ইউসুফ কামাল : তিন.
চার তালায় পিছনের দিকে মনোবিজ্ঞান বিভাগের অন্য পাশে ইকোনোমিক্স। মাঝ খানে একটা অস্থায়ী কেন্টিন। কেন্টিন বলতে যা বোঝায় সেটা তেমন কিছু না। ক্লাশের মাঝে মাঝে আড্ডা, গল্প গুজবের একটা জায়গা। টেবিল চাপড়ানির সাথে গান গাওয়ার একটা জায়গা ছাড়া কিছু না।
মাঝে মাঝে বন্ধু হ্যাপি আকন্দ চলে আসতো। টগবগে একটা তরুণ, চা সিগারেটে কোনও অরুচি ছিলো না। মুলত: ভাই লাকী আকন্দের গানগুলোই সে বেশি গাইতো। অসম্ভব জীবনী শক্তিতে ভরপুর এক তুর্কি তরুণ যেন।
এই নিল মনিহার এই স্বর্ণালী দিনে তোমায় দিয়ে গেলাম শুধু মনে রেখো….
দ্বীপজ্বালা রাত জানি আসবে আবার। কেটে যাবে জীবনের সকল আধার
স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে শুধু আমায় ডেকো……
সেই হ্যাপি কিছু দিনের মধ্যেই হারিয়ে গেল দুরারোগ্য ক্যান্সারের কাছে হার মেনে। সত্যি তাকে এখন স্মরণেই ডাকতে হয়। এমন চির চঞ্চল একটা প্রাণ যে এত তাড়াহুড়ো করে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি আমরা কেউ। সেই হ্যাপি স্মরণের ওপারেই চলে গেল, মাঝে মাঝেই স্মৃতির জানালা খুলে প্রিয় হ্যাপিকে খুঁজে বেড়াই এখনো। ওর প্রিয় গানটা শুনলেই এখনো মনের মধ্যে চলে আসে প্রিয় হ্যাপির সেই স্মৃতিময় ঘটনাগুলো।
সেদিন কেন জানি শেষের ক্লাশটা হবে না শুনে বিদ্যুত’কে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরীফ মিয়ার কেন্টিনের দুই টাকা প্লেটের তেহারী খেয়ে হাঁটা ধরলাম টিএসসি’র দিকে। মনে হলো প্রিয় সবুজ ঘাসের লনে যেয়ে একটু বসি। ভেতরে ঢুকতেই দোতলায় গানের আওয়াজ পেলাম। বিদ্যুত বলল, চলো দেখি কে ওখানে। ফিরোজ সাঁই মুখ্য ভূমিকায় – সাথে আরো কয়েক জন। ম্যারাথন গানের মাঝে একটুও যেন বিশ্রাম নেই চলছে তো চলছেই। যখন বেরোলাম রোদের আলোটা থিতিয়ে এসেছে, বৈকালিক আড্ডা শুরু হয়ে গেছে রোকেয়া হলের সামনের টিএসসি’র সড়ক দ্বীপে।
কিছুক্ষণ উদ্দ্যেশ্যহীন হাঁটা হাঁটি দুইজন, চলে এলাম জগন্নাথ হলের দিকে। পথে শামসুন্নাহার হলের সামনে কিছু বৈকালিক ভীড়। চোখে পড়লো কিছু চেনা, অর্ধ চেনা কিছু মুখ। ভাবলাম কৈ কেউতো এগিয়ে এলো না – অনুযোগের স্বরে বল্লো না দেরী হলো যে! একটু আগে আসলে বেশীক্ষণ কথা বলা যেতো। এখনি তো হলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে।
পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে দু/এক সবসময়ই থাকে। আসলে তেমন করে কাউকে কি খুঁজেছি! এমন কথা তো ভাবিওনি। আর এমনি করে গল্প করে সময় কাটাতে সবাই পারেও না। হাঁটতে হাঁটতে জগন্নাথ হলের পুকুর ডানে রেখে সোজা এসে ঢুকলাম কেন্টিনে। ঢুকেই দেখি বন্ধু পিযুষ, সুভাষ, বিক্রম বসে আছে। আরেক প্রস্থ গল্পের সাথে দুই কাপ চা শেষ করে যখন উঠলাম দেখি চারদিকে হেমন্তের হাল্কা কুয়াশা, মনে হয় এবার শীতটা আগে ভাগেই এসে পড়বে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বকশী বাজারের বাসার দিকে পা বাড়ালাম। হাঁটতে হাঁটতে বুয়েট, মেডিকেল হোস্টেল, আলিয়া মাদ্রাসা পার হয়ে উমেশ দত্ত রোড এর বাসার গেটে চলে এলাম, পাশের চায়ের দোকানে হিন্দি গানের সুর।
নভেম্বর মাস। চারদিকে জাসদের অশান্ত রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো গণতন্ত্রের আতুড়ঘর। সারা দেশের রাজনীতির কর্মকান্ড সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে এখান থেকেই মোটামুটি আবর্তিত হতো। ডিপার্টমেন্টের ব্যাপারে একটা জরুরি আলোচনা ছিলো ডিপার্টমেন্টের হেড ড: রওশন আলীর সাথে। আগের দিনই সাফায়েত ভাই আমাকে থাকতে বলেছিলেন। বরিশালের মানুষ বয়সে সামান্য বড়ই হবেন কিন্তু মানুষটার মনটা খুবই ভালো ছিলো। খুব ভালো সাংগঠনিক শক্তি ছিলো তার মধ্যে। পরবর্তিতে ডিপার্টমেন্টের নির্বাচনে আমরা তার গ্রুপের হয়ে নির্বাচন করেছিলাম। সে এক লম্বা ইতিহাস।
চার তারিখ সকাল ৯:০০টার আগেই সবাই অপরাজেয় বাংলার সামনে হাজির। যথারীতি বিদ্যুতকে বলাই ছিলো। আরো কয়েকজন এসে হাজির। তখনো অপরাজেয় বাংলার কাজ চলছে। সারাদিন দেখতাম ডাকসুর কর্মকর্তা ম. হামিদের ব্যাস্ততা। প্রতিটা মূর্তিকে পাথরের ঢালাই দিয়ে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অবয়বে আনা হচ্ছে। আমরা মাঝে মাঝে কলাভবনের পূর্ব প্রান্তের সিড়িতে বসে বসে কাজ দেখতাম। স্থপতি আব্দুল্লাহ্ খালিদকে দেখতাম তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কি গভীর একাগ্রতা নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকতে। তিল তিল করে মাটির উপরে উঠে দাঁড়াচ্ছে তার স্বপ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রছাত্রীকে মডেল করিয়ে তাদের দুইজন অস্ত্রধারী মুক্তিযাদ্ধা আর একজন নারী সেবিকা। ভাবতাম কবে যে শেষ হবে! শেষটা দেখে আসতে পারিনি তার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে চলে এসেছি। মাঝে কিছু দিন কাজ বন্ধ ছিল।
দশটার দিকে সাফায়েত ভাই কয়েকজন ছাত্রসহ এসে দাঁড়ালেন নির্মাণরত অপরাজেয় বাংলার সামনে। হাত ইশারা করতে এগিয়ে গেলাম। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা। গতরাতে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। একটা কিছু করা দরকার। দেখতে দেখতে জহুরুল হক হল থেকে বেশ কিছু ছাত্রসহ বন্ধু সিরাজ, পুনু এসে হাজির। তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত মিছিল করবো। আর সেটাই ’৭৫ পরবর্তি ঢাকা শহরে মোশতাক সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের প্রথম মিছিল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে শুরু করে বলাকা সিনেমা পার হয়ে এগিয়ে চল্লো ৩২ নং এর দিকে। আমি ছিলাম মিছিলের সম্মুখ ভাগে মোটর সাইকেলে আর আমার সাইকেলে উল্টো হয়ে বসে পুরো মিছিলের ভিডিও করছিলেন কবি জসিমউদ্দিনের জৈষ্ঠ সন্তান, হাসু ভাই। ধানমন্ডি মাঠ অতিক্রম করার সময় ন্যাপের মহিউদ্দিন সাহেব রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে বল্লেন, আমি কি আপনাদের সাথে শরীক হতে পারি? যেহেতু আমি মিছিলের সম্মুখ ভাগে ছিলাম তাই আমি সম্মতি দেওয়াতে উনি মিছিলে যোগ দেন। রাস্তার দুই পাশের মানুষ অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখছে গুটি কয়েক ছাত্রের দু:সাহসিক কর্মকান্ড। দেখতে দেখতেই ৫০/৬০ জনের মিছিল ধানমন্ডি মাঠ পার হয়ে এগিয়ে চল্লো। এর মধ্যেই কোথার থেকে কেউ কিছু ফুলও যোগাড় করে এনেছে। এক সময় আমরা পৌঁছলাম গেট বন্ধ ৩২ নম্বরের সামনে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের অগাধ ভালোবাসার কি রূপ সেটা সেদিন দেখেছি।
কে জানতো এই মিছিলের জন্যেই বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটা নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটাবে পরাক্রম শক্তির এক পক্ষ। উর্দীধারী এক পক্ষের বিদায় যে এমনি মর্মান্তিক হবে তা কি আমরা বুঝেছিলাম? জনশ্রুতি ছিলো, আমাদের মিছিলের শেষাংশে নাকি খালেদ মোশারফের মা অথবা তার ভাই রাশেদ মোশারফ ছিলেন। আর এ মিছিলের মাধ্যমেই নাকি জনগণ ও অন্যান্য সবার কাছে জনাব খালেদ মোশারফের অবস্থান শক্ত প্রমাণ করতে চাইছিলেন।
এবং এই ঘটনার দুএক দিনের মাথাতেই খালেদ মোশারফ নিহত হন। আসলে বিষয়টা এমন ছিলো না। পরাশক্তি অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতেই এই অপবাদটা অন্যের ঘাড়ে তুলে দিয়ে নিরবে তাদের কাজ করে বেরিয়ে গেছে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা