সাজ্জাদ আলী : প্রতিবার দেশে যাবার সময় বন্ধুদের পাঠানো উপহার সামগ্রী বয়ে নিয়ে যাই। প্রবাসীরা আপনারজনদের জন্য এটা ওটা পাঠিয়ে স্বজন বিচ্ছেদের জ্বালা জুড়ায়। কেউ পাঠায় মায়ের জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য, আবার কেউ শাশুড়ি বা শালির জন্য। তবে যখন কেউ তার বাবার জন্য কিছু পাঠায়, আমার চোখের জল আর বাঁধ মানে না। গেলবার বন্যা তার আব্বার জন্য নগদ দুই হাজার ডলার পাঠাল। টাকাটা দিতে সে আমার অফিসে এসেছিলো। আমাকে বলে, তুই কিন্তু নিজে মিরপুরে আমাদের বাসায় যাবি। আব্বাকে দেখে আসবি, আর হাতে হাতে ডলারটা দিবি।

বন্যা বাবার জন্য টাকা পাঠাচ্ছে! ওর এই সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করি! ওর বাবা আছেন। আমার কেন নেই? অফিসের মধ্যে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। অপ্রস্তুত হয়ে বন্যা তাড়াতাড়ি রুমের দরজা ভেজিয়ে দিল। আমার কাঁধে হাত রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। বেশ খানিকক্ষণ নীরবতার পরে বন্যা বললো, সরি দোস্ত, তোকে ডিস্টার্ব করাটা উচিত হয়নি। একবার মনে হয়েছিল যে তোর হাত দিয়ে আব্বার জন্য টাকা পাঠালে তুই ইমোশনাল হয়ে পড়তে পারিস। ডলারগুলো তো হুন্ডি করেও পাঠাতে পারতাম। তবু যে কেন তোকে কষ্ট দিলাম?

টিস্যু পেপারে চোখ মুছতে মুছতে নিজেকে সামলে নিলাম। বললাম, তুই বোস না, সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ডলারটা এনে তুই ভালই করেছিস। টাকা দিতে যাওয়ার সুবাদে চাচাজানের সাথে দেখাটা হয়ে যাবে। প্রায় চৌদ্দ বছর আগে শেষ দেখেছি তাকে।

বন্ধুর সামনে কেঁদে ফেলেছি বলে বেশ লজ্জা লাগছে। নিজেকে আরো একটু গুছিয়ে নিয়ে বললাম, দেখ না বন্যা, এই বয়সেও তুই দিব্যি বাবার স্নেহ পাচ্ছিস। অথচ ১৫ বছর বয়স থেকে আমি বাবা হারা। আর জানিস তো মাত্র ৪২ বছরে আব্বা চলে গেলেন। তুই বল বন্যা, ওটা কী কারো চলে যাওয়ার বয়স? কী এমন তাড়া ছিল তাঁর? আমার হাতপা বেঁধে সাগরে না ফেললে ওনার বুঝি আর চলছিলো না!

আমি আবারো কেঁদে ফেলি কিনা, বন্যার সেই অশঙ্কা। দ্রæত প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, ক্ষিধা লাগছে, লাঞ্চ করাবি না? চল, উঠে পড়, ম্যাকডোনাল্ডস খাবো আজ।

খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন আমার আব্বা। কি যে তাঁর শখ, তা কারো বোঝার উপায় ছিল না। তবে কলকাতা থেকে ফিনফিনে পাতলা আদ্দি কাপড় আনিয়ে পাঞ্জাবি তৈরি করাতেন। একটা পাইলট কলম সব সময় বুক পকেটে থাকতো। কোচ দিয়ে কুপিয়ে শোল/গজার মাছ মারার নেশা ছিল তাঁর। স্টেইনলেস স্টীলের চেনওয়ালা একটি সিটিজেন ঘড়ি ছিল আব্বার। কী যে যতœ করতেন! ঘড়িটা হাতে পরার আগে রুমাল দিয়ে খানিকক্ষণ মুছতেন! দেখতে দেখতে ৪১ বছর পেরুলো। আজও চোখ মুদলে সে সব ছবি আমি স্পষ্ট দেখি।

টরন্টোতে বা নিউইয়র্কে যখনই বড়সড় কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যাই, পুরুষদের সেকশনে গিয়ে আমি হাতঘড়ি নাড়াচাড়া করতে থাকি। কেনার সামর্থ্য আছে। কিন্তু সে ফেন্সি ঘড়ি কাকে পরাবো আমি?

আব্বা স্টার সিগারেট খেতেন। দিনে তিন চার প্যাকেট। পারিবারিক ডাক্তার হরেন কাকু প্রায়ই বলতেন, চেয়ারম্যান তুমি তো নেশা ছাড়বা না। তয় ফিল্টারঅলা সিগারেট খাও। ওডায় ক্ষতি একটু কম হবি।

আব্বা হাসতে হাসতে বলতেন, আচ্ছা ঠিক আছে হরেনদা। তুমি যখন কইতিছো তখন একটা তো কিছু করাই লাগবি। দ্যাশগাঁয়ে তো পাওয়া যাবি না, খুলনারতে ফিল্টারয়ালা সিগারেট বেশি কইরা আনাইয়া ঘরে রাখতি হবি।

যখন দেশে যাই তখন ট্রানজিট এয়ারপোর্টগুলোর ডিউটি ফ্রি শপে থরে থরে ফিল্টারওয়ালা সিগারেট সাজানো দেখতে পাই। মার্লবোরো, ডানহিল, বেনসন এন্ড হ্যাজেস ইত্যাদি সব সিগারেটের কার্টুনগুলো উল্টাই পাল্টাই। ইচ্ছা করে দোকানের সব সিগারেট কিনে ফেলি। কিন্তু কার জন্য কিনবো?

আচ্ছা বলুন তো আব্বা, কিসের এত তাড়া ছিল আপনার? বলা নেই কওয়া নেই, রোগ বালাইয়ের কোনো সিম্পটম নেই, অথচ হুট করে চলে গেলেন? বিশ গাঁয়ের লোকের কথা ভেবেছেন আপনি। তারাও মেনেছে আপনাকে। তাদের কষ্টে আপনি কাতর হয়েছেন। কিন্তু কই রওনা হবার আগে নিজের ছেলেমেয়েদের কথা, আম্মার কথা, একটিবারও তো ভাবলেন না?

আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু আপনার ছোট ছেলেটা? আলভী তো তখন মাত্র দুমাসের। বড় হয়ে সে দেখবে, সবার একটা করে ‘বাবা’ আছে। শুধু তার নেই! আপনার মতো বিচক্ষণ একজন মানুষ বিষয়টা আমলে রাখলো না? এটা মানা যায় না।

স্মরণ করুন তো আব্বা, বুড়ি, চম্পা, কলি আপনার বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকতো। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেই ওরা একসাথে দৌঁড়ে যেত। কার আগে কে দরজা খুলে দেবে, তা নিয়ে পাল্লাপাল্লি! কী জানেন, আপনিও চলে গেলেন, আর ওদের অপেক্ষাও ফুরোলো!

শেলীটার কথা মনে পড়ে না আপনার? সে তো রাতে আপনার কোলের মধ্যে ঘুমাতো। যাবার বেলা হাতখানা তার মুখে বুলিয়েছিলেন কী?

তুলির তো যত বায়না সব আপনার কাছেই ছিল। মানকু-জামা, হিল-হা স্যান্ডেল (হাই হিল বলতে পারতো না তখনও), নতুন সাইকেল, আরো কত কী চাই তার! ওর আব্দারগুলোর তবে কী হবে আব্বা?

বলুন তো, আম্মার সুখের জীবনটাকে তছনছ করে দিয়ে কী এমন স্বর্গলাভ হল আপনার?
অবেলায় যে চলে গেলেন, বলি কিসের এত তাড়া ছিল?

কৈফিয়ত:
মৃত্যুদিনে বাবাকে যেভাবে মনে পড়েছে, হুবহু সে সব কথাই লিখেছি। একান্তই ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সব কথা। এমন বিষয় প্রকাশ্যে না আনাই উচিত ছিল। আবার মনে হল, পাঠক বন্ধুরাও তো অনেকেই বাবা হারা। আমার ব্যথা বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না!

(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)