হাসান গোর্কি : আল্পসের পাদদেশে পর্বতের গায়ে সবুজ লতাগুল্মে ঢাকা একটা গুহায় বাস করে সিংহ দম্পতি: জুনু-জিয়ানা। তাদের একমাত্র সন্তান জুম্মাম। জুম্মামের ছোট দুইবোন ছিল। জন্মের দুইদিন পর নেকড়ের দল তাদের ধরে নিয়ে গেছে। এক ভাই মারা গেছে মড়কে।

একদিন সন্ধ্যায় পূবের আকাশ জুড়ে রুপালি আলো ছড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। জুনু জুম্মামকে বলল, “আজ তুমি আর আমি এই পাহাড়ের শেষ প্রান্তটা দেখতে যাবো। সেখান থেকে পৃথিবীর শেষটা দেখা যায়।” উঁচু পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে তারা শেষ প্রান্তে পৌঁছুল।
বড় থালার মত স্বর্ণাভ চাঁদের দিকে মুখ করে একটা সমতল পাথরের ওপর পাশাপাশি বসল তারা। সামনে আদিগন্ত জ্যোৎস্নার সমুদ্র পেরিয়ে যে অস্পষ্ট কালচে পাহাড়ের রেখা দেখা যায় সেটাকে দেখিয়ে জুনু বলল,
“ঐ পাহাড়ে থাকত আমাদের পূর্ব পুরুষরা। এরপর পৃথিবীর শেষ। একবার খরায় সব উদ্ভিদ মরে যায়, জলাধারের জল শুকিয়ে যায়, হরিণ- শুকর- খরগোশের দল খাদ্য না পেয়ে অন্য কোথাও চলে যায়। তোমার প্রপিতামহর প্রপিতামহর পিতামহ ছিলেন গোত্রপতি। তিনি সবাইকে বললেন, ‘আমরা ঐ পাহাড়টিতে যাবো। সেখানে জলাধার আছে, হরিণ আছে, খরগোশ আছে। আর পাহাড়ের গায়ে আছে অনেক খাদ যা শীত ও বর্ষা থেকে আমাদের বাঁচাবে। সবাই তার কথায় বিশ্বাস করে এখানে চলে এলো। তারপর থেকে আমরা এখানে আছি।

আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি আমার শেষ কথাগুলো বলতে। তুমি দেখেছ আমার শরীরের মাংস-পেশীতে ভাঙন ধরেছে। তোমার শিকার করা মাংস আমি খাই। তুমি ঐ সন্ধ্যা তারাটির দিকে তাকিয়ে দেখো। সে ছিল আমাদের আদি পিতা। সে মৃত্যুর পর আকাশে চলে গেছে। অন্য যে তারাগুলো দেখছ, তারাও আমাদের পূর্ব-পুরুষ। তারা সবাই দেখেছে আমরা কি অসীম শৌর্যের সাথে বংশ পরম্পরায় তাদের ধরে রেখেছি। শিকারের কাজে তোমার কৌশল ও সাহসিকতায় আমি মুগ্ধ। আমি জানি তুমি তোমার পূর্ব পুরুষদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তোমার দায়িত্ব দিয়ে যাবে।”

শুক্ল পক্ষের শেষ দিনের প্রোজ্জ্বল চাঁদটা ততক্ষণে জুনু-জুম্মামের মাথার ওপরে উঠে এসেছে। আটলান্টিকের সীমানা পেরিয়ে সহস্র-কোটি বছর ধরে যে বায়ু আল্পসের উপত্যকায় বয়ে চলেছে তার একটা প্রবাহ এসে তাদের শীতলতা দিয়ে গেল। সদ্য যৌবনে পৌঁছা সুঠাম শরীরের জুম্মাম বলল, “আপনি মহান। ঝুঁকি নিয়ে আপনি গোত্রের সবার জন্য শিকার ধরে নিয়ে এসেছেন, সবার নিরাপত্তা দেখেছেন। আমি নিশ্চিত করছি আপনার যা কিছু আমি ধারণ করি তার সবটুকু আমার সন্তানদের দিয়ে যাবো।”

এরপর তারা ধীর পায়ে গুহায় ফিরে এলো। দেখল, সারাদিন শিকারের পেছনে ছুটে ক্লান্ত মা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
গল্পটা আমি পড়েছিলাম বাবুদের জন্য লেখা একটা জর্জিয়ান রূপকথার বইয়ে। এবার তাহলে আমরা কীভাবে মৃত্যুর পর ভূমন্ডলের একটা কোথাও থেকে যাবো তার জন্য একটা রুপকথা তৈরি করা যাক:
“শিলার খুব জানতে ইচ্ছে করল মরে যাবার পর কী ঘটে? আমরা কোথায় যাই? পৃথিবীর সমুদ্র, পাহাড়, বনানী, মরুভুমি, প্রান্তর-তেপান্তর জুড়ে বা অনন্ত নক্ষত্ররাজি, গ্রহ, গ্রহাণুসজ্জিত এই মহাবিশ্বের কোন এক কোণে কি আমাদের জায়গা হবে না! ডেভিড বø্যাককে এটা জিজ্ঞাসা করা যায়।

