রীনা গুলশান : একদিন বেশ তাড়াহুড়া করে অফিসে যেতে হয়েছিল, আতিকের লাঞ্চ রেডী করে কিচেনের কাউন্টার টপে রেখে এসেছে। বাড়ি এসে দেখে, আতিক লাঞ্চ না নিয়েই চলে গিয়েছে। অথচ, আতিকের অফিস মাত্র ৭/১০ মিনিটের ড্রাইভ। আর প্রিয়তার ৪৫/ থেকে ১ ঘন্টার ড্রাইভ। এটা নিয়ে কথা বলায়, তার জবাব ছিলো- আজ গাড়ির মধ্যে দাওনি কেন?
সেই শুরু। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাঙ্গা চোরা শুরু হলো, আতিকের প্রতিটি ব্যবহারে।
এরপর, তার শশুর-শাশুড়ী বেড়াতে এলো। যদিও প্রায় ৬ মাস ছিলো। প্রথম প্রথম প্রিয়তা তার স্বভাব সুলভ নম্রতার সবটুকু ঢেলে দিলো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়। তাকে অফিস থেকে এসে রান্না করা, ঘর ক্লিন, এমনকি টেবিলে খাবারটা পর্যন্ত বেড়ে দেওয়া। প্রথম প্রথম শাশুড়ী মা, তাকে হেল্প করতে চাইতো। কিন্তু একদিন উইকেন্ডে, রান্নার সময়, শাশুড়ী তাকে পেঁয়াজ, সবজী কেটে দিচ্ছিলো। আতিক রান্নাঘরে এসে তার মাকে বললো : মা, তুমি কেন কাজ করছো? তুমি বেড়াতে এসেছো। তাছাড়া তোমার বৌমা আছে না?
: তোদের এখানে কাজের লোক নাই, প্রিয়তা একা একা কত করবে?
: না, না, মা, তুমি এদিকে আসো, ও একাই একশো।
এবং, এরপর আশ্চর্যজনক হলো, উনি রান্নাঘরের ধারে কাছেও আসে না। কোন কাজেই হেল্প করে না। উল্টো, সে অফিস থেকেই এলেই শুরু হয়ে যেত তার নানান খাবারের বাহানা। এমনকি, বৌমা, মাথায় একটু তেল দিয়ে দাওতো? নখটা একটু কেটে দেবে? ইত্যাদি। তবে শশুর বাবা মাঝে মাঝে বলতো, বৌমা অফিস করে, একা কত করবে? ৬ মাস পর ওরা দেশে গেলো। এই ৬ মাসের মধ্যে মাত্র ৪/৫ বার সে বাপের বাড়ি গেছে। মায়ের রাজ্যের নালিশ এর সামনে, প্রিয়তা এক রাশ বেদনাহত বোবা চাহনি নিয়ে বসে থাকতো। ততোদিনে সে এতটুকু বুঝে গেছে, নিজে বিয়ে করার যন্ত্রণা!, কোন দিকেই উঁচু গলায় কথা বলা যায় না। তবে, ওর বাবা ঠিক বুঝে যেত। মনে হয়, ওর বাবা খুব ছোট বেলা থেকেই ওর ভেতরটা দেখতে পায়। ওর সবটুকু কষ্ট। আনন্দ। সঅব।
এই এতটুকু বয়সেই সে বুঝে গেল, সবাইকে আনন্দের ভাগ দেওয়া যায়। কিছু কষ্টের কথা সবাইকে বলতে নেই। তবু অমিতা বুঝে যায়। কারণ, একমাত্র অমিতা তার গলার ভাজ, চোখের কাঁপুনি সঅব চিনতো। এক সাথে বড় হয়েছে। কত ঝগড়া, কত ভালোবাসা; সব এক সাথে। কোন কিছুই ওর কাছে লুকানো প্রায় দুঃসাধ্য।
বিয়ের দু’ বছরের মাথায়, একবার অমিতা ওর বাসায় বেড়াতে এসেছিলো। যাবার সময় ওর গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুব ফিসফিস করে বলেছিলো- মনে হয় না তুই এই ঘরে বেশি দিন টিকতে পারবি।
আতিককে সত্যি বুঝতে পারছিলো না প্রিয়তা। প্রতিটি প্রহর যেন পরাজয়ের কথা বলছিলো তার সাথে। সে এই পরাজয় কিছুতেই মানতে পারছিলো না। নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছিলো। তখন সে ভাবলো, হয়তো একটি বেবী এলে, আতিক চেঞ্জ হবে। যদিও সে মাঝে মধ্যে গায়ে পর্যন্ত হাত তুলছিলো। আবার বেশ কিছুটা পরেই এসে হাত, পা ধরতো। যাতে সে আবার ৯১১ কল না করে। কত রাত প্রিয়তা একাকি লিভিং রুমে অঝোরে কেঁদে কাঁটিয়েছে। এই ভাবে মেঘভাঙ্গা প্রহরের মধ্যে সে দিবা রাত্রি নিমজ্জিত ছিলো। এক ছুটির দিনে, আতিককে, সে নিজেই বললো, আমাদের একটা বেবী এলে কেমন হয়?
: বেবীটা দেখবে কে? দুজনই চাকরি করি?
: কেন ডে-কেয়ার অথবা আম্মু।
: ওকে। আমার তো কোন অসুবিধা নাই। যদি তুমি সব কিছু ম্যানেজ করতে পারো।
আর তখনই সে, মা, হবার জন্য মরিয়া হয়ে গেলো। যতটা না মাতৃত্বের জন্য, তার থেকে অনেক বেশি ছিলো সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য এবং ৩/৪ মাসের মধ্যেই একদিন সে উল্লসিতভাবে আতিককে, তাদের নবজাতকের আগমনি বার্তা শুনালো। আতিককে বেশ উদ্ভাসিত মনে হলো। সে নিজে থেকেই বললো, এখন থেকে তুমি সব কাজ করবে না। আমরা ভাগ করে করবো।
প্রিয়তা, মনে মনে প্রবল আনন্দের স্রোতে ভেসে গেল। মনে হলো চিত্কার করে বলে, “পেরেছি” আমি সত্যিই আতিককে জয় করতে পেরেছি। প্রেগনেন্সির দু’ মাস সে সত্যিই নিষ্ঠার সাথে তাকে হেল্প করলো। এমনকি কোন এক বর্ষণ মূখর, ছুটির দিনে, সে ঘোষণা করলো, আজ আমি নিজ হাতে তোমাকে খিচুড়ি, ডিম ভাজা খাওয়াবো। প্রিয়তাকে অত্যন্ত অবাক করে দিয়ে, সত্যি আতিক তাকে অতি সুন্দর খিচুড়ি, ডিম ভাজা খাওয়ালো। এমন কি, নিজে হাতে খাওয়ালো, সেই বিবাহ পর্বের প্রথম সোনালী দিনগুলোর মত। আহা এই সব দিনগুলো হারিয়ে কেন যায়? আনন্দে প্রিয়তা কেঁদে ফেললো, আতিকের বুকের ভাজে।
এরপর অফিস আর, ৬ সপ্তাহ পর পর একবার করে ডাঃ এর কাছে চেক করতে যায়। ৫ মাসের মাথায় চেকআপ এবং আলট্রাসাউন্ড এর রিপোর্ট দেখে ডাঃ জেনেটের মুখ গম্ভির হয়ে গেলো। সে তবু স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-
: প্রিয়তা, আমি খুবই দুঃখিত, তোমার বাচ্চার গ্রোথ নাই বললেই চলে। ৫ মাসে বেবীর যে ওজন হবে, তার প্রায় অর্ধেক।
প্রিয়তার বুক কেঁপে উঠলো। আর ওর মা, পারভীন ঝাঁঝিয়ে উঠলো ডাঃ এর সামনেই।
: ডাঃ আমি এই কথা আগেই বলেছি ওকে, আমার তিনটে বেবী হয়েছে, তাছাড়া সে মারাত্মক দূর্বল ও । ঠিক মত খায় না।
প্রিয়তা কোন কথা না বলে মায়ের সাথে, বাপের বাড়ি চলে এলো। সারাদিন চুপচাপ শুয়ে বসে কাটালো, অফিস গেলো না। ওর মা / বাবা ২/৩ মাস থেকেই ওকে নিয়ে আসতে চেয়েছে। সে আসেনি। ভেবেছে আতিকের সত্যিই বুঝি পরিবর্তন আসবে। কিন্তু মাস খানেক পরই, সেই আগের আতিক। সেই অর্ডার করা। চরম স্বার্থপরতা। বিয়ের পরপর আতিকের একটা কাজিন সেলিনা, ওদের বাড়িতে এসেছিলো, স্বামী এবং দুই বাচ্চা নিয়ে। ৩/৪ দিন ছিলো। ওরা ফিলাডেলফিয়ায় থাকে। একদিন অফিস ফেরত, প্রিয়তা রান্না করছিলো। আবার আতিকের বারবার বিভিন্ন অর্ডারি খাবার, চাও সার্ভ করছিলো। সেলিনার খুব খারাপ লাগছিলো- রান্না ঘরে এসে মুখটা কালো করে বললো-
: আতিক দেখি এখনও একটুও চেঞ্জ হয়নি। একই রকম আছে।
: কেমন চেঞ্জ?
: না, ওর তো “বাই-পোলার” অসুখ আছে। এই ভালো। এই খারাপ। দুটো রূপ। তুমিতো সবই জানো তাই না? আমেরিকায় আসার পর আমার বাসায় ৩/৪ মাস ছিলো, আমি খুবই টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। এখন নিজেই বিয়ে করেছে। এখন নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে, কি বল?
প্রিয়তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। তবু কিছুই বুঝতে দেইনি সেলিনা আপাকে। নিজে ভালোবেসে বিয়ে করার কত জালা, সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। না যায় সওয়া, না যায় কাওকে বলা? এক অসহনীয় অনন্ত দহন কেবল কুরে কুরে খায় অহর্নিশ।
তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা ছিলো। বেবীটা এরই মধ্যে তার স্বত্বায় যেন মিশে গিয়েছিল। একেই কি মাতৃত্ব বলে? সে জানে না। তবে ডঃ এর ঐ কথা শোনার পর থেকেই সে অনবরত চুপিচুপি কাঁদছিল। পারভীন দেখছিল এবং সবই বুঝতে পারছিল। সে অফিস গেল না এবং আতিককে, এস এম এস করে জানিয়ে দিল সব, ডাঃ জেনেট যা কিছু বলেছে। সন্ধ্যায় তবু বাসায় রওনা দিল। একটা দিনেই মায়ের আদরে বেশ ফ্রেশ লাগছিল।
বাসায় আসতে আসতে তার অনাগত সন্তানের কথা ভেবে সে অত্যন্ত উত্কন্ঠিত হচ্ছিল। কারণ আতিকের যত্ন এবং সাহায্য তো দুই মাসেই শেষ। তারপর আবার সেই পুরানো আতিক। কিন্তু সেতো আর সেই পুরানো প্রিয়তা নয়। সে এখন প্রেগন্যান্ট। সব সময় ক্লান্ত বোধ করে। অফিসের কাজ। বাড়ির কাজ, সব মিলিয়ে, তার নিজের প্রতি একদম যত্ন হচ্ছিলো না। তারপর মাঝেমাঝে খুব বমি হতো। নিজের রান্না একদম খেতে পারছিলো না। আতিক একটা ডিম ভেজে দিলেও, সে সোনা মুখ করে খাচ্ছিলো। সে সেটাও করতো না। মাঝেমাঝে প্রিয়তা কমপ্লেইন করছিল-
: তুমিতো কিছু রাধতে পারো, আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছি।
: আমিতো তোমাকে আগেই বলেছি, আমার দ্বারা এসব হবে না। আর চাকরি করে তোমার পক্ষেও সম্ভব নয়।
: তাহলে চাকরি ছেড়ে দেই?
: তাহলে চলবে কি করে, বাড়ি কেনা হলো।
: বাড়ির ২৫% ডাউন পেমেন্ট আমি দিয়েছি। এই দুই বছর মর্টগেজও আমিই দিয়েছি। এবারে তুমি চালাও।
: আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দেশে টাকা পাঠাতে হয়।
: তাই বলে কি আমরা কখনও বাচ্চা নিবো না? এটা কেমন কথা বলছো?
: বাচ্চা চাইছো, তো এখন ঠ্যালা সামলাও- বিভত্স মুখ করে আতিক জবাব দিল।
গত মাস তিনেক এরকম ঝগড়া ওদের ৩/৪ বার হয়েছে। কোন কাজ হয়নি। সে যেমন, তার থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণও তাকে সরানো যায় না। একবার শশুরকে ফোন করে কিছুটা বলেছিলো। কারণ ঐ মানুষটা যথেষ্ট বুঝদার। তাতে হিতে বিপরীত হলো। বাসায় এসে প্রচন্ড ঝগড়া শুরু করলো। জিনিসপত্র ভাঙ্গলো।
: তোর এত্ত বড় সাহস, আমার বাবাকে নালিশ করিস?
প্রিয়তা ভয়ে, লজ্জায় কোন জবাব দিলো না। কাউকে বলতে পারছিলো না। এক অসহনীয় কষ্টে সে দিনে দিনে ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছিলো। অফিসের কলিগরা পর্যন্ত ওকে নিয়ে উত্কন্ঠিত ছিল।
তবে আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। সব কিছু ছাপিয়ে, আজ প্রিয়তার মাতৃত্বটাই প্রবলভাবে জেগে উঠলো। বাসায় গিয়ে, বাচ্চার জন্য টুকিটাকি কেনা জিনিশগুলো গুছিয়ে নিলো। তারপর তার নিজের বেশ কিছু কাপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিশ গুছিয়ে নিচ্ছিল। এর মধ্যে আতিক এলো। সব কিছু দেখলো। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো –
: এসব কি হচ্ছে?
: কিচ্ছু না। অনেক আগেই যেটা হলে ভালো হতো। আমি এসময়টা আম্মুদের বাসায় থাকবো। আমি তোমাকে এস এম এসে লিখেছিতো, বেবীর কোন গ্রোথ নাই। আমি নিজের রান্না খেতে পারছি না। অফিস করে আমি এত কাজও করতে পারছি না। তুমি বলেছিলে, হেল্প করবে। মাত্র এক/ দেড় মাস হেল্প করলে। তারপর সেই আগের জায়গাতে চলে গেছো।
: আমার পক্ষে ওসব সম্ভব নয়। আমিতো আগেই বলেছিলাম, চাকরী করে বাচ্চা নেওয়া যাবে না?
প্রিয়তা যেন এতদিনে নিজেকে সত্যি হারালো, চিত্কার করে বললো-
: মানে কি? যারা চাকরি করবে, তাহলে তারা কখনো মা হতে পারবে না?
: কেন পারবে না? মা হতে চাইছো, তাহলে ঠ্যালা সামলাও।
: এটা বাংলাদেশ নয়, এটা কানাডা। এখানে সবাই সেয়ার করে কাজ করে। ঘরে বায়রে একা হাতে কেও করে না। তোমার মত কেও নবাবীও করে না। (চলবে)