ভজন সরকার: (১)
এক সময় অনুতাপ হতো অনেক কিছুতেই। ঈর্ষা হতো অনেককেই। আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম তার পরিচিত এক মহিলা যতবার বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনকে দেখতেন, ততবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে কান্না করতেন।

গল্পটা শুনে আমার মনে হয়েছিল গ্রীক মিথোলজির নার্সিসাসের কথা। নার্সিসাস ছিলেন অনিন্দ্য দেহ শৌষ্ঠবের অধিকারী। একদিন জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নার্সিসাস এমন বিমোহিত হলেন যে, তিনি তাঁর জীবনের বাকী সময় নিজেকে দেখেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই কত চিত্র, কত গল্প-কবিতা-সাহিত্য নার্সিসাসকে নিয়ে রচিত হয়েছে সারা বিশ্বে। বাংলাতেও ‘নার্সিসাস সুখ’ ব’লে আত্ম-সুখে বিমোহিত সুখকে বোঝানো হয়ে থাকে।
নার্সিসাসের বিপরীতেও কিছু তত্ত¡ আছে, যা থেকেই হয়ত ঈর্ষা কিংবা পরশ্রীকাতরতা শব্দগুলোর উত্পত্তি হয়েছে। ওই যে ভদ্রমহিলা যিনি নায়িকা সুচিত্রা সেনকে দেখে প্রতিবার নিজে পরশ্রীকাতরতায় ভুগেন, প্রতিবার ভেঙে পড়েন, তাঁর বেলায় গ্রীক মিথোলজির নার্সিসাস কাহিনি একেবারেই অকার্যকর।

তবে এটাও তো সত্যি যে, প্রতিটি মানুষ নিজেকেই বেশী ভালোবাসে। প্রতিটি মানুষ নিজের অবচেতনেই নিজের সব কিছুতেই এক ধরনের সান্ত¡না খুঁজে নেন। নিজের বাড়িটা, নিজের গাড়িটা, নিজের ছেলে-মেয়েগুলো, নিজের চাকুরী, নিজের ব্যবসা-বানিজ্য-পেশা সব কিছুতেই এক ধরনের আত্মতৃপ্তি খুঁজে নেন। তা না হ’লে কিছুতেই মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না।

যদিও মানুষ উপরে উপরে দেখায় যে, সে কিছুতেই সুখী নয়। “ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস”- কথাটির গভীরে লুকিয়ে আছে এক ধরনের অবিমৃশ্যকারীতা বা হঠকারীতা। কারণ, কোনো মানুষই সারাজীবন অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। আর সেই জন্যেই হয়ত সব দুঃখের সাথে মিশে থাকে কিয়দংশ সুখ কিংবা সুখের আভাষ। অতীত ভুলে বর্তমানকে সাথে নিয়ে প্রতিটি মানুষ তাই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন, প্রতিটি মানুষ প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহ করেন। হ্যা, এটাও এক প্রকারের নার্সিসিজমই বটে।

(২)
২০২০-২০২১ বছর দু’টো ‘করোনা’- সংক্রমিত হয়েই রইল। কত মানুষের কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা এ সময় স্থবির হয়ে গেল। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের বিশ্বভ্রমণের সব পরিকল্পনা থেমে গেল ব’লে কী হাহাকার! ওদিন তিনি কথায় কথায় বলছিলেন, তাঁর ঈর্ষার কথা; তাঁরই আরেক সহকর্মী দু’বছর আগে অবসরে গিয়ে কীভাবে সারাবিশ্ব ঘুরে বেড়ালেন সে কথা।

হঠাত করেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে মানুষ বিশ্বভ্রমণে যায়, তা দেখে তোমার ঈর্ষা হয় না?
আমি নির্বিকার কন্ঠে বললাম, না, হয় না। তবে আমার ঈর্ষা হয় মাত্র ২৪ জন মানুষকে।
ভদ্রলোক একটু হতচকিত হয়ে গেলেন। আমি বললাম, বুঝলেন না তো। ২৪ জন মানুষ চাঁদে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে ১২ জন চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রেখেছিলেন। আমার খুব ঈর্ষা হয় এই ২৪ জন মানুষকে। সৌরজগতের (এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের) একমাত্র অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রহ পৃথিবীকে এত দূর থেকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সাফল্যকে আমি শুধুমাত্র ঈর্ষা করি।

ভদ্রলোক কতটুকু বুঝলেন আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, আমি ওই সৌভাগ্যবান ২৪ জন মানুষকেই কেবল ঈর্ষা করি বিশেষকরে ভ্রমণ বা পরিব্রাজনের জন্য তো অবশ্যই। ইচ্ছে করে ওঁদের দৃষ্টিতে দেখতে আমাদের এ পৃথিবীকে। নাসার একটি ছবি দেখে ওদিন আমি হতবিহবল হয়ে বসে ছিলাম; চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর উদয় এবং অস্তের ছবি। চন্দ্রের ধূসর কালচে পৃষ্ঠ থেকে চকচকে নীলের এক বলয়, যা পৃথিবীর ৭০ ভাগ জলপৃষ্ঠের ছবি। ওই দৃশ্য দেখার পর পৃথিবীর আর সব সৌন্দর্যকেই অবজ্ঞা করা যায় অনায়াসে।

১৯৬৮ সালে ২৪ ডিসেম্বর ‘এপলো- ৮’ থেকে নভোচারী বিল এন্ডারস এই অপূর্ব ছবিটি পাঠিয়েছিলেন। ‘এপলো-৮’ চাঁদের অক্ষপথে ঘুরছিল। আর সেখান থেকেই সূর্যোদয়ের মতো পৃথিবী-উদয়ের এক অনন্য সুন্দর দৃশ্য দেখে তিনি সাথে সাথেই সেটা ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। এর পরে চাঁদের অক্ষপথ থেকে আরও রঙ-বৈচিত্রময় পৃথিবী-উদয়ের ছবি তোলা হয়েছে। কিন্তু বিল এন্ডারসের ওই ছবিটিই ছিল প্রথম তোলা পৃথিবীর অনিন্দসুন্দর ফটোগ্রাফ।

প্রচন্ড ধর্মভীরু বিল এন্ডারসের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মভাবনাই পরে বদলে গিয়েছিল মহাবিশ্বের এ বিস্ময় দেখে। বাকী জীবন তিনি এই অসাধারণ সুন্দর পৃথিবীর প্রকৃতিকে রক্ষা করতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বিপুল মহাবিশ্বের মধ্যে আমাদের এই পৃথিবীই কেবলমাত্র এতো সবুজ, সতেজ এবং বিবিধ রঙ-বৈচিত্রে ভরা। তাই নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই পৃথিবীর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে রক্ষা করার কথা বিল এন্ডারস আজীবন বলে যাচ্ছেন।
আসলেই তো মহাবিশ্ব এক মহাবিস্ময়। আর সে মহাবিস্ময়ের মাত্র কণামাত্র আমাদের সৌরমন্ডল। এই সৌরমন্ডলেও আছে অসংখ্য মহাবিস্ময়। সৌরমন্ডলের তেমনি এক মহাবিস্ময় চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায় তাঁর চলচ্চিত্র ‘আগন্তক’-এ সুন্দর ও সহজ ভাবে তুলে ধরেন। অনেকের মতেই ‘আগন্তক’ চলচ্চিত্রটি সত্যজিতের সমাজ সচেতন নির্মাণের মধ্যে অন্যতম। সত্যজিত রায় ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালি’ নির্মাণ করেন। এর পরের প্রায় সাড়ে তিন দশক অসংখ্য বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তাঁর হাতে। নব্বই দশকের প্রথম দিকে পরপর তিনটি চলচ্চিত্র ‘গনশত্রু (১৯৯০)’, ‘শাখাপ্রশাখা (১৯৯২)’ এবং ‘ আগন্তুক (১৯৯২)’ নির্মাণ করেন তিনি। সত্যজিতের শেষের এ তিনটি সিনেমার প্রত্যেকটিই সমাজ সচেতনামূলক। এদের মধ্যে ‘আগন্তুক’ সিনেমাটি ব্যতিক্রমি ও সাহসী নির্মাণ বিভিন্ন কারণে।
‘আগন্তুক’-এর অন্যতম চরিত্র মনমোহন মিত্র এক ভ্রমণপিপাসু প্রথাবিরোধী আধুনিক মানুষ। প্রচলিত বিশ্বাস, ধর্ম, ঈশ্বরভাবনাসহ সব কিছুই নির্মোহ যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। সত্যজিত রায় তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মনমোহন মিত্রকে দিয়ে ইস্কুল পড়ুয়া বালকদের সহজ ভাষায় মহাবিশ্বের এক বিস্ময় বর্ণনা করিয়েছেন। সে বিস্ময়টি হলো পৃথিবী, চন্দ্র এবং সূর্যের দূরত্ব, আকার ও আকৃতি।

