ঋতু মীর : “The greatest gift that you can give to others is the gift of unconditional love and acceptance”

১।
পর্যবেক্ষণে সত্যবতীর বরাবরই অনাবিল আনন্দ। সামজিক অনুষ্ঠানে, আসরে, রাস্তায়, সাবওয়ে বা বাসে, দোকান পাটের ভিড়ে এমনকি একা ঘরেও বেশ মনোযোগের সাথে সে চারপাশ দেখতে থাকে। অবলোকনের জগতে বিচরণের এক অবাধ স্বাধীনতা আছে। একাগ্র নিমগ্নতায় দৃশ্যমান ঘটনার সাথে অবচেতনে লুকিয়ে থাকা চিন্তাগুলো যোগসূত্র টেনে ঘুড়ির সুতার মত ছাড়া যায় বহুদূর। খুব সাধারন অথবা নৈমিত্তিক, মনে রাখার মত কিছু নয় হয়তো, কখনো উপভোগ্য, চমকপ্রদ বা অভিনব কখনোবা অতি বিরক্তিকর। সবকিছুই তাঁর মনের মধ্যে নিজস্ব কায়দায় আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। পর্যবেক্ষণেরও একটা অব্যক্ত ভাষা আছে। প্রতিদিনের দৈনন্দিনতায় ভাল বা মন্দ, দৃষ্টিনন্দন বা দৃষ্টিকটু, কাক্ষিত বা অনাকাক্সিক্ষত- সব কিছু কেবল দেখার জন্য দেখা নয়, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতায় তাকে মনে গেঁথে নেয়া। তারপর নিজের সাথে নিজের কথা বলা, নিজেকেই প্রশ্ন করা, নিজে নিজেই শেখা, ঋদ্ধ হওয়া এবং গ্রহণ বা বর্জন করা। সত্যবতীকে বুঝি আজ পর্যবেক্ষণের ভূতে পেয়েছে! পরের স্টেশনের নাম ঘোষণায় হুঁশ ফিরে। গন্তব্যের উল্টো পশ্চিমমুখী ট্রেনে চেপে বসেছে সে! মুচকি হাসিতে নিজেকেই বলে- ‘বয়স বেড়েছে ঢের!’ প্লাটফর্মে ঢুকতেই ইস্টের ট্রেনটা দৌড়ে ধরে সত্যবতী। ট্রেনের বগিটা আজ বেশ ফাঁকা ফাঁকা। পছন্দমত জায়গায় বসার সুযোগ পাওয়াতে ফুরফুরে মন সত্যবতীর। এক ভীষণ মজা পাওয়া কৌতূহলী চোখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ছোট্ট কুকুর কোলে নিয়ে বসা তরুণীর সিট ঘেঁষে। কোলের মধ্যে গ্যাঁট হয়ে বসেছে ধবধবে সাদা লোমে চোখ মুখ ঢাকা প্রিয় পোষা। ব্যাগ খোলার প্রয়োজনে পাশের সিটে পোষাটিকে কোল থেকে নামায় তরুণী। পেলব দুটো হাত ব্যাগের চেন খোলায় ব্যস্ত। ছোট্ট পোষাটি একটুও সময় ক্ষেপণ না করে আবার কোলে চড়ে বসে। মনিবের চোখে ওর বাঙময় আহ্লাদী চোখ নীরব ভাষায় কথা বলে- অর্থাৎ আমাকে কোলে নাও এবার! তরুণীর অভিব্যাক্তি আরও মনোরম। ঠোঁটে প্রশ্রয় মেশানো স্নেহের হাসি। সুন্দর মুখটা এই মুহূর্তে যেন অনিন্দ্যসুন্দর দেখায়- ‘তোমার আর তর সইল না, আমিতো ব্যাগটা বন্ধই করলাম না এখনো!’ সত্যবতীর চোখ আঠার মত আটকে যায় এই দৃশ্যে। সম্পূর্ণ বিপরীত দুই প্রাণীর শর্তহীন, ভাষাহীন ভালোবাসার লেনদেন দেখে সে। কি অপার্থিব বিমূর্ত আনন্দ এই দেখায়!

