ঋতু মীর : “Happiness is a journey not a destination”
১।
দরজার নিচে রেখে যাওয়া চিরকুটটা দেখে কৌতূহলে হাত বাড়ায় সত্যবতী। ‘কথা বলতে চাই’! এই সাথে নাম এবং এপার্টমেন্ট নম্বর লেখা। একেবারে পাশ লাগোয়া প্রতিবেশী অথচ কোনদিন মুখদর্শন হয়নি। নিজেকে একটু অপরাধী লাগে সত্যবতীর। স্বভাবে আপাদমস্তক সামাজিক হলেও কিছুটা ‘বিচ্ছিন্ন’ থাকার প্রবণতা সত্যবতীর সহজাত। নিজের চারপাশে এক দেয়াল তৈরি করে সে অনির্বচনীয় কোন নিরাপত্তার সুখ অনুভব করে। বিচ্ছিন্নতার মত ‘স্ট্রেস’ ব্যাপারটাও যেন সত্যবতীর জন্মগত। সামান্য মশা কামড় দিলেও ওই ক্ষুদ্র উড়ন্ত প্রাণীটার মৃত দেহ চোখে না দেখা পর্যন্ত তার উত্কণ্ঠা কমে না- যদি আবার আসে কামড়াতে! ‘কথা বলতে চাই’ এই মর্মে চিরকুট যে অহেতুক অস্থিরতার জন্ম দেবে সেতো জানা। নিজের মনেই কৌতুকে হাসে সত্যবতী- এমন উত্কণ্ঠা নিয়ে মানুষ বাঁচে কয়দিন! এমনিতে কন্ডতে বসবাসের নিয়মগুলোতে প্রথম প্রথম প্রচণ্ড বিরক্ত হত সে। শব্দ, হুল্লোড়, পার্টি, লোক সমাগমসহ আরও অনেক কিছুতেই আছে কিছু বিধিনিষেধ। বিল্ডিং ম্যানেজমেন্টের আইনগত নিয়মকানুন তার কাছে এক আরোপিত শৃঙ্খল। এখন অবশ্য ‘যাহা সইবে তাহাই সয়’ নিয়মে চলে সে। বহুতল এই ভবনে নানা ধরণ, নানা সংস্কৃতির মানুষের গাদাগাদি বসবাস। ছুটতে ছুটতে যাওয়া আসার পথে সামান্য ‘হাই’ হ্যালো’ বলার মত মুখোমুখি সময়ও যেন কারো হাতে নেই। সত্যবতীকে অনেকেই ‘ত্রিনিদাদ’ ‘শ্রীলঙ্কান’ অথবা ‘গায়ানীজ’ ভেবে আলাপ জুড়ে লিফটে। খোলাসা করে বলার আগেই হুরহুরিয়ে নেমে যায় সে নিজে অথবা অন্যপক্ষ। তাকে কেউ ‘গায়ানীজ’ ভাবলে কি এক অজ্ঞাত কারণে ভিতরে বেশ রাগ হয় তার। মনকে শাসন করে সত্যবতী- মাল্টিকালচারের এই দেশে বিশেষ কোন দেশ বা গোষ্ঠীর বিষয়ে এমন মনোভাব পোষণ কিন্তু প্রচণ্ড রেসিস্ট। নিজ মনেই হাসে সে- ভাগ্যিস! মানুষ একে অন্যের মন পড়তে পারে না!
২।
আবোল তাবোল ভাবনার মাঝেই ‘কথা বলতে চাই’ এসে হাজির। রুক্ষ, উরুখুরু, চোয়াল ভাঙ্গা চেহারা। প্যান্ট, সার্ট, জুতায় ফ্যাক্টরির কাজের ছাপটা বেশ স্পষ্ট। হাতের মুঠিতে কুকুরের দড়িটা ধরা। গা ঘেঁষে দাঁড়ানো কুকুরটা একঝলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেয় সত্যবতী। প্রাণীটার সারা দেহে যেন অযত্নের ছাপ! জায়গায় জায়গায় গায়ের লোম উঠে গেছে। চামড়া জুড়ে ঘায়ের ক্ষত। চোখে অসুস্থতার কাতর চিহ্ন। কিছু না শুনে বুঝেই অ্যানিম্যাল এবিউস ইস্যুতে ত্বরিত Judgmental হয়ে পড়ে সে। প্রশ্নভরা চোখে কুকুরের মনিবের দিকে তাকায়। সেইসাথে বুকের ভিতরে ঢেঁকির পাড় পড়তে থাকে। না জানি তার বিরুদ্ধে কি কমপ্লেইন নিয়ে এসেছে! এই তো সেদিন ড্রাগ রাখা সন্দেহে পুলিশ নাকি কোন বাসার দরোজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকেছে! কি কাণ্ড! স্ট্রেসের পারদটা লাফিয়ে উপরে উঠতে থাকে সত্যবতীর। হঠাত তাকে বিস্মিত করে অদ্ভুত নরম স্বরে কথা বলে ওঠে মানুষটা। পরম মমতায় কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে চলে। কুকুরের প্রতি ভালোবাসায় মাখামাখি দৃষ্টি। বলে- তার মাথার উপরের ফ্লাটে শব্দ হয় রাত বিরাতে, বৃদ্ধ মা, সে এমনকি কুকুরও ঘুমাতে পারে না সেই শব্দে। কমপ্লেইন করবে তাই এপ্লিকেশনে সত্যবতীর সাইনসহ সমর্থন দরকার। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে সত্যবতীর। শুরুতে কত কি না ভেবেছিল সে! ভেবেছিল বলবে- হারমোনিয়াম, গান এবং সমস্বরে রিহার্সেলের বিকট শব্দ পাই নিয়মিত! বলবে- প্রায়ই লোকজনের হই হট্টগোল শোনা যায় তোমার ফ্লাটে! বলবে- রান্নার বিশ্রী গন্ধতো মাঝে মাঝেই পাই! আশ্চর্য হয় সত্যবতী! সেসব কিছুই বলে না। এপ্লিকেশনের পূর্ণ সমর্থনে দ্রæত মাথা ঝাঁকিয়ে কৃতজ্ঞতায় সম্মতি জানায় সত্যবতী। আলগোছে জিজ্ঞেস করে- গানের শব্দে ডিস্টার্ব হয়নাতো? নাতো! মৃদু হাসিতে ভাঙ্গা চোয়াল আলতো মাথা নাড়ে। মাঝে মাঝে বেডরুম থেকে খুব হাল্কা নরম সুর শুনি। ভালোই তো! তোমরা আছো কি নেই সেটাও বুঝি না অনেক সময়। কথায় কথায় বলে কুকুরটা খুব অসুস্থ। চিকিত্সা চলছে। বিশেষ মনোযোগে তাকায় সত্যবতী। এদেশে কুকুরের চিকিত্সা বেশ খরচ সাপেক্ষ জানে সে। দিনকয়েক পরে অন্যরকম খবরে ধাক্কা খায় সত্যবতী। লাগোয়া প্রতিবেশী বাসা বিক্রি করে চলে যাচ্ছে। অসুস্থ কুকুরসহ কন্ডতে থাকার অনুমতি নেই। কুকুরকে ছেড়ে থাকা, মেরে ফেলা কোনটাই যে সম্ভব নয়- তাই বাড়িই ছাড়ছে ওরা। অজানা বিষণ্ণতার এক চাপা কষ্ট ঘিরে ধরে সত্যবতীকে। কারণে, অকারণে, যখন, তখন কত কিছুতেই, কত না উদ্বিগ্ন সে। নিজের চারপাশে নিশ্চিন্ত সুখের উপাদানগুলোকে জড় করতে, গোছাতে, নিরাপদ রাখার আয়োজনে কত না ব্যস্ত এই ক্ষুদ্র জীবন। অথচ যে মানুষটি অসুস্থ কুকুরকে সঙ্গী করে অবলীলায় অনিশ্চিত জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে এভাবে প্রস্তুত তার সুখ, তার নিঃশর্ত ভালোবাসার সংজ্ঞাটা কি জানে সত্যবতী? নাহ! সে জানে না যে, সুখ মানেই নিজের চারপাশের সব কিছু নির্ভেজাল ঠিকঠাক থাকা নয়। মানুষ তখনই সুখী যখন সীমার মাঝেও অসীম সুখের উপাদান সে নিজের মধ্যে নিজেই খুঁজে নেয়। সত্যবতী জানে না যে- অন্ধকার আর শুন্যতার মধ্যেও সুখ পাখী খুঁজে নেয়ার ইচ্ছা, সংগ্রামই কারও কাছে অনন্ত এক সুখ! ভীষণ অন্যমনস্কতায় ফোনটা হাতে নেয় সত্যবতী। এই মুহূর্তে বন্ধু জোনাকিকেই খুঁজছে সে! ‘There is no path to happiness, happiness is the path’ জানতো! জোনাকি! (চলবে…)
ritu.mir9@gmail.com
‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’-ছোট্ট এই বাক্যের অন্তর্নিহিত দার্শনিক অর্থটা ব্যাপক, বোধের অনুভবে গভীর। কেবল ট্রেন এবং প্লাটফর্মের মধ্যকার বিপজ্জনক ব্যবধান নয়, এই শুন্যতা, এই গ্যাপ, এই স্পেস, এই অন্ধকারটুকু ছড়িয়ে আছে মানুষের সামাজিক বলয়ের চারপাশে। আমরা তার কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না। মানুষ, সমাজ, সম্পর্ক, ভলোবাসা, সুখ, দুঃখ, আবেগ, যুক্তি এবং পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মানসিকতায় সৃষ্ট গ্যাপ বা শুন্যতার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় তুলে ধরার প্রয়াসেই- মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!