আমরা জানি, খোলা চোখে পৃথিবী থেকে পূর্ণচন্দ্র ও সূর্যকে একই আকৃতির দেখায়। যদিও সূর্য, পৃথিবী ও চন্দ্রের আকৃতির ব্যবধান অনেক। মোটামুটি হিসেবে পৃথিবীর ব্যাস প্রায় ১২,৭৪২ কিলোমিটার, চন্দ্রের মাত্র ৩,৪৭৪ কিলোমিটার আর সূর্যের ১৪ লক্ষ কিলোমিটার। (ছবিতে বিস্তারিত)। আর পৃথিবী থেকে চন্দ্রের দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটার আর সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১,৫০০ লক্ষ কিলোমিটার। সে হিসেবে চন্দ্রের তুলনায় সূর্যের আয়তন ৪০০ গুন বেশী। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও চন্দ্রের চেয়ে ৪০০ গুন বেশী।

অথচ পৃথিবী থেকে চন্দ্র ও সূর্যকে একই আকৃতির চাকতির মতো দেখায়। তাই তো পূর্ণচন্দ্র ও পূর্ণসূর্য গ্রহনের সময় পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য এ তিন চাকতি পারস্পারিকভাবে একে অপরের উপর চাকতিচাকতি বসে যায়।

আর এটাই প্রকৃতির মহাবিস্ময়। যদিও এ মহাবিস্ময় আর তেমনটি থাকবে না। কারণ, মহাকাশবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, পৃথিবী থেকে চাঁদ ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো পৃথিবী থেকে গোলাকার চাঁদকে কালেকালে ক্রমশ ছোটো আকারে দেখাবে। তাই পূর্ণ গ্রহনের সময়ও চাঁদের চাকতি সূর্যের চাকতিকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলতে পারবে না।
কিন্তু এই ‘ক্রমশ কাল’ বিষয়টি কতো? এটাও এক কঠিন প্রশ্ন এবং মহাবিস্ময়। কারণ, সূর্যের বয়স ৪.৬০৩ বিলিয়ন বছর। আমাদের পৃথিবীর বয়স ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর। আর স¤প্রতি বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর পরে চাঁদের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সাথে মংগল গ্রহের সমান আকারের এক বিশাল বস্তুর সংঘর্ষে। সে হিসেবে চাঁদের বয়স ৪.৫১ বিলিয়ন বছর মাত্র।

সময়ের হিসেবটি যখন লক্ষ-কোটি বা মিলিয়ন-বিলিয়ন বছরের, মানুষের এ স্বল্পতম জীবনকালে চাঁদ ও সূর্যকে একই আকৃতির দেখার সম্ভাবনাও তাই প্রায় নিশ্চিত। নিশ্চিত তাই পূর্ণচন্দ্র এবং পূর্ণসূর্য গ্রহন প্রত্যক্ষ করাও।

মহাকাল সাপেক্ষে মানুষের জীবন নিমেষমাত্র। আর এই নিমেষমাত্র জীবন নিয়ে মানুষের কতো কীর্তি! কতো সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, পাওয়া বা না-পাওয়ার কাব্যগাঁথা! নার্সিসাস সুখ তো আছেই, সেই সাথে আছে ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতাও। এসব কিছু নিয়েই আমাদের জীবন। এসব কিছু নিয়েই আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবী। রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দর করে এ অনিত্যকে বর্ণনা করেছেন “ অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে”।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)