শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : এরপর আমি দোলনাটার ঝুলানোর ধাতব রশি ধরে দোলনার পাটাতনের উপর উঠে দাঁড়ালাম। দোলনার পাটাতনটা বেশ লম্বা। আমি আমার দু’হাত দু’পাশে প্রসারিত করে পাটাতনের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হেঁটে কয়েকবার আসা যাওয়া করলাম। আমার মনে পড়ছে ঐ শিল্পীদের চেহারা যাদের আমি দেখেছিলাম ফিন চৌ শহরে, যাদের আছে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার দক্ষতা! তাদের মুক্ত, সাবলীল আর জড়তা হীন অঙ্গ ভঙ্গি আমার মনের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলেছে। আমি ওদের ভুলতে পারছি না। আমি ঐ দড়াবাজ শিল্পীদের অনুকরণ করে দোলনার বড় পাটাতনটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত আরও কয়েক বার আসা যাওয়া করলাম। আমার পায়ের নীচে দোলনার পাটাতনটা অবিরাম এপাশ ওপাশ করে দুলছিলো। কিন্তু আমার আছে ভারসাম্য রক্ষা করার সহজাত অসাধারণ দক্ষতা! আমি যেন একজন সত্যিকারের দড়াবাজ শিল্পীর মতো নিজের শরীরটাকে দাঁড়ানো অবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি, সেই সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি দোদুল্যমান দোলনার লম্বা পাটাতনটাকে!
“তোমরা কি অনুমান করতে পারছো, আমি কি করছি?”, নীচে থাকা প্রাসাদের নিরাপত্তা রক্ষীদের উদ্দেশ্যে আমি উচ্চ স্বরে বললাম!
প্রাসাদের নিরাপত্তা রক্ষীরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে! হয়তো সত্যি সত্যি তারা কিছুই বুঝতে পারছে না! তারা বিস্ময়ে অভিভূত, কারণ চোখের নিমিষেই আমার অসুস্থতা প্রায় পুরোটাই স্থায়ীভাবে সেরে গেছে! দীর্ঘ ক্ষণের নীরবতা ভাঙ্গলো ইয়েন লাঙ! সে উপরের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে একটা রহস্যময় আর প্রাণবন্ত মুচকি হাসি হেসে বললো, “জাঁহাপনা হাঁটছেন, জাঁহাপনা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছেন!”
অনেক দিন হয়ে গেলো আমার ভাই তুয়ান ওয়েন-এর কোন খবরাখবর পাই নাই! আমি পশ্চিম সীমান্ত পরিদর্শন করে প্রাসাদে ফিরে আসার দ্বিতীয় দিন ভোরে, তুয়ান ওয়েন তার তীর ধনুকের থলে, তীরের বস্তা, বইখাতা আর পুঁথি পত্র সাথে নিয়ে তাম্র কাঠি পাহাড়ের নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহে চলে গেছে, ওর সাথে গিয়েছে তিন চার জন বালক ভৃত্য!
সেই নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহ, এক কালে যেটা ছিলো আমার পড়াশোনা করার স্থান! আমার মাতা মং ফু রেন-এর ধারণা তুয়ান ওয়েন নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহকে বেছে নিয়েছে কোন একটা অসত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। এরই মধ্যে তুয়ান ওয়েনের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, ওর এখন বিয়ে করে সংসারী হওয়া দরকার। কিন্তু সে নানা উছিলায় দেরী করছে, বিয়ে করছে না! সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ওর পছন্দের জিনিস হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র, তলোয়ার, বর্শা, তীর, ধনুক এবং সুন যু-র বই যুদ্ধের কলা কৌশল গ্ধ গ্ধ সুন যু এই গ্রন্থটি রচনা করে ছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে]!
মং ফু রেন মনে করেন, গত বেশ কয়েক বছর যাবত তুয়ান ওয়েন-এর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো যে, সে এক দিন অধিষ্ঠিত হবে সিয়ে দেশের সিংহাসনে, তার হস্তগত হবে সম্রাটের ক্ষমতা। তাই ষড়যন্ত্র মূলক বদ মতলব তার মাথায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক!
অন্যদিকে এ বিষয়ে হুয়াং ফু ফুরেন-এর দৃষ্টি ভঙ্গি ভিন্ন। তাঁর সব পৌত্র রাজকুমারদের প্রতি, তাঁর আছে প্রগাঢ় স্নেহ আর ক্ষমা সুলভ উদার দৃষ্টি! তিনি তুয়ান ওয়েন-কে প্রাসাদ ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছেন।
পরে এ প্রসঙ্গে হুয়াং ফু ফুরেন আমাকে বলেছিলেন, “এক বনে দুই বাঘ না থাকাই ভালো! তোমাদের ভাইদের মধ্যে মতের বিরোধ সব সময় লেগেই আছে! প্রকাশ্য আর গোপন দ্ব›দ্ব এড়ানোর জন্য বরং এক জনকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়াই ভালো হয়েছে। মুরুব্বি হিসাবে আমার কাঁধের উপর থেকে অল্প হলেও চাপ কমেছে!”
আমি বলেছি, “আমার জন্য ওটা কোন ব্যাপার নয়, তুয়ান ওয়েন প্রাসাদে থাকুক বা না থাকুক, আমার তাতে কি যায় আসে! আমার শুধু একটাই কথা, সে যেন আমার দিকে গুপ্ত তীর মারার চিন্তা আর না করে! তা হলেই হবে, আমি ওর কাজে কোন বাধা দেবো না!”
সত্যিই, তুয়ান ওয়েন কি করে, না করে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমার বারবারই মনে হয় তুয়ান ওয়েন আর তুয়ান উ, এই দুই সহোদর ভাই এর রক্ত পিপাসু আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন ওদের সাধ্যের বাইরে! এ যেন পিঁপড়ার দলের বড় বৃক্ষ সরাবার আকাঙ্ক্ষার মতো! যদি না এ কাজে সর্বোচ্চ ক্ষমতা উত্স হুয়াং ফু ফুরেন এর সায় না থাকে। অন্যথায় ওরা আমার একটা পশমেরও কোন ক্ষতি করার সামর্থ্য রাখে না। আমার মনে পড়ছে, তুয়ান ওয়েন এর বিরক্তি ভরা গম্ভীর মুখটা। আরও মনে পড়ছে, এক বার একটা ইউক্রেন দেশের ঘোড়ার পিঠে চড়ে তুয়ান ওয়েন একটা ঈগল পাখীকে তাক করে ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে নিক্ষেপ করছিলো তীর। ওর ভঙ্গিটা ছিলো খুবই সজীব আর প্রাণবন্ত! যা কি না আমার হৃদয়ে তৈরী করছিলো একটা অদ্ভুত বিচিত্র সন্দিহান আর ঈর্ষা কাতর অনুভূতি! আসলে সিংহাসনে বসার আগ পর্যন্ত আমি কখনোই ভাবি নাই যে আমি এক দিন হবো সিয়ে দেশের সম্রাট, আর তুয়ান ওয়েন বারবারই ভেবেছে এক দিন সে বসবে সিংহাসনে, হবে দেশের সম্রাট! আসলে ওর আর আমার মধ্যে তীব্র দ্ব›েদ্বর মূল কারণ হচ্ছে : ভুল মানুষের ভুল পদে আসিন হওয়া!
কখনও কখনও আমার সত্যিই সন্দেহ হয়, জীবন্ত সমাহিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইয়াং ফু রেন যে কথাটা বলতে চেয়েছেন সেটা হয়তো সত্যিই! আমি হচ্ছি সিয়ে দেশের নকল সম্রাট, আর সিয়ে দেশের সত্যিকারের সম্রাট হচ্ছে তুয়ান ওয়েন! আমি অনুভব করি, সিয়ে দেশের সম্রাট হিসেবে আমাকে মানয় না, বরং তুয়ান ওয়েন সিয়ে দেশের সম্রাট হওয়ার জন্য আমার চেয়ে বেশি যোগ্য আর উপযুক্ত!
আসলে এটা একটা গোপন সমস্যা, যে সমস্যার কথা কাউকে বলা যায় না! আমি ভালো করেই জানি আমার এই হীনমন্যতার বিষয়ে কারো সাথে আলোচনা করলেই সূত্রপাত হবে ভয়াবহ সন্দেহের! এমন কি সেই মানুষটা আমার সব চেয়ে প্রিয় ভাজন ইয়েন লাঙ যদি হয়, তবুও রক্ষা নেই! সম্রাট হিসেবে আমার কর্ম জীবনের প্রারম্ভে এই গোপন সমস্যাটা যদিও খুব বিপজ্জনক ছিলো না, তবুও ছিলো বিপুল বিস্ময় ভরা একটা অনুভূতি! এটা যেন একটা ভারী শিলা খণ্ড যেটা চেপে বসে ছিলো আমার ভঙ্গুর আর দুর্বল রাজ মুকুটটার উপর। যা কিনা আমার মানসিক অবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলো। আর এ ভাবেই আমি হয়ে উঠেছিলাম এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের এক গুঁয়ে আর দুর্বিনীত প্রকৃতির তরুণ সম্রাট!
আমি খুবই স্পর্শ কাতর, আমি খুবই নিষ্ঠুর, আমি খুবই প্রমোদ বিলাসী, আসলে আমার মধ্যে টইটম্বুর হয়ে আছে শিশুসুলভ ছেলেমিপনা!
তুয়ান ওয়েন প্রাসাদ থেকে চলে যাওয়ার পর, সে কোথায় যায়, কি করে, কোথায় থাকে এ সব বিষয় নিয়ে মং ফু রেন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তিনি নিয়োগ করেছেন একজন গুপ্তচর। এই লোকটা একজন কাঠুরিয়ার ছদ্ম বেশে দূর থেকে নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহের ক্রিয়াকলাপ নজরদারি করছে। লক্ষ্য রাখছে তুয়ান ওয়েনের গতি বিধির উপর। গুপ্তচর জানিয়েছে, তুয়ান ওয়েন প্রতিদিন ভোরে পড়া মুখস্থ করে, বিকেলে করে শরীর চর্চা। রাতে সে একটা মোম বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতে যায়। সব কিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে চলছিলো। কিন্তু কোন একদিন ঐ গুপ্তচর হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসলো স্বাগত বসন্ত গৃহে। সে জানালো খুব সকালে তুয়ান ওয়েন এর পশ্চিম দিক বরাবর যাত্রা করার খবর! মং ফু রেন বললেন, এমন একটা ব্যাপার ঘটবে সেটা তিনি আগেই জানতেন! তাঁর অনুমান তুয়ান ওয়েন যাবে ওর স্বজনদের কাছে! সে যাবে ফিন চৌ শহরে পশ্চিমের সুবাদার চাও ইয়াং-এর কাছে! চাও ইয়াং এর রক্ষিতা ইয়াং শ্র হচ্ছে তুয়ান ওয়েন ও তার সহোদর তুয়ান উ-এর আপন খালা! পশ্চিম অঞ্চলের দিকে তুয়ান ওয়েন এর পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি উন্মোচিত করেছে ওর অসন্তুষ্টি আর ক্ষমতা দখলের খায়েশ!
“তোমাকে অবশ্যই ওকে জোর করে থামাতে হবে পথের মধ্যে। ও তো হচ্ছে একটা বন্য হিংস্র বাঘ, ওকে ঢুকাতেই হবে খাঁচার মধ্যে!”, তুয়ান ওয়েন পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদারদের সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কি কি অন্তর্ঘাতমূলক কাজ কর্ম করতে পারে তার বিস্তারিত বিবরণ দিলেন মং ফু রেন, আমাকে উদ্দেশ্য করে! তাঁর চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে অস্বাভাবিক দুঃশ্চিতার ছাপ। তিনি বার বার উপদেশের ছলে বললেন, তুয়ান ওয়েন-কে জোর করে আটকানোর বিষয়টা যেন হুয়াং ফু ফুরেন-এর কাছে গোপন রাখা হয়, অন্যথায় ঐ ডাইনী বুড়ী মাঝ খান দিয়ে নতুন কোন ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে!
আমি আমার জন্ম দাত্রী মাতা মং ফু রেন-এর পরামর্শ আর উপদেশ মান্য করে চললাম। প্রাসাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই বিশাল সিয়ে রাজ প্রাসাদের ভিতরে বসবাস করা কোন মহিলার নিখুঁত সু² আর তীক্ষ্ণ উপলব্ধি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক! আমি খুব ভালো করেই জানি আমার সম্রাটের পদটাই হচ্ছে আমার মা মং ফু রেন এর প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার উত্স! তাঁর সম্পূর্ণ শক্তি আর প্রজ্ঞার এক অর্ধেক তিনি ব্যয় করেন তাঁর শাশুড়ী অর্থাত আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন-এর সাথে ওনার গোপন ও প্রকাশ্য দ্ব›েদ্ব, বাকী অর্ধেক তিনি ঢালেন, সিয়ে দেশের সম্রাটের যে মুকুটটা আমার মাথায় পরানো আছে সেটার অভিভাবকত্বের কাজে! কারণ তিনি হচ্ছেন আমার জন্ম দাত্রী জননী, আর আমি তো হচ্ছি সর্বোচ্চ মর্যাদাবান মানুষ, সিয়ে দেশের ‘মহামান্য’ রাজাধিরাজ!
অশ্বারোহী বাহিনীর দ্রুত গতির ঘোড়াগুলো ছুটে গিয়ে ঝাউ পাতা নদীর খেয়া ঘাটে তুয়ান ওয়েন-এর গতি রোধ করতে পারলো। লোক মুখে শোনা যায় ঐ সময় তুয়ান ওয়েন ছুটছিলো পাগলের মতো। সে, তাকে পশ্চাত ধাবনকারী অশ্বারোহীদের কাছ থেকে পালানোর জন্য দ্রুত খেয়া নৌযানে আরোহন করতে চাচ্ছিলো। সে হাঁটু পানিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, নদীর পানি ছিলো বরফ শীতল ঠান্ডা! সে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর পিছনে পিছনে ছুটে আসা অশ্বারোহী সেনা দলের দিকে তিনটা তীর নিক্ষেপ করেছিলো। খেয়া নৌযানের সারেং আতঙ্কিত হয়ে জাহাজটাকে তীরের দিকে না এনে, দাঁড় বেয়ে ওটাকে মাঝ নদীর দিকে নিয়ে যায়। ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে তুয়ান ওয়েন আর খেয়া নৌযানে চড়ে বসতে পারেনি। সে মাঝ নদী বরাবর কয়েক পা এগিয়েছিলো, তারপর সে আবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলো, তীরে দন্ডায়মান অবস্থায় আছে কালো চিতার মুখ অবয়ব খোচিত ধ্বজাধারী অশ্বারোহী সেনাদল! তার চেহারায় ফুটে উঠেছিলো বীরত্বপূর্ণ দুঃখ আর হতাশার বিবর্ণ আলো! এরপর সে নিজে নিজে ঝাউ পাতা নদীতে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করে! তার দেহটা খুব দ্রুতই ডুবে যাচ্ছিলো। তীরে দাঁড়ানো অশ্বারোহী সেনারা এ দৃশ্য অবলোকন করে খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে পরে। তারা তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়, ঘোড়া ছুটিয়ে নদীতে নেমে যায়। ভিজে চুপ চুপে হয়ে যাওয়া তুয়ান ওয়েন-কে টেনে তুলে ঘোড়ার পিঠে এনে বসায়।
ধরা পরার পর ঘোড়ার পিঠে আসিন অবস্থায় তুয়ান ওয়েন পুরোপুরি বাক্য হারা হয়ে গিয়েছিলো। ফিরে আসার পথে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উত্সুক দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ জানতো ঐ মানুষটা হচ্ছে প্রাসাদের বড় রাজ কুমার তুয়ান ওয়েন। ওরা ভেবেছিলো এটা হচ্ছে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রাসাদের দিকে ফিরে আসা মানুষ জন ও ঘোড়া। কেউ কেউ রাস্তার পাশের গাছের ডালে উঠে বাঁশের কাঠির আতশবাজি জ্বালিয়ে ওদের স্বাগত জানাচ্ছিলো। আতশবাজি আর জয়া ধ্বনির আওয়াজ কানে আসার সময় ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা তুয়ান ওয়েনের দু’চোখ বেয়ে নেমে আসছিলো অশ্রু ধারা? ওকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় তাম্র কাঠি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহে। তুয়ান ওয়েন এর দুঃখ ভারাক্রান্ত বদনে প্রত্যাশিতভাবেই অশ্রু ধারার দাগ তখনও শুকিয়ে যায়নি।
নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহে গৃহবন্দী দশায় থাকার দিনগুলোতে একবার তুয়ান ওয়েন-কে দেখতে গিয়েছিলাম আমি। শীতল আর নিঃস্তব্ধ নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহটার সব জিনিসই আগের মতোই আছে, শুধু নেই আগের মানুষগুলো। শীত কালে চক্রবাক পাখীগুলো কোন দিকে যায় জানি না। গুরু গৃহের সামনের বড় গাছটা শীতের দিনে খাড়া আর হেলানো জীর্ণ শীর্ণ ডাল পালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের সিঁড়ির ধাপে এখনও জমে আছে জমাট বাঁধা তুষার। আমি দেখতে পেলাম তুয়ান ওয়েন হীমেল বাতাসের মধ্যে একাকী একটা পাথরের বেদীর উপর বসে আছে। কোন ক্ষোভ নাই, কোন অভিযোগ নাই, এমনই এক ধরনের ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি নিয়ে সে আমার এবং আমার সাথে আসা অশ্বারোহী দেহরক্ষীদের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
“তুমি কি আবারও ফিন চৌ-এর দিকে ভেগে যাওয়ার চিন্তা করছো?”
“ভেগে যাওয়া কিংবা পালানোর কথা আমি কখনোই চিন্তা করিনি। আমি ফিন চৌ যেতে চেয়েছিলাম একটা নতুন তীর ধনুক কিনে আনতে। (চলবে)