শিলার মিডিয়া এনালাইসিস কোর্সের ইনসট্রাক্টর ডেভিড। সব কিছুর একটা সমাধান আছে তার কাছে। সমাধানগুলো ভুল না শুদ্ধ সেটা জানা সহজ নয়; কিন্তু আপাত সন্তুষ্টির জন্য যথেষ্ট। শিলা তার পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা ডেভিড বলো তো, যে জীবন এতক্ষণ স্থায়ী, যা আমাদের প্রতি মুহূর্তে বিলুপ্তির দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমরা ঠিক আগের মুহূর্তের আনন্দ বেদনার কোনটিকেই ছুঁতে পারছি না- সেটাকে বহন করার যথার্থতা কী?
এই অদ্ভুত ও আকস্মিক প্রশ্নে বিচলিত বা বিস্মিত না হয়ে সে বলল-

সময়ের ক্ষুদ্রতম ইউনিট ও অবিভাজ্য। যেমন একটা সেকেন্ডকে এক কোটি ভাগে ভাগ করা সম্ভব। একশ কোটি ভাগে, হাজার বা লক্ষ কোটি ভাগেও তাকে বিশ্লিষ্ট করা সম্ভব। এমনকি এক সেকেন্ডকে অনন্ত সংখ্যক ভাগেও বিভক্ত করা যায়। তার অর্থ এই আপাত ক্ষুদ্র সময়টার বিস্তৃতি ও মহাকালের মত। আমরা আমাদের জীবনের সত্তর বা একশ বছরের সাথে তুলনা করছি বলে এটাকে সীমিত মনে হচ্ছে। তুমি তোমার ভাল লাগার মানুষটির হাত ধরার প্রথম মুহূর্তটিকে এক সেকেন্ড না ভেবে মহাকালের সমান ভাবতে পারো।

শেষ অংশটা ডেভিড স্বগতোক্তির মত করে নিজের ভাষায় বলল, “প্রফিতে দুমমপ্রেসন্ত, কারপারস্কোসে’ এভূতোয়া- উপস্থিত মুহূর্তটি উপভোগ করো, কারণ এটাই তুমি।”
এরকম যান্ত্রিক ব্যাখ্যা শিলা শুনতে চায়নি। তার মনে হলো, মরে যাবার পর একটা অজ্ঞাত, প্রান্তহীন, বোধের অতীত গভীর অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। তখনও আজকের মত আকাশে চাঁদ উঠবে, প্যাসিফিক আইল্যান্ডের কোন এক নির্জন অরণ্যে জংলি গোলাপ ফুটবে, রকি মাউন্টেইনের গা বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ শীতল জলের ধারায় স্যামনের ঝাঁক খেলা করবে, কুয়াকাটায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখতে যাবে অনেক পরে পৃথিবীতে আসা মানুষরা। সে তাদের অংশ হতে পারবে না। সে বলল,
তুমি আমাকে বলো, মরে যাবার পর কী ঘটে? আমরা কোথায় যাই?
—মরে যাবার পর আমাদের শরীর মাটিতে মিশে যাবে। আমাদের সমাহিত করা হবে বা দাহ করা হবে। আমাদের দেহ ভস্ম বা দেহাব শেষের উপরে যে গুল্ম জান্মাবে সেটার শেকড় আমাদের শরীরের অবশেষ তাদের শরীরে শুষে নেবে। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়বে প্রাণে উদ্ভিদে, জলে, মাটিতে, বাতাসে। এভাবে আমরা বেঁচে থাকব অনন্ত কাল- অথবা যতক্ষণ না আমাদের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া পরমাণুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।”

এটা আমার লেখা একটা অপ্রকাশিত ছোট গল্পের অংশ। ডেভিডের কথা শুনে আমরা খুশি হতে পারি আবার শিলার মত হতাশও থেকে যেতে পারি। আমরা যেমন ইচ্ছা করি সেটাই হয়তো প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে সত্য।
জীবনানন্দ দাশ “আমাকে তুমি” কবিতায় লিখেছেন, “খর রৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয় সীরুপসীর মত ধান ভানে- গান গায়- গান গায় এই দুপুরের বাতাস। এক-একটা রোদেলা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।”

তিনি এক দুপুরের ‘জনবিরল গভীর বাতাসে’ একটা পরিপূর্ণ জীবন প্রশান্তিতে পার করে দিতে চান; মরে যাবার পর “অরব অন্ধকারের ভেতর থেকে নদীর চ্ছলচ্ছল শব্দে” আর জেগে উঠতে চান না।

ম্যাকবেথ নাটকে স্কটল্যান্ডের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতি ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করে স্কটল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করে বসেন। এই কৃতকর্মের জন্য তিনি অনুতপ্ত হন এবং জীবন বোধ নিয়ে স্বগতোক্তি করেন যাকে শেক্সপিয়ারের দর্শন বলেই ধরা হয়।
ডানকান ভাবেন জীবন হলো “আগামীকাল থেকে আগামীকালে মন্থরগতিতে হামাগুড়ি দিয়ে চলা; দিনের পর দিন- নির্ধারিত সময়ের শেষ পংক্তি পর্যন্ত। আমাদের সমগ্র অতীত মোহময় ব্যর্থতা, মৃত্যু ধূলিতে একাকার হবার পথ মাত্র। জীবন কেবল ঘূর্ণায়মান ছায়া এবং এমন এক ব্যর্থ অভিনেতা যে জীবন মঞ্চে অভিনয় করার সময় অর্থহীন ভঙ্গিমায় ঘুরে ঘুরে ক্লেদাক্ত ও শেষে চিরদিনের মতো নিশ্চুপ হয়ে যায়।
জীবন নির্বোধের বলা একটা অসাড় আস্ফালনপূর্ণ কল্প গল্প যা শূন্যগর্ভ তাছাড়া আর কোন অর্থ বহন করে না।”

জীবন যে অর্থহীন সেটা বুঝে সৃষ্টির কারণ বা কারকের সাথে অভিমানের শান্তি পাওয়া যাবে। এই বোধ অন্য কাজে লাগবে না। জীবনের গন্তব্য বোঝার পরও অফিসে যেতে হবে, ভাত রান্না করতে হবে, ডাক্তারের কাছে ধর্না দিতে হবে। এ থেকে পরিত্রাণ নাই। তাই একটা ভাল বিকল্প হলো, বেঁচে থাকার সবটুকু সময় অর্থপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করা।” একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু”র মত চারপাশের সকল ক্ষুদ্র উপাদান থেকে আনন্দের উপকরণ খুঁজে বের করার যোগ্যতা অর্জন করলে হয়তো আমরা ভাল থাকব। যারা এটা পারে তারা অনেক বৈরি পরিবেশে ওপারে।

১৯ শতকের ঘটনা- ইংল্যান্ডে দুই ফাঁসির আসামী পাশাপাশি সেল এ বন্দী ছিল। তাদের একজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। রাতে জেল পুলিশ তাকে ডাকতে গিয়ে দেখল সে পাশের সেলের বন্দীর সাথে লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দাবা খেলছে। তাকে বের হয়ে আসতে বলা হলো। সে বলল সে খেলাটা শেষ করে আসতে চায়। জেল সুপার অনুমতি দিলেন। দুই ঘন্টা পর তার ফাঁসি কার্যকর করা হলো।

পত্রিকায় এরকম আরও একটা ঘটনা পড়েছিলাম। ঘটনাটা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের। জর্জ অ্যাপল (নামটি মনে রাখুন। নিবন্ধের শেষ বাক্যে কাজে লাগবে) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে। তাকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসানো হয়েছে। সামনে জেল কর্তৃপক্ষের লোকজন ছাড়াও সাংবাদিক ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার লোকজনকে বসতে দেওয়া হয়েছে। তাকে তার শেষ ইচ্ছা জানাতে বলা হলো। সে বলল উপস্থিত সুধিমন্ডলির উদ্দেশ্যে সে পাঁচ মিনিট কিছু বলতে চায়।

অনুমতি পাওয়ার পর উঠে দাঁড়িয়ে কীভাবে সে স্কুলের এ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এবং প্রতিবেশীর বাসার জানালায় মই লাগিয়ে তিন তলায় উঠে তার চেয়ে দু বছর বড় এক তরুনীর সাথে প্রেম করতো তার বর্ণনা দিল। সে ছিল ফর্সা, বেঁটে এবং গোলগাল। আপেলের মত চেহারার সাথে নামের মিল দেখে লোকজন কীভাবে খুশি হতো তারও বর্ণনা দিলো।
হাসিমুখে বক্তৃতা শেষ করে সে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসে পড়ল এবং বলল, “তো ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ! আপনারা আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সেদ্ধ আপেল দেখতে পাবেন।”
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, জুন ২৯, ২০২১।