২।
ট্রেন থেকে নেমে বাসে ওঠার মুহূর্তে ভ্রু কুঁচকে ওঠে সত্যবতীর। এত ভিড় কেন বাসটায়? শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে হ্যান্ডরেল ধরে দাঁড়ানোর উপায়ও যে নেই! একরাশ বিরক্তিতে প্রায় পায়ের উপর উঠে যাওয়া হাঁটু ঘেঁষা বেবি স্ত্রলারে ফিরে তাকাতেই চোখ ভীমরী খেয়ে যায়। আরে কেরিয়ারে শিশু কোথায়? এতো দেখছি মোজা টুপিতে ঢাকা, বেল্ট বাঁধা নিরাপত্তায় একেবারে আসলের মত দেখতে একটা গোলাপি খরগোশ! চমকে ওঠে সত্যবতী- স্ত্রলারের খরগোশ ওর বোতামের মত চোখ দিয়ে চারপাশ দেখছে। আরে এতো নকল নয় আসলই! বাদামী রঙ বেতফলের মত স্বচ্ছ চোখে অবিকল এক শিশুর নিস্পাপ কৌতূহল! কি এক অজানা মুগ্ধতার আবেশে মন ছুঁয়ে যায়। ক্লান্ত শরীরে সিটে বসতে না পারার ক্ষেদটা আর থাকে না সত্যবতীর। কার্যকারণ ছাড়াই জোনাকির কথা মনে পড়ে তার। বাসায় ফিরে ফোন দেবে একবার। পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা আদ্যপান্ত জোনাকির সাথে সেয়ার করার আনন্দ যে একদম অন্যরকম। তাঁদের কথোপকথনের সেই সময়টা ভীষণ ‘কোয়ালিটি টাইম’! আজ বৃহস্পতিবার, শুক্রবারের উইকএন্ডের আনন্দটা সত্যবতী যেন এই মুহূর্ত থেকেই উপভোগ করতে চায়। জোনাকিও তার মত এমন ফুরফুরে মেজাজেই আছে জানে সে! কথায় কথায় ভাবনা বহুদুর গড়ায় সত্যবতীর। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের কি এমন নিঃশর্ত ভালোবাসা গড়ে ওঠে? এই যে ছোট্ট পোষা কুকুরটির মত, সেই যে গোলাপি খরগোসের মত? জানো জোনাকি! জগতে কেবলমাত্র মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কটাই হয় নিঃশর্ত।

এছাড়া মানুষের আর সব সম্পর্কেই বোধহয় ‘প্রত্যাশা’ আর ‘প্রাপ্তি’ নামের ভারী পারদের ওঠানামা চলে সবসময়। এই প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার পুরু দেয়াল ভালোবাসার আলোতে ছায়া ফেলে। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেয়ায় এবং গ্রহণের ক্ষমতায় অমানিশার গ্রহণ লেগে যায়! (চলবে)

‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’- তিন শব্দের সমন্বয়ে এই বাক্যের অন্তনিহিত দার্শনিক অর্থটা ব্যাপক, বোধের অনুভবে গভীর। কেবল ট্রেন এবং প্লাটফর্মের মধ্যকার ব্যবধান নয়, এই শুন্যতা, এই গ্যাপ, এই স্পেস, এই অন্ধকারটুকু ছড়িয়ে আছে মানুষের সামাজিক বলয়ের চারপাশে। আমরা তার কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না। মানুষ, সমাজ, তার সম্পর্ক, আবেগ, যুক্তি, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অসঙ্গতিতে সৃষ্ট গ্যাপ বা শুন্যতার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় তুলে ধরার প্রয়াসেই- ‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’!