হিমাদ্রী রয় : ইস্যু দেখলেই কেবল আমদের হিস্যু করতে মনে হয় এর আগে শুধুই চেপে চেপে রাখি। এই চাপ থেকে যে কিডনি বিকল হতে পারে সেটা কজনেইবা মাথায় রাখি। মানুষের অবক্ষয় দেখে পীড়িত হই, শিক্ষিত অমানুষদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ পোষণে শরম লাগে তবু কথা বলি, তবু চেতনা জাগে। এই ঘুম ভাঙানিয়া কেবল সতস্ফুর্ততা থেকে হয় তা কিন্তু নয়। জাত-পাত, গোত্র কিংবা কওমের প্রতিকুলে গেলে কথা বলবো ঝেঁপে আর অনুক‚লে হলে তখন কথা বলি মেপে।

তবে কেউতো আছেন ক্রুসে বিদ্ধ হবেন জেনেও কথা বলেন। কিন্তু কথার ভিড়ে কথা হারিয়ে যায় যেমন ইস্যুর তলে ইস্যু চাপা পড়ে। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আফগানিস্তানের জন্য চাপ যতটা কম প্যালেস্টাইনের ব্যাপারে রিয়াকশনে তাপ ততটাই বেশি এই হচ্ছে আমাদের অনেকের মনোগত আচরণ।

একজন মানুষ হিসাবে আমি যেমন চাই যে একাত্তরে পাকিস্তানিরা যেভাবে বাংলাদেশের মানুষের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল তার আন্তর্জাতিক স্বিকৃতি, ঠিক সেই মানুষ হয়েই চাইছি ইসরায়েলের এই আগ্রাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকুক। এর জন্য মানুষের বাইরে যেয়ে আর কোন পরিচয়ের দরকার নেই। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি বিগত দিনে ফিলিস্তিনিদের হত্যার জন্য ইসরাইলের একদিন বিচার হবে।

কিন্তু আফগানিস্তানের শিশুগুলোর কান্না যাদের ভাবায় না আবার প্যালেস্টাইনের শিশুদের জন্য ভাবাবেগে তাড়ায় তাদের বোধদয় কবে হবে। লড়াইটা কোন দেশ বা ধর্মের বিরুদ্ধে নয় লড়াই হউক হেইটফুল আইডোলজির বিরুদ্ধে সে হউক তালেবান, আর,এস,এস কিংবা হামাস, হেফাজত অথবা ইসরায়েলি আগ্রাসন।

স্বদেশের ইস্যুতেও চাপাচাপি আর মাপামাপির বাইরে কিন্তু নই এই কদিন চঞ্চল পর্ব নিয়ে যা হয়েছে তা কিন্তু আগেও মোশাররফ করিম এবং জয়া আহসানকে নিয়ে হয়েছে। যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল আজকের বাংলাদেশ, সাংস্কৃতিক কর্মীরা কেউ চেপে গেছেন তো কেউ মেপে কথা বলেছেন। ব্যতিক্রম আছেন কেউ কেউ, ফজলুর রহমান বাবু ভাইসহ আরো কিছু শিল্পীদের সরব হতে দেখেছি।

এই দিক থেকে সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জন্য বেয়াদব আমলা জেবুন্নেসার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা দেশে ও প্রবাসে সোচ্চার হয়েছেন, রোজিনা অন্তত এই ভেবে শান্তি পাবেন যে এখনো মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ। যদিও মুনিয়া ইস্যুতে আমার সাংবাদিক ভাই-বোনেরা মৌন রোজা বা মৌন ব্রতে ছিলেন!

সংবাদে প্রকাশ এই এক কোটি আগে আর এক কোটি পরে লেনদেন নতুন কিছু নয় এই সিস্টেমের মধ্যেই আমরা বড় হয়েছি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ এর বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলো শুনলে অথবা পড়লেই এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চেয়ে জনতার সহযোগিতা চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু পাহাড়ের মত অটল মানুষটিকেও চোরের দল, জালিমের গোষ্ঠী বাঁচতে দেয়নি। আজ শুধু লেনদেনের সংখ্যা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। এখন স্যোশাল মিডিয়া সবার নাগালে তাই আমরা ভাইরাল করতে পারি। কিন্তু তাতে কি, নির্লজ্জ চোরের দলও আমাদের সাথে কদম-কদম তাল মিলিয়ে চলেছে। আমি আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছি, চোর, দুর্নীতিবাজ আমলা ও কর্মচারী সেই আওয়াজে সামিল হয়ে তালি দিচ্ছে। কারণ যতক্ষণ না আপনি নাম খুঁজে পাচ্ছেন কিংবা রোজিনা ইসলামের মত কেউ নাম সামনে নিয়ে না আসছে ততক্ষণ ঘুষখোর কর্মচারী, চোর আমলা আর আমজনতা সবই একই নৌকায় দোহার দিচ্ছে ‘দে দে পাল তুলে দে’। লেজে পা না পড়লে কোন জাতের সাপ চেনার উপায় কি? চোর আমলাদের নিয়ে কবিতা করবেন, গান করবেন তাতে কি? বেশরম চোরের দল সাধারণ মানুষের সাথে মিশে করতালি করছে। লাশকাটা ঘরে ইস্যুর ময়নাতদন্ত শেষ কেইস ক্লোজড, খেল খতম পয়সা হজম, উষ্ণতা কম আবার নতুন ইস্যুতে হবে গা গরম। তাই নতুন কিছু ভাবতে হবে।

হিন্দিতে একটা কথা আছে সো মে আসসি বেঈমান ফিরভি ম্যেরা দেশ মহান। দেশের জন্ম থেকেই অহংরথে ঐ চোর আমলাদের দৌরাত্ম এবং তা দেখেই বেড়ে উঠতে হয়। ধরুন যে শিশুটি সচিবালয় দেখেনি, রাস্তায় বের হলেই কিন্তু সে আমলা নামক দম্ভের অস্তিত্ব টের পায়। রাস্তায় যখন সরকারি গাড়ি চলে তাতে বড় করে লেখা থাকে অমুক মন্ত্রণালয় তমুক মন্ত্রণালয়। ক্ষমতার আওয়াজ রাজপথেও হাইড্রোলিক হর্ণ বাজিয়ে জানান দেয়। আমরা যারা কানাডায় আছি এটাও কিন্তু আমলাতান্ত্রিক দেশ কিন্তু কেউ কি রাস্তায় এই ধরনের যানবাহন দেখি যে কানাডা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের গাড়ি, বা ফ্ল্যাগ উড়ানো মন্ত্রির গাড়ি, না দেখি না। কিন্তু বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক ভুত সর্বভূতে বিরাজমান।

আমাদের দেশে সকল সরকারি কর্মকর্তা ভি,আই,পি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। কেউ নিজেকে প্রজাতন্ত্রের অধীন চাকর মনে করেন না সবাই নিজকে অফিসার জানেন এবং হক মনে করেন পাওয়ার প্লে গেইম খেলার। আমাদের এই অভ্যাস স্থান, কাল পরিবর্তনেও যায় না। কোন কানাডিয়কে শুনবেন না বলতে যে তার অফিস আছে, তারা বলে কাজ আছে। আমাদের বাঙালিদের ইউরোপ-আমেরিকায় এসেও অফিস থাকে এবং ভি,আই,পি সিন্ড্রোমে ভোগে। সর্বাঙ্গে আমলাতান্ত্রিক ভাইরাস নিয়ে আমরা ফেইসবুকে আমলাদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিই।

এক জেবুন্নেসা হয়তো বিচারের আওতায় আসবে তাতে কি? কাল আরেক জবা রাণী শিরোনাম হবেন আর আবার আমরা ধিক্কার ধিক্কার জানিয়ে এক সময় ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর বলে নতুন ইস্যু খুঁজবো। আর যারা মাঠে তারা পুলিশের ডান্ডা খেয়ে।
আমদের পুলিশ অপরাধ দমনে নয় অপরাধ দেকভালে পৃথিবীর এক নম্বর পুলিশ। ছিনতাই, চাঁদাবাজির জন্য তারা নজরানা পান, পুলিশের নাকের ডগায় ব্যাংক লুটেরা বিদেশে পাড়ি জমাতে পারে তার জন্য অপরাধ শেষে শুকরানা পেয়ে যান,হোটেলে পুরুষের সাথে নারী থাকলে তারা কাবিননামা চাওয়াকে হক মনে করেন এ হল তাদের হকরানা আর জবরানা জবরদস্তি করে তারা মন্ত্রী বাবুর গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কালো বিড়াল বানাতে পারেন কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সাহেবার আঁচলের নিচে যে কালো বিড়াল ম্যাও তাকে দুধ খাওয়ানো ফরজ মনে করেন।

রাষ্ট্রের কাঠামোতে ফাটল ধরেছে,লড়তে হবে পুরো সিস্টেমের বিরুদ্ধে। রোজনিরা যুগে যুগে লক্ষ সাহসের একত্রিত আওয়াজ হয়ে আসেন। তাই আসুন আওয়াজটাকে জিইয়ে রাখি।
যুগ যুগ ধরে এই যে ভি,আই,পি সিন্ড্রোম গ্রো করেছে এর জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ি আর দায়ী নীতিহীন দলবাজির রাজনীতির প্রতি আমাদের সমর্থন এবং ভ্রস্ট নেতা নির্বাচন। যাদের হাজার হাত,হাজার পেট, হাজার মুখ। যত চোর আমলা সব ঐ নেতার স্বরুপ,নেতা কিংবা মন্ত্রী এক তবু এদের লক্ষ লক্ষ রুপ। যত অসত দুর্নীতিবাজ, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, উপ-সচিব আজকের এই ভ্রস্ট রাজনীতির পয়দা এবং রাজনীতিতেই বিলীন।এদের সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী,ভয়ে সত ত্যাগি আমলা কিংবা সরকারি কর্মচারী যেন অসুর দ্বারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত।

কত আর একজনকে খুঁজবেন দপ্তরে দপ্তরে হাজার হাজার চোর বেশরম আমলা বর্তমান। শুধু ক্ষমতার ইস্তেমাল করা তাদের কর্ম আর লুটহং পরমং ধর্ম। মানবতা শ্মশান শয্যায়, আদর্শের বাজারে, এখন ঈদ-পূজার অপেক্ষা করতে হয় না। সারাবছর জুড়েই মূল্যছাড় সেল! সেল! সেল!