন, বিদ্যাসাগর স্যার উইলিয়াম জোন্সকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, কালিদাসের লেখা শেক্সপিয়ারের সাথে তুলনীয়। ১৯৮৯ সালে অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের বছর উইলিয়াম জোন্স ‘শকুন্তলা’ ফরাসিতে অনুবাদ করেন। বিদ্যাসাগরের অনুজ লেখক বঙ্কিমচন্দ্র যখন ‘শকুন্তলা’ নিয়ে লিখেছেন তখন বিদ্যাসাগরের ‘শকুন্তলা’ও বেরিয়ে গেছে। বঙ্কিম শেক্সপিয়ারের দুটো চরিত্র নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন, আমরা জানি। প্রবন্ধটির নাম – ‘শকুন্তলা মিরন্দা ও দেসদিমোনা।’ সেখানে দুই পর্বে আলোচনা করে বঙ্কিম বলছেন, শকুন্তলার সঙ্গে মিল আছে মিরান্দার প্রথমদিকে। তার উদ্ভিন্ন যৌবনের বয়সে। কিন্তু যখন শকুন্তলা রাজদরবারে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয় তখন তার মধ্যে এক ধরনের সাহস এবং এক ধরনের প্রতিবাদী বা অধিকার চেতনা জাগে সেখানে তাকে প্রায় দেসদিমনার মতো লাগে। কিন্তু দুজনের চরিত্র এক নয়। বঙ্কিম দেখাতে চেয়েছেন যে, শকুন্তলা চরিত্রটি মিরান্দা ও দেসদিমনা দুই চরিত্রের সমন্বয়। যেমন মিরান্দা প্রকৃতিতে গড়ে উঠেছে সম্ভবত ভূমধ্য কিংবা ক্যারিবিয়ান সাগরের এক নির্জন দ্বীপে। বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষ সে দেখেনি। প্রথম সে ফার্দিনান্দকে দেখে। যদিও এখানে বঙ্কিমের দৃষ্টির কিছুটা অন্ধতা আছে, রবীন্দ্রনাথেরও আছে। সেই দ্বীপে আরেক লোক ছিল যাকে বঙ্কিম লিখেছেন কালিবন, কালিবনকে বঙ্কিম মানুষই মনে করেননি। সে বঙ্কিমের কাছে পুরুষ না। বঙ্কিম বলছেন, ঐ প্রকৃতির দ্বীপে বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষকে মিরান্দা দেখেনি। কারণ কালিবনকে বঙ্কিম পুরুষও মনে করছেন না, মানুষও মনে করছেন না। বঙ্কিমের কাছে ঐটা কোনো আলোচ্য বিষয় না। এটাকে বলে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি। বঙ্কিম তাকে মানুষই মনে করেননি কিন্তু শেক্সপিয়র তাকে খানিকটা মানুষ মনে করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের চেয়েও কম দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ওখানে এরিয়েল হচ্ছে আসল চরিত্র। ঐটাই প্রকৃতি যা মূর্তিমান হয়ে কথা বলে উঠেছে। অর্থাৎ একেবারেই রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি। রবীন্দ্রনাথ অভিজাত শ্রেণির মানুষ, বঙ্কিমও এবং তাঁদের কালের যে আদর্শ রোম্যান্টিকতা এটা সম্পূর্ণভাবেই অভিজাত শ্রেণির রোমান্টিকতা। সে সময়কার দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল ভাব, স্থায়ী ভাব এবং রস। রস নানারকমের – শৃঙ্গার রস, বীর রস, রুদ্র রস ইত্যাদি।

রাজাকে তো বীর ধর্ম পালন করতে হয় এবং রাজার দৃষ্টিতেই গোটা নাটকটা লেখা। এটা দোষ বা মন্দ না। নাটকটি নায়কের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা যেখানে নারী ও প্রকৃতি প্রায় সমান। যেমন প্রথমে রাজা রথ নিয়ে যাচ্ছেন, শর নিক্ষেপ করছেন মৃগের প্রতি, আশ্রম মৃগ। ঋষিকুমাররা এসে রাজাকে আশ্রমমৃগ মারতে অনুরোধ করে। রাজা রথ থামতে বলেন এবং পরবর্তীতে রাজার শিকারে পরিণত হন অনভিজ্ঞ শকুন্তলা। শকুন্তলার মধ্যে লজ্জা আছে কিন্তু বঙ্কিম বলছেন মিরান্দার মধ্যে সেই লজ্জা নেই। লজ্জা জিনিসটা সে শেখেনি। কিন্তু শকুন্তলা শিখেছে কিভাবে? বাবা ছাড়া আর কাউকে তো সে দেখেনি? তাই তাকে সখি পরিবৃত্ত করা হয়। মহাভারতে এই সখি নেই, অনসূয়া প্রিয়ংবদা নেই। এটা কালিদাস ভালোভাবেই করেছেন। আমরা শকুন্তলাকে দেখি বল্কল পরিহিতা, তখনো কাপড় পরে না। এ জিনিসগুলো দেখলে বোঝা যায় নাটকীয়তা তৈরি করার সমস্ত উপাদান কালিদাসের মধ্যে আছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, এটা নিয়ে যে রোমান্টিকতা করা হয়েছে, সেখানে শকুন্তলা একটা উপকরণ মাত্র। আমরা ব্যক্তি হিসেবে শকুন্তলাকে দেখি প্রথমে সে লজ্জা পায়, তারপরে তার যেতে ইচ্ছে করে না। কুশাগ্র দ্বারা পদতল ছিন্ন হয়েছে বলে বসে পড়ে, বল্কল লতায় লেগে গেছে বলে দাঁড়িয়ে থাকে। তারও রাজাকে দেখতে ইচ্ছে করে। অর্থাৎ তার যৌবনের বিকাশ দেখানো হচ্ছে। রাজাও এটা বুঝতে পারছেন। রাজা তো এমন হাজারো নারী বশীভূত করেছেন। তার যেমন রথ যাচ্ছে, শর যেভাবে যাচ্ছে, তার চোখের দৃষ্টিও সেভাবে যাচ্ছে। অর্থাৎ এটা হচ্ছে, অবজেক্ট ও সাবজেক্টের মধ্যে অসাম্য। শুধুমাত্র যখন পঞ্চম অঙ্কে শকুন্তলা রাজগৃহে গিয়ে পৌঁছে এবং দাবি করে রাজা তাকে বিয়ে করেছে, রাজা তখন বিয়ের প্রমাণ দেখতে চান। শকুন্তলা আংটি খুঁজতে গিয়ে দেখে, সেটি হারিয়ে গেছে। রাজা তখন বলে, নারী ছলনাময়ী। শকুন্তলা বলে রাজা যেন নিজের চরিত্রকে তার ওপর আরোপ না-করে। সারা পৃথিবীকে রাজা ঠকিয়েছে। তাই নিজের মতো শকুন্তলাকেও মনে করছে যে সে ঠকাচ্ছে। তখন ধরণী দ্বিধা হও বলে শকুন্তলা চলে যায়। ওখানে তার খানিকটা ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য এইটুকুও দেখতে পাননি। বিদ্যাসাগরকে বঙ্কিমের সঙ্গে তুলনা করলে, আবার বঙ্কিমকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি রোমান্টিক।

সলিমুল্লাহ খান বলেন, আরেকটা জিনিস কারো নজরে পড়েনি, সেটা হচ্ছে দুর্বাসার শাপটা কী? শকুন্তলা বসে ছিল বাড়িতে। দুর্বাসা একজন মুনি। তিনি সবই জানতেন। কন্ব যে তখন আশ্রমে নেই, সোমতীর্থে গিয়েছেন সেটা তিনি জানতেন। দুর্বাসা ঘরে টোকা দিলে শকুন্তলা উত্তর দেয় না। শকুন্তলার তো উত্তর দেবার কথাও না। অনসূয়া প্রিয়ংবদা সাড়া দেয়। কিন্তু ওদের সঙ্গ তো দুর্বাসা চান না। দুর্বাসার কামনার বস্তু শকুন্তলা হয়ে উঠল কি না এই কথা বঙ্কিমও জিজ্ঞেস করেননি, বিদ্যাসাগর করেছেন কিনা জানা নেই, রবীন্দ্রনাথও জিজ্ঞাসা করেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এটা প্রকৃতির একটা কৌশল মাত্র। অর্থাৎ শকুন্তলা এবং রাজা যে সীমা লঙ্ঘন করেছে পিতার অনুমতি না নিয়ে, সেটার শাস্তিস্বরূপ দুর্বাসা আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু দুর্বাসার বাসনাটা কী? দুর্বাসার দাবিটা কী? অতিথি সৎকার কথাটার অর্থ কী? এটাতো রূপক কথা। আসলে দুর্বাসা বলতে চেয়েছে, শকুন্তলা রাজাকে যে সুবিধাটুকু দিয়েছে তা তারও চাই? তার যে রেগে যাওয়া এটাই অভিশাপের মূল কারণ এবং অভিশাপ কিছুতেই তিনি মোচন করবেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার পায়ে ধরতে যায় অনসূয়া প্রিয়ংবদা। এসব রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েনি। এর কারণ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি। শকুন্তলাকে তিনি একটা অবজেক্টের বেশি দেখছেন না। শকুন্তলার যে সাবজেক্টিভিটি সেটা তিনি ভালো করে দেখছেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেন, শকুন্তলার পতনের জন্য শকুন্তলাই দায়ি অথবা প্রকৃতির সীমা লঙ্ঘনের জন্য দায়ি। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ। আরেকটি বিষয় – শকুন্তলার স্বামী কেন তাকে ভুলে গেল? রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সেখানে বলেছেন এটা দুষ্যন্তের অপরাধ। কিন্তু সেই অপরাধের জন্য দুর্বাসার শাপই দায়ি। প্রত্যাখানের কারণ রাজার স্মৃতিবিভ্রম। আমরা জানি, শকুন্তলা আংটি ছাড়াও নানা স্মৃতিকথায় রাজাকে মনে করাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আমাদের সমাজে যে স্ত্রীরা স্বামীকে আপনি সম্বোধন করে এটা কিন্তু শকুন্তলাতেও দেখতে পাই। এসবও রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েনি।

অধ্যাপক খান বলেন, শেক্সপিয়ার হচ্ছেন আধুনিক যুগের প্রারম্ভের মানুষ, এলিজাবেথের যুগের মানুষ, আমাদের দেশের সম্রাট আকবরের যুগের মানুষ। আর কালিদাস তার অন্তত দেড়হাজার যুগের আগের মানুষ। দুটো এক যুগ নয়। দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও পার্থক্য আছে। বিদ্যাসাগর কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নিয়ে যে বলেছেন এমন কীর্তি মানব সমাজে হয় না সেটা ঠিক আছে । যদি আমরা শেক্সপিয়ার না পড়তাম, যদি স্যার উইলিয়াম জোন্স না বলতেন এটা শেক্সপিয়ারের সাথে তুলনীয় তবু কি ভারতীয়রা প্রশংসা করত না? করত অবশ্যই। শেক্সপিয়ার এসে এটা ঢেকে ফেলেছেন। শেক্সপিয়ার এবং কালিদাস এক জিনিস না। উভয়ের নিজস্ব রুচি আছে। তবে এটা বলা যায়, বঙ্কিম যে বলেছেন শকুন্তলাকে বুঝতে হলে আমাদের শেক্সপিয়ারের ঐ দুই চরিত্রকে মিলিয়ে দেখলে কিছুটা সুবিধা হয় – সেটা অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ অনেক বেশি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা এই অর্থে যে, একটি চরিত্রকে বুঝতে হলে তার পরিপ্রেক্ষিতটা বুঝতে হয়। শেক্সপিয়ার টেম্পেস্টের চরিত্রদের একটা নির্জন দ্বীপে নিয়ে গেছেন কিন্তু কালিদাস নিয়েছেন তপোবনে যেখানে শকুন্তলা বেড়ে ওঠে দুই সখি, ঋষিপুত্র, পিসি গৌতমীসহ আরো অনেকের সাহচর্যে। কিন্তু টেম্পেস্ট এর গল্প যে দ্বীপে, সেখানে বাবা প্রসপ্যারো ছাড়া আর কেউ নেই।

আলোচক বলেন, শেক্সপিয়ারের নাটকের সঙ্গে কালিদাসের তুলনা অনেকে করলেও ইউরোপে কিন্তু ‘শকুন্তলা’ নাটক খুব একটা বেশি অভিনীত হয়নি। ইউরোপিয় সেন্সিবিলিটিতে এটা তেমন একটা স্পর্শ করেনি, যদিও দৃশ্যকাব্য হিসেবে অতি উচ্চমানের এটা তারা বলেছেন। এটাকে ঠিক নাটক বলা যায় না তবে কাব্য বলা যায়। বঙ্কিম বলেছেন, নাটককে দুভাবে ভাগ করা যায়। শ্রæতিকাব্য ও দৃশ্যকাব্য। ‘শকুন্তলা’কে কাব্য হিসেবে অত্যন্ত উন্নতমানের বলা যায়। বঙ্কিম বলেন – গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ নাটক না, এটা কাব্য কিংবা বায়রনের মানফ্রেড ঠিক নাটক না, কাব্য মাত্র। কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ও সেইরকমেরই। এটা বঙ্কিমের যুক্তি। এখানে চরিত্রগুলো আবেগ প্রকাশ করে কিন্তু ঘটনার সেরকম স¤প্রচার নেই। প্লট বা ঘটনাচক্র কম। কিন্তু মানুষের চরিত্র, অভিব্যক্তি অনেক গভীর অথবা গভীরতর। সেইজন্য দুটো দেশের দুই সময়ের দুই সাহিত্য তুলনা করার সময় আমাদের বিনয়ের সঙ্গে দেখা উচিৎ যে, একটা আরেকটার হুবহু প্রতিলিপি হবে না। এইজন্য বিদ্যাসাগর ঠিকই বলেছেন, ‘শকুন্তলা’ অপূর্ব পদার্থ।

‘শকুন্তলা’ সংস্কৃত নাটক ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল’ থেকে অনূদিত, আমরা জানি। অধ্যাপক খান বলেন, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত বিদ্যাপাঠের গুরুত্ব নিয়ে বলেছেন। ১৮১৬-১৭ সালে যখন হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয় ইংরেজি শিক্ষাকে বিধিবদ্ধ রূপ দেওয়ার জন্য, তার আগেই কিন্তু মানুষ ওয়ার্ডবুক দিয়ে ইংরেজি পড়া শুরু করেছিল। ইংরেজরা যখন কোলকাতায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে তখন কাজের প্রয়োজনেই ইংরেজি শেখার হিড়িক পড়ে যায়। সেটি সংহত করার জন্য হিন্দু কলেজ হয়। রামমোহনকে কমিটিতে রাখা হয়নি তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের জন্য। পরে যখন সংস্কৃত কলেজের প্রস্তাব আসে তখন বড়লাট আর্মহার্স্টকে একটা চিঠিতে রামমোহন লিখেছিলেন সংস্কৃত কলেজ করে পয়সা নষ্ট না-করতে। আরবি, সংস্কৃত পড়ার দরকার নেই। ইংরেজি পড়তে হবে। অর্থাৎ হিন্দু কলেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুযোগ না পেয়েও রামমোহন ইংরেজি শেখার জন্য আলাদা স্কুল করেছেন। তিনি নিজে সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন, গ্রিক-হিব্রæসহ ৯-১০টি ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। ওদিকে বিদ্যাসাগর নিজেও সংস্কৃত শিখেছেন, ইংরেজি শিখেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলা আগে না শিখে ইংরেজি শেখাটা ঠিক হবে না। কিন্তু সংস্কৃত আমাদের শিখতে হবে কেন? কারণ সংস্কৃত ছাড়া বাংলা হিন্দির মতো ভাষা উন্নত করা যাবে না ইংরেজির চ্যালেঞ্জের সামনে। কেন সংস্কৃত পড়া দরকার তার কারণের মধ্যে তিনি ৪টি কারণ উল্লেখ করেছেন। চতুর্থ কারণটা হলো, সাহিত্য সাহিত্যের জন্য। ইউরোপিয় ফিলোলজির কারণে আমরা সংস্কৃত ভাষাকে পুনরাবিষ্কার করেছি। এটা এক নম্বরে, যখন জানলাম যে সংস্কৃত ল্যাটিন এবং ফারসির মত ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা। সংস্কৃত যদি না শিখতেন ইউরোপিয় পণ্ডিতেরা তাহলে এই আবিষ্কারটি হতো না। সুতরাং সংস্কৃত শেখার একটা নগদ লাভ হলো, পৃথিবীতে যেটা বলি কম্পারেটিভ লিংগুইস্টিক্স তখন বলত ফিলোলজি বা শব্দবিদ্যা ওটা আবিষ্কৃত হতো না। এটা এক নম্বর লাভ। দুই নম্বর লাভ হলো ইংরেজি এসেছিল ভারতে। কিন্তু তার সামনে আমাদের হিন্দি বাংলা এগুলোকে বিকশিত করতে সংস্কৃত ছাড়া উপায় ছিল না। অর্থাৎ বাঙালি পণ্ডিতদের ইংরেজির সাথে লড়তে হলে সংস্কৃততে শক্তিশালী হতে হবে, যেমন বিজ্ঞানের পরিভাষা আবিষ্কার করতে হবে। তিন নম্বর হচ্ছে ‘পূর্বকালীন লোকদিগের আচার ব্যবহার রীতি নীতি ধর্ম উপাসনা ও বুদ্ধির গতি প্রভৃতি বিষয় সকল মনুষ্যের অবশ্যজ্ঞেয়। ইহা বোধহয় সকলেই অঙ্গীকার করিয়া থাকেন।’ আমরা জানি, সংস্কৃতে ইতিহাস বই নেই। একমাত্র কাশ্মীরের কলহনের লেখা রাজতরঙ্গিনী যেটা খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে লিখিত অর্থাৎ আজ থেকে ৮০০-৯০০ বছর আগে সেটি ছাড়া। তারপরও সংস্কৃত কেন পড়ব? কারণ ভাষার মধ্যে, সাহিত্যের মধ্যে মানুষের লোকাচার, রীতি, ধর্ম, উপদেশ এইসব পাওয়া যায়। ইতিহাস না, পুরাণ আছে আমাদের। এই পুরাণই আমাদের ইতিহাস। এইজন্য সংস্কৃত জানা দরকার। তাহলে দাঁড়ালো, প্রথমত শব্দবিদ্যার জন্য সংস্কৃত শেখা দরকার। দ্বিতীয়ত আমাদের বাংলা হিন্দি প্রভৃতি আধুনিক ভাষাকে উন্নত করার জন্য সংস্কৃত শেখা দরকার। তৃতীয়ত ইতিহাসের ঘাটতি মেটাবার জন্য, প্রাচীনকাল সম্পর্কে জানার জন্য সংস্কৃত শেখা দরকার। সংস্কৃত সাহিত্যের অজস্র বই আছে। চতুর্থ কারন – ‘যাবতীয় সাহিত্যশাস্ত্রের অনুশীলনে যে আমোদ যে উপকার ও যে উপদেশ লাভ হইয়া থাকে, সংস্কৃত সাহিত্য সেই আমোদ, সেই উপকার এবং সেই উপদেশ প্রদানে অসমর্থ নহে।’
সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘শকুন্তলা’ রবীন্দ্রনাথের যুগে যেই রোমান্টিক চরিত্র ধারণ করেছে, সেটা বঙ্কিমের যুগেও ছিল, আর শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুগে। উদ্দেশ্য – সাহিত্যের জন্য সাহিত্য। এটা হচ্ছে সাহিত্যের প্রথম পদক্ষেপ। দেশে বিদ্যাচর্চা কমে গেলে কী হয় সেটা বুঝতে যদি ইউরোপের দিকে তাকাই তাহলে দেখি, তাদের মধ্যেও একসময় গ্রিক ভাষার সঙ্গে সম্পর্কটা কমে গিয়েছিল। পরে ব্যবসা বাণিজ্যের বৃদ্ধি বা আরবদের সঙ্গে সংযোগ যে কারণেই হোক তাদের মধ্যে আবার জানবার প্রেরণা জাগে। ভারতবর্ষেও ইংরেজরা এসেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র শেক্সপিয়ার এবং গ্যেটের উদাহরণ দিয়ে যে আমরা ‘শকুন্তলা’য় আগ্রহী হয়েছি এটা বলাটা কৃপণের মতো হবে।

আলোচক বলেন, বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন শকুন্তলা একজন নারী এবং শেষ পর্যন্ত সে রিভিন্ডিকেটেড হয়েছে অর্থাৎ তার স্বামী কর্তৃক সে স্বীকৃতি পেয়েছে। মহাভারতের মতো না। মহাভারতে দৈববাণী লেগেছে। মহাভারতে রাজাকে জিজ্ঞেস করা হয় তুমি তোমার স্ত্রীকে প্রথমে গ্রহণ করো নাই কেন? রাজা বলে, লোকে বিশ্বাস করত না। ছয় বছরের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলে লোকে বিশ্বাস করত না যে শকুন্তলা আমার স্ত্রী। দেশবাসীকে তো আমার বোঝাতে হবে। সীতার অগ্নিপরীক্ষাও একই কারণে হয়েছিল। রাবণ সীতাকে নিয়ে বন্দি করে রাখার পরও যে সীতা পবিত্র ছিল সেটার প্রমাণ দিতে হয়েছে। তাকে আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে। সীতা এসেছে নি¤œ শ্রেণি থেকে। যদিও পরে সীতাকে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। শকুন্তলার জন্ম খেয়াল করলে দেখা যায় শকুন্তলা ঋষিকন্যা কিন্তু ঋষি কর্তৃক পরিত্যক্তাও বটে। সে মেনকার মেয়ে। মেনকা মানে অপ্সরা। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিম বলেছেন, শকুন্তলা অপ্সরা-রক্ষিতা কিন্তু অপ্সরা মানে তো গণিকাই, যদিও আমরা এতে দেবত্ব আরোপ করতে পারি। শকুন্তলাকে উপস্থাপনই করা হয়েছে অনভিজাত মেয়ে হিসেবে। কন্ব তো তার পিতা না। শকুন্তলা তাকে ডাকে তাত মানে কাকা। এসব কথা খেয়াল করলে দেখা যায়, শকুন্তলা অনসূয়া প্রিয়ংবদা জেলেরা সেখানে কথা বলে অদেব ভাষায়।

সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিদ্যাসাগর শিক্ষক হিসেবে জন্মেছিলেন এবং তাঁর সমস্ত লেখা শিক্ষার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর ও লেখক বিদ্যাসাগরের যে যোগসূত্র সে সম্পর্কে তিনি বলেন, বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার বহুল আলোচিত। কিন্তু সেই সমাজ সংস্কারের কারণে তিনি তাঁর স্বজাতির দ্বারা খুব একটা অভিনন্দিত হননি। ইংরেজ শাসনের কল্যাণে তাঁর কিছু প্রয়াস সফল হয়েছে। তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ইংরেজদের চাকরি ছেড়ে দেন। জীবনের শেষ অনেকগুলো বছর তিনি বঙ্গদেশ ছেড়ে কর্মাটারের সাঁওতাল পল্লীতে জীবন কাটান। তিনি বাঙালিদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও অপমানিত হয়েছেন। সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে তিনি আঘাত পেয়েছেন। বর্ণ হিন্দুদের অভিশাপও তিনি কুড়িয়েছেন। তিনি তাঁর অধিকাংশ কাজগুলোই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। একপর্যায়ে বিদ্যাসাগর সাহিত্যচর্চাকে গ্রহণ করেছেন সমাজ সংস্কারের মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু আমরা যদি সাহিত্যকে শুধু সমাজ সংস্কারের মাধ্যম হিসেবেই দেখি তাহলে সাহিত্যকে বড়ো সংকীর্ণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সাড়ে তিন হাত দেহের জন্য যেমন সাড়ে তিন হাত ঘর যথেষ্ট নয়, তেমনি সাহিত্য শুধুই সমাজ সংস্কারের জন্য নয়। ‘জীবনচরিত’, ‘চরিতাবলী’তে ইউরোপিয় মহা মনীষীদের জীবনী তিনি লিখেছেন। কেন লিখেছেন? শিশুদের উপকারের জন্য, তারা যাতে এমন হয় সেজন্য। ‘কথামালা’ লিখেছেন। এসব তিনি নিজের প্রতিভা জাহিরের জন্য লিখেননি। বাংলা ভাষার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা বিশেষ করে নিচের স্তরে বাড়ানোর জন্য লিখেছেন। অনেকে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ব্যাপৃত। ঐতিহাসিকভাবে সেটাই করণীয় ছিল।

বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারকে দুই এলাকায় ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে হিন্দু সমাজের সংস্কার। বাল্যবিবাহ নিরোধ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন। ‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে তিনি বিধবা বিয়ের পক্ষে যা লিখেছেন তা খুবই সাহসী এবং তার আবেদন অসাধারণ। যে বছরে তিনি ‘শকুন্তলা’ অনুবাদ করেন সেই বছরেই তিনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তার ৩ বছর পরেই তৎকালীন ইংরেজ সরকার বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন করে। এ পর্যায়ে সঞ্চালক সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা সিরিজের ‘শকুন্তলা’র ভূমিকায় সম্পাদক আনিসুজ্জামানকে উদ্ধৃত করে পাঠ করেন – ‘নারী দুঃখকাতর যে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য এবং বহুবিবাহ রহিত করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আন্দোলন করেছিলেন সেই বিদ্যাসাগরই আরেক ভাগ্যাহতা নারীর আলেখ্য রচনায় এখানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। যে নারী জন্মসময়ে জননী কর্তৃক পরিত্যক্তা এবং গর্ভবতী অবস্থায় স্বামী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা, নিজের অদৃষ্ট ছাড়া আর কাউকে যে নিজের মন্দ ভাগ্যের জন্য দায়ি করতে পারে না। শকুন্তলা তেমন নারীর বৃত্তান্ত।’ আলোচক বলেন, কাজেই এটা বিদ্যাসাগর প্যাশন ছিল বলা যায়। কিন্তু তাঁর প্যাশন এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনসাধারণের মধ্যে যে সাধারণ কুসংস্কার আছে সেটা দূর করতে হলে বিদ্যা বিস্তার করা দরকার। অথচ এখনও আমাদের সেই উপলব্ধি আসেনি যে, একমাত্র দেশীয় ভাষার মাধ্যমে যদি দেশের শিক্ষা বিস্তার না হয় শিক্ষাবিস্তার কখনোই হবে না। ইংরেজরা আসার আগে মুঘল আমলে সারা ভারতবর্ষে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগেরও কম ছিল। ইংরেজরা দুশো বছর থেকে যাওয়ার পর এটা শতকরা ৬ ভাগের বেশি হয়নি। কাজেই ইংরেজ শাসনে যে আমরা ‘আধুনিক’ হয়েছি বলি এটা অনেকটাই কল্পনামিশ্রিত।

এই পর্যায়ে বিদ্যাসাগরের বিচিত্র গদ্যরীতি, বাংলা ভাষাকে সাহিত্য পদবাচ্য করে তোলা ও বাংলা ভাষায় তাঁর সার্বিক অবদান নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচক বলেন, বিদ্যাসাগরের অবদান বলতে গেলে তাঁর গদ্যগুলো আলোচনা করা দরকার। আখ্যানমঞ্জরী, জীবনচরিত, চরিতাবলী, কথামালা ইত্যাদি। এই যে আমরা ঈশপের গল্পগুলো এখন বাচ্চাদের পড়াই এগুলো কিন্তু বিদ্যাসাগর কষ্ট করে বাচ্চাদের জন্য লিখেছেন। তাঁর বর্ণপরিচয় অসাধারণ ভালো বই। বাংলা ভাষার ব্যাকরণটা তিনি ভালোভাবে বুঝেছিলেন। বর্ণপরিচয়ে উদাহরণ সহ যেই বাক্যগুলো লিখেছেন সেগুলো অপূর্ব। ‘শকুন্তলা’ ছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়ার থেকে ভ্রান্তিবিলাস, হিন্দি থেকে বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদি। বিতর্কমূলক প্রবন্ধ ব্রজবিলাসে রসিকতা করেছেন। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা সংস্কার করেছেন, বাংলা গদ্য নির্মাণ করেছেন। এর আগে যে রাজা রামমোহন বাংলা গদ্য লিখেছেন সেটাও খারাপ না। রামমোহন রায়ের বাংলা ব্যাকরণ এখনো পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাকরণ। কিন্তু বিদ্যাসাগর বাচ্চাদের শেখানোর জন্য অসাধারণ কাজ করেছেন। রামমোহনের গদ্যে কমা বেশি ছিল না, দাঁড়ি ছিল। আগে পয়ারে দাঁড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। বিদ্যাসাগর কমাটা চালু করেছেন বেশি এবং ড্যাশও চালু করেছেন। এখন যদিও বাংলায় অত বেশি কমার ব্যবহার নেই। তিনি যুক্তিযুক্তভাবে ‘কী’ ব্যবহার করেননি, যেমন করেননি বঙ্কিম, মাইকেল, দেবেন্দ্রনাথও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ করেছেন। বিদ্যাসাগর নিরেট শব্দকে অনিরেট করেছেন বাচ্চাদের সুবিধার জন্য। তিনি অবশ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন আত্মস্থ করতে পারেননি। বর্ণপরিচয়ে বাচ্চাদের জন্য খুব সহজ করে বাক্য লিখেছেন তিনি। বর্ণপরিচয়ে বিদ্যাসাগরের সহজতম গদ্য পাই কিন্তু বিষয় যখন বড়ো হয়েছে তখন অন্য গদ্য লিখেছেন। বলা দরকার, ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতদের হাতে তৈরি গদ্য হয়ত অবিকশিত ছিল। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়রা ১৮০৫ সালের দিকেই বই লিখেছেন, সিরাজউদ্দোলার ওপর বই লিখেছেন। বাংলা গদ্য পায়ে পায়ে যে হাঁটছিল সেটা তো সত্য কথাই। কিন্তু তাঁদের আদর্শ ছিল দুই রকমের। কতগুলো ছিল ফারসিবহুল গদ্য, যেমন মুন্সিরা যেগুলো লিখতেন কারণ ফারসি তখন ছিল হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভদ্রলোকের ভাষা। আবার ওদিকে ইংরেজি শেখা লোকেরা লিখেছেন সংস্কৃত আশ্রয় করে। রামমোহনের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ বাংলায় লেখা হতো। ছিল নববাবু বিলাস, নববিবি বিলাসের মত ব্যাঙ্গাত্মক রচনা। বিদ্যাসাগর এগুলো এবং অন্যান্য রচনার ওপর ভিত্তি করেই ১৮৪৭ সালে ২৭ বছর বয়সে অনুবাদ করেন বেতাল পঞ্চবিংশতি। বিদ্যাসাগরের মত একজন সংস্কৃত পণ্ডিত কীভাবে এত চমৎকার বাংলা লিখেছেন সেটাই অভাবনীয়। সংস্কৃত থেকে শুধু না, তিনি দেশের মানুষকে অন্তর দিয়ে পাঠ করে সেই বোধ থেকে লিখেছেন। এর এক বছর পর তিনি মার্শম্যানের ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন ‘বাঙালার ইতিহাস’। সেই গদ্যও প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে। তিনি শুধু ফারসি না, লোকের মুখের শব্দ ব্যবহার করেছেন অজস্র। আমরা দেখি, ‘শকুন্তলা’র গদ্যরীতিও একটা অন্তর্নিহিত ছন্দ অর্জন করেছে। এ পর্যায়ে আলোচক ‘শকুন্তলা’র কয়েকটি জায়গা থেকে পাঠ করে উপাখ্যানটির অনবদ্য গদ্যশৈলীর ব্যাখ্যা দেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির যে রেনেসাঁস, বিদ্যাসাগর সেখানে একটা অন্যতম চরিত্র। প্রথমে রামমোহন, এরপর বিদ্যাসাগর, এরপর বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ। আলোচক বলেন, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর এঁদের বাদ দিলে আমরা গরীব হয়ে যাব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদের স্কুল কলেজে বিদ্যাসাগরের রচনা না পড়ে উপায় নাই যদি আমরা বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করাতে চাই। বিদ্যাসাগরের মতো মানুষ তৈরি করাটাই আমাদের কর্তব্য, যিনি আমাদের দেশের ভাষাটায় দক্ষ কিন্তু বিদেশি ভাষাও জানেন। আমাদের বিদ্যার আদর্শ এটাই হওয়া উচিৎ ছিল। বিদেশি ভাষা শিক্ষারও বিকল্প নাই। কিন্তু সেই আহরিত জ্ঞান যদি নিজ ভাষায় প্রকাশ-সংকলন করা না-যায় তাহলে বিদ্যার্জনই বৃথা। বিদ্যাসাগর শিক্ষক হিসেবে আমাদের যা দেখিয়েছেন সেটা আদর্শস্বরূপ। তাঁকে শুধুমাত্র গল্পকার হিসেবে দেখলে অন্যায় হবে।

আলোচক সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিদ্যাসাগরও মানবিক ত্রæটির ঊর্ধ্বে নন কিন্তু বাংলা গদ্য গঠনের যুগে, রামমোহন-ভবানীচরণ এঁদের পরের যুগে বিদ্যাসাগরের যে সাহিত্যকীর্তি, দ্বিতীয়ত শিক্ষক হিসেবে তাঁর কীর্তি, তৃতীয়ত সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর কীর্তি – এসব যেন আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

বিদ্যাসাগরের কর্মযজ্ঞ অন্তহীন। কোনো বিশেষণ দিয়েই তাঁকে পুরোপুরি ধরা যায় না? বিদ্যাসাগরের সামাজিক ভূমিকা, গদ্য, ব্যক্তিগত জীবন এসব নিয়েই সমগ্রভাবে বিশাল আলোচনার অবকাশ আছে। সেই অবকাশের মধ্য থেকে ১৮৫৪ সালে রচিত বিদ্যাসাগরের কেবল একটি সাহিত্যকর্ম ‘শকুন্তলা’ বেছে নেওয়া হয়েছে পাঠশালার এই আসরে। তবে ‘শকুন্তলা’র আলোচনার পাশাপাশি বাংলা গদ্য, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে পথিকৃতের কাজ করেছিলেন, সেই কাজগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাও উঠে এসেছে আলোচক সলিমুল্লাহ খানের আলোচনায়। মূল আলোচনার পাশাপাশি তিনি শ্রোতা-দর্শকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাগ্মীতায়।

বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ, গভীর, সরস আলোচনা দর্শক-শ্রোতারা ভীষণ উপভোগ করেন এবং শ্রোতারা প্রশ্ন-মন্তব্য করে সক্রিয় ছিলেন আলোচনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এই আসরের